#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#আলো_ইসলাম
২২
–দেখতে দেখতে দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। বদলে গেছে অনেক কিছু। তাশরিফ পুনরায় তার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। আবারও গানের জগতে ফিরে যাচ্ছে সে। অনেক জায়গা থেকে তাকে নতুন করে ডাকা হচ্ছে গানের জন্য। মমতা খান ছেলেকে পেয়ে বেজায় খুশি। তার ইচ্ছে পুরণ হয়েছে। আর সেটা ছুটির হাত ধরে। তার বিশ্বাস ছিলো ছুটির প্রতি আর সে বিশ্বাস ছুটি রেখেছে। তিনি ছুটি আর ছায়াকে বুকে আগলে অনেকক্ষণ কান্না করেছিলেন সেদিন। আবেগটাকে সামলাতে পারেনি। হারানোর শোক থেকে ফিরে পাওয়ার যে একটা আনন্দ সেটা মমতা খান উপলব্ধি করেছে ছুটির জন্য। ছুটিরা কয়দিন থেকে বাড়ি ফিরে যায়। তবে ইমরানকে সাথে নিয়ে যায় ছুটি নিজের ভাই করে। বড্ড মায়া লাগে তার ইমরানের মুখটা দেখলে। নিজের ভাই নেই তাই হয়তো ভাইয়ের আক্ষেপ টা একটু হলেও গভীরে জায়গা নিয়েছিলো। সেটা ইমরান পুষিয়ে দিচ্ছে এখন। ছায়ার কথা তো বাদই দিলাম। বেচারি ইমরানের পেছনে লাগার জন্য সব সময় রেডি। ছোট ভাই যে তার। ভাই বোনের খুনশুটি কত মধুর ছায়া হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে এখন। ইমরানকে খালা নিয়ে যেতে চাইলেও ছুটি, তাশরিফ দেয়নি। ইমরানের সুন্দর ভবিষ্যৎ দরকার একটা। খালা তো এতিমখানার বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাছাড়া বয়সও হয়েছে তার। তাশরিফ খালা আর ইমরান দুজনের দায়িত্ব নিতে চাই৷ কিন্তু খালা এতিমখানা ছেড়ে কখনো থাকতে পারবে না। ওই বাচ্চাগুলো তার প্রাণ। তাশরিফ জোর করেনি৷ তবে ইমরান নতুন বোন পেয়েছে তাদের আর হারাতে চাইনা। ছুটি আর ছায়াকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে৷ তাই হয়তো বোনের জায়গাটা দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি তাকে। ইমরানের দায়িত্ব ছুটির পরিবারের। আরমান তালুকদার আর ছাবিনা তালুকদারও ইমরানকে ছেলে হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেছেন৷ তাদের যথেষ্ট সামর্থ আছে ছেলেকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার। তাই ইমরান, ছুটি আর ছায়া এখন তিনভাই বোন হিসেবে সবার কাছে গণ্য।
– এদিকে রোহান ফিরে যাবে তার স্থানে। দুই মাস অনেক ঘোরাঘুরি আড্ডা দিয়েছে সবাইকে নিয়ে। ছুটিকে তার মনে ধরেছে অনেক আগেই৷ কিন্তু কখনো সাহসে কুলায়নি সেটা বলে ওঠার। আবির আর ছায়ার ব্যাপার টা সবাই জানে এখন। তাশরিফ নিজে থেকে জানায় সবাইকে। মমতা খান ছুটিকে বলেছিলেন এবার তাশরিফকে বিয়েটা করতে৷ ছুটি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস রেখেছিলো৷ এতে মমতা খান কি বুঝেছিলো কে জানে৷ দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বলেনি আর। তাশরিফের দিক হতেও কোনো রেসপন্স পাইনি ছুটি। তাই সে আর কোনো পিছুটান, কোনো মায়া বাড়াতে চাইনা৷ যা চলে গেছে সেটা পেছনে থাক। সামনে বাড়িয়ে আর না দুঃখ বাড়াক সে। সব কিছু নিয়মের অন্তরালে চলে তার জীবনটাও তাই চলছে।
– আবির,রোহান মমতা খান বসে আছে একসাথে। তাশরিফ বাইরে থেকে এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। মমতা খান এখন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। আবির আর তাশরিফ অফিসের দায়িত্ব নিয়েছে। তাশরিফ তার গান নিয়ে ব্যস্ত সময় দেওয়ায় পুরো দায়িত্ব আবিরের উপর বর্তায়। আবির নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করে আর তার জন্য উপরে যিনি আছেন তার প্রতি শুকরিয়া জানিয়েও শেষ হয়না৷ তার জন্য তো আবির পরিবার হারিয়েও এমন পরিবার পেয়েছে৷ কয়জনের ভাগ্যে তা থাকে৷ মাঝে মাঝে ইমরানকে নিজের জায়গায় বসায় আবির৷ তার আর ইমরানের ভাগ্য সত্যি নিদারুণ সুন্দর নির্মাণ। পরিবার হারা হয়েও আবার পরিবারে নিবেশ।
তাশরিফকে কয়দিন বেশ চাঞ্চল্য আর অস্থির লাগছে। কিছু একটা নিয়ে সে ভাবছে বা বলতে চাই এমন। কিন্তু সেটা বলে উঠতে পারছে না কোনো কারণে।
— তাশরিফ তোকে একটা কথা বলার ছিলো। মমতা খানের কথায় তাশরিফ সাবলীলভাবে বলে হ্যাঁ আম্মা বলো।
– আমরা আগামীকাল ছুটির বাসায় যাবো বিয়ের কথাবার্তা বলতে৷ তুইও থাকিস কিন্তু। বিয়ের কথা শুনে তাশরিফের হার্টবিট লাফ দেয়। ভেতরে প্রবল উত্তেজনাও।
– বিয়ের কথাবার্তা বলতে মানে? কার বিয়ের? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে তাশরিফ।
– কার আবার ছুটির। ছুটির বিয়ে না হলে তো ছায়াকে আর আনতে পারছি না এ ঘরে। তাশরিফের দম বন্ধকর অবস্থা। ছুটির বিয়ে মানে তার আর ছুটির বিয়ের কথা। সত্যি এতো কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। সব হারিয়ে আবার সব কিছু ফিরে পাবে সে?
— শুন, রোহান ছুটিকে পছন্দ করে আমার মনে হয় ছুটিও রোহানকে পছন্দ করে একটু হলেও। তাই আমি ঠিক করেছি রোহান আর ছুটির বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে ও বাড়ি যাবো কাল৷ খুব ইচ্ছে ছিলো ছুটিকে এই বাড়ির পুত্রবধূ করে নিয়ে আসার। সেটা তো হলো না তাই রোহানের সাথে বিয়েটা দিতে চাই ছুটির। ছুটি অনেক ভালো মেয়ে তাই সে ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। রোহান তো অনেক ভালো ছেলে, নিজের ভাতিজা বলে বলছি না। কিন্তু ছুটি সুখে থাকবে আমার মনে হয়। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। ঠিক আছে না? মমতা খানের প্রশ্নবোধক চাহনি তাশরিফের দিকে৷ এদিকে তাশরিফের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে যেনো। সত্যি কি এটা সম্ভব?
– কি রে বল? পুনরায় মমতা খানের কথায় তাশরিফ হুসে ফিরে বলে হ্যাঁ, কিছু বলছো?
– বললাম কাল যাবি তো রোহান আর ছুটির বিয়ের পাকা কথা বলতে?
– আমি আবার কেনো আম্মা? তোমরা যাওনা। আমার কাল কাজ আছে। তাশরিফ উঠে দাঁড়ায় কথাটা বলে।
— কোনো কথা শুনবো না আমি৷ কাল আমাদের সাথে যাবি এটাই ফাইনাল। রোহান লজ্জা মিশ্রিত হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। তাশরিফের নজর রোহানের দিকে এবার।
– ছুটিকে ভালোবাসিস? শটকার্ট প্রশ্ন তাশরিফের। রোহান লাজুক হেসে বলে ছুটি এমন একটা মেয়ে যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না৷ প্রথম দেখায় মন দিয়ে ফেলেছি ছুটিকে।
— তাশরিফ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর বলে আর ছুটি?
– কি পুলিশের মতো জেরা করছিস তুই, ছুটিও পছন্দ করে রোহানকে। আবির বলে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে।
— তাশরিফ আর কিছু না বলে ঘরে চলে যায় হনহনিয়ে। ব্যথা হচ্ছে বুকের এক পাশে৷ তীব্র সে ব্যথা৷ অনেক দিন পর আবার সে ব্যথার সাথে আলিঙ্গন করলো সে৷ ইলহাম যাওয়ার পর যে ব্যথার সাথে পরিচয় হয়েছিলো সেটা আবারও বুকে স্থান নিচ্ছে মনে হয়। তাচ্ছিল্যের হাসি আসে তাশরিফের। তার জন্য এটাই বরাদ্দ ছিলো তাহলে সমস্যা কি সব কিছু মেনে নিতে।
,,নির্ঘুম রাত কাটে একটা আবারও। শত সুখের মাঝেও কিছু একটা না পাওয়ার অনিহা। অথচ সে বারবার ঠেলে দিয়েছে সব কিছু পেয়েও। তাশরিফ উৎকন্ঠা তার মধ্যেকার অনুভূতি নিয়ে।
– তাশরিফ ভাবে তার মা এর সাথে একবার কথা বলবে এই নিয়ে। ছুটিকে সে হারাতে চাইনা আর। কেনো আবার অনিয়ম করা হচ্ছে সম্পর্কের। রোহান ভালোবাসে ঠিক আছে কিন্তু ছুটি? ছুটি তো তাকেই ভালোবাসে। একটা মানুষ একটা মানুষকে পছন্দ করতেই পারে তাই বলে ভালোবাসা বলে না সেটাকে। তাছাড়া তাশরিফের দিক হতে সম্পর্ক নড়বড়ে ছিলো ঠিকই কিন্তু ছুটির ক্ষেত্রে তো তা নয়। ছুটি সে এক সম্পর্ক ঘিরে থেকে গেছে আজও। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয় তাশরিফ এইসব ভেবে।
–সকাল থেকে ছাবিনা তালুকদার আর আরমান তালুকদার ব্যস্ত৷ ছায়াও আজ ভীষণ দৌড়ঝাপে আছে। বোনের বিয়ে বলে কথা। ইমরান তো কিছুই জানে না৷ তার কৌতুহলের শেষ নেই। আর এটারই মজা নিচ্ছে ছায়া। ছুটি শুনেছে সব৷ আর শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া রাখেনি সে৷ সব কিছুর একটা শেষ দরকার খুব করে। তাই সে শেষ টা দেখার অপেক্ষায় পথ দেখে।
— রোহান,আবির, তাশরিফ মমতা খান সবাই এসেছে কিছুক্ষণ আগে। ছায়া সবাইকে নাস্তা দিয়ে গেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন আজ এখানে করা হয়েছে। তাশরিফ এসেছে ছুটির মতামত কি হয় সেটা জানতে। রোহানের মতো কি সেও বিয়ের স্বপ্ন দেখছে সেটা তাশরিফ নিজ কানে শুনবে নিজ চোখে দেখবে।
— আরমান তালুকদার আর মমতা খান কথাবার্তা বলেন। যদিও আগে থেকে সবটা জানা সবারই। ছুটিও একপাশের সোফায় মাথা নুয়ে বসে। এখানে তাকে কোন যুক্তিতে বসিয়ে রেখেছে তার বোধগম্য নয়। কিন্তু অস্বস্তি যে ভীষণ রকম হচ্ছে সেটা বুঝতে বাকি নেই।
— আম্মা! রোহানের বিয়েতে মত আছে মানলাম কিন্তু ছুটি কি চাই সেটা জেনেছো তোমরা? হঠাৎ তাশরিফ বলে উঠে।
-উৎপল চাহনি রাখে ছুটি। সবারই বিস্ময়কর ফেস।
— সেভাবে জানা হয়নি৷ তবে আমার বিশ্বাস ছুটিরও মত আছে এই ব্যাপারে। কি ছুটি, রোহান কে বিয়ে করতে সমস্যা নেই তো তোমার? মমতা খানের প্রশ্নে আহত দৃষ্টি রাখে ছুটি।
–তাশরিফ আগ্রহপূর্ণ চোখে তাকিয়ে। এই বুঝি ছুটি বলবে এই বিয়ে সে করবে না৷ কেনো করবে? সে তো রোহানকে ভালোবাসে না।
– বাবা-মা রাজি থাকলে আমার সমস্যা নেই রানীমা। তাছাড়া তাদের মতামতের একটা গুরুত্ব আছে আমার জীবনে ।
বাবা-মার উপর দায় দিয়ে এইভাবে কাটাতে পারো না তুমি ছুটি! তাশরিফ উত্তেজিত কন্ঠে কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায়। ঘাবড়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে সবাই তাশরিফের দিকে….
চলবে..
❌কপি করা নিষেধ ❌ ভুলক্রুটি মাফ করবেন।