শেষ রাত পর্ব-৮+৯

0
1032

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুব তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় যুগল চেপে ধরলেন আমার গালে। একটু আগেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেভাবে তুলতুলের মুখের সর্বত্র জুড়ে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন। ঠিক সেভাবেই বোধহয় অবাঞ্ছিত স্পর্শে কাতর করতে চাইলেন আমাকে৷ আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। থমকে গেল আমার মন মস্তিষ্ক সব। এক হাত দিয়ে শক্ত করে খামচে ধরে রাখলাম ধ্রুবর শার্টের কিছুটা অংশ। কয়েক সেকেন্ড কাটলো এভাবেই। ধ্রুবর তপ্ত ঠোঁট জোড়া এবার অগ্রসর হতে লাগলো আমার বা গালের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে সচল হলো আমার মস্তিষ্ক। তৎক্ষনাৎ মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। তার বুকের কাছে হাল্কা ধাক্কা প্রতিবাদ করলাম। আমার প্রতিবাদ কিংবা বাধা ধ্রুব খেয়াল করলো কি-না জানি না। সে নিজের মতোই শব্দ করে চুমু খেলেন আমার বা গালে। আবারও স্তব্ধ হলাম আমি। বলহীন শরীর এবার থরথর করেই কেঁপে উঠলো। ধ্রুব আমাকে মুক্ত করলেন তার উষ্ণ ছোঁয়া থেকে। তুলতুলকে কোলে নিয়ে আনন্দের সাগরে মন ভাসাতে ভাসাতেই ছুটে চললেন রুমের বাহিরে। কানের মধ্যে তীরের মতো এসে বিঁধলো তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর।

‘মা!! মা!! দেখো তুলতুল আমাকে পাপা ডেকেছে। এক বার দু’বার না তিন-চার বার বলেছ। বাবা তো আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। তুমি জলদি বাবাকে ডাক দাও। তোমাদের সামনে তুলতুল পাখি আবারও আমাকে পাপা ডাকবে দেখে নিও…’

এই রকম আরও নানান কথা ধ্রুব বেশ উত্তেজনা নিয়ে একের পর এক বলে যাচ্ছেনল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আগের জায়গায়। তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে গালে হাত দিয়ে স্তম্ভিত হলাম আমি। ডান গাল এখনও জ্বালা করছে। ওনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ঘষাতেই গাল জ্বলে উঠেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল কোনো কিছুই মাথায় ডুকছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত মুহুর্তটা। ধ্রুব কি খেয়াল করেছে সে কি করে গেছে আমার সাথে! হয়তো খেয়াল করেনি তাই তো ড্রয়িং রুমে এত হৈ-হুল্লোড়। মনি মা আর বাবার সাথে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। এই অযাচিত ঘটনার কথা মনে পরলে কি তিনি লজ্জা পাবেন! অস্বস্তি বোধ আর অনুশোচনায় চুপ করে রইবেন। না-কি বরাবরের মতোই তার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটবে না!

ঘড়িতে সময় বারোটা বেজে একুশ মিনিট। রুম আধো আলো আর আধো আঁধার। ফেরি লাইটের আলোয় সব কিছুই স্পষ্ট। তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে। রুম আলোকিত করে রাখার কারণ আমি আর তুলতুল দু’জনেই। তবে তুলতুলের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরে খুবই অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয় মাথার ভেতর। এই কারণেই সব সময় রুম আলোকিত করে রাখতে হয়। যদিও এতে ধ্রুবর খানিকটা অসুবিধে হয় তবে তিনি কখনই তা মুখ ফুটে প্রকাশ করেননি। কিন্তু উনি না বললেও আমি বুঝতে পারি। তুলতুলের অপর পাশে ধ্রুব পাশ ফিরে শুয়ে আছেন৷ হয়তো ঘুমিয়ে পরেছেন এতক্ষনে। তবে আমার ঘুম আসছে না। ঘন্টা খানেক সময় চুপচাপ শুয়ে থাকার পরেও দুচোখের পাতায় ঘুম এসে ধরা দিলো না। কাল ভার্সিটিতে যেতে হবে ভেবেই ঘুমানোর চেষ্টা করলাম খুব। তবে কোনো লাভ হলো না এত চেষ্টা করেও। মাথাটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে যাওয়া মন আর ধ্রুবর স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমি। সব কিছু মিলিয়ে কেমন গন্ডগোল পাকিয়ে গেছে মাথায়।

‘তুলতুলের আম্মু!’

আচমকাই ধ্রুবর ডাকে আমি আনমনেই ‘জ্বি!’ বলে সাড়া দিলাম। পরক্ষণেই নিজের মুখ চেপে ধরলাম। ধ্রুব এখনও ঘুমান নি! এক দেড় ঘন্টা শুয়ে থেকেও ঘুমায়নি তিনি! কি আশ্চর্য! আর উনি জানলেই বা কিভাবে আমি জেগে আছি। আমি তো একটুও নাড়াচাড়া করিনি।

‘আমার মনে হচ্ছিলো আপনি এখনও ঘুমান নি ঠিক তা-ই হলো। আমার ধারনাই সত্যি।’

ধ্রুব নিম্নস্বরে কথাটা বললেন। তার কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো আমাকে সজাগ পেয়ে তিনি কিঞ্চিৎ খুশি বোধ করছেন। আমি আগের মতোই চুপ করে রইলাম। ধ্রুব এবার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার দিকে ফিরলেন। আমার মুখোমুখি হয়ে নরম গলায় বললেন-

‘তখনকার ঘটনার জন্য আমি সরি। আমি আপনাকে ওভাবে চুমু… মানে টাচ করতে চাইনি। আসলে তুলতুলের মুখে প্রথম পাপা ডাক শুনে অতিমাত্রায় খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কি করেছি না করেছি কিছুই খেয়াল করিনি।’

আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘হুম বুঝতে পেরেছি।’

‘আপনার এতো অস্বস্তিবোধ করতে হবে না। আর লজ্জাও পেতে হবে না। আমরা আমরাই তো। জাস্ট একটু চুমুই তো খেয়েছি তা-ও আবার গালে। তুলতুলকেও দিয়েছি ও লজ্জা পায়নি তাহলে আপনি কেন এত লজ্জা পাচ্ছেন!’

আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। ধ্রুব তার নিজের কথাতেই থতমত খেয়ে গেলেন। লোকটা কখন কি বলেন তা সে নিজেও জানে না। যখন যা মুখে আসে তা-ই বলে ফেলে। পরে আবার নিজেই হকচকিয়ে যায়। কি অদ্ভুত মানুষ উনি। ধ্রুব গলা পরিষ্কার করে কথা পালটানোর চেষ্টা করলেন।

‘আমাকে পাপা ডাকতে হবে এটা তুলতুলকে কিভাবে শিখিয়েছন?’

‘আপনার ছবি দেখিয়ে শিখিয়েছি।’

ধ্রুব ছোট্ট করে ‘ওহহ’ বলে চুপ করে গেলেন। আবারও নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হলো সাড়া ঘর। আমরা কেউই আর কোনো কথা বললাম না। হয়তো সেই ঘটনার জন্যই অস্বস্তি বোধ করছি দুজনে। দুজনের মনেই হয়তো চলছে লজ্জা আর অস্বস্তির মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতি।

‘মনি মা! তুলতুলের দুধের ফিটার আমি রেডি করে দিয়েছি। ঘুম থেকে উঠলে ওকে খাইয়ে দিও। আর হ্যাঁ গোসল করানোর সময় পানি হাল্কা গরম করে নিও। পানি যেন বেশি গরম না হয় খেয়াল রেখো।’

মনি মা কপাল কুচকে বিরক্তিভাব নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ভারি কন্ঠে বললেন-

‘এখনই এমন অস্থির হয়ে পরেছিস তাহলে ক্লাসে মন বসাবি কিভাবে? এত চিন্তা না করে চুপচাপ যা৷ দেরি হচ্ছে তোর। আর হ্যাঁ ক্লাসে বসে বসে আবার তুলতুলকে নিয়ে অস্থির হোস না। ওর জন্য আমি আছি।’

আমি মাথা নিচু করে মলিন মুখে ধ্রুব কাছে গেলাম। ধ্রুবর অদ্ভুত চাহনি আমার দিকেই স্থির। আমি ধ্রুবর সাথে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। দরজার কাছে এসে আবারও দাঁড়ালাম। মনি মা’র দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললাম-

‘তুলতুল বেশি কান্নাকাটি করলে আমাকে কল দিও মনি মা।’

মনি মা ক্ষেপে গিয়ে রাগান্বিত গলায় বললেন-

‘তুই এখন যাবি নাকি দিবো এক চড়! কি শুরু করেছিস কতক্ষন ধরে? আমি বলেছি তো আমি তুলতুলের খেয়াল রাখবো। তুই নিজের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা কর। তুলতুলের জন্য তোর রেজাল্ট খারাপ হলে একদম তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসবো তোকে মনে থাকে যেন। এখন যা। আরেকটা কথা বললে খবর আছে।’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। এই কয়দিন তুলতুলকে ছাড়া এক মুহুর্তের জন্যেও কোথাও যাইনি৷ আজ তুলতুলকে রেখে বাহিরে যাচ্ছি ভেবেই মনটা খুতখুত করছে। তুলতুল কিভাবে থাকবে তা ভেবেই চিন্তায় সব গুলিয়ে ফেলছি। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন-

‘উফফ তুলতুলের আম্মু আসো তো। তোমাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।’

আমি থমথমে পায়ে ধ্রুব সাথে হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বসিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘আর কিছুদিন পর হয়তো আপনার এক্সাম। ঠিক মতো পড়াশোনায় মন দিন। না হলে আম্মু ভীষণ রাগ করবে। আর তুলতুলকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আম্মু আগেও ওর খেয়াল রেখেছে আর ভবিষ্যতেও রাখতে পারবে।’

আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। মেয়েটাকে ছাড়া একমুহূর্তও মন টিকছে না। এতক্ষন কিভাবে থাকব তা-ই বুঝতে পারছি না। তুলতুল ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলেই হয়তো মাম্মা মাম্মা বলে কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন কি মনি মা ওকে সামলাতে পারবে! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটিতে এসে পরলাম৷ ধ্রুব গাড়ি থামিয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘আচ্ছা সাবধানে থাকবেন আর কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে কল দিয়েন।’

আমি ইতস্তত করে মিনমিনিয়ে বললাম-

‘আপনার নাম্বার আমার কাছে নেই।’

ধ্রুব অবিশ্বাসের চোখে আমাকে তাকালেন। মাথা নাড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলেন,

‘আমার নাম্বার মানে আপনার হাসবেন্ডের নাম্বার আপনার কাছে নেই?’

আমি তার দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। ধ্রুব বোধহয় হতাশ হলেন। ছোট করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে আমার দিকে হাত বাড়ালেন। আমি না বুঝে ওনার হাতের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব এবার বিরক্ত প্রকাশ করলেন। হাত নাড়িয়ে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললেন-

‘ফোন দিন। আপনার ফোন।’

আমি কিছুক্ষন স্থির বসে থেকে ফোন বের করে ওনার হাতে দিলাম। তিনি আমার ফোনে কিছু একটা করলেন। খানিকক্ষণ পর আমার ফোন দিয়েই নিজের একটা সেলফি তুললেন। তারপর আবারও ফোনে কিছু একটা করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি ফোন হাতে নিয়ে ভীষণ আগ্রহের সাথে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। ধ্রুব তার নাম্বার সেভ কিরে দিয়েছে আমার ফোনে। খুব সুন্দর করে ‘তুলতুলের আব্বু’ লিখে নিজের ছবি দিয়ে সেভ করেছেন নাম্বার। আমি ফোন থেকে চোখ তুলে বিস্ময় নিয়ে তাকাই ধ্রুবর দিকে। নির্লিপ্ত তার চাহনি। তিনি কি আমার উপর অধিকার খাটাচ্ছেন? আদর্শ স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছেন নাকি এমনিতেই বিনাকারণে এমন করছেন!

‘কি হলো যান। দেরি হচ্ছে তো আপনার আমার দুজনের। আমাকে পরেও দেখতে পারবেন। অনেক সুযোগ আছে দেখার।’

আমার তীক্ষ্ণ চাহনি ওনার দিকে নিক্ষেপ করে বিনাবাক্য ব্যয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। ধ্রুব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন-

‘ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবেন। আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।’

আমি হাল্কা করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই তিনি চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে ভার্সিটির ভেতরে আসলাম। অডিটোরিয়ামের দিকে আসতেই কারও আকর্ষণ কাড়া ডাকে আমি থমে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধক করেই কেঁপে উঠলো বুক। ভার্সিটিতে আসতেই পুরনো স্মৃতি চারপাশ থেকে আকড়ে ধরতে লাগল।

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘এই যে ভাবি! কেমন আছেন ভাবি?’

পেছন ফিরে আমি মানুষটার দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলাম বাউন্ডুলেপনার এই সদস্যকে। মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন রাফিন ভাই। সাদাফের খুব কাছের ফ্রেন্ড উনি। আমাকে দেখলেই ভাবি ভাবি বলে জান বের করে দেওয়ার উপক্রম হয় তার। ভাবি ডাকতে ডাকতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে তবুও যেন তার মন ভরে না। রাফিন ভাই দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তরল ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘জানেন ভাবি! দু’দিন ধরে ভার্সিটিতে এসে কতবার খুঁজে গেছি আপনাকে! অবশেষে আজ আপনাকে পেয়েই গেলাম।’

আমি ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কড়া বললাম-

‘শুনুন রাফিন ভাই। বার বার আমাকে ভাবি ডাকবেন না। আমি আপনার ভাবি না। মনে থাকে যেন এই কথা।’

রাফিন ভাই আবারও হাসলেন। সহজ গলায় বললেন-

‘আচ্ছা ভাবি মনে থাকবে।’

আমার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। কিন্তু এতে তার কোনো হেলদোল হলো না। তিনি আগের মতোই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘আপনি এখানে কি করছেন? আপনার তো এখন দেশের বাহিরে বাকি সবার সাথে থাকার কথা।’

রাফিন ভাই মুখ কালো করে বিষন্ন গলায় বললেন-

‘তিন দিন আগেই এসেছি। ওদের সাথে ট্যুর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি ভাবি। সবগুলা শা’লায় এত হাঁটাহাঁটি করতে পারে জানা ছিল না। আমি ওদের সাথে আর একদিন থাকলেই হয়তো মরা লাশ হয়ে ফিরতাম দেশে।’

‘ওহহ আচ্ছা! তা আমাকে খুঁজছিলেন কেন? কোনো দরকার ছিল নাকি এমনি!’

রাফিন ভাই আমার দিকে একটা ধূসর রঙের খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ভাবি, এই যে এটা। সাদাফ এই খাম আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছে। লাভ লেটার লিখেছে হয়তো আপনাকে।’

কথাটা বলেই রাফিন ভাই দুষ্টু হাসি দিলেন। আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম ওনার হাতের খামটার দিকে। এটা কি আদোও লাভ লেটার মনে হচ্ছে? এমন ধুসর কালো খামে কি ভালোবাসার কথা থাকে না-কি বিষন্নতার কথা, মন খারাপের কথা থাকা উচিত!

‘অনু তুই এখানে কি করছিস? জলদি চল ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তো।’

আচমকাই সানি আমার কাছে এসে খুব তাড়া দিয়ে কথা গুলো বলে। আমি কিছু বলবো তার আগেই আবারও অস্থির হয়ে বলল-

‘তাড়াতাড়ি চল না ভাই। তোকে নিতে এসে এখন দেখছি আমাকেও বকা খেতে হবে টিচারের কাছে।’

আমি চুপ করে রইলাম৷ একবার সানির দিকে আরেকবার রাফিন ভাইয়ের দিকে তাকালাম। রাফিন ভাই আমার হাত ধূসর রঙের খামটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ভাবি আপনি এখন ক্লাসে যান। আমিও বাসায় চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন ভাবি। আল্লাহ হাফেজ।’

রাফিন ভাই চলে যেতেই সানি আমাকে টেনে ক্লাসের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমি রোবটের মতো সানির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছি। হাতে এখনো রাফিন ভাইয়ের দেওয়া সেই খাম। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। অনুভূতিহীন ভাবেই পুরোটা সময় ক্লাসে বসে রইলাম। সানি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তবে আমার মস্তিষ্ক সেসব কিছুই বুঝতে পারছে না। স্পষ্ট শুনতে পারছি না কারও কোনো কথা। ক্লাস শেষ হতেই ভরদুপুরে ভার্সিটির পাশের আম বাগানে এসে বসলাম। সানিও আমার পিছু পিছু লেগে আছে। একটা সময় দারুণ বিরক্তি নিয়ে বলল-

‘এভাবে চুপ করে আসছিস কেন আসার পর থেকে? আর রাফিন ভাই এখানে কেন এসছিল? কিরে তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? কিছু বল।’

সানি হাল্কা করে আমার গায়ে ধাক্কা দিলো। আমি নেড়েচেড়ে বসলাম। চোখ তুলে শান্ত চাহনিতে তাকালাম সানির দিকে। ওর চোখেমুখে বিরক্তির সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠেছে। কপালে সুতীক্ষ্ম ভাঁজও পরেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘সানি আমি একা থাকতে চাচ্ছি। তুই প্লিজ বাসায় চলে যা।’

‘কিন্তু দোস্ত…’

সানির কথার মাঝেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললাম-

‘প্লিজ সানি…’

সানি মুখ অন্ধকার করে ফেলল। আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। মলিন মুখে বলল-

‘আচ্ছা সাবধানে থাকিস। ধ্রুব ভাইকে ফোন করে বলিস তুই এখানে। নাহলে উনি তোকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে যাবেন।’

আমি চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই সানি চলে গেল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ব্যাগ থেকে ধূসর রঙের খামটা বের করে দেখলাম উপরে খুব সুন্দর করে লেখা ‘অনুপাখি’। লেখাটা দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। ঝাপসা হয়ে এলো আমার দৃষ্টি। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুললাম। ধূসর রঙের চিঠি আর তার সাথে একটা লালচে-হলুদ রঙের ম্যাপল পাতা। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলাম পাতাটা। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। চিঠির ভাঁজ খুলতেই সাদা রঙের জেল পেন দিয়ে লেখা হাজারো শব্দ চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। প্রথম দেখাতেই বুঝলাম এগুলো সাদাফের হ্যান্ড রাইটিং। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠি পড়ার সাহস জুগানোর চেষ্টা করলাম।

অনুপাখি,

প্রথম চিঠি লিখলাম তোমাকে আর প্রথমেই ভুল করে ফেললাম, এটাই তো ভাবছো তাই না! তবে জেনে নাও আমি ভুল করি নি। ইচ্ছে করেই তোমার নামের আগে প্রিয় সম্মোধন করিনি। প্রিয় শব্দটা তোমার জন্য না। তুমি তো আমার কাছে প্রিয় থেকেও বেশি কিছু। ছোট্ট একটা শব্দ ‘প্রিয়’। এই শব্দ দিয়ে তোমার গুরুত্বটা ঠিক প্রকাশ করা যাবে না তাই লিখিনি।

কেমন আছো তুমি অনুপাখি? খুব রেগে আছো আমার উপর তাই না! খুব কি অভিমান জমেছে তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকের উপর? ভীষণ ভীষণ ভীষণ অভিমান! না-কি ক্ষুদ্র অভিমান! নিশ্চয়ই সারাক্ষণ মন খারাপ করে বসে থাকো। রাতের বেলা কান্নাকাটি করে মাথা ব্যথা তুলে ঝিম ধরে শুয়ে থাকো। ঠিক বলেছি না আমি! আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হয়৷ তবে আমি খুব স্বার্থপর অনুপাখি। তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকটা খুব বেশিই স্বার্থপর। আমি চাই তুমি আমার উপর রাগ করো। অভিমান করো। আমার জন্য নিজের চোখেরজল বিসর্জন দাও। কেন জানো তো! কারণ মানুষ তো তার উপরেই রাগ,অভিমান করে যাকে সে ভালোবাসে। একটা মানুষ তার জন্যই চোখেরজল ফেলে যাকে সে হারানোর ভয় পায়। যে মানুষটা’কে সে তীব্র ভাবে ভালোবাসে। তোমার রাগ, তোমার অভিমান, তোমার চোখের জল এসব কি প্রমাণ করছে না তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসো? এতে কি প্রমাণ পাচ্ছে না ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক কতটা ভালোবাসাময় হবে?

