রহস্য গল্প: শেষ পর্বের শুরু (প্রথম পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা
চলন্ত গাড়িঘোড়ায় পায়চারি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু হামিদ সাহেব এখন সেই কঠিন কাজটাই করছেন। যার ফলাফল স্বরূপ একটু পরপর এর ওর গায়ে হেলেদুলে পড়ছেন। কেউই কথা শোনাতে ছাড়ছে না।
আমি সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে চুপ আছি, কিছু বলছি না। অবশ্য বলেও তেমন লাভ হবে বলে মনে হয় না।
কম রিসার্চ তো করিনি এই পায়চারি নিয়ে। কোনো কারণই চিহ্নিত করতে পারিনি। আমার তো মাঝেমাঝে মনে হয়, লোকটার ঘাড়ে জ্বীন-ভূত টাইপের কিছু আছে, নির্ঘাত আছে। তা না হলে এইরকম অদ্ভুত রোগ কারো থাকে?
.
মানুষটার সাথে পরিচয় আমার হুট করে।
চৈত্র মাসের ক্যাটক্যাটে রোদে গলায় মাফলার জড়িয়ে এক ভদ্রলোক কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রি করছেন। কারো সাথেই কথা বলছেন না, পুরোপুরি সুইচ অফ মোডে আছেন। টিকিট বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে যথাসম্ভব হাঁটাহাঁটিও সেরে নিচ্ছেন।
আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘এইভাবে হাঁটছেন কেন? আর এই গরমে গলায় মাফলারই বা প্যাঁচিয়ে রেখেছেন কেন? গরম লাগে না আপনার?’
প্রথম প্রশ্নের কোনো জবাব এলো না। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘গলায় টনসিলের সমস্যা।’
এতকাল শুনেছি শীতকালে টনসিলের সমস্যা বাড়ে, কিন্তু এই লোকের বেলায় তো দেখছি পুরোপুরি উল্টো। পাগল নাকি!
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, ‘একটা ধুমকেতু ট্রেনের টিকিট দেন তো।’
সাথে সাথে টিকিট কেটে হাতে দিলেন। আমিও চুপচাপ সেটা নিয়ে ট্রেনে উঠলাম।
গল্পটা এই পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু বাধ সাধলো অন্য জায়গায়। কন্ডাকটর টিকিট চেক করার সময় ধরা খেলাম। লোকটা ধুমকেতুর বদলে সূবর্ণ ট্রেনের টিকিট দিয়েছেন। আমিও তাড়াহুড়ায় বিষয়টা আগে খেয়াল করিনি। কোনো মানে হয়!
কন্ডাকটরকে হাজার চেষ্টা করেও কিছুই বোঝাতে পারলাম না। উল্টে নতুন করে আবার টিকিট করতে হলো। লোকটার জন্য এতগুলো টাকা গচ্ছা গেল ভাবতেই ভীষণ মাত্রায় রাগ হলো। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, ‘এবার রাজশাহী ফিরে এর প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বো।’
যথারীতি পরেরবার রাজশাহী এসে সবার আগে গেলাম টিকিট কাউন্টারে৷ এই সময় কাউন্টার সাধারণত ফাঁকা থাকে।
আমাকে দেখেই লোকটা ফিক করে হেসে দিলেন। আমারও কেন জানি রাগটা পড়ে গেল। বকাঝকা করতে ইচ্ছে হলো না। আর যাইহোক, হাস্যরত মানুষের উপর রাগ করে থাকা যায় না। সেই সাধ্য আমার নেই।
আমি কিছু বলার আগেই উনি মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘আমি জানতাম, তুমি আবার আমার সাথে দেখা করতে আসবে।’
আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম, ‘জানতেন মানে? কীভাবে জানতেন? তাহলে আপনি ইচ্ছে করেই আমায় ভুলভাল টিকিট ধরিয়ে দিয়েছেন?’
উনি প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
‘আসলে আমাকে তোমার একটা কাজ করে দিতে হবে।’
কথাটা বলে মুখে একটা পান পুরে নিলেন।
লোকটার কথা শুনে আমি পুরো ভ্যাবাচেকা খেলাম।
‘কাজ মানে? কিসের কাজ? অপরিচিত একজন মানুষকে হুটহাট কাজের কথা বলছে কেন? এ নির্ঘাত পাগল হবে…’
আপন মনে কথাগুলো যখন ভাবছিলাম তখন উনিই আবার মুখ খুললেন।
‘এই ছেলে কী ভাবছো এত? আমি পাগল নাকি সেটা? আরেহ না, আমি ওসব পাগল টাগল কিছু না। আসলে রোজই তোমায় এই রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখি৷ পাশের ওই ভার্সিটিতে পড়ো বোধহয়। স্থানীয়?’
এবার আমার রীতিমতো রাগ হলো। উনি কি তাহলে আমায় ফলো করছেন?
এবার আর রাগ নিয়ন্ত্রণ হলো না। বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বললাম, ‘কেন? সেটা জেনে আপনার কী? আর আপনি জানলেনই বা কীভাবে আমি ভার্সিটিতে পড়ি? তাহলে আপনি কি আমায় ফলো করছেন?’
আমার প্রশ্নে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো বলে মনে হয় না। স্বাভাবিকভাবে আগের ভঙ্গিতেই পান চিবাতে চিবাতে বললেন, ‘আসলে আমি এখানে নতুন পোস্টিং হয়েছি। মাস দুয়েক হবে আরকি। তাই ভালোভাবে কোনোকিছুই চিনি না। এখানে আশেপাশে কোনো মেস আছে তোমার জানাশোনা? কোয়াটারের রুমগুলো বড্ড ঘিঞ্চি।’
‘মেস? ব্যাচেলর মেস?’
কথাগুলো বলে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাচেলর মেস।’
‘কিন্তু আপনাকে দেখে তো ব্যাচেলর মনে হয় না। ব্যাপারটা কী?’
‘সে পরে একসময় বলবো। আছে নাকি তাই বলো?’
‘আমি জানি না।’
কথাটা বলেই হাঁটা দিলাম।
লোকটা বার কয়েক ‘এই ছেলে এই ছেলে…’ বলে ডাকলেন। তবুও আমি হাঁটা বন্ধ করলাম না। বরং হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম। যত্তসব পাগল ছাগল। এদের সাথে কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো।
.
মাস দুয়েক পরের ঘটনা।
এক সন্ধ্যায় ব্যাগপত্র নিয়ে হামিদ সাহেব আমাদের মেসে উঠলেন। শুধু মেসে নয়, একদম আমার রুমে।
পাঁচ-পঞ্চাশ বয়সী একজন মানুষ ব্যাচেলর মেসে কী করছেন সেটা আমার ঠিক বোধগম্য হলো না। আর সত্যিকথা বলতে, আমার সেসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই।
আমি যতই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, মানুষটা ততই ভাব জমাতে আসেন। কিছুটা গায়ে পড়া স্বভাব আছে বটে। বিরক্ত লাগে।
তবে ওনার রান্নার হাত চমৎকার। মাঝেমধ্যেই এটা সেটা রান্না করে সবাইকে খাওয়ান। মানুষকে খাওয়ানোর মধ্যে নাকি অদ্ভুত তৃপ্তি আছে।
সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত দারুণ রান্না শিখলেন কীভাবে?’
আমার কথা শুনে উনি একমুহূর্ত চুপ হয়ে থাকলেন। তারপর হেয়ালির সুরে বললেন, ‘খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ কতকিছু শিখে ফেলে। কেউ কেউ বেঁচে থাকার উপায়ও খুঁজে বের করে। সেখানে আমি নাহয় রান্না শিখলাম। সামান্য একটা ব্যাপার।’
কথাগুলোর সাথে সাথে হামিদ সাহেবের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা মিইয়ে যেতে থাকলো। চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কথার মানে।
পুনরায় আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঠিক বুঝিনি কী বললেন? তবে আমি নিশ্চিত, আপনার স্ত্রী আপনার রান্নার প্রেমে পড়েই আপনাকে বিয়ে করেছিলেন।’
‘ইমলির মা বেঁচে থাকলে কি আমার আজ রান্না করে খেতে হয়? মানুষটা বেঁচে থাকতে আমাকে কুটোটিও নাড়তে দেয়নি। একগ্লাস জল গড়িয়েও খেতাম না। সবসময় একটা সাহেবি ভাব নিয়ে চলতাম। মানুষটাও আমায় প্রশ্রয় দিতো। তারপর কী থেকে কী হয়ে গেল! কলেরাও এলো, আমার সাজানো গোছানো সংসারটা শেষ করে দিয়ে গেল।’
কথাগুলো বলা মাত্রই ওনার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়লো। মুখ ধীরেধীরে বিবর্ণ হতে শুরু করলো।
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বললাম, ‘এবার আপনার পায়চারি করার অভ্যাস বন্ধ করতে হবে কিন্তু। রাতদুপুরে এইভাবে পায়চারি করলে ভূত-টূত ভেবে ভয় পেয়ে যাই।’
আমার কথা শুনে উনি হাসলেন, মৃদু হাসি। ভাবে মনে হলো কোনো মজার জোক্স বলেছি আমি।
হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘মানুষের কত অদ্ভুত অদ্ভুত রোগ থাকে। আমার রোগটা তো সামান্য। তাছাড়া হাঁটাহাঁটি করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমি এত হাঁটি জন্যই এখানো ফিট আছি।’
আমি কোনো জবাব দিলাম না। নতুন করে মানুষটাকে ঘাঁটানোর ইচ্ছে নেই। পায়চারি করে যদি শান্তি পান তবে তাই করুক। আমার কী?
চলবে…