শৈশব

0
888
মা ঝাড়ু নিয়ে আমাকে তাড়া করছে। বাবাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে বাবার পিছনে দাঁড়িয়েছি। বাবা আমাকে এক হাতে আড়াল করে মা’কে প্রশ্ন করছে, কী করেছে আমার ছেলে? মারতে আসছ কেন? -তোমার ছেলে ছোট ছোট মাছের আব্বা আম্মা ধরে নিয়ে আসছে। এখন এই ছোট ছোট পোনা মাছগুলোকে ব্যাঙ, সাপ খেয়ে ফেলবে না? ছেড়ে দাও, আজ খবর আছে তার। বাবা হাসতে হাসতে আমাকে বলছে, কিরে? কোন মাছের আব্বা আম্মা ধরে নিয়ে আসছিস? আমি বাবাকে বললাম, বড়ই গাছের নিচে যে ক্ষেত, সেখানে টাকি মাছের পোনা ছিল। আমি বড়শি দিয়ে পোনা মাছের আব্বা আম্মা দুইটারেই ধরছি।
বাবা আমাকে ইশারায় পালাতে বললেন, আমি দৌড় দিলাম। মা পেছন থেকে বলছে, আজ বাড়িতে আসিস। আজ তোর ভাত বন্ধ। তখন আমি সবেমাত্র ক্লাস ফোরে পড়ি। মাছ ধরার প্রতি প্রচণ্ড নেশা। যেখানেই পানিতে একটু নাড়াচাড়া দেখি সেখানেই মাছ ধরতে নেমে পড়ি। বাড়িতে ভাত বন্ধ শুনে মারবেল খেলায় মেতে উঠলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছি বাবা দেখে নাকি। তাহলে ভাত বন্ধের সাথে বাড়িতেও ঢুকতে পারব না, পিটুনির ভয়ে। কে জানি পেছন থেকে একবার বলল, শাওন তোর বাবা আসল, দৌড় দে। দৌড় দিয়ে অনেক দূর যাওয়ার পর নিজের বোকামির জন্য মাথার পেছনের দিকে দুই হাত ধরে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে মনে মনে গালি দিচ্ছি। বাবা আসার কথা শুনে পিছনে না তাকিয়ে এভাবে দৌড়ানো ঠিক হয়নি।
বড়ই গাছের নিচের ক্ষেতে পোনা মাছগুলো এখনো বিড়বিড় করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদের আব্বা আম্মাকে হারিয়ে আর্তনাদ করে কাঁদছে। আমি চুপি চুপি বাড়ির গেইট দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাবা মা রুমের বাইরে নেই। আমি সেই সুযোগে আমার ছোট ঠেলা জাল নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বড়ই গাছের নিচ থেকে এক ঠেলায় সব পোনা মাছ জালে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। -মা, এই মা দেখো ওদের নিয়ে আসছি। মা বাইরে বেরিয়ে দেখে আমি জালে পোনা মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। -তুই কী করলি এইটা? -তুমি না বলছ আমি পোনা মাছের আব্বা আম্মাকে নিয়ে আসলে ওদের ব্যাঙ, সাপ খেয়ে নিবে? তাই ধরে ওদের আব্বা আম্মার কাছে নিয়ে আসছি। মা এবার লাঠি নিয়ে তাড়া করল। আমি দৌড়ে গিয়ে বড়ই গাছে উঠে পড়েছি। মা নিচ থেকে বলছে, নেমে আয়। এখন আসলে কম মারব, আর যদি কোটা(বড় লাঠি) দিয়ে গুতা দিয়ে ফেলি তাহলে আরো বেশি মারব। মা’কে কোটা দিয়ে আমাকে নামাতে হয়নি। পরনে ছিল লুঙ্গি। নানাজান আমার সুন্নতে খাৎনায় লুঙ্গিটা দিয়েছিলেন। বল্লার কামড়ে লুঙ্গি গাছের উপরে রেখেই নেমে পড়েছি। বড়ই গাছে যে বল্লার বাসা ছিল তা আগেই জানতাম। কিন্তু দৌড়ে গাছে উঠার সময় মনে ছিল না। কপালে, গালে, ঘাড়ে বল্লার কামড়ে লাল হয়ে গুটি হয়ে গেছে। আর কি যে ব্যথা। আমার চিৎকারে বাবাও বের হয়ে এলেন। পাশের ঘর থেকে পান খাওয়ার চুন এনে আমার মুখে ঘাড়ে দিয়ে দিলেন। চুন দিলে নাকি ব্যথা কমে যায়। বাবা বলছে, কেন এত দুষ্টুমি করিস বল তো? এখন কষ্টটা কে পাচ্ছে?
ঘরের টিনের চালে, গাছে অসংখ্য কাক কা কা করে ডাকছে। আমার মাথার উপর দিয়ে কতগুলো কাক উড়ে যাচ্ছে। যেন এখনি ঠোকর দিবে। মা কোমড়ে আঁচল পেঁচিয়ে বলছে, কাকের বাচ্চা এখন যেখানেরটা সেখানে রেখে আয়। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছি, মা আমি এটাকে পালব। -দেখ কত কাক আসছে। তোরে ঠোকর দিয়ে নিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি রেখে আয়। মা লাঠি নিয়ে দৌড়ানি দেয়াতে আমি কাকের বাচ্চা নিয়ে দৌড় দিলাম। আমার মাথার উপর দিয়ে কাকগুলোও উড়ে যাচ্ছে। প্রায় ঠোকর দিয়ে ফেলবে এমন ভাব। আমি কাকের বাচ্চা ফেলেই দিলাম দৌড়। আমার আর কাকের বাচ্চা পুষতে হবে না। প্রতিদিন দুপুরে আর সন্ধার পর পিটুনি খাওয়াটা নিয়মিত হয়ে গেছে। পুকুরে গোসল করতে নেমে ডুবিয়ে চোখ লাল টুকটুক করে বাড়ি ফিরতাম আর পিটুনি খেতাম মায়ের হাতে। দুই তিনবার গোসল করতাম গরমের দিনে। হাফপ্যান্ট দুই তিন ভিজার পর কতদিন গামছা আর তোয়ালে পরে থাকতে হয়েছে। শেষে বুদ্ধি করে আর হাফপ্যান্ট ভিজাই না। হাফপ্যান্ট খুলে পুকুর পাড়ে রেখে নামতাম। গোসল শেষে আবার শুকনা হাফপ্যান্ট পরে বাড়ি ফিরতাম। যে পুকুরে গোসল করতাম সে পুকুরের মালিকের কড়া নিষেধ যেন গোসল করতে না নামি। আমাদের জন্য নাকি মাছ মরে যায়। কে মানে বাধা নিষেধ? একদিন পুকুরের মালিক আমাদের চারজনের হাফপ্যান্ট পুকুর পাড় থেকে নিয়ে গেল। এখন না পারি উঠতে না পারি পুকুরে থাকতে। কতক্ষন আর পানিতে থাকা যায়? ক্লাস ফোর পড়ুয়া ছেলে আমি।আমার লজ্জা একটু লাগতেই পারে। ল্যাংটা হয়ে বাড়ি ফিরব কিভাবে? শেষ অবধি পুকুর পাড়ে ঝুকে থাকা ছোট মেহগনি গাছে উঠলাম। পাতাসহ কিছু ছোট ডাল নিয়ে নিচে নেমে এলাম। কলা গাছের বাকল দিয়ে সে ডাল কোমরে বেঁধে জংলী সেজে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে দেখি হাফপ্যান্ট নিয়ে যাবার খবর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। আমাকে দেখেই মা লাঠি নিয়ে বের হলেন। আমি কোমড় দুলিয়ে আবার দৌড়। এখন যুবক হয়ে ভাবছি, আমার সেই শিশুকালটাই কত ভালো ছিল। মায়ের বকুনি আর পিটুনি খেয়েও যে শৈশব পেররিয়ে এসেছি সে শৈশব আমাকে আজও হাতছানি দিয়ে ডাকে। আর আফসোস হয় বর্তমান শিশুকিশোরদের দেখে। তারা কখনো জানতেই পারবে না আমাদের দুরন্ত শৈশবের কথা। লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,, ,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে