শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব-১২+১৩

0
711

#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#আলো_ইসলাম
১২

– গিটার দেখে আসিফের ভ্রু কুচকে আসে। স্বাভাবিক চেহারাটা অস্বাভাবিকে পরিণত হয় একটু।
– এটা তো তাশরিফের গিটার, এখানে কেনো? কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে আসিফ।

— তাশরিফ গান করবে তাই নিয়ে আসা এখানে। মমতা খানের সরল জবাব।
– তাশরিফ গান করে আবার? উত্তেজিত কন্ঠে বলে ফেলে আসিফ। ছুটি ভ্রু কুচকে বলে আবার মানে? আসিফ দমে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলে না মানে, ও তো গান ছেড়ে দিয়েছে তাই বললাম।

– হ্যাঁ, তাশরিফ আর গান করে না৷ ইনফ্যাক্ট এই গিটারও আর ছুঁয়ে দেখেনি। আজ অনেক দিন পর গিটারটা নিয়ে আসলাম যদি আজ অন্তত বলে তাই। মা এর ইচ্ছেতে গিটার নিয়ে আসা,আবির বলে।
ওহ! ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে আসিফ। তা তাশরিফ কে দেখছি না যে, ও কি বাসায় নেই?

– দুপুরে বেরিয়েছে কি কাজ আছে বলে। এখনো ফিরেনি৷ আমরা তো ওরই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার কি খবর আসিফ৷ বেশ নাম ডাক করেছো কয় বছরে। আমার তাশরিফ টা যদি আজ এই জগতে থাকতো তাহলে ও অনেক ভালোবাসা পেতো মানুষের কিন্তু এখন! ওর জন্য শুধু ঘৃণা আছে মানুষের মনে। মমতা খান ভেঙে পড়েন কথাটা বলে।

— মন খারাপ করবেন না আন্টি সব ঠিক হয়ে যাবে। কেনো যে তাশরিফ এই কাজ করতে গেলো। ও তো ইলহামকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তাহলে কেনো ওকে খু’ন করতে গেলো এটাই বুঝলাম না। আফসোস নিয়ে বলে আসিফ।

– আপনি শিওর যে, খু”ন টা তাশরিফ ভাইয়ায় করেছে? ছুটি বলে গম্ভীর কণ্ঠে। হকচকিয়ে উঠে আসিফ।
– না মানে, সবাই তো সেটাই জানে৷ আমি এর বাইরে কি আছে কিভাবে বলবো বলো! বাই দ্যা ওয়ে তুমি তো ছুটি তাই না? কথা ঘুরিয়ে বলে আসিফ৷.

– আমাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি আপনার? কেন জানি আসিফকে ভালো লাগছে না ছুটির।

– আরে না না কি যে বলো। কত এসেছি আমি এখানে। তুমি তো সব সময় এখানেই থাকতে। আমরা একসাথে আড্ডাও দিয়েছি কত সব মনে আছে। এই বছর তিন ব্যস্তর জন্য আর আসা হয়ে উঠে না৷ প্রায় সময় দেশের বাইরে থাকি কি-না। লং টাইম পর দেশে আসলাম তাই ভাবলাম আন্টির সাথে আই মিন সবার সাথে দেখা করে আসি। তাশরিফের সাথেও কথা হয়না আর। হাসার চেষ্টা করে বলে আসিফ।
* এর মধ্যে নাস্তা নিয়ে আসে একজন। রোহান গিয়ে ছুটির পাশে দাঁড়ায়।

– আমার না কেনো জানি সন্দেহ হচ্ছে ভদ্রলোককে। কথাবার্তায় একটা সন্দেহের গন্ধ পাচ্ছি! রোহান বলে ফিসফিসিয়ে।
– হুম আমারও তাই মনে হচ্ছে। ছুটির কথায় রোহান প্রফুল্ল কন্ঠে বলে ওয়াও আমাদের কি মিল। আমরা একই চিন্তাধারায় আছি তাই না। ছুটি একটা ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর লুক রাখলে রোহান চুপসে যায়।

– আচ্ছা উনাকে তো চিনলাম। আগে কখনো দেখিনি তো এখানে? আসিফ বলে ছায়াকে উদ্দেশ্য করে।