যাইহোক, খুব শীগ্রই এসে তোমার সামনে হাজির হবো। তোমার রাগ ভাঙাবো। তোমার মনে জমে থাকা অভিমান একটু একটু করে ভালোবাসায় পরিনত করবো। আর কি করা যায় বলো তো! ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে। তোমাকে বিয়ে করে খুব খুব খুব শীগ্রই নিজের করে নিবো। আর অপেক্ষা করাবো না তোমাকে অনুপাখি।

ইতি,
তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিক।

পুনশ্চঃ ১.গাছের নিচে বসে চিঠি লিখছিলাম। চিঠির সাথে তোমাকে কি গিফট দেওয়া যায় তা-ই ভাবছিলাম। ঠিক তখনই গাছ থেকে এই পাতাটা ঝরে চিঠির উপর পরলো। তখনই আমি বুঝে ফেললাম পাতাটা তোমার ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল হয়ে পরেছে। ঠিক যেমনটা আমার চোখ ব্যাকুল হয়েছে তোমাকে দেখার জন্য। একটু ভালোবাসা দিয়ে ছুঁয়ে দিও পাতাটাকে। আমি না-হয় ভেবে নিবো তুমি আমাকে স্পর্শ করেছো।

পুনশ্চঃ ২.ভালোবাসি কথাটা কি বলতে হবে? তুমি কি অনুভব করতে পারছো না আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি? আমি জানি তুমি বুঝতে পারছো। অনুভব করতে পারছো তাই না অনুপাখি! আর হ্যাঁ ধূসর রঙের চিঠি পেয়ে মন খারাপ করো না। ভালোবাসা সব সময় রঙিন কাগজেই প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। আমার ভালোবাসার রঙ না হয় ধূসর রঙের-ই হলো। খুব কি ক্ষতি হবে!

চোখ চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম আমি। ভীষণ জ্বালা করছে চোখদুটো। চোখের কার্নিশ বেয়ে অবিরত নোনাজল গড়িয়ে পরছে। অসহনীয় কিছু যন্ত্রণা চোখের পানি হয়ে ঝরে যেতে চাইছে। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। উত্তপ্ত মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো। এই ছোট্ট একটা কাগজ দুমড়েমুচড়ে দিলো আমাকে। এত সুন্দর রঙিন ম্যাপল পাতাটা খুবই বিষাক্ত মনে হলো। যে বিষের একটু ছোঁয়াতেই মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু হলো আমার মন আর আমার ভালোবাসারও। ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল আমার হৃদয়। খুব কি দরকার ছিল এই চিঠি দেওয়ার! খুব কি প্রয়োজন ছিল এই সময় এসে আমাকে আরও দূর্বল করার। আমার ভাঙা হৃদয়ে আরও আঘাত করার?

হঠাৎই আমার ডান কাধে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার কান্নাভেজা ঝাপসা চোখ দুটো দিয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে আমার ডান পাশে। তার ঠোঁটজোড়ায় সহজ সরল হাসি। তার নির্লিপ্ত দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেললাম। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। আবারও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। ধ্রুব আমার পাশে বসলেন। নিঃশব্দে আমার ওড়না নিয়ে মাথায় বড় করে একটা ঘোমটা দিয়ে দিলেন। কিন্তু কেন? আমার কান্না লুকাতে চাইলেন! নাকি আমাকে কান্নার করার সুযোগ করে দিলেন? আমার জানা নেই এর উত্তর।
বেশ খানিকটা সময় পাড় হলো নিরবতায় আর শব্দহীন কান্নায়। নিরবতা ভেঙে প্রথমে ধ্রুবই কথা বললেন। দারুণ শান্ত শীতল গলায় বললেন-

‘তুলতুল কান্না করলেও ওকে আপনার মতোই কিউট লাগে।’

ধ্রুব হাসলে খুব সুন্দর করে। আমি তাকালাম তার হাসির দিকে। কি সুন্দর স্নিগ্ধ সেই হাসি। এই হাসিতে বিষন্নতার কোনো ছোঁয়া নেই। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। ডান হাত আমার দিয়ে বাড়িয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘চলুন এবার যাওয়া যাক।’

আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম। ধ্রুব অপেক্ষা করলেন না। উনি নিজে থেকেই আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে