শেষ বিকালের আলো পর্ব-০৩

0
808

#শেষ বিকালের আলো
#পর্ব_০৩
#নিশাত_আনজুম

দরজায় টোকা দেওয়ায় নিহান দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। হাবীবকে দেখে সেখান থেকেই চিল্লিয়ে মাকে বললো, ” হাবীব ভাইয়া এসেছে আম্মু।”

তারপর হাবীবের হাতে বড় বড় বইয়ের প্যাকেট দেখে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো, ” এতো বড় বড় এগুলো নোভা আপুর বই?”

” হ্যা। দিয়ে আয় ওকে।”

” আমার জন্য ব্যাট কিনো নি?” ছোট করে নিহান জিজ্ঞেস করলো যেন কেউ শুনে না নেয়।

” বলেছি না পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে ব্যাট বল সব কিনে দেবো। ”

নোভার মা হাবীব এসেছে শুনে বিছানা থেকে উঠে সামনের রুমে গেলেন। তার ডায়াবেটিসের ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। কাছের ফার্মেসিতে নিহানকে পাঠালে সেখানে পায় নি।

” তুমি এতো কষ্ট করে আবার এসেছো কেন বাবা? তোমাকে বলেছি বাজারের ফার্মেসীতে পেলে আমাকে জানাতে। আমি নিহানকে পাঠাতাম।”

” সমস্যা নেই চাচী। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিহান ছোট মানুষ তাই আমি নিয়ে এসেছি।” হাবিব সোফায় বসে বললো।

নোভা বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছে।
নিহান নোভার সামনে বইগুলো ধুপ করে রেখে বললো, ” মোবাইল থুইয়ে এবার পড়তে বয় মা! না পড়লে আমাকে বলিস, ভাঙারির কাছে বেচে দেবো বইগুলো। ফিফটি ফিফটি ভাগ।”

নোভা উঠে বসে বললো, ” যে নিয়ে এসেছে তাকে দিয়ে আয়। বলবি আমার লেখাপড়া শেষ। টাকা খরচ করে এসব বই আনার কোনো মানে হয় না।”

নিহান বইগুলো যেভাবে নিয়ে এসেছে সেভাবে নিয়ে গেল।

” নোভা আপু বলেছে বইগুলো বেচে দিয়ে টাকাগুলো ফিফটি ফিফটি ভাগ করে দুজনে নেবো। ভাইয়া, তুমি কি আমার সাথে যাবে বইগুলো বিক্রি করতে? তুমি সাথে গেলে টাকা বেশি পাবো।” বলেই দাঁত বের করে হাসলো নিহান।

” তোর নোভা আপুকে বেচে দিলে টাকা বেশি পাওয়া যাবে। চল, ওকে বেচে দিয়ে ফিফটি ভাগ করে নিই।”

রুম থেকে হাবিবের কথা শুনে নোভা রাগে ফেটে পড়লো। মা হাবিবকে শরবত বানিয়ে দিতে বলেছে। নোভা কিচেনে গিয়ে পানির গ্লাসে মাঝারি চামচে চার চামচ লবণ গুলে নিয়ে নিহানকে দিয়ে পাঠালো। ব্যাটাকে লবণ খাইয়ে ওর রাগটা একটু কমাক। পানি মুখে নিতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো হাবীব। তাড়াতাড়ি উঠে বেসিনে গিয়ে ফেললো। নোভার মা সোফাতেই বসে ছিল।
” কী হয়েছে বাবা? খারাপ লাগছে তোমার? ”

” লবণ! মুখে নেওয়া যাচ্ছে না। ” বলে বেসিনে আবার থু ফেললো।

নোভার কাছে জিজ্ঞেস করলে সে এসে বললো, ” গরম থেকে এসেছে তাই একটু লবণ পানি দিয়েছি আর কী!”

” হ্যা, লবণ পানিই দিয়েছিস। লবণের মধ্যে একটু পানি দিয়ে গুলেছিস।” দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস বললো হাবীব।

নোভার মা বকলেন নোভাকে। মেয়েটা কোনো কাজ পারে না। আফসোসও করলেন মেয়ের বিয়ের পর সংসারজীবন নিয়ে।
চাচী হাবীবকে ভাত খেয়ে যেতে বললেও হাবীব খেলো না।
__________________

হামিদ ঘরে এলো রাত এগারোটার দিকে। ততক্ষনে সবাই খাওয়াদাওয়া শেষ করলেও সে হামিদের অপেক্ষায় ছিলো। হামিদ আসলে তাকে ডাকলো খেতে।

” আমি খেয়ে এসেছি।” হামিদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জবাব দিলো

” আমি না খেয়ে অপেক্ষা করছিলাম আপনার জন্য। ”

” আমার জন্য অপেক্ষা করতে কে বলেছে তোমাকে! আমি কখনো বলেছি আমার সাথেই খেতে হবে তোমার! তাহলে?” হামিদের কথায় বিরক্তি স্পষ্ট।

অথচ হামিদ একা খেতে চায় না। বলে একা একা খেতে ভালো লাগে না। সেতু আর কিছু না বলে হামিদের কোলে রায়ানকে দিয়ে বললো, ” ওকে একটু রাখুন। আমি খেয়ে আসছি।”

হামিদ ফোন পাশে রেখে রায়ানকে বুকে নিয়ে আদর করতে লাগলো। খেয়ে এসে ছেলের হাসি মুখ দেখে সেতুর ভীষণ ভালো লাগলো। ছেলেটা বাবাকে পেয়ে কী খুশি! বাবার সঙ্গ তেমন পায় না সে। সেতু বিছানা থেকে হামিদের জামা, জুতো গুছিয়ে রাখলো। তারপর বিকালে কেনা শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। শাড়িটা পরে এসে দেখলো রায়ান ঘুমিয়ে পড়েছে। সে হামিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করলো, ” শাড়িটায় কেমন লাগছে আমাকে? মানিয়েছে?”

হামিদ সেতুর কথায় তাকালো সেদিকে। সেতুর প্রশংসা করে না সে কখনো। কেন যেন মন চায় না। সেতুর দিকে তাকিয়ে ছোট করে বললো, “হুম, ঠিকঠাক।”

” কয়েকটা ছবি তুলে দেন!”

” এই রাতের বেলা কীসের ছবি! ভালো আসবে না পরে তুলো। লাইটটা অফ করে দাও। চোখে আলো পড়ছে।”

ভালো করে দেখলোও না একটু। সেতু নিজেই কয়েকটা সেলফি তুলে তারপর শাড়ি পালটে নিলো। লাইট অফ করে বিছানায় এসে রায়ানকে একপাশে রেখে বালিশ, কাঁথা একটার উপর আরেকটা রাখলো যাতে রায়ান গড়িয়ে না পড়ে। তারপর হামিদের পাশে শুয়ে তার বুকে হাত রেখে জড়িয়ে ধরলো। হামিদ বললো, ” কাল সকালে তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে, সেতু। ঘুমাবো।”

” হ্যা, ঘুমান। আমি তো কিছু করছি না।”

হামিদ সেতুর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো, ” গরম লাগছে আমার। একটু দূরে যাও।”

সেতু হাত সরিয়ে নিয়ে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।
__________________
সকালে হামিদ নাস্তা করতে বসেছে। সেতু পানি এগিয়ে দিয়ে বললো, ” মেজো ভাইয়া আর আদিবা কালকে বেড়াতে যাচ্ছে কাছে কোথাও। দুইদিন নাকি থাকবে। আমরাও বেড়াতে গিয়েছি অনেক দিন হচ্ছে। যাবেন কোথাও? দুই তিন ঘন্টার ভেতর চলে আসা যায় এমন জায়গায়। ”

” ঘরে কে থাকবে? মা একা হয়ে যাবে।”

” এখন না। ওরা আসলে যাবো আর কয়েক ঘন্টা-ই তো।”

হামিদ রুটি ছিড়ে মুখে দিলো। বললো, ” সময় কোথায় আমার। অফিসে কাজের চাপ অনেক। ”

ততক্ষণে হাবিব এসে বসেছে। হামিদের খাওয়া শেষ। বের হবে এখন সে। সেতু তাড়াতাড়ি গিয়ে টিফিন বক্সটা দিল। হাবিব কাউকে না দেখে জিজ্ঞেস করলো, ” বাকিরা কোথায়, ভাবী। কাউকে দেখছি না যে!”

” মা পাশের বাড়িতে গেছে। মেজো ভাইয়া আর আদিবা ফটোশুট করতে গেছে কোথাও। আদিবার নাকি খুব ইচ্ছে এই সময়টা স্মৃতি হিসেবে রাখার।”

হাবিব হাসলো। ” খুব ভালো। মেজো ভাবীর কিন্তু অনেক শখ। দেখেছো এই সময়ও কেমন সব পূরণ করছে! তোমাদের তো রায়ান হওয়ার পরও বোধহয় তিনজনের একসাথে ছবি নেই, তাই না!”

” তুলিনি কখনো। ”

” তুললে বড় হলে রায়ানকে দেখাতে পারতে যে সে কেমন ছিল ছোট বেলায়, তোমরা কেমন ছিলে। আচ্ছা সমস্যা নেই। আমার এক পরিচিত ভাই আছে। সে খুব ভালো ফটোগ্রাফার। তাকে দিয়ে একদিন তোমাদের তিনজনের ছবি উঠাবো।”

” সময় কোথায় তোমার ভাইয়ের!” সেতু আনমনে উত্তর দিলো। হাবিব নাস্তা করতে করতে বললো, ” সময় থাকবে না কেন? আর ভাইয়ার নাহয় সময় নেই, তোমার তো আছে! বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়েদের সময় কি শুধু সংসারের জন্য বরাদ্দ হয়ে যায়? নিজের শখ আহ্লাদ পূরণের জন্য নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে, সময় বের করতে হবে। মেজো ভাবীকে দেখো, সে এ সময়ও নিজের শখ আহ্লাদ আনন্দের সাথে পূরণ করছে। সংসার করার পাশাপাশি নিজের শখও পূরণ করা যায়। তুমি তো আগে শখের বশে রান্না করতে, বিয়ের আগে তো তোমার খাবারের একটা পেইজও ছিল শুনলাম সেসব করতে ইচ্ছে করে না তোমার? মানুষের মুখে তোমার রান্নার প্রশংসা শুনতে ইচ্ছে করে না! ”

” করি তো। এই যে সবার জন্য রান্না করি সেসব তো শখের বশেই করি।”

” উহুম। সেটা তুমি দায়িত্ববোধ থেকে করো। দায়িত্ববোধ আর শখ কিন্তু এক না।”

হাবিব কথাগুলো বলে সেতুর দিকে চাইলো। সেতু আনমনা হয়ে টেবিলের উপর পানিগুলোতে আঁকিবুঁকি করছে। হাবিবের খাওয়া শেষ। সে একটু পরেই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললো, ” নিজের আনন্দগুলো নিজেই খুঁজে নাও ভাবী। নিজেই নিজেকে ভালোবাসো আগে। অফিসের সময় হয়ে গেছে। আমি বের হচ্ছি।”

সেতু বুঝলো না হাবিব হঠাৎ তাকে এসব কেন বলছে। কলের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো তার। দীনা ফোন করছে। সকাল থেকেই অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে সে মোবাইল বন্ধ করে দিলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে