#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
৯
–তুই এখানে? ছুটির কথায় ছায়া পিছু ফিরে বলে তোর সাথে দেখা করতে আসলাম আপাই। কেমন আছিস তুই? সব ঠিকঠাক? ছায়ার কথার জবাব না দিয়ে ছুটি রোহানের দিকে তাকায়। রোহান মুচকি একটা হাসি ধরে রেখেছে মুখে।
– ঘরে আয়, ছোট করে বলে ছুটি।
– আপাই তোকে বলেছিলাম না রোহান ভাইয়ার কথা৷ ইনি সে! অবশ্য তোদের পরিচয় হয়ে গেছে ইতি মধ্যে। রোহান ভাইয়া খুবই মিশুক আর অনেক ভালো। প্রমাণ পেয়েছিস নিশ্চয়? ছায়ার বেশ উৎসাহ রোহানকে নিয়ে
– সাথে বেশি বকাও স্বভাব আছে আস্তেই বলে ছুটি। ছায়ার কর্ণধার হলেও রোহান ভ্রু কুচকে বলে কিছু বললে।
– জ্বি না! ছায়া ঘরে আয় মুখ ভেটকিয়ে কথাটা বলে ছুটি চলে যায়, ছায়া হাসে।
– দেখলে তোমার আপাই কেমন ঝগরুটে রোহান বলে কিউট ফেস করে। ছায়া মুচকি হাসে।
— পরের দিন সকালে ছুটি আবারও তাশরিফের ঘরে আসে কফি হাতে। তাশরিফ ঘুমাচ্ছে এখনো। ছুটি কফির মগ রেখে গতদিনের ন্যায় জানালা আর বারান্দার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়৷ সম্পুর্ন আলো এসে ঘরকে আলোময় করে তুলে। ছুটি লক্ষ্য করে আজ মাত্র দুইটা সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। ছুটি একটা দীর্ঘশ্বাস মুচকি হাসে। ছুটি ঘরে এসে তাশরিফকে ডাকে। তাশরিফ আজ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকায় আলোতে কোনো রিয়াকশন দেখা দেয়না। ছুটির ডাকে তাশরিফ নড়েচড়ে উঠে আবারও ঘুম রাজ্যে তলিয়ে যায়। ছুটি কোমরে হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে আজ যদি কফি ঠান্ডা হয়েছে তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে তাশরিফ ভাইয়া। ছুটির কন্ঠস্বর এত উচ্চ ছিলো যে তাশরিফ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে চোখ ডলতে থাকে।
– কি সমস্যা তোমার? সকাল সকাল জ্বালাতন করতে আসো কেনো। তাশরিফ রাগ দেখালেও সেটা কাজে দেয়না৷ ছুটি মুখটায় রাগী ভাব এনে বলে তুমি এইভাবে প্রতিদিন উপেক্ষা করতে পারো না আমায়। আমার আনা কফিকে অসম্মান করতে পারো না৷ ছুটির কথায় কি রিয়াকশন দেবে তাশরিফ বুঝে উঠে না। কফিকে আবার সম্মান ও দিতে হয়৷ তাশরিফের নিশ্চুপতার সুযোগে ছুটি বলে জলদি ফ্রেস হয়ে এসো।। আজ তোমার ঘর ক্লিন করবো৷ কি একটা অবস্থা করে রেখেছো ঘরের৷ মনে হয় না কোনো মানুষ থাকে। ছুটি টেবিলের উপর এলোমেলো হয়ে থাকা কয়টা কাগজ গোছাতে গোছাতে বলে। তখনই ছুটির চোখ আটকে যায় একটা কাগজে। ছুটি গভীর মনোযোগ রাখার আগেই তাশরিফ ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে নেয়।
– আমার ঘরের কোনো জিনিসে হাত দেবেনা তুমি। বেরিয়ে যাও বলছি৷ ছুটি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
– কি হলো শুনতে পাওনি কি বললাম। আমার আশেপাশে আসবে না তুমি। কাউকে চাইনা আমার।
– ওইটা কিসের কাগজ ছিলো। কি লোকাচ্ছেন আপনি আমার থেকে? ঘাবড়ে যায় তাশরিফ ছুটির কথায়।
– তার কৈফত কি তোমাকে দিতে হবে? ছুটি আর কথা বাড়ায় না৷ কারণ জেদ আর জোর দিয়ে কিছু হবে না। যা করার কৌশলে করতে হবে ছুটি এটাই ভাবে মনে মনে।
– আমার জানারও ইচ্ছে নেই। আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন৷ কফি কিন্তু ঠান্ডা হওয়ার পথে।
– তোমাকে কফি নিয়ে আসতে কে বলে। নিয়ে যাও কফি৷ আমি এখন আর কফি খাইনা।
– খান না তো কি!আজ থেকে খাবেন। আপনি কি চান আমি আপনাকে ডিস্টার্ব না করি? ছুটির কথায় তাশরিফ কিছুক্ষণ নিরব চাহনি রেখে বলে এতখনে বুঝলে?
– আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনাকে! ছুটির কথায় তাশরিফ বিরক্ত হয়ে বলে অবশ্যই চাই।
– তাহলে কফিটা শেষ করুন আমি চলে যাবো তারপর। তাশরিফ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। বিছানা থেকে নেমে বড় বড় ধাপ ফেলে ওয়াশরুমে যায়। ছুটি মুচকি হাসে। যেনো বিশ্বজয় করে ফেলেছে সে৷ এমন এক প্রশান্তি মনে।
— তাশরিফ ওয়াসরুম গেলে ছুটি বিছানা গোছায় আর গুণগুণ করে গান করে। ছুটির নজর বালিশের নিচে রাখা কাগজটার দিকে৷ যেটা তাশরিফ নিয়ে সেখানে রেখেছে। কি আছে কাগজে, কিসের কাগজ না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাবে না ছুটি ।
– গুণগুণ থেকে ছুটি গলাটা ছেড়ে দেয় একটু তখনই তাশরিফ আসে।
– ছুটি আপন মনে কাজ করছে আর গান করছে কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। তাশরিফের ধমকে তটস্থ হয়ে উঠে ছুটি।
– স্টপ ছুটি! বন্ধ করো গান৷ একদম গান করবে না আমার সামনে। আই হেট সং! আমি ঘৃণা করি গানকে। তাশরিফ ভীষণ রেগে যায়৷ এদিকে ছুটি ভয়ে গুটিয়ে দাঁড়ায়। এমন তাশরিফকে আগে কখনো দেখেনি সে। তাশরিফ যে এমন রিয়াক্ট করবে এটাও ভাবেনি সে
– বেরিয়ে যাও!এখুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও বলছি।
– ছুটির হাত-পা কেঁপে উঠে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলে তাশরিফ ভাইয়া আ– আই সেড আউট। ছুটিকে থামিয়ে দিয়ে বলে তাশরিফ।
তাশরিফের চিৎকারে কেঁদে দেয় ছুটি। ছলছলে চোখে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। তাশরিফ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। হাতে থাকা টাওয়ালটা ছুড়ে মারে বিছানায়। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সে।
– এরই মধ্যে রোহান আসে। ছুটিকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যেতে দেখে খুব খারাপ লাগে রোহানের।
আসবো ব্রো? রোহানের কথায় তাশরিফ পিছু ঘুরে।
– রোহান তুই? কবে এসেছিস? স্বাভাবিক হয়ে বলে তাশরিফ।
– কালই আসলাম, তুমি তো বাসায় থাকো না তাই দেখা হয়নি। এই জন্য এখন আসলাম দেখা করতে৷ আবার কখন বেরিয়ে যাও এই ভেবে।
-ওইখানে দাঁড়িয়ে কেনো ভেতরে আয়। তাশরিফের কথায় রোহান বারান্দার দিকে যায়।
– মামা-মামি সবাই কেমন আছে? জিজ্ঞেস করে তাশরিফ।
— টুকটাক কথা শেষে রোহান বলে ছুটিকে এইভাবে না বকলেও পারতে৷ অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো দেখলাম। রোহানের কথায় বুকের মধ্যে ধক করে উঠে তাশরিফের৷ সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। এইভাবে না বললেও পারতো সে।
-তাশরিফ কে কিছু বলতে না দেখে রোহান বলে পারলে একটা সরি বলো ওকে। আমি নিচে যাচ্ছি, তুমিও এসো। একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো আজ আমরা। কথাটা বলে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকে রোহান।
তুই যা আমি আসছি। তাশরিফের কথায় রোহান খুশি হয় অনেক।
– ছুটি ঘরে এসে কান্না করছে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না৷ তাশরিফ যে এইভাবে হুট করে রেগে যাবে বুঝতে পারেনি ছুটি। সে তো একটু গানই করছিলো আপন মনে। কেনো এইভাবে রিয়াক্ট করতে হবে তাকে?
– আসবো? রোহানের কন্ঠস্বর পেয়ে ছুটি চোখ মুছে নেয় তাড়াতাড়ি করে।
– আপনি? রোহানের দিকে না তাকিয়ে বলে।
– ব্রো-র কথায় কষ্ট পেয়েছো অনেক তাই না? হঠাৎ রোহানের মুখে এই কথা শুনে ছুটি হকচকিয়ে তাকায়। চোখের মধ্যে আবারও পানি চলে আসে।
— মন খারাপ করো ছুটি। জানো তো ব্রো এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। অনেক টা চেঞ্জ এসেছে তার মধ্যে। তাকে স্বাভাবিক করতে গেলে এইসব আমাদের উপেক্ষা করতে হবে।
– আমি সব জানি উকিল সাহেব। আমাকে বোঝানো লাগবে না। আমি মন খারাপ করিনি। ছুটি বলে দৃঢ় কন্ঠে।
উকিল সাহেব? ও হ্যালো আমার সুন্দর একটা নাম আছে ওকে! রোহান বলে মলিন কন্ঠে।
– তো? আপনি তো এখানে এসেছেন উকিলগিরি করতে। তাই এর থেকে ভালো নাম আর হয়না আপনার জন্য। আর আমি আপনাকে এই নামেই ডাকবো বুঝছেন?
– কেউ যদি ভালোবেসে… বাকি কথা শেষ করার আগে ছুটি ভ্রু কুচকে রাগী লুক রাখে৷ তাই দেখে রোহান ঘাবড়ে গিয়ে বলে না মানে পছন্দ হলে বলতেই পারো আমার প্রবলেম নেই। তা ব্রেকফাস্ট হবে না?
– ইসস! আমি তো ভুলেই গেছি সবাই এখন ব্রেকফাস্ট করবে৷ রানীমা তো অফিস যাবেন একটু পর আমাকেও বেরুতে হবে তার সাথে। আপনি নাস্তা করবেন না?
– ছুটির কথায় রোহান বলে আমি তোমাকে এই জন্য ডাকতে আসলাম। আমিও ব্রেকফাস্ট শেষে বেরোবো। ব্রোর কেসের দেরি নেই। আমাকে সব রকম প্রিপারেশন নিতে হবে।
– আচ্ছা উনার কি ফাঁসির আদেশ হবে এই রায়ে? ছুটি বলে মন খারাপ করে।
– যদি আমরা কোনো প্রমাণ পেশ করতে না পারি তাহলে হবে। কারণ সব প্রমান তো ব্রোর বিরুদ্ধে আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। কোর্ট শুধুমাত্র সময় দিয়েছে ফলাফল দেওয়ার জন্য। ফুপি ক্ষমতার জোরে ব্রো-কে বাইরে রাখতে পেরেছে এই যা। তাছাড়া ব্রো সেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।।
— কি করবো না করবো কিছু বুঝতে পারছি না। উনি তো এক ধাপ সরছেন না উনার কথা থেকে। রানীমার জন্য খারাপ লাগছে অনেক। মন খারাপ করে বলে ছুটি।
-চিন্তা করো না ছুটি। একটা না একটা পথ ঠিক পাবো আমরা। ব্রো যে নির্দোষ এটা 100% শিওর আমি। দুজনেই একটা দীর্ঘশ্বাস রাখে এরপর।
— দুপুরের দিকে ছুটি ঘরে বসে আছে। বাইরে থেকে এসে রেস্ট করছে সে৷ প্রচুর রোদ বাইরে৷ তাপমাত্রা দিনকে দিন বাড়তেই আছে। ছুটি চোখ বন্ধ কিছু একটা ভাবছে তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দে হকচকিয়ে উঠে।
– দরজার পাশে তাশরিফ কে দাঁড়িয়ে থাকতে অবাক হয়ে যায় ছুটি। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় সে।
* তাশরিফ ভাইয়া তুমি?
– ভেতরে আসবো? তাশরিফের নরম কন্ঠস্বর।
– এটা তো তোমারই বাড়ি, আমার অনুমতি নেওয়া বেমানান।
– আমার বাড়ি! কথাটা বলে তাশরিফ তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় একটা।
– এখন তো তুমি আছো এই ঘরে তাই অনুমতি নেওয়া টা উচিত বলে মনে হয় আমার। এ্যানি ওয়ে যে কারণে এসেছিলাম আমি, তাশরিফের কথায় ছুটি ছোট করে বলে কিছু লাগবে? তাছাড়া তুমি তো এই সময় বাড়ি থাকো না৷ আজ হঠাৎ বাড়িতে আবার ঘরে এসেছো কিছু বলবে? ছুটি যেনো ভয় পাই মনে মনে।
– ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আমি তোমাকে এমন কিছুই বলবো না যেটা শুনে ঘাবড়ে যেতে হবে। আমি জাস্ট সরি বলতে এসেছি তোমাকে৷ সকালের বিহেভিয়ার জন্য সরি। ছুটি মুগ্ধ হয়ে তাকায়।
– তাশরিফের এই কোমল ব্যবহার আবারও বিমুগ্ধ করে তুলছে তাকে।
— ছুটিকে চুপ থাকতে দেখে তাশরিফ বলে আমি আসছি তাহলে! তাশরিফ বেরিয়ে যাবে তখনই ছুটি পেছন থেকে বলে তাশরিফ ভাইয়া, আমি কি তোমার মনে সেই জায়গাটায় আছি যে জায়গায় তিন বছর আগের ছুটি ছিলো? হঠাৎ ছুটির এমন প্রশ্নে থমকে যায় তাশরিফ। বিস্ময় নিয়ে তাকায় সে।
— যদি আগের তাশরিফ থাকতো আজ এখানে তাহলে বলতাম ছুটির জায়গাটা একটুও কমেনি৷ কিন্তু বর্তমান তাশরিফ আর অতীতের তাশরিফ খানের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। বর্তমান তাশরিফের কেউ নেই সে ছাড়া। তাই এখানে কারো অস্তিত্ব নেই” তোমারও না। ছুটির খারাপ লাগে কথাটা শুনে। কান্নায় দম বন্ধ হয়ে আসে যেনো। নিজেকে সামলে নেয় ছুটি।
— আমি কিন্তু এখনো অপেক্ষায় আছি সে স্থান ফিরে পাওয়ার। তিন বছর পর নতুন করে আশাবাদী আমি। সত্যি ফিরিয়ে দেবে?বন্ধু হতে পারবো না আমি বর্তমান তাশরিফ খানের। এতটাই অযোগ্য আমি?
চলবে…