শেষ বিকেলের রোদ পর্ব-২৬

0
990

শেষ বিকেলের রোদ-২৬ তম পর্ব
©শাহরিয়ার

— কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠবো এমন সময় কেউ একজন বলে উঠলো দাঁড়াও দাঁড়াও। সকলে এক সাথে পেছনে ফিরে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম। আপুর সেই মোটা ফ্রেমের চশমা পরা কাজিন দৌঁড়ে আসছে আর বলছে দাঁড়াতে, কি পরিমাণ রাগ উঠেছে তা নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। তবুও নিজেকে যতটুকু সামলে রাখা যায় রাখলাম। মেয়েটা এসে বলতে শুরু করলো আমিও তোমাদের সাথে যাবো। কারো মুখে কোন কথা নেই, সে আমাদের সাথেই যাবে এমর সময় আপু বললো তুমি আমাদের সাথে যেয়ে কি করবে? আমাদের অনেক সময় লাগবে, তাছাড়া তুমিতো সেখানে রেডিও হবে না। আর আমরা আগে ডাক্তারের কাছে যাবো তারপর পার্লারে যাবো। আপুর কথা শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগলো, আমার যতটা ভালো লেগেছে হয়তো মেয়েটার ঠিক ততটাই খারাপ লেগেছে। সে মন খারাপ করে পেছনে হাঁটা শুরু করলো। আমরা তিনজন গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি রওনা হলো শহরের দিকে। সোহান সামনের সিটে আমরা দু’জন পেছনের সিটে বসেছি। গাড়ির জানালার গ্লাস হালকা করে নামিয়ে দিতেই বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেলো মাথার সব চুল।

সোহান:- পেছনে ফিরে তাকিয়ে, এই ঠাণ্ডা লাগবে এভাবে গ্লাস খুলে রাখিস না।

আফরিন:- কিছু হবে না বরং ভালোই লাগবে আরতো কয়েক মিনিটের ব্যাপার। চাইলে হিংসা না করে তুমিও গ্লাস নামিয়ে দিতে পারো।

সোহান:- ফুলটুসির সাথে থেকে বেশী পাকনা হয়ে গেছিস তাই না?

— আপু হাসছে, আমি রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম তোমাকে আমি কি করেছি?

সোহান:- আমাকে যা করার তা তো করেছিস সাথে আফরিনকেও নিজের মত কথা বলতে শিখিয়ে ফেলেছিস।

— তোমার বোনতো কচি খুকি কিছুই বুঝে না, জানে না, তাকে হাত ধরে ধরে শিখাতে হবে? আজ বিয়ে দিচ্ছো কয়েকদিন পর দেখবা ডজন ডজন ছেলেমেয়েরা যেয়ে তোমাকে মামা মামা বলে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে। এমন কথা শুনে দু’জনেই শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে

সোহান:- তোদের এমন প্লানের জন্যই দেশের জনসংখ্যা রাতারাতি দ্বিগুন হয়ে গেছে।

— কথা বলতে বলতে গাড়ি পার্লারের সামনে চলে আসলো। সকলে গাড়ি থেকে নামলাম। সোহান আমাদেরকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো তোদের হলে আমাকে ফোন দিস আমি বাহির থেকে ঘুরে আসি। আপু আবার দুষ্টমি করে বললো কেন আমাদের সাথে আসো তোমাকেও একটু সাজিয়ে দিবে। সোহান রাগান্নিত চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বের হয়ে গেলো। প্রায় তিন ঘন্টার মত সময় লাগলো দু’জনের তৈরি হতে ততক্ষণে দুপুর হয়ে এসেছে, রেডি হবার পর সোহানকে ফোন দিতেই সে জানালো আসেপাশেই ঘুরছে অপেক্ষা করতে এসেই আমাদের নিয়ে যাবে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতেই সোহান চলে আসলো। আমাদের দিকে এক নজর দেখে মুর্তির মত হা করে দাঁড়িয়ে রইলো।

আফরিন:- এই ভাইয়া কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

সোহান:- লাল পরী আর নীল পরী দেখতাছি,

— এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকলে মুখে মাছি ঢুকবে।

সোহান:- মুখ বন্ধ করতে করতে ঢুকলে সমস্যা নাই, সুন্দরিদের দেখতে দেখতে পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়।

— এসব ফাজলামো বাদ দিয়ে চলে জীবনে বহুবার দেখেছো আর বহুবার দেখতে পাবে যার কোন হিসেব নেই, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আপুর মেকআপ নষ্টরদ হয়ে যাবে।

সোহান:- হয়তো দেখতে পাবো কিন্তু আজকের মত কি আর পাবো বলতে বলতে নামতে শুরু করলো।

— রাগী রাগী ভাব নিয়ে বললাম এর চেয়েও ভালো ভাবেও হয়তো দেখতে পারো। গাড়িতে উঠতেই গাড়ি এগিয়ে যেতে শুরু করলো বাড়ির পথে। পুরো রাস্তায় সোহান ফোনে আমাদের দু’জনের ছবি তুলতে তুলতে বাড়িতে এসেছে। আমি জানি ছবি তোলা শুধুই একটা বাহানা, ও আমাকে দেখার জন্যই মোবাইল হাতে নিয়ে এতো ছবি তুলেছে। বাড়িতে আসতেই আপুকে নিয়ে রুমের ভিতর ফ্যানের নিচে বসালাম। সোহান ওর রুমের দিকে চলে গিয়েছে, দুপুরের খাবার আমি আর আপু মায়ের হাতে খেয়ে রুমে বসে বসে গল্প করছি, বরযাত্রী আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। এমন সময়

বড় চাচী:- ঘরে ঢুকে বললো তোকে সোহান ডাকছে রুমে কেন জানি।

— বড় চাচীর দিকে তাকিয়ে আমাকে আবার ডাকছে কেন? তোমার ছেলের কাছে গেলে আমার সাজগোজ নষ্ট করে দিবে। আমি এখন যাবো না।

বড় চাচী:- দেখ পাগলী মেয়ে বলে কি, ও কি এতো বোকা যে আজ তোর সাজগোজ নষ্ট করে দিবে?

— তোমার ছেলের কোন বিশ্বাস নেই, বলতে বলতে ব্যাগ থেকে পাঞ্জাবীর প্যাকেটটা বের করে নিলাম।

আফরিন:- এটা কিসের ব্যাগরে?

— তোমার ভাইয়ের জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনেছি সেই ব্যাগ, বিয়ে বাড়িতে এসেছে সব শার্ট আর টিশার্ট নিয়ে।

বড় চাচী:- মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে এজন্যই তোকে এতো ভালোবাসি। বাড়ির কার কি প্রয়োজন, সব খেয়াল তুই রাখিস।

— হয়েছেতো এখন আমাকে যেতে দাও। নয়তো তোমার ছেলেই আবার এখানেই চলে আসবে বলে রুমের ভিতর থেকে বের হয়ে সোহানের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রুমে ঢুকতেই সোহান অপলক চেয়ে রইলো। কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো?

সোহান:- কি বলবো না বলবো সে পরে দেখা যাবে আগেতো তোকে দেখতে দে।

— ফাজলামো বাদ দিয়ে কি বলবা বলো?

সোহান:- হেঁটে পেছনে যেয়ে ধাক্কা মেরে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে, এতো তাড়া কেন তোর?

— উফ গরমে ঘেমে সব সাজ নষ্ট হয়ে যাবে।

সোহান:- হবে না ফ্যানের নিচে বস।

— খাটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি পুরো খাট জুড়ে শার্ট প্যান্টের ছড়াছড়ি। সোহানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম এসব কি?

সোহান:- এ জন্যই তো তোকে ডেকেছি কোনটা পরবো বুঝতে পারছি না।

— আজ বিয়ের দিন আর তুমি শার্ট পরবে?

সোহান:- কি করবো? পাঞ্জাবীতো নিয়ে আসি নাই, আর তুইও তো মনে করলি না একবার ও।

— আমি মনে করবো কেন? পাঞ্জাবী কি আমি পরবো? এতো বড় হয়েছো নিজের জিনিস নিজে গুছিয়ে নিয়ে আসতে পারো না? বলেই পাঞ্জাবীর ব্যাগটা সোহানের দিকে এগিয়ে দিলাম।

সোহান:- ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে কি আছে এর ভিতর?

