#শেষ বিকালের আলো
#পর্ব_০৮
#নিশাত_আনজুম
হামিদ প্রচুর মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সায়মা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না। হামিদকে ব্ল্যাকমেইল করছে হামিদের পরিবারের সবাইকে জানিয়ে দিবে বলে। সায়মার কথা হলো হয় সে সেতুকে বলবে হামিদকে যেন ছেড়ে চলে যায় নয়তো হামিদ যেন গোপনে সায়মাকে বিয়ে করে সম্পর্ক চালিয়ে যায়। সেতুকে, পরিবারের কাউকেই সায়মা সেটা জানাবে না। গোপনই থাকবে। এতে হামিদের তো সমস্যা হবে না। বউ তো বউয়ের জায়গায় থাকবে। হামিদের রাগে গা কাঁপে। একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়ের ক্ষতি চায়! অবশ্য হামিদেরই দোষ। সে যদি সায়মাকে এড়িয়ে চলতো, সুযোগ গ্রহণ না করতো তাহলে এই সমস্যায় পড়তো না। তার তো কত সুন্দর সংসার জীবন! ঘরে বউ আর ফুটফুটে একটা বাচ্চা রেখে সে অন্য মেয়েকে এতোদিন প্রায়োরিটি দিত সেটা ভেবেই নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। সায়মা বার বার কল করে বিরক্ত করছে বাইরে দেখা করার জন্য। বিছানার মধ্যে রায়ান আর ঐপাশে সেতু। রায়ানকে একদম বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে সেতু ঘুমিয়ে আছে। এক হাত দূরত্ব। হাত বাড়ালেই সেতুকে ছুঁতে পারবে। কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। সেতুকে সে বিয়ের তিন বছরেও ভালোভাবে জানে না। পরিচয়ের তিন মাসের মাথায় বিয়ে হয়েছিল তাদের। দুজনেই প্রেমের সম্পর্কে না জড়িয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঐ তিনমাসে হামিদ সেতুকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিল! হামিদের তখন মনে হতো সেতুকে পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। এতো মিষ্টি একটা মেয়ে! বিয়ের পর ভালোই চলছিলো তাদের সংসার। সেতুর উজাড় করা ভালোবাসা, কেয়ারিং, হামিদকে মান্য করা সবকিছুই ভালো লাগতো। তারপর সায়মার সাথে পরিচয় হওয়ার পর সেতুকে বিরক্ত লাগা শুরু হলো। বলে না মানুষ সহজে কিছু পেয়ে গেলে, বেশি পেলে সেটার গুরুত্ব দিতে জানে না হামিদেরও তাই হয়েছে। সায়মার খাঁটি ভালোবাসা তার কাছে সস্তা লেগেছে। হামিদ কপালের উপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে এইসব ভাবছিল। আগে অন্ধকারে ভয় পাওয়ায় সেতু যদি লাইট জ্বালিয়ে রাখতে বলতো খুব রাগ করতো সে লাইটের আলোতে ঘুমাতে পারতো না বলে। এখন সে লাইট জ্বালিয়েই ঘুমায়। কই ঘুমের তো ব্যাঘাত ঘটে না। এখন সে বুঝতে পারছে লাইটে তার সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল সেতু। সেতু যা বলে সবই তার কাছে সমস্যা মনে হতো। তার ভাবনায় ছেদ পড়লো মোবাইলে রিং হওয়ায়। হাতে বাড়িয়ে নিয়ে দেখলো সায়মার কল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল আপনাআপনি। রিসিভ করলো না পাশে ঢিল মেরে রাখলে মোবাইলটা। পরপর পাঁচবার করে ফেলেছে কল। হামিদ মোবাইল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হাতে নিতেই দেখলো সায়মার ম্যাসেজ। সেতুকে একটু দেখে সে উঠে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় গেল। রুমে সেতু থাকায় সে যথাসম্ভব নিচু স্বরে কথা বলার চেষ্টা করলো। হামিদ যখন আবারও বললো সায়মার চাকরি খোয়াবে সে তখন সায়মা পালটা জবাব দিলো সে বসকে বলবে হামিদের কাছ থেকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের স্বীকার হয়েছে সে। সায়মার এমন কথায় হতবাক হলো হামিদ। কেমন নোংরা মনমানসিকতার মেয়ে সায়মা! গা রি রি করছে হামিদের। রাগে কল কেটে দিয়ে বারান্দা থেকে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে আসে। কোন বিপদ যে আসছে তার কে জানে! ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে সেতু হাত বাড়িয়ে তার মোবাইল দেখছে। হামিদ ভয়ে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ” সে কী! তুমি ঘুমাওনি?”
” ঘুমাতে পারছি কই রিংয়ের আওয়াজে! আমার সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।” বিরক্তির স্বরে কথাটা বলে পাশ ফিরলো সেতু। সায়মা এর মধ্যে আবারও তিনবার কল দিয়েছে। ম্যাসেজের নোটিফিকেশনও এসেছে। হামিদ সায়মার নম্বর ব্লক করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। অস্থির অস্থির লাগছে তার। মনে হচ্ছে সংসারটা ভাঙবে এবার।
হামিদ পরদিন অফিসে গিয়ে দেখে সায়মা আসেনি। জানতে পারে সায়মার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসেনি। হামিদ চেয়েছিল আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে সায়মার। সায়মার পরিবারে একমাত্র সে-ই উপার্জনক্ষম। বুড়ো মা বাবাকে দেখা, বাবার চিকিৎসা খরচ পুরোটাই সায়মার উপর। তাই তো সায়মার চাকরি পেতে সে সাহায্য করেছিল। বিকালে অফিস থেকে এসে হাবিবের কাছ থেকে জানতে পারলো সেতু নাকি আজ জেলার একটা রান্নার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় পুরষ্কার পেয়েছে। এতো বড় খবরটা সেতু হামিদকে জানালো না। হামিদ খুবই মর্মাহত হলো। সেতুর এতো বড় প্রাপ্তি অথচ সে কিছু জানে না। হামিদ বিষন্ন মন নিয়ে রুমে গিয়ে দেখলো সেতু ফোনে কথা বলছে। খুব হাসাহাসি করছে অপর পাশের ব্যক্তির সাথে। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হামিদ বললো, ” এতো বড় একটা খবর আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না সেতু।”
” আরে আমি নিজেই জানতাম না। সবুজ ভাই অনেকদিন ধরে বলছিল। আমি না করে দিয়েছিলাম। শেষে উনি জোর করছেন তাই আর না করতে পারিনি। সেখানে গিয়ে পারবো না কি পারবো না তাই জানাইনি।”
হামিদ মনে মনে বললো, ” সবাইকে তো জানিয়েছো। শুধু আমার বেলায়..”
সেতু বিছানায় বসে আজকের ছবিগুলো দেখছিল। হামিদ দূর থেকে যখন সবুজের সাথে সেতুর ছবিটা দেখলো তখন জিজ্ঞেস করলো, ” সবুজ বিয়ে করেনি এখনো? ”
সেতু ‘ না’ বলতেই হামিদ আবার জানতে চায়লো, ” ও নাকি তোমাকে পছন্দ করতো? ”
সেতু অবাক হয়ে উত্তর দিলো, ” হ্যা। করতো। কিন্তু আপনাকে কে বললো? ”
দীনা জানিয়েছে এই গোপন খবরটা। হামিদ সেটা না বলে বললো, ” শুনেছি আর কী! তুমিও পছন্দ করতে?”
” আমিও যদি পছন্দ করতাম তো আজকে এই ঘরে না থেকে সবুজ ভাইয়ের ঘরে থাকতাম।”
হামিদ মনে মনে স্বস্তি পেল। কিন্তু এই সবুজ বিয়ে না করে এখনো বসে আছে কেন? এখনো সেতুকে পছন্দ করে না তো! সেতুর পেছনে পড়ে আছে।
রাতে শুতে গিয়ে হামিদ সেতুকে বললো, ” তুমি কেমন যেন হয়ে গেছো।”
সেতু হামিদের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন হয়ে গেছি?”
” আগের মতো নেই।” হামিদ সোজাসাপটা জবাব দিলো।
” আপনি কী অভিযোগ করছেন? কিন্তু আমি তো অভিযোগ করার মতো কিছু করিনি। আগের মতোই পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা করছি, আপনার সবকিছু বলার আগে রেডি করে দিচ্ছি। কোনো দায়িত্ব এড়িয়ে চলছি না। সবই পালন করার চেষ্টা করি।”
হামিদ মনে মনে বললো, ” সব কিছুই ঠিকঠাক করছো। শুধু আগের মতো পাগলামি করছো না। তোমার পাগলামি, ভালোবাসা খুব মিস করছি। আরেকবার পাগলামি করো, আমি একটুও বিরক্ত হবো না।”
কথাগুলো মনেই রয়ে গেল। মুখ ফুটে সেতুকে বলার সাহসটা নেই তার। হামিদের জবাব না পেয়ে সেতুও আর পাত্তা দিলো না।
ঘটনা ঘটলো পরের দিন। হামিদ অফিসে একটু দেরিতেই গিয়েছিল। গিয়ে শুনলো বস তাকে ডেকেছে। সেখানে গিয়ে সায়মাকে দেখে অবাক হলো। আরও অবাক হলো এটা শুনে যে সায়মা সত্যি সত্যিই বসের কাছে কমপ্লেইন করেছে হামিদ তাকে সেক্সুয়ালি হ্যারাস করেছে। হামিদ অনেকবার বললেও বস বিশ্বাস করলো না। সায়মার কেঁদে কেঁদে বলা কথাগুলোই সত্য মনে হলো তাঁর। আস্তে আস্তে অফিসের সবার কানে গেল। বস সকলের সামনে তাকে অপমান করে অফিস ছাড়তে বললো। লজ্জায়, অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। তার চরিত্রে এমন দাগ লাগবে সে ভাবতে পারেনি। অফিস থেকে বেরিয়ে সে সোজা সায়মার বাসায় গেল। সায়মার মাকে আজকের ঘটনাটা জানালো। সায়মার মায়ের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। হামিদ যে বিবাহিত ছিল তিনি জানতেন না। হামিদের চোখের জল দেখে তাঁর চোখও ভিজে উঠলো। হামিদ তাদের অনেক সাহায্য করেছে। সায়মার বাবাকে যে চার বার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তখন হামিদ তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিল, সাহস দিয়ে পাশে থেকেছিল। সেই হামিদের সাথে সায়মার এমন আচরণ তিনি মানতে পারছেন না। সায়মাকে তো এমন শিক্ষা দেননি তিনি। মেয়ের টাকায় সংসার চলে বলে মেয়ের সবকিছুতে প্রশ্রয় দিবেন এমন মা নন তিনি। সায়মার এমন কাজে তিনি হামিদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। হামিদের দুই হাত ধরে আশ্বস্ত করলেন যে সায়মা অফিসে গিয়ে নিজের মুখে হামিদকে দেওয়া অপবাদ তুলে নিবে, নিজের ভুল স্বীকার করবে। হামিদও এটাই চায়। চাকরি তার লাগবে না। সবার সামনে যে তার চরিত্রে কালি পড়লো সেটা মুছতে চায়। সায়মাদের বাসা থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরছিল সে। পথেই হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্ট হলো। রিকশা উলটে সে আর ড্রাইভার খাদে পড়েছে। হামিদের শরীরের অর্ধেক রিকশার নিচে। হামিদ করুণ স্বরে আল্লাহকে ডাকলো। এটাই বোধহয় তার অপরাধের শাস্তি। রায়ানের চেহারা ভেসে উঠলো চোখে। সেতুর কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হলো না।
চলবে…