– আমার বোন ছায়া। ছুটি বলে সোজাসাপ্টা।

– ও আচ্ছা! এরপর রোহানের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি রোহান তাই না?
– আপনি আমাকে চেনেন? অবাক হয়ে বলে রোহান।

– চিনবো না কেনো! তাশরিফের থেকে তোমার কথা শুনেছি অনেক। তোমার ছবিও দেখেছি। তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। তুমি যে রিসেন্টলি এডভোকেট হয়েছো এটাও জানি।

– আই সি! তার মানে আপনি আমার উপর পুরো স্টাডি করে এসেছেন। রোহানের কথায় আসিফ থতমত খেয়ে যায়৷ চা পান করছিলো সে সময় গলায় আটকে যায়।
– আস্তে সেলিব্রিটি সাহেব। দেখেশুনে পান করুন। ছুটির হেয়ালি কথা।

-এই আপু উনাকে বল না আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিতে, ছায়া বলে। আবির তো নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
– কেনো হ্যাংলামি করছিস ছায়া। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। ছায়ার মুখটা মলিন হয়ে যায় ছুটির বকা খেয়ে।

– তুমি কি কিছু বলবে ছায়া? আসিফের কথায় ছোট ছোট চোখ করে তাকায় ছায়া। এরপর ছুটির দিকে তাকিয়ে চুপ মেরে থাকে।

— তোমার মা কেমন আছেন আসিফ? মমতা খানের কথায় আসিফ মুচকি হেসে বলে জ্বি আন্টি ভালো। আচ্ছা তাশরিফ কখন আসতে পারে?

– তা তো জানি না৷ ফোনও বন্ধ বলছে ওর। ছেলেটা আমার আর স্বাভাবিক নেই। যে হাসিখুশি, প্রানবন্ত ভাব ছিলো এখন সেটা নেই আর। আমার ছেলেটা আর আমার নেই। মমতা খান চোখ মুছতে মুছতে বলে।
মন খারাপ করবেন না আন্টি। কি বলবো বুঝতে পারছি না সত্যি। হঠাৎ এমন হয়ে যাবে সত্যি ভাবিনি৷ ব্রাইট একটা লাইফ ছিলো তাশরিফের। কেনো এমন করতে গেলো ও। তাছাড়া ইলহামও অনেক ভালো মেয়ে ছিলো। যেমন সুন্দরী তেমন ভালো ব্যবহার। আমি তো প্রথম দেখায় তার ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটার এমন মৃ/ত্যু হবে সত্যি ভাবিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলে আসিফ। ছুটি আর রোহান শুধু শুনছে আসিফের কথাগুলো।

– তিন বছর আগে…..

– তাশরিফের ছোট থেকে স্বপ্ন ছিলো বড় গায়ক হওয়া। সময়ের ব্যবধানে সেটা বাস্তবায়ন হয়। একটা অনুষ্ঠানে অডিশন দিয়ে প্রথম স্থান দখল করে নেয় তাশরিফ আর সেকেন্ড পজিশনে থাকে আসিফ। আসিফ আর তাশরিফ কলেজ থেকে ভালো বন্ধু। তাশরিফ যেমন ভালো গান করে তেমন আসিফও। কিন্তু আসিফের তুলনায় তাশরিফের গানে স্কিল ছিলো অনেক ভালো। এরপর থেকে ভিন্ন স্টুডিও থেকে ডাক আসে তাশরিফের। দেশ বিদেশে গান গাওয়ার সুযোগ পাই। খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তাশরিফ। তখন আসিফও গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ তবে সবার কাছে আগে তাশরিফ প্রায়োরিটি পেতো। তাশরিফের সিডিউল না পেলে এরপর আসিফকে ডাকা হতো। তাশরিফের ছোট থেকে এতিমখানায় যাওয়া অভ্যাস। এতিমখানার বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসে সে। তাই প্রতি বছরের মতো সে বছরও তাশরিফ তার জন্মদিনে একটা এতিমখানায় যায়। গান করে, খাওয়া দাওয়া, বাচ্চাদের সাথে পুরো দিন কাটায় প্রতিবার তার জন্মদিনে।

— তাশরিফের ২৭ তম জন্মদিন ছিলো সে বার। তাশরিফ সে দিনটা এতিম বাচ্চাদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটা এতিমখানায় যায় সবাইকে নিয়ে। সেখানে গিয়ে দেখা মিলে ইলহামের। ইলহামের খালা ওই এতিমখানায় থাকে বাচ্চাদের দেখাশোনা সাথে রান্নার কাজটা তিনি করেন। ইলহামও সাহায্য করে তাকে। ইলহামের একটা ভাই আছে নাম ইমরান। ইলহামের বাবা-মা অনেক আগেই মা’রা গেছেন। ইলহামের বাবা ছিলেন ট্যাংক চালক। একটা এক্সিডেন্ট তিনি মা;রা যান ইমরান জন্ম নেওয়ার এক বছরের মাথায়। এরপর ইলহামের মা দুই ছেলে-মেয়েকে মানুষ করে। ইমরানের যখন বয়স ৮ তখন ইলহামের মাও মারা যান ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে। সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে হারিয়ে যান তিনি। এরপর থেকে ইলহাম তার ভাইকে নিয়ে খালার সাথে থাকে। খালার যেহেতু কোনো ছেলে মেয়ে নাই তাই দুজনকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ ভালোবাসায় রাখে।

— তাশরিফ প্রথম যখন ইলহাম কে দেখে এতিমখানায় তখনই ভালো লেগে যায়। যাকে বলে “প্রথম দেখায় প্রেম”। ইলহাম দেখতে সুন্দরী আর লাজুক ছিলো ভীষণ। চেহারায় গভীর মায়া। যে মায়ায় তাশরিফ আবদ্ধ হয়ে যায়। ইলহামও তাশরিফের একজন ভক্ত ছিলো। তাই তাশরিফকে সামনে থেকে দেখতে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু ওই মানুষটাই যে তার জীবন সঙ্গি হয়ে যাবে এক সময় কল্পনাও করেনি।
– এরপর আস্তে আস্তে তাদের কথাবার্তা, দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে। তাশরিফ প্রায় সময় ওই এতিমখানায় যায় বাচ্চাদের জন্য চকলেট খাবার নিয়ে ইলহামকে দেখার জন্য। এক পর্যায়ে দুজনের প্রেমের সম্পর্ক হয়। যদিও প্রথমে ইলহাম আগাইনি। তাশরিফ এত বড় গায়ক তার মতো সামান্য একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে ভেবে অবাক হয়েছিলো। ভেবেছিলো ক্ষণিকের আবেগ। কিন্তু তাশরিফের সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে হার মানে ইলহাম। তাশরিফ একদিন ইলহাম কে তার বাড়িতে নিয়ে যায় হুট করে। এরপর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেদিন ছুটিও উপস্থিত ছিলো সেখানে। মমতা খানও প্রথমে খুশি হতে পারেননি। কারণ তিনি মনে মনে তো ছুটিকে ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু তাশরিফ যে আরেকজন কে ভালোবাসবে ভাবেনি। মমতা খান একবার ভেবেছিলো ছুটির কথা তাশরিফকে বলবে। কিন্তু ছুটি যখন নিজ ইচ্ছেতে সরে যায় মমতা খান তখন নিজেকেও মানিয়ে নেয়। ছেলের আনন্দ খুশিতে তিনিও সামিল দেন।

— রাতে খাবার টা আজ এখানেই খেয়ে যাবে তুমি আসিফ। মমতা খানের কথায় আসিফ বলে না আন্টি আমাকে যেতে হবে। এখানে থেকে বেরিয়ে একটা জায়গায় যেতে হবে আবার। তাশরিফের সাথে তো দেখা হলো আবার নাহয় আসবো, সেদিন খেয়ে যাবো, তাশরিফ আসলে বলবেন আমার কথা। আসিফ উঠে দাঁড়ায় কথাগুলো বলে।

– এরপর আসিফ একটা ছোট নোটপ্যাড বের করে তাতে কিছু একটা লিখে ছায়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ছায়া তো পুরাই শকড। আসিফ নিজ ইচ্ছেতে তাকে অটোগ্রাফ দিচ্ছে৷ হাসি মুখে নিয়ে নেয় ছায়া সেটা৷

— ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার গান গুলো অনেক ভালো লাগে আমার । ছায়া বলে মুখে চওড়া হাসি রেখে।
– তাহলে একদিন গানের আসর বসানো যাক কি বলো? আসিফের কথায় ছায়া অতি আবেগী কন্ঠে বলে সত্যি?

– ছায়া! ছুটির ধমকে দমে যায় ছায়া। আবিরও রেগে যায় এবার।

* বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে ছায়া! আবিরের কথায় আসিফ বলে ওকে বকছো কেনো। আমি সত্যি তোমাদের নিয়ে একদিন গান বলতে চাই যদি তোমরা চাও তো।
– সে পরে দেখা যাবে। তোমার মুল্যবান সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। আবির বলে।

তুই এখানে? তাশরিফ উপস্থিত হয় এর মধ্যে।

– তুই চলে এসেছিস। ভালোই হলো তোর সাথে দেখাটা হয়ে। তোর ফোন অফ পাচ্ছি তিনদিন ধরে তাই বাড়িতে চলে আসলাম দেখা করতে। মনে হচ্ছে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তোর?

— তাশরিফের চোখ যায় গিটারে।
* এটা এখানে কেনো? উত্তেজিত কন্ঠে বলে তাশরিফ।
– শুনলাম তুই নাকি আবার গান করবি৷ কথাটা শুনে অনেক ভালো লাগলো। আন্টি তো সে আশায় তোর গিটার টা নিয়ে এসেছে। তাই না আন্টি। আসিফ বলে হেয়ালি নিয়ে।

– এই গিটার কে আনতে বলেছে তোমাদের। আমি গান করবো এটা কে বলেছে তোমাদের? দুদিন ভালো ব্যবহার করছি ভালো ভাবে কথা বলছি মানে এই নয় আমি আমার অস্বাভাবিক জীবন থেকে সরে এসেছি। আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। কেনো আমাকে বিরক্ত করছো তোমরা। কেনো ভালো থাকতে দিচ্ছো না আমার মতো করে। চিৎকার করে বলে তাশরিফ। মমতা খানের চোখ ভরে আসে। ছুটি ছায়া তটস্থ হয়ে যায় তাশরিফ কে দেখে। সেই পুরনো তাশরিফকে দেখছে সবাই।

— শান্ত হো তাশরিফ। এত উত্তেজিত হলে হবে। আন্টি তোর গান মিস করে তাই একটা আবদার করে ফেলেছে৷ এতে রাগ করার কিছু নাই৷ তোর সাথে কথা আছে আমার, আমরা তোর ঘরে গিয়ে বসি?

– অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাশরিফ ঘরে যায় আসিফকে নিয়ে।

– ব্রো এমন রেগে গেলো কেনো হঠাৎ? রোহান বলে মলিন কন্ঠে।
– আমিও কিছু বুঝলাম না,আবির বলে।
– রানীমা কান্না করো না প্লিজ৷ জানো তো ভাইয়া কেমন। ছুটি বলে মমতা খান কে শান্ত করে।

— তোর বাড়িতে এমন একটা ফুল আছে আগে বলিস নি তো? আসিফের কথায় ভ্রু কুচকে বলে ফুল?

– ছায়া! সদ্য ফুটন্ত একটা গোলাপ। আসিফের কথাটা বলতে দেরি তাশরিফের কলার ধরতে দেরি হয়না আসিফের।

চলবে..

#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#আলো_ইসলাম
১৩

— ছায়ার কথা বলাতে তাশরিফ রেগে যায় ভীষণ। আসিফের কলার চেপে ধরাতে আসিফ মুচকি হেসে তাশরিফের হাতের দিকে তাকায়।
– তোর ওই নোংরা মুখ দিয়ে ছায়ার নাম নিলে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি। আসিফ শব্দ করে হাসে তাশরিফের কথায়।

– হাত’টা নামিয়ে নে। কেনো শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছিস তুই! আরে আমি তো ভালোবেসে ফেলেছি ছায়াকে। প্রথম দেখায় আমার হৃদয় হরণ করেছে। আর করবে না কেন বল? এত কিউট দেখতে একটা মেয়ে। তুই আমাকে কোনো দিন বলিসই নি তোর বাড়িতে এমন একটা ফুল ঘুরে বেড়ায়। তুই কি একাই সে ফুলের ঘ্রাণ নিতে চাস নাকি হুম।