— খুলেই দেখো।

সোহান:- ব্যাগটা খুলতেই ওয়াও! এতো সুন্দর পাঞ্জাবী।

— থ্যাংকিউ বলেই শরীর থেকে টিশার্ট খুলতে যাবে অমনিই বললাম তোমার কি শরম লজ্জা নেই, এতো বড় একটা মেয়ের সামনে তুমি খালি গা হচ্ছো।

সোহান:- বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আমি কি মেয়ে মানুষ নাকি? যে জামা খুলতে পারবো না?

— তুমি মেয়ে মানুষ না তাতে কি আমিতো মেয়ে মানুষ যাও ওয়াশ রুমে যাও। সোহান ওয়াশ রুমে যেয়ে পাঞ্জাবী পরে আসলো। আমি এতো সুন্দর লাগছিলো সোহানকে বলে বুঝাতে পারবো না।

সোহান:- কিরে এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?

— কই তোমাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।

সোহান :- সত্যি তোর চয়েজ আছে বলতেই হবে আয়তো সেল্ফি তুলি।

— আমি সোহানের পাশে দাঁড়াতেই সোহান বললো আরেকটু কাছে আয়, আমি একদম সোহানের বুকে মাথা রেখে দিলাম সোহান ছবি তুলে নিলো। দু’জন ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। লক্ষ করে দেখলাম আসে পাশের যারা ছিলো আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, অনেকেতো আস্তে আস্তে বলেও দিচ্ছে দু’জন কে বেশ মানিয়েছে। কোন কথা না বলে সোজা আফরিন আপুর কাছে চলে আসলাম। আপুর পাশেই পরিবারের সকলেই বসে ছিলো। সবাই বললো তোরা দু’জন ওর পাশে বস আমরা বের হই, বাড়িতে মেহমানে ভরে গেছে, বলে একে একে সকলে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। আমরা তিন জন বসে গল্প করছি।

সোহান:- বুঝলি ফুলটুসি আজ ওর আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না, দেখছিস কেমন একবার এদিক একবার সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। ইস কখন আকাশের বাড়ির লোকজন আসবে, কখন কবুল বলে শ্বশুড় বাড়ি যাবে, ফুলে ফুলে সাজানো বাসর।

আফরিন:- ভাইয়া ভালো হবে না কিন্তু, আমার বিয়েটা হোক তারপরেই তোমাদের বিয়ের কথা বলছি তখন দেখবো কে তাড়াহুরো করে বাসর ঘরে যাবার জন্য, সারা রাত তোমাকে বাহিরে দার করিয়ে আমরাই ঘরের ভিতর ঢুকে ঘুমাবো।

— উফ কি শুরু করলে তোমরা, চলোতো তোমার স্টেজে যাবার সময় হয়েছে, হয়তো অল্প সময়ের ভিতর বরযাত্রীরা চলে আসবে। তিনজন হেঁটে চলে আসলাম ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর স্টেজটার সামনে। দু’জন মিলে ধরে আপুকে স্টেজে তুলে দিয়ে আপুর পাশে বসলাম। এক পাশে সোহান আর এক পাশে আমি দু’জনের চোখাচোখি হচ্ছে, কথা হচ্ছে মনে মনে সোহানের দিকে তাকিয়ে বললাম একদিন আমিও এভাবে লাল বেনারসি পরে এভাবে স্টেজে বসে রইবো, ভাবতাছি সেদিন যদি বর বেশে অন্য কেউ আসে তখন তোমার কেমন লাগবে, যদি এভাবে ঠিক স্টেজের কোনায় বসে থাকতে হয়?

আফরিন:- উফ কি সব কথা বলছিস? উল্টা পাল্টা কথা বলে আমার মনটা খারাপ করে দিসনা তো তোরা।

সোহান:- বলতে দে ওকে হয়তো আমাকে ওর ভালোই লাগে না আমাকে। হয়তো ও চায় অন্য কারো জন্য সাজতে, আসলে মনতো তার নিজের মতই চাইবে নিজের মতই চলবে আমরা কি তাদের আটকে রাখতে পারবো বল?

— এই কি বলতে চাও তুমি হ্যাঁ, আমি কখনোই এমনটা চাইনা বুঝলে এমনটা তোমার মনের মাঝে আছে। দু’জন ঝগড়া করছি এমন সময় বাহিরে গাড়ির হর্ণ বাজতে শুরু করলো, বর যাত্রী চলে এসেছে ঝগড়া থামিয়ে দৌড়ে চলে গেলাম গেটের সামনে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে