শেষ রাত পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
1682

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩৪(অন্তিম পর্ব)
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুবর গায়ে জড়ানো শার্টের হাতের দিকেটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে লিনা। লিনাকে ধ্রুবর এতটা কাছে দেখে ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলাম আমি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু বিশ্রী চিন্তাভাবনা এসে মাথায় চড়ে বসলো। ক্ষনিকের জন্যই চোখের সামনের দৃশ্যটাকে ভীষণ আপত্তিকর মনে হলো। ভয় হলো। বুকে চিনচিনে ব্যথাও হলো। খুব বাজে একটা অনুভূতির উপস্তিতি অনুভব করলাম। মস্তিষ্ক সচল হওয়ার আগেই পরিস্থিতিটা একদমই ভিন্ন একটা মোড় নিলো। আচমকাই একটা লোক এসে ধ্রুবর সামনে দাঁড়ালো। লোকটার উপস্থিতিতে লিনা ভয় কিংবা অস্বস্তিতে ধ্রুবর আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলো। লোকটা কড়া গলায় ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

‘আমি আমার স্ত্রীর সাথে একা কথা বলতে চাই। আপনি এখন আসুন।’

ধ্রুবর এক বিন্দুও নড়লেন না। আগের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘লিনা আপনার স্ত্রী ছিল, এখন নেই। তাই যা বলার আমার সামনেই বলুন।’

লোকটা কিছুটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে লিনার উদ্দেশ্যে বললেন-

‘লিনা তুমি মামলা উঠিয়ে নাও। আমাদের ডিভোর্স হয়েছে তাই সব কিছু এখানেই শেষ করো। তোমার মামলার জন্য আমাকে কতটা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে জানো? খুব কষ্টে তোমার খোঁজ নিয়ে এখানে এসেছি।’

লিনা কিছুই বলল না। ধ্রুবর একবার লিনার দিকে চেয়ে আগের মতোই গম্ভীরমুখে বললেন-

‘কাপুরুষের মতো নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আর আপনাকে এভাবেই ছেড়ে দিবো তা তো হয় না।’

‘লিনা তুমি চলো আমার সাথে। এক্ষুনি তুমি মামলা উঠিয়ে নিবে। চলো।’

লোকটা ধ্রুবকে অন্য পাশে ধাক্কা দিয়ে লিনার হাত ধরে জোড়াজুড়ি করতে লাগল। লিনা বাঁধা দিচ্ছে। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে তবে পুরুষালী শক্তির কাছে পেরে উঠছে না। কিছুতেই না। জবরদস্তি করার এক পর্যায়ে লোকটা রেগেমেগে লিনার গালে সজোড়ে চড় বসিয়ে দেয়। লিনা শান্ত হয়ে গেল। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ধ্রুব কিছুক্ষণ হতবাক হয়েই তাদের দিকে চেয়ে রইলেন। পরক্ষণেই চোখেমুখে ভয়ংকর রাগ ফুটে উঠলো তার। তেড়ে এসে লোকটা কলার ধরে মারতে যাবে ঠিক তখনই লিনা ধ্রুবকে বাধা দেয়। সেই সুযোগেই লোকটা ছাড়া পেয়ে রেলিঙ টপকে পাশের ছাদে চলে যায়। আমি এখনও ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সিড়ি ঘরের দরজার কিছুটা আড়ালে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। রাগে সাড়া শরীর রি রি করছে। কিন্তু রাগটা কার উপর? লোকটার উপর নাকি লিনার উপর! লোকটা তাকে ধ্রুবর সামনেই গায়ে হাত তুললো অথচ লিনা তবুও লোকটাকে রক্ষা করলো। এটা কি তাহলে বাঙালি নারীর পরিচয়! সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করার অসীম ক্ষমতা বাঙালি নারীদের মধ্যে ঠুসে ঠুসে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীরা মুখ বুঝে স্বামীর সংসারে সবকিছু সহ্য করবে। মায়েরা সন্তানের জন্য সব কিছু ত্যাগ করবে। এভাবেই হয়তো কিছু নারীরা সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। তাদের মনের খবর কেউ জানে না। সকলের চোখে এটাই স্বাভাবিক। এটাই নিয়ম। মেয়ে মানেই মায়ের জাত। মেয়ে মানেই অসীম মায়া। মেয়ে মানেই মানিয়ে চলা। এটাই মেয়েদের জীবন।
অশ্রুজলে টইটম্বুর হয়ে ওঠা চোখদুটো ভীষণ ক্লান্ত হয়েই বাধ ভেঙে দিল। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে লিনা। ধ্রুব লিনার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। লিনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আমি সিড়িঘরের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছাদে পা রাখলাম। সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েও থমকে গেলাম। এই মুহুর্তে লিনার কাছে যাওয়া হয়তো বেমানান দেখাবে। আমার উপস্থিতি লিনার জন্য লজ্জার এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণ হবে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার ঝামেলা অন্য কারও সামনে প্রকাশ পাওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্যই লজ্জার ব্যাপার। খুব বিশ্রী আর তিক্ত অভিজ্ঞতা এটা।
হঠাৎই ধ্রুবর সাথে আমার চোখাচোখি হলো। সাথে সাথেই উনি লিনার কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিলেন। আমি কোনো কথা না বলে লিনার দৃষ্টির অগোচরে ছাদ থেকে নেমে এলাম। রুমে এসে স্তম্ভিত হয়ে বিছানায় বসে রইলাম। অন্যের খারাপ পরিস্থিতি না দেখা অব্দি নিজের অবস্থান বোঝা মুশকিল। নিজেকে লিনার অবস্থানে কল্পনা করতেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি৷ নিজেকে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে মনে হচ্ছে। ভীষণ সুখী মানুষ হিসেবেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম। আমার ভাগ্যও তো লিনার মতো হতে পারতো তবে তা হয়নি। ধ্রুবর, মনি মা, আব্বু আর তুলতুলভেই সবগুলো মানুষকে পেয়েই আমি খুশি। কেউ আমাকে কখনো আঘাত দেয়নি। আমাকে কষ্ট দেয়নি। খুব সহজেই আমাকে আপন করে নিয়েছে। না চাইতেই আমাকে অসীম ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখেছে।
মিনিট খানেক সময় পেরুতেই ধ্রুব হন্তদন্ত হয়ে রুমে এলেন। আমি উঠে ওনার সামনে গেলাম। তিনি আমাকে দেখা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে বললেন-

‘তুলতুলের আম্মু আপনি যেমনটা দেখেছেন বিষয়টা তেমন না৷ প্লিজ আপনি লিনা আর আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাববেন না৷ আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।’

আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব হয়তো ভেবেছেন আমি তাদেরকে একসাথে দেখে অন্যকিছু ভেবেছি। আসলেই তো প্রথমে তাদের দেখে বাজে চিন্তাই করেছিলাম। পুরো ব্যাপারটা না দেখলে হয়তো ভুল বুঝেই বসে থাকতাম। ধ্রুব আমার বাহু ধরে হাল্কা ঝাঁকি দিতেই আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। ঘোর লাগা কন্ঠে বললাম-

‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না।’

ধ্রুব অবাক হলেন। ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কিছু জিজ্ঞেস করার নেই আপনার?’

‘নাহ।’

‘লিনা আর আমাকে এত রাতে ছাদে একসাথে দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করার নেই? আমার কাছ থেকে কিছু জানার নেই?’

আমি কপাল কুচকে ফেললাম। সহজ গলায় বললাম-

‘নাহ কিছু জানার নেই।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিলেন। ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে আচমকাই শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। চোয়ালে শক্ত করে রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। ভয় এবং অস্থিরতায় ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখখানা হঠাৎই পরিবর্তন হতে লাগল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা এসে আমার ডান হাত চেপে ধরলেন তিনি। চাপা রাগ নিয়ে শক্ত গলায় বললেন-

‘কোনো কিছুই বলার নেই আমাকে?’

আমি কোনো প্রত্যুত্তর করলাম না৷ ধ্রুবর এমন ব্যবহার দেখে কিছু বলার সাহস কিংবা ভাষা কিছুই খুজে পেলাম না৷ কোনো কিছু না বুঝে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার নিশ্চুপতা-ই যেন ধ্রুবর রাগের কারণ হলো। আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ হলো আমার নিরবতা। ধ্রুব রাগে চিড়বিড় করে উঠলেন। আমার হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বললেন-

‘কথা বলছো না কেন? উত্তর দাও। আর কত চুপ করে থাকবে? এমন গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে আর কতদিন অনন্যা? এত এত ভালোবাসার পরেও কেন আমি তোমার মনে একটু জায়গায় করতে পারলাম না? কেন আমাকে নিয়ে একটু ভাবতে পারছো না? কেন আমার বিষয়ে তোমার কোনো আগ্রহ নেই? এতগুলো মাস তোমাকে সময় দেওয়ার পরেও কেন আমাকে একটুও ভালোবাসতে পারলে না অনন্যা? আমি কখনো তোমার কাছে কিছু চাইনি। শুধুমাত্র একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশায় প্রতি দিন প্রতিমুহূর্ত অপেক্ষা করে যাচ্ছি। তবুও কেন আমি ব্যর্থ হলাম? উত্তর দাও।’

ধ্রুব রাগ দেখে আমি ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। ভয়াতুর চোখে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব আবারও গর্জে ওঠা কন্ঠে বললেন-

‘সেদিন লিনা আর আমাকে রাস্তায় দেখে আমাকে কিছুই বলো নি। মার্কেট থেকে লিনার সাথে বেরিয়ে যেতে দেখেও কিছু জানতে চাওনি। আর আজকেও না। সব সময়ের মতো আজকেও তুমি নির্লিপ্ত। স্ত্রী হিসেবে তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার উপর। আমি বিষয়ে সব কিছু জানার অধিকার আছে। অথচ তুমি আজ পর্যন্ত সে অধিকার বিন্দুমাত্রও খাটাও নি। কখনও আমার কাছে কিছু জানতে চাওনি৷ আমি কি করলাম কেন করলাম তা নিয়ে মাথা ঘামাও নি। এতদিনে কি আমাকে একটুও ভালোবাসতে পারোনি? আমি কি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না অনন্যা?’

ধ্রুব থামলেন। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘থাক তোমাকে আর কিছুই বলতে হবে না।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিলেন। এক মুহুর্তে দেরি না করে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর যে-ই গতিতে বেরিয়ে গেছেন তার চেয়েও দ্রুত পায়ে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ফিরে আসলেন। আমি মাথা তুলে ওনার দিকে তাকালাম। নাহ এখন আর রাগের ছিটেফোঁটাও নেই। শান্ত শীতল চোখ দুটোতে ভয়ের খেলা। অস্থিরতা আর ভয়াবহ উত্তেজনা। থমথমে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। ওনার হাত উঁচু করে কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন-

‘এটা রক্ত! তোমার রক্ত!’

আমি এবারও চুপ রইলাম। চোখ নামিয়ে স্থির করলাম আমার হাতের দিকে। তৎক্ষনাৎ ধ্রুব ছুটে এসে আমার হাত ধরলেন। উদ্ধিগ্ন হয়ে আমার হাত তুলে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। লাল রঙের কাঁচের চুড়ি গুলো রক্তে ভিজে আছে। ভাঙা চুড়ির দু টুকরো এখনও হাতে বিঁধে আছে। হাতের কবজি থেকে তালুতে বেয়ে পরছে রক্ত। আমি হাতের ব্যথা অনুভব করতে পারলাম না। একটুও টের পেলাম না। পুরো শরীর যেন বোধশক্তি হীন হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে শুধু ধ্রুবর কথা গুলোই ঘুরছে। ধ্রুব একাই এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। আমি ধ্রুবর সাথে স্ত্রীর মতো আচরণ করিনি৷ কথাটা সত্য। অপ্রিয় তিক্ততায় ঘেরা একটি সত্য। তবে আরেকটা সত্য হলো আমি তাকে ভালোবেসে ফেলছি৷ অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। ধ্রুব অনেক আগেই আমার মনের সবটুকু জায়গায় দখল করে নিয়েছেন। সব কিছুই ধ্রুব পেরেছে। শুধু আমিই তা প্রকাশ করতে পারিনি। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি।

ধ্রুব আমাকে নিয়ে বিছানায় বসালেন। তড়িঘড়ি করে আমার সারা রুম খুঁজে ফাস্টএইড বক্স বের করলেন। আমার পাশে বসে হাতের রক্ত মুছতে মুছতে অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বললেন-

‘আমি সরি। তোমাকে আঘাত করার কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না। আমি ইচ্ছে করে এমনটা করি না। সত্যি বলছি আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি। রাগের মাথায় এমনটা হয়েছে। প্রমিজ করছি আর কখনও এমন হবে না। আর কখনও রাগ দেখাবো না।’

আমি শান্ত চোখে ধ্রুবকে দেখছি। ধ্রুবর অস্থিরতা, আমাকে নিয়ে তার ভয় সবটাই প্রকাশ পাচ্ছ তার ব্যবহারে। আমার হাত থেকে চুড়ির টুকরো বের করতেই মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলাম। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আমি জানি আপনি কখনো ইচ্ছে করে আমাকে আঘাত করবেন না। এটা একটা এক্সিডেন্ট তাই নিজেকে এর জন্য অপরাধী ভাবার কিছু নেই। আসলে আমি আপনাকে আর লিনা আপুকে নিয়ে অন্য কিছু মনে করেনি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আর তাছাড়া আমি ছাদের পুরো ঘটনাটা-ই দেখেছি। লিনা আপু অস্বস্তিবোধ করবে আমাকে দেখলে তাই আমি তখন আপনাদের সামনে না গিয়ে রুমে চলে এসেছি।’

ধ্রুব আমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মিহি কন্ঠে বললেন-

‘সরি আমার ভুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্য কিছু ভেবে ওখান থেকে চলে এসেছেন।’

তিনি খুব সাবধানে আমার হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিচ্ছেন। আমি হাতের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারও ধ্রুবর ফ্যাকাসে বর্ণের হয়ে যাওয়া মুখের দিকে দৃষ্টি দিলাম। শান্ত গলায় বললাম-

‘আমি আপনার মতো এত সহজে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না। আমি চাপা স্বভাবের মেয়ে তাই হয়তো আমার অনুভূতি আপনাকে বোঝাতে পারি না।’

ধ্রুব সব কিছু গুছিয়ে আবারও আমার পাশে এসে বসলেন। আলতো করে আমার ধরে আবেগি হয়ে বললেন-

‘তোমাকে কিছু প্রকাশ করতে হবে না। শুধু দিন শেষ তোমাকে আমার পাশে পেলেই হবে। তুমি আমার পবিত্র ভালোবাসা। শুদ্ধ ভালোবাসা। তোমার ভালোবাসার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারবো। তবে তোমাকে আমার পাশে সব সময়-ই চাই। ভালোবাসা নয় শুধুমাত্র তোমার একটু উপস্থিতই আমার জীবনটাকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। আমার সানসাইন তুমি। আমার প্রতিটি শেষ রাতে আমি তোমাকে চাই।’

‘আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি ধ্রুব।’

আমার কথা শুনে ধ্রুব বিস্ফোরিত চোখে আমাকে দিকে চেয়ে রইলেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন-

‘ সত্যি?’

আমি মাথা নাড়লাম। ধ্রুব আবারও থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কবে থেকে! আমাকে বলনি কেন?’

‘মনে করে দেখুন বুঝে যাবেন।’

আমার সহজ সরল জবাবে ধ্রুব খানিকটা আনমনা হয়ে গেলেন। নিশ্চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বললেন-

‘যেদিন আমার গালে চুমু দিয়েছিলে তার আগে থেকে তাই না?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই ধ্রুব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে বললেন-

‘কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি মুখে এই কথাটা শোনার জন্য জানো? এই শেষ রাতে তোমার মুখে এমন কথা শুনবো ভাবতেই পারিনি। কতটা বোকা আমি এতদিন বুঝতে পারিনি।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিয়ে দু গাল আগলে ধরলেন। আমার চোখের দিকে চেয়ে শীতল কন্ঠে বললেন-

‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি সানসাইন। প্রথম দিন থেকেই ভালোবাসি৷ অনেক বেশিই ভালোবাসি।’

আমি হাসলাম। ধ্রুব আবারও নরম গলায় বললেন-

‘চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। দিবো?’