– আসিফ! তাশরিফ মারার জন্য হাত উঠায়।

– ভুলেও এই কাজটা করতে যেওনা বন্ধু। তুই নিশ্চয়ই ইমরানের কথা ভুলে যাসনি। ইমরানের কথা বলাতে দমে যায় তাশরিফ। অসহায়ত্ব প্রকাশ পাই তার চোখ মুখে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা। আসিফ আবারও হাসে।

– সব হাওয়া ফুস! তুইও না তাশরিফ মাঝে মাঝে যেনো সব ভুলে যাস। যেমন এই কয়দিনে সব ভুলে গিয়ে আবারও নতুন জীবন শুরু করার চিন্তাভাবনা করছিস। আমার কথা তোর মনেই নেই। তাই তো আজ আসলাম তোকে আবারও তোর জায়গা দেখায় দেওয়ার জন্য। বাই দ্যা ওয়ে! তুই কি আবারও গান গাওয়ার চিন্তা করছিস? ভ্রু কুচকে বলে আসিফ।

– না আমি নতুন জীবন শুরু করার কথা ভাবছি আর না গান৷ তাশরিফ দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়।

– তাহলে গিটার?
– আমি জানি না৷ মা হয়তো ভেবেছিলো আমি আজ গান করবো। তাছাড়া আমি তো বাসায় ছিলাম না তুই জানিস। খুব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা তাশরিফের।

— হুম জানি বাসায় ছিলিস না৷ কোথায় গিয়েছিলি এটাও জানি! গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে আসিফ। এইদিকে তাশরিফ আতংকিত চোখে তাকায়।

– তোর কি মনে হয় বল তো! তুই খুঁজলেই ইমরানকে পেয়ে যাবি? এতই সহজ? যদি তাই হতো তাহলে তো তিন বছর আগেই পেয়ে যেতিস ওকে। তখন তোর নাম-ডাকও ছিলো, পাওয়ার জশ সব কিছুই ছিলো। তখনই যখন পারিসনি এখন কেনো বৃথা চেষ্টা করিস। আমি আগেই জেনে গিয়েছিলাম তুই ইমরানের খোঁজ পেয়ে লোক লাগিয়েছিস৷ তাই আমিও ওকে কায়দা করে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। তোর ফাসির রায় না হওয়া পর্যন্ত এমনই চলবে। ইমরানকে তুই কখনোই পাবি না।

— আমি তো তোর সব কথা মেনে নিয়েছি, সব দোষ নিজের করে নিয়েছি৷ তাহলে কেনো এমন করছিস? কেনো ইমরানকে ছাড়ছিস না৷ আমি তো বলছি আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল পরিমাণ সরবো না। তুই ইমরানকে ফিরিয়ে দে আসিফ প্লিজ। অনুনয় করে বলে তাশরিফ।

– উচ্চস্বরে হাসে আসিফ। তাশরিফ বিস্ময় নিয়ে তাকায়।
– কি করুণ অবস্থা তাশরিফ খানের। আমার না সত্যি করুণা হয় তোকে দেখে কিন্তু কি করবো বল৷ আমি আবার সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা। তাই আমার কাজ না হওয়া পর্যন্ত ইমরান আমার কাছেই থাকবে৷ ও ভালো আছে বিশ্বাস কর৷ বেশ আয়েশে আছে। যদিও মাঝে মাঝে আপু আপু করে। কখনো তোকে খুঁজে তো কখনো খালা নাকি যেনো,হাউএভার, তবে ভালো আছে। তাশরিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

— আমার ফাসির রায় হওয়ার পর যে ইমরানকে ছেড়ে দিবি তার কি গ্যারান্টি আছে? তাশরিফের কথায় আসিফ হেসে বলে আমি হারামি আছি তাই বলে এতটাও খারাপ ভাবিস না। আর আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া তোর কাছে কোনো অপশনও নেই৷ তাই আমাকে বিশ্বাস কর ঠকবি না। তোর শুনানির দিনই ইমরানকে আদালতে দেখতে পাবি৷ কারণ ইমরানের সাক্ষীও যে লাগবে সেখানে। আগের বার যে সবাই ইমরানের খোঁজ করেছে সেটা আমি জানি। নেক্সট টাইম তাকে কোর্টে হাজির করতে বলেছে। তা নাহলে যে তোর রায় হবে না৷ তাই ইমরান আসবে সেদিন তোর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে। তবে হ্যাঁ! কোনো রকম চালাকি করার চেষ্টা করলে সেখানেই ইমরানের লা/শ পড়ে যাবে। সে ব্যবস্থা করেই পাঠানো হবে ইমরানকে।

— তাশরিফের নিজেকে বড় অসহায় লাগছে এই মুহুর্তে। কিছু করার নেই৷ জীবন তাকে নিয়ে অনেক আগেই নিষ্ঠুর খেলায় নেমেছে।

– এবার আসল কথায় আসা যাক! আসিফের কথায় তাশরিফ কৌতুহলী হয়ে বলে আসল কথা?
– ছায়াকে আমার ভালো লেগেছে। ওকে আমার চাই৷ আর কিভাবে পাবো সেটা তুই জানিস৷ আই মিন ওকে পেতে যা যা করা লাগবে তুই করবি সব৷ এনি হাউ ছায়াকে আমার চাই। অনেকদিন তো হলো সিঙ্গেল থাকা৷ এবার বিয়েটা করা দরকার কি বলিস?

তাশরিফের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে রাগে৷ কিন্তু কিছু করতে পারবে না সে। হাত-পা যে বাধা তার।

– তুই কেনো ছায়াকে জড়াচ্ছিস এসবের মধ্যে। দেখ আসিফ তুই যা ইচ্ছে আমার সাথে কর৷ প্লিজ এর মধ্যে আর কাউকে টানিস না। ছায়া ছোট এখনো। তাছাড়া ও খুব ভালো মেয়ে৷ তুই ওর জীবন টা নষ্ট করিস না৷ আমি তোর বন্ধু হয়ে হাত জোড় করছি আসিফ প্লিজ।

– তোর কেনো মনে হচ্ছে যে ছায়ার জীবন নষ্ট করবো আমি। বললাম না ওকে ভালোবেসে ফেলেছি৷ বিয়ে করতে চাই৷ খুব ভালো রাখবো বিশ্বাস কর৷ কিন্তু তুই যদি আমার কথা না শুনিস তাহলে.. শয়তানি হাসি দেয় আসিফ

– একটা মানুষকে ধরে কতজনের ক্ষতি করবি তুই? আমার জীবন শেষ করে দিয়েছিস, ইলহামকে.. তাশরিফের দম বন্ধ হয়ে আসে কথাটা বলতে৷ চোখ ভরে পানি। তাশরিফ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে এখন আবার ছায়ার পেছনে কেনো পড়ছিস? তুই ছায়ার থেকে অনেক ভালো আর সুন্দরী মেয়ে পাবি৷ প্লিজ ছায়ার কথা ভুলে যা।

– আমার তো ছায়াকেই লাগবে। তার ব্যবস্থা কর দ্যাটস এনাফ। যদি আমার কথার বাইরে যাস তাহলে ইমরানের এক হাত তোর কাছে গিফট হিসেবে পাঠিয়ে দেবো। তাশরিফ কি করবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমি আজ আসি, আর একটা কথা,, নেক্সট টাইম আমার ফোন ইগ্নোর করার সাহস দেখাসনা। তাহলে ফল ভালো হবে না৷ যত আনন্দ,যত তামাশা করে নে কয়দিন। এরপর.. আসিফ উপরে ইশারা করে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়।

– আসিফ যাওয়ার মিনিট পাঁচের মধ্যে তাশরিফের ঘরে থেকে ভাঙচুরের শব্দ শোনা যায়। সবাই ভয় পেয়ে যায় তাতে, সাথে অনেকটা অবাক হয়। ছুটি, ছায়া, রোহান, আবির ছুটে আসে তাশরিফের ঘরে।মমতা খান আতংকিত চেহারায় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।

— তাশরিফ কি হচ্ছে এইসব! কেনো পাগলামো করছিস? আবির বলে তাশরিফ কে ধরে।
— সব তছনছ করে দেবো আমি। কিছু ভালো লাগছে না আমার। আমি একা থাকতে চাই। কাউকে চাইনা আমার। উন্মাদের মতো করে তাশরিফ। ছায়া ভয়ে গুটিয়ে যায়। ছুটি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তাশরিফকে দেখে তারও ভয় করছে। রোহান তো স্তম্ভিত হয়ে গেছে।

— কি হয়েছে তোমার তাশরিফ ভাইয়া? সবই তো ঠিক ছিলো তাহলে হঠাৎ কি এমন.. ছুটি কথাটা শেষ করার আগেই তাশরিফ তেড়ে যায় ছুটির দিকে। ছুটির দুই হাত চেপে ধরে দেয়ালে ঠেসে ধরে। সবাই তো ঘাবড়ে যায়। ছায়া ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে। এদিকে ছুটির অবস্থা বেহাল। হৃদস্পন্দন দ্রুত ওঠানামা করছে।

– আমি বলেছিলাম কেউ এসো না আমার জীবনে। কাউকে চাইনা আমার! আমি একা আছি একাই থাকবো৷ কেনো এলে তোমরা? কেনো শুনলে না আমার কথা? কি করবো এখন আমি? কিভাবে বাঁচাবো ছায়াকে? শকুনের নজর পড়েছে ওর উপর! তাশরিফ চিৎকার করে বলে কথাগুলো। কিন্তু ছায়ার নাম শুনে সবাই কৌতুহলী হয়ে উঠে। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ছায়া কোথায় থেকে আসছে এখানে, সবার মনে প্রশ্ন।

– ছায়াকে বাঁচাবে মানে? কার থেকে বাঁচাবে, কি বলছো তুমি? ছুটি বলে সব ভয় দূরে রেখে নিজেকে শক্ত করে।
– তাশরিফ হুসে আসে। কি বলে ফেলেছে ভেবেই বিরক্ত হয় নিজের উপর। ছেড়ে দেয় ছুটিকে। এক হাতে চুল টেনে উপরে তাকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফুঁকে স্বাভাবিক হতে চাই।

– কি হয়েছে তাশরিফ? আবির বলে আবারও।

– আবির প্লিজ সবাইকে নিয়ে যা এখন৷ আমি একা থাকতে চাই একটু। তোরা কেউ আর ডিস্টার্ব করবি না আমাকে। আর ছুটিকে বল ওর নিজের বাড়িতে যেতে। ছায়া, ছুটি কেউ যেনো এখানে না আসে। হঠাৎ এতো কঠোর কেনো হচ্ছে ওদের প্রতি বুঝতে পারছে না কেউ।

— কি হয়েছে বলবি তো? আসিফ আসার পর থেকে তুই…. শাট আপ আবির। তোকে যেতে বলেছি আমি। এক কথা কতবার বললে শুনবি তোরা। আচ্ছা তোরা থাক আমি বেরিয়ে যাচ্ছি বাসা থেকে! তাশরিফ চলে যাবে তখন ছুটি বলে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না৷ আমরাই চলে যাচ্ছি। তবে হ্যাঁ, তোমার ঘর থেকে যাচ্ছি শুধু এই বাড়ি ছেড়ে নয়। সব সত্য না জানা পর্যন্ত আমি কোথাও যাবো না৷ আমি এসেছি নিজের ইচ্ছেতে আর যাবো নিজ ইচ্ছাতেই। ছুটি বেরিয়ে যায় কথাটা বলে। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলে তাশরিফ মেঝেতে বসে খাটের সাথে হেলান দেয়। কিছু ভালো লাগছে না তার। ছায়াকে কিভাবে বাঁচাবে ভেবে পাচ্ছে না।

– ব্রো হঠাৎ রেগে গেলো কেনো বুঝলাম না। সব তো নরমাল ছিলো একটু আগে পর্যন্ত। রোহান বলে আপসেট হয়ে।
– আমার তো সন্দেহ ওই আসিফকে নিয়ে। ওর মধ্যে নিশ্চয় রহস্য আছে কোনো! আমার তো একদম ভালো লাগেনি বেডাকে। ছুটির কথায় রোহান ভ্রু কুচকে বলে এটা কেমন ভাষা?

খাঁটি বাংলা ভাষা রোহান ভাইয়া৷ আপনি বুঝবেন না৷ আপাই যখন রেগে যায় তখন এমন দুই একটা বাংলা ভাষা বলে। ছায়ার কথায় আবির ধমক দিয়ে বলে তুই চুপ থাক৷ সব সময় বেশি বকা। আচ্ছা ছুটি, তাশরিফ কিন্তু ছায়ার কথা বলছিলো৷ ওকে বাঁচাতে পারবে না কি যেনো৷ এই কথা কেনো বললো ও? আবিরের ভীষণ কোতুহল।

– সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না৷ আমি আপনাকে একটা কাগজের ব্যাপারে বলেছিলাম মনে উকিল সাহেব? ছুটির কথায় রোহান বলে ওই যে ব্রোর ঘরে যেটা দেখেছিলে তুমি?

– হ্যাঁ! আমার বিশ্বাস ওই কাগজে কিছু একটা আছে৷ কাগজটা পেলে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো সামনে। কিন্তু উনি তো কাগজটা আলমারিতে লক করে রেখেছেন। কিভাবে পাবো বুঝছি না৷ ভাবান্তর হয়ে বলে ছুটি।

– তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি ছুটি, তাশরিফ কিন্তু আসিফকে একদম পছন্দ করে না। এটা আসিফও জানে। ইলহামের সাথে বিয়ে হওয়ার পরেই আসিফের সাথে তাশরিফের ঝামেলা হয় কিছু একটা নিয়ে। এরপর থেকে দুজন আলাদা হয়ে যায়। আমি তো সব সময় ওদের সাথে থাকতাম সব বুঝতে পারি৷ যদিও তাশরিফ কিছু বলেনি আমাকে আলাদা করে আর আমিও জানতে চাইনি। আবিরের কথায় সবাই গভীর ভাবনায় ডুব দেয়।

– এই আসিফের মধ্যে গোলমাল আছে কোনো। কি রহস্য আছে সেটাই বের করতে হবে আমাদের ছুটি বলে ভ্রু উঁচিয়ে।
-আইডিয়া! রোহান বলে উত্তেজিত কন্ঠে। সবাই কপাল কুচকে তাকায়।

– ওই কাগজটা পাওয়ার একটা আইডিয়া পেয়েছি আমি৷ যদিও জানি না কাজে দেবে কি-না। তবে ট্রাই তো করতে পারি আমরা।
– কি আইডিয়া পেয়েছেন শুনি? ছুটির কথায় রোহান বেশ হাসি মুখে বলতে থাকে৷ সব শোনার পর সবার মধ্যে যতটা আগ্রহ হয়েছিলো ততটাই নিরাশ হয়।

– এই নাকি আপনি উকিল! কি উদ্ভট চিন্তা রে বাবা। ছুটির কথায় ছায়া আর আবির মুচকি হাসে৷ রোহান মুখটা বাংলার পাঁচের ন্যায় করে রাখে।

– এইভাবে হবে না৷ অন্য কিছু ভাবতে হবে৷ আবিরের কথা শেষ হতেই রোহান বলে আমার কথার দাম দিলে না তো। ওকে ফাইন! আমি কাজটা করে দেখাবো ইটস মাই চ্যালেঞ্জ।

– ওকে! ক্যারি অন ছুটি বলে হেয়ালি নিয়ে।

— কাটে আরও একদিন। তাশরিফ ঘর থেকে বের হয়নি তারপর থেকে। খাবার দিতে গেলে ফিরিয়ে দেয় আবার নিচে সবার সাথে খাওয়ার জন্য ডাকলে বারণ করে দেয়। যতটা আশাবাদী হয়েছিলো সবাই তাশরিফ কে নিয়ে ঠিক তার বেশি হতাশ হয় আবার।

– তাশরিফ সকাল সকাল শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়। আজ বাইরে যাবে সে। এইভাবে ঘর বন্দি হয়ে বসে থেকে কোনো লাভ হবে না আর না সমাধান আসবে। তাশরিফ আলমারি খুলে শার্ট বের করে তখনই রোহান আসে হন্তদন্ত হয়ে।

– ব্রো সাপ! হঠাৎ রোহানের এমন কথায় হকচকিয়ে উঠে তাশরিফ।

চলবে..

❌কপি করা নিষেধ ❌ভুলক্রুটি মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে