শেষ বিকেলের রোদ-২৮ তম পর্ব
©শাহরিয়ার
— আমি রাগ করবো কেন? আমার রাগ করার কোন অধিকারই নেই বলেই হাঁটা শুরু করতে সোহান পেছন থেকে শাড়ির আঁচল ধরে টান দিলো। ছেড়ে দাও আমাকে কেউ দেখবে।
সোহান:- না ছাড়বো না, আমার সাথে চল তারপর ছাড়বো।
— বললামতো যাবো না,
সোহান:- শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিয়ে ঠিক আছে।
— সোহান নিজের রুমের দিকে চলে গেলো আমিও চলে আসলাম আম্মুর সাথে ঘুমানোর জন্য। দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেলো। আপু আর আকাশ ভাইয়া চলে গেলো তাদের বাড়িতে নতুন জীবন সাজানের জন্য। আর আমরাও চলে আসলাম ঢাকায়। সোহানের সাথে নিয়মিত কথা হচ্ছে গভীর রাত অব্দি ছাদে বসে গল্প করছি সকলের চোখের আড়ালে। এভাবেই কেটে গেলো আরও সাতটা দিন। রাতে ডিনার করতে বসছি এমন সময় বড় চাচা বাবাকে বলতে শুরু করলেন।
বড় চাচা:- বুঝলি আরমানদের বাড়ি থেকে ফোন আসছিলো।
— বড় চাচার কথা শুনে খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম।
বাবা:- কি বলে উনারা।
বড় চাচা:- উনারাতো উনাদের বাড়ির মেয়েকে আমাদের বাড়িতে দিতে চাচ্ছে আর আমাদের বাড়ির মেয়েকে উনাদের বাড়িতে নিতে চাচ্ছে।
বাবা:- এটাতো ভালো কথা তারপরেও আমরা ওদের দু’জনের সাথে কথা বলি, আফরিনের কাছেও খোঁজ খবর নিয়ে দেখি আরমানের সম্পর্কে।
বড় চাচা:- হ্যাঁ তাতো নিবোই, ওরা বলতাছে বিয়ের পর ইকরাকে নিয়ে আরমান জার্মানিতেই চলে যাবে। আর সোহান যদি জব করতে চায় করবে। যদি নিজে ব্যবসা করতে চায় তাও করতে পারে কিংবা ইউরোপের কোন দেশে গেলে সেখানেও পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছে।
— কি সব নিয়ে কথাবার্তা বলছো তোমরা?
বাবা:- তোর আর সোহানের বিয়ের বিষয়ে কথা বলছি। সোহান বাড়িতে আসুক তারপর ওর সাথেও কথা বলি।
— আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি না, আমার লেখাপড়া শেষ হবে তারপরেই বিয়ের বিষয়ে চিন্তা করবো।
বাবা:- এতো ভালো সম্পর্ক সব সময় আসে না। তোমার সাথে পরে কথা বলবো, যদি কোন রকম কারো সাথে রিলেশন থাকে তবে তা ভুলে যাও।
— কি সব কথাবার্তা বলছো এসব হুট করে বিয়ের কথা বললেই হলো। বলেই খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে আসলাম। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সোহানকে ফোন দিলাম।
সোহান:- হ্যাঁ বল কি বলবি?
— তুমি কোথায়?
সোহান:- টিউশনিতে আছি কেন কি হয়েছে?
— তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো, বাবা আর বড় চাচা বিয়ে ঠিক করতাছে।
সোহান:- কার বিয়ে?
— কার আবার আমাদের দু’জনের।
সোহান:- বাহ তাহলেতো ভালোই।
— কিসের ভালো? তোমার আর আমার বিয়ে মানে এই নয় যে তোমার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে।
সোহান:- তাহলে কি?
— তোমার সাথে নীলার আর আমার সাথে আরমানের বিয়ে ঠিক করতাছে তারা।
সোহান:- কি?
— যা শুনছো তাই, এতো কথা বলতে পারবো না, তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসো। বলেই ফোন কেটে দিলাম। মাথায় কোন কিছুই কাজ করছে না। হুট করে কি হচ্ছে। আর বাবা বড় চাচাই বা হঠাৎ বিয়ের জন্য এতো উঠে বসে লেগেছেন কেন? রাত দশটার সময় ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি সোহান আর আমি। সোহানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কি করবে এখন তুমি?
সোহান:- কি করবো, না আমার বাবা কোন কথা শুনতে চাচ্ছে না তোর বাবা। এই অবস্থায় আমি কি করতে পারি বল?
— তোমাকে কিছু করতে হবে না। তোমার সামনে দিয়ে আমার বিয়ে হয়ে যাবে আর তুমি তা চেয়ে চেয়ে দেখো।
সোহান:- কি বলছিস এসব তুই? তোকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো বল?
— কেন পারবে না, তাছাড়া নীলা তোমাকে পছন্দও করে এমন না যে নীলা তোমাকে পছন্দ করে না।
সোহান:- ওহ আর তোকে যে আরমান পছন্দ করে? তাহলে তোরতো আরও বেশী খুশি হবার কথা।
— দেখো আমি আজ কোন ঝগড়া করতে চাচ্ছি না। তুমি সোজা বাড়িতে বলো তুমি আমাকে পছন্দ করো। আমরা একজন আরেক জনকে ভালোবাসি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমিও তা বললো।
সোহান:- তা সম্ভব নয়। এটা বললে বরং আরও রাগ করবে উনারা।
–তাহলে কি তুমি বলবে না তাদের আমাদের সম্পর্কের কথা?
সোহান:- কি করে বলবো আমি বল?
— ওহ ঠিক আছে তোমাকে বলতে হবে না, তুমি তোমার মত থাকো আর আমার সাথে কোন রকম কথা বলার চেষ্টা করবে না। বলেই সোজা ছাঁদ থেকে নেমে নিচে রুমে চলে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে হাউমাউ করে কান্না করে দিলাম। মনে হতে লাগলো সোহানকে ভালোবাসাটাই আমার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল। যে মানুষ নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা বলতে জানে না। পুরো পৃথিবী যেন থমকে যাচ্ছে চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মনের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। সোহান একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে মেসেজ করে যাচ্ছে কোন কিছুর রিপ্লাই করার মত ইচ্ছে শক্তি আর মনের ভিতর বেঁচে নেই। দেখতে দেখতে রাত দিন সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেটে গেলো আরও সাতটা দিন, এই সাত দিনে সোহানের সাথে আমার তেমন কোন কথায় হয়নি, যতটুকু সম্ভব সোহানকে এড়িয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, এক কথায় মায়া যতটুকু সম্ভব কাটিয়ে নেবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবনে হয়তো কোন দিনও ভুলতে পারবো না। কিন্তু মায়াতো কাটিয়ে নিতেই হবে। আজ হোক কাল হোক বিয়েটা ঠিকই আরমানের সাথে হবে। বাড়ির পরিবেশ আর বাবা চাচাদের কথা বার্তায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাসের শেষের দিকে ডাইনিং এ বসে আছি সকলে, এর মাঝে বড় চাচা বলতে শুরু করলো।
বড় চাচা:- যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে আগামি শুক্রবারই ইকরা আর আরমানের বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে। তার কিছুদিন পর নতুন তারিখ ঠিক করে সোহান আর নীলার বিয়েটাও ওরা করিয়ে দিতে চাচ্ছে।
বাবা:- এটাতো খুশির কথা, এর ভিতর কি উনারা আসবে আমাদের এখানে?
বড় চাচা:- না উনারা বিয়ের দিনই আসবে, তার আগে আসবে না। যেহেতু উনারা ছেলে মেয়েদের দেখেছেন আর আমরাও দেখেছি আর লেনদেনের কোন বিষয় নাই তাই উনারা সোজা বিয়ের আসরেই আসবে।
— আমার দু’চোখের কোনে জল চলে আসলো, নিজেকে সামলে চুপ করে খাবার টেবিল থেকে উঠতে যাবো এমন সময় বাবা ডাক দিয়ে বললেন তোমার বন্ধু বান্ধবিদের লিষ্ট দাও, কার্ড তৈরি করতে হবে এবং তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমি কোন রকমে সেখান থেকে চলে আসলাম।
ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে আপুকে ফোন দিলাম, আপু বললো আমরা কি করবো বল, ভাইয়াতো কোন কিছুই বলছে না, আমরা কিছু বলে দোষের ভাগী হবো বল। আমি বললাম কবে আসবে তোমরা?
আফরিন:-বরযাত্রীর সাথেই আসতে হবে আমাদের মামাও তাই বলেছে।
— ওহ আচ্ছা ভালো থেকো আপু তুমিই ভালো কাজ করেছো বিয়ের আগে কাউকে ভালো না বেসে। ফোন কেটে দিয়ে নিরবে দু’চোখের পানি ফেলছি। আরতো কোন উপায় নেই। রাত দশটা পনের মিনিট আবার ও সোহানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ছাঁদের একো কোনায়। আগামিকাল আমার বিয়ে। তুমি ভালো থেকো নিজের খেয়াল নিও। সময় মত ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে বাড়ি থেকে বের হইও। কালকের পর থেকেতো আর আমি থাকবো না। তখন এসবের খেয়াল রেখো।
সোহান:- হুম তুই ও সুখি হইস।
— সোহানের চোখের কোনে জল জমে আছে হয়তো সোহানের সাথে আকাশের ও আজ মন খারাপ। গুগিগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে আসলাম। ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে আছি, বাহিরে যে বৃষ্টি হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশী ঝড় তুফান আমার হৃদয়ের ভিতর হচ্ছে। তা কেউ বুঝে না কাউকে বুঝাতে পারি না। নানান রকম চিন্তা করতে করতে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পরলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠার পরেও দেখতে পেলাম বৃষ্টি হচ্ছে।
মা:- তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে, কিছুক্ষণ পরেই তোর ছোট খালামনি চলে আসবেন তার সাথে পার্লারে যাবি রেডি হবার জন্য।
— তুমি যাও আমি রেডি হয়ে আসছি। মা চলে যেতেই আমি ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। ফ্রেস হয়ে এসে ডাইনিং এ মাকে ডাক দিলাম।
মা:- এখানে আয় নাস্তা করে নে।
— না খাবো না তুমি আসো, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো, যেয়ে দরজা খুলতেই দেখি ছোট খালামনি চলে এসেছেন। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে কেমন আছি জিজ্ঞাসা করলো। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে ভালো আছি তুমি কেমন আছো? খালু আসলো না?
ছোট খালা:- তোর খালু পরে আসবে, কিছু মার্কেটিং করতে বের হইছে তোর জন্য।
মা:- দু’জনে নাস্তা করে তারপর বের হো।
— আমি রুমের দিকে যেতে যেতে মাকে বললাম খালাকে নাস্তা দাও। আমি খাবো না, অল্প সময় পর মা আর খালামনি একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে আমার রুমে এসে ব্যাগটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো শাড়িটা খুলে দেখতো তোর পছন্দ হয় কিনা। ব্যাগটা হাতে নিয়ে যখন পরে আসবো তখন দেখবে কেমন লাগছে,পছন্দ অপছন্দের কিছু নেই তোমাদের পছন্দ হয়েছে তাতেই হবে। বলেই ছোট খালার হাত ধরে রুম থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য সোজা পার্লার, খালা মনি গেট খুলতেই সোহানের মুখোমুখি হলাম সোহানের দু’হাত ভর্তি নানান রকম ফুল। রাগে ইচ্ছে করছিলো সব একটা টান মেরে ছিড়ে ফেলে চিৎকার করে বলি প্রেমিকার বিয়েতে বাসর ঘর সাঁজানোর দায়িত্ব নিয়েছো তুমিতো সফল পুরুষ। নিজিকে সামলে নিয়ে মাথাটা নিচু করে সোহানকে পাশ কাটিয়ে খালামনির হাত ধরে এগিয়ে চললাম বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে জলে। কোন রকমে সে জল লুকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
চলবে…