ধ্রুব অনুমতি চাইলেন ঠিকই তবে অনুমতির অপেক্ষা করলেন না।৷ তার আগেই আমার মুখে চুমু দিতে লাগলেন। আমি বাধা দিলাম না। অস্বস্তিও অনুভব করলাম না।

খুব সকালেই আজ ঘুম ভাঙলো। পুরো বাড়িতে তখন পিনপতন নীরবতা। গতকালের ক্লান্তিতে হয়তো এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। কারও ঘুম না ভেঙে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ছাদে চলে এলাম। ছাদে পা রাখতেই আমি চমকালাম। ছাদের এক কোণে রাখা কাঠের বেঞ্চিতে লিনা মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি তাকে বিরক্ত করলাম না। চুপচাপ নিঃশব্দে অন্য পাশে গিয়ে রেলিঙ ধরে দাঁড়ালাম। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর লিনা খুব মিষ্টি করে আমার নাম ধরে ডাকলো।

‘অনন্যা! এখানে আসো।’

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে লিনার দিকে চাইলাম। সব সময়ের মতোই সারা মুখ জুড়ে হাসি ছড়িয়ে আছে। উন্মুক্ত চুলগুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। খুব কায়দা করেই ডান গালের অর্ধেকটা চুল দিয়ে ডেকে রেখেছে। আমি অবাক হলাম মেয়েটার মুখের হাসি দেখে। রাতে ঘটে যাওয়া এমন বিশ্রী ঘটনার পরেও হাসছে! কীভাবে পারছে হাসতে! নিজেকে সকলের সামনে এতটা স্বাভাবিক রাখার অভিনয় করতে কষ্ট হচ্ছে না! নিজের মনেই প্রশ্ন গুলো আওড়াতে লাগলাম৷ এসব ভাবতে ভাবতেই থমথমে পায়ে লিনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। লিনা হাত দিয়ে তার পাশে বসার ইশারা করে বললেন-

‘বসো আমার পাশে। তোমার সাথে কথা বলি।’

আমি বসলাম লিনার পাশে। কিছুটা বিস্ময় আর অস্বস্তি নিয়েই চুপ করে বসে রইলাম৷ লিনা একটু বাঁকা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন-

‘তোমাকে সরি বলার ছিল।’

‘সরি! কিন্তু কেন?’

লিনা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি উৎকন্ঠিত হয়ে প্রশ্নটা করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে লিনা মুচকি হাসলো। ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে নম্র গলায় বলল-

‘তুমি আমার ছোট তাই তোমাকে তুমি করেই বলছি৷ কিছু মনে করো না।’

আমি হাল্কা করে মাথা নাড়লাম। লিনা দৃষ্টি নামিয়ে আবারও বলতে লাগলেন,

‘ডিভোর্সের ব্যাপারটা এখন অনেক কমন একটা বিষয়। এতে লজ্জা পাওয়া কিংবা বিব্রতবোধ করার কিছু নেই। তবে আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা পুরোপুরি ভিন্ন৷ আমি হৃদয়কে বিয়ে করেছিলাম অনেকটা পাগলামি করে। পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। খালার সাথেও অনেক বাজে ব্যবহার করেছি হৃদয়কে খারাপ বলায়। সবাইকে বাদ দিয়ে আমি শুধু হৃদয়কে বেছে নিয়েছিলাম। ভালোবাসি বলেই এমন পাগলামি করেছি৷ কিন্তু বিয়ের পর আমার প্রতি হৃদয়ের ব্যবহার দেখে দিন দিন একটু একটু করে সেই ভালোবাসা মরে যেতে লাগল। একটা সময় সকল অনুভূতিরাই মরে গেল। শুধু নিজের ভুলের জন্য লজ্জিত বোধ করছিলাম। সবার সাথে করা অন্যায়ের জন্য খুব বেশিই লজ্জিত ছিলাম। তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ আমার ছিল না। এই কারণে দুটো বছর ধরে চেষ্টা করে গেছি নিজেকে হৃদয়ের সাথে মানিয়ে নিতে। তবে তা আর সম্ভব হলো না। অবশেষে হৃদয় আমাকে ডিভোর্স দিয়েই ছেড়েছে। ডিভোর্সের পর নিজেকে সকলের থেকে আলাদা করে রাখতে চেয়েছি। তবে ধ্রুব আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আম্মুর কাছে নিয়ে যায়। ডিভোর্সের পর থেকেই মানুষের মুখোমুখি হতে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগে। যার কারণে আমি শুধু পালিয়ে বেড়াই৷ নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রাখি। এই জন্যই তোমার সাথে কথা বলা হয়ে ওঠে নি। তোমার সাথে ভালো করে পরিচয়ও হতে পারিনি। তাই আমি দুঃখিত।’

আমি ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলাম। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করিনি। আস্তে আস্তে সবার সাথে মেশার চেষ্টা করলেই একটা সময় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ-নিয়ে চিন্তা করবেন না।’

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে থাকবো না। আপাতত এই শহরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই যাওয়ার আগে তোমার সাথে একটু ভালো করে পরিচিত হয়ে নিচ্ছি। ধ্রুবর মুখে তোমার কথা এত শুনেছি যে তোমার দেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল। প্রতিনিয়ত ধ্রুব তোমার এত বর্ননা দিয়েছে যে মনে মনে আমি তোমার একটা কল্পনা চিত্র এঁকে ফেলেছি। শুধু তোমাকে দেখার পালা ছিল। তবে এই রকম পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব হয়নি এতদিন। তবে এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর, স্নিগ্ধ, পবিত্র। ধ্রুবর কথা গুলোও এখন কম মনে হচ্ছে।’

লিনার কথায় আমি নিঃশব্দে হাসলাম। তবে মুখে কিছুই বললাম না। লিনা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সহজ গলায় বললেন-

‘জানো তো আমার কোনো ভাই নেই। বাবাও মারা গেছেন অনেক আগে। তখন থেকেই ধ্রুবদের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। ওনারা সব সময় আমাদের খেয়াল রেখেছেন। মোহনা আপু মারা যাওয়ার পর ধ্রুব এনি আপু আর আমার মাঝেই যেন মোহনা আপুকে খোঁজার চেষ্টা করতো৷ বড় ভাইয়ের মতোই খেয়াল রাখতো। তবে আমার ব্যবহারের জন্য খালা অনেকটা কষ্ট পেয়েই আমাদের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কাল রাতে ধ্রুব যখন খালাকে সব কিছু বলে ছাদে আমার কাছে পাঠায় তখন খালা ঠিক আগের মতোই আমাকে বুকে আগলে নেন। তার মধ্যে কোনো প্রকার খোঁপ ছিল না। এই পরিবারের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে ধ্রুবর প্রতি। ধ্রুব বেশ কিছুদিন ধরেই আমার ঝামেলা গুলোকে সালাচ্ছে নিজ হাতে। অফিসের কাজ করে এসে আমাকে নিয়ে ছুটোছুটি। তারপর আবারও অফিসে গিয়ে রাত পর্যন্ত কাজ করে তুলতুলকে দেখতে যাওয়া। এত এত চাপের মধ্যেও ধ্রুব কোনো প্রকার অভিযোগ করেনি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম আমার কারনে ধ্রুব তোমাকে আর তুলতুলকে সময় দিতে পারছে এটা ভেবে। সব শেষে একটা কথাই বলবো সরি।’

আমি মুখের হাসি ধরে রেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘শুধু মাত্র স্ত্রী সন্তান নিয়ে একটা পুরুষের পৃথিবী হয় না। তার আশেপাশে আরও অনেক মানুষ থাকে। স্ত্রী আর সন্তান ছাড়াও পরিবারের বাকি সদস্য কিংবা আত্মীয় স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব থাকে। বিপদেআপদে তাদের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। এই কারণে বার বার সরি বলার কিছু নেই।’

———————

‘কি ব্যাপার অনু তোকে আজ খুব খুশি খুশি মনে হচ্ছে। চেহারা তো একদম ঝলমলিয়ে উঠেছে। ব্যাপার কি হ্যাঁ?’

ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই হঠাৎ সানিয়ার মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলাম। আমার লজ্জা বাড়িয়ে দিতে সানিয়া খুব ভয়ংকর একটা কথা বলল।

‘অদ্ভুত তো। বাসর হলো তোর ভাইয়ের আর লজ্জা পাচ্ছিস তুই? দেখে তো তোকেই নতুন বউ লাগছে। কই ধ্রুব ভাই কই? উনি কি জানেন ওনার বউ লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে!’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকালাম। পাশের সোফায় মনি মা মুখ চেপে হাসছেন। ওনার হাসি দেখে যেন আমার লজ্জার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেল। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মনি মা’র কোল থেকে তুলতুলকে নিয়ে দ্রুত পায়ে রুমের দিকে যেতে লাগলাম। পেছন থেকে মনি মা’র কন্ঠ স্বর শোনা গেল,

‘আরে আস্তে-ধীরে যা। পরে যাবি তো।’

রুমে এসেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তুলতুলকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই ধ্রুবর উপর হামলে পরলো। সব সময়ের মতোই ধ্রুবর গাল ধরে টানতে টানতে বলল-

‘পাপ্পা ঘুম ওঠ। পাপ্পা…’

বেশ কিছুটা সময় ডাকাডাকি করার পর ধ্রুব চোখে মেলে তাকালেন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘তুলতুল পাখি আরেকটু ঘুমাতে দাও।’

কে শোনে কার কথা! তুলতুল আগের মতোই ধ্রুবকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে ধ্রুব হাল ছেড়ে দিলেন। আড়মোড়া ভেঙে আধশোয়া হয়ে বসলেন পেছনে হেলান দিয়ে। তুলতুল সঙ্গে সঙ্গেই ধ্রুবর উপর উঠে দু’হাতে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে বসলো। ধ্রুব আড় চোখে আমার দিকে চেয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘মেয়েটাকে একদম আপনার মতোই বানিয়েছেন। আস্তো এক নাছোড়বান্দা।’

আমি তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। ভারী কন্ঠে বললাম-

‘আমার মেয়ে তো আমার মতোই হবে।’

ধ্রুব খানিকক্ষণ স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আচমকাই আমার হাত ধরে টান মেরে তার কাছে নিয়ে গেলেন। এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-

‘পূর্ণতার জন্যই আজ আমার জীবনটা পূর্ণ হয়েছে। ও না থাকলে হয়তো আপনার সাথে বিয়েই হতো না।’

আমি হাল্কা হেসে বললাম- ‘আমাদের জীবনের পূর্ণতা হয়েই ও এসেছে। আমাদের গুড লাক তুলতুল পাখি।’

ধ্রুব কিছুটা সময় চুপ থেকে গাঢ় স্বরে ডাকলেন,

‘তুলতুলের আম্মু!’

‘জ্বি বলুন’

‘ভালোবাসি তোমাকে সানসাইন।’

হঠাৎই ধ্রুবর এমন কথায় খানিকটা লজ্জা পেলাম। দৃষ্টি নামিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আমিও’

ধ্রুব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কি আমিও?’

ধ্রুব আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চুপ করে আছি। ঠিক তখনই তুলতুল স্পষ্ট গলায় বলল-

‘ভালোবাসি।’

তুলতুলের কথায় আমরা দুজন এক সাথেই হেসে ফেললাম। ধ্রুব শক্ত করে আমাদের দু’জন জড়িয়ে ধরে বললেন-

‘হ্যাঁ ভালোবাসি। আপনাদের দুজনকেই ভালোবাসি মহারানী।’

~সমাপ্ত..🌻🌻

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে