#শেষ_পরিণতি
(সিজন ২ পর্ব ৩)
মাজেদা বেগম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পাথরের মতো জমে গেলেন।
তার মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে।
ওখানে এক মিনিটও দাঁড়িয়ে না থেকে তিনি দ্রুত রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
রাগে থরথরিয়ে কাঁপছেন তিনি।
তার মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখার আগে হয়ত অন্ধ হওয়াই ভালো ছিলো।
কোনো মা’ই নিজ চোখে তার সন্তানকে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত অবস্থায় দেখতে চাইবেন না।
কিন্তু না চাইতেও মাজেদা বেগমের সামনে এমন কিছু পড়লো।
তাও আবার নীলিমার সাথে!
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
মাজেদা বেগম দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পরে রাজন বের হয়ে মাজেদা বেগমের পেছনে দাঁড়ায়।
কারও মুখে কোনো শব্দ নেই।
নিরবতা ভেঙে মাজেদা বেগম বললেন,
-তোকে আমি পেটে ধরেছি এটা ভাবলেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
রাজন নিচু কন্ঠে বলে,
-মা তুমি যেটা ভাবছো তেমন কিছুই না। আসলে…রাজনের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাজেদা বেগম বলেন,
-তোর লজ্জা করছে না, এতো বড় ঘৃণিত কাজ করে আমার সাথে কথা বলতে?
আমি যেমনটা ভাবছি তেমনটা নয় মানে কি?
আমি তো নিজ চোখে দেখেছি তোর নোংরা কাজ কর্ম। ছিহ! ইচ্ছে করছে তোদের দুইটাকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিই।
ঘরে প্রেগন্যান্ট স্ত্রী রেখে, এসব করার আগে কি তোর একটুও বিবেকে বাঁধলো না?
কি করে পারলি তুবার মতো একটা লক্ষী মেয়েকে ঠকিয়ে, এমন চরিত্রহীন মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে?
এতোকিছু হওয়ার পরেও তুবা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওই পতিতাকে এ ঘরে জায়গা দিয়েছে, আর তোরা সেই তুবাকেই ঠকালি!
বিশ্বাস ভালোবাসার এই দাম দিলি!
আজ আমার চোখে তুই এবং নীলিমা উভয়ে সমান অপরাধী।
আমি তো শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়ের ভেতরে অনেক ভেজাল আছে।
মাজেদা বেগমের কথার উত্তরে রাজন জোর গলায় বলে,
-নীলিমাকে নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না মা।
আমি ওকে ভালোবাসি। তাছাড়া আমি তো কোনো ভুল করিনি।
নীলিমা আমার প্রথম ভালোবাসা, ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে চাওয়াটা কি পাপ?
আমি ঠিক করেছি আমি নীলিমাকে বিয়ে করবো।
রাজনের কথা শুনে মাজেদা বেগম নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলেন না।
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে রাজনের মুখে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
-তোর সাহস হয় কি করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলার!
তুবার মতো একটা মেয়েকে তুই স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিস এটা তোর ভাগ্যের ব্যাপার।
তুই তাকে ফেলে ওই চরিত্রহীনার পেছনে ঘুরছিস!
-আমি তুবাকে ফেলে দেবো সেটাতো বলিনি মা।
একসাথে দুই বিয়ে করা তো জায়েজ আছে। আমি তুবা এবং নীলিমা দুজনকেই স্ত্রীর সম্মান দিয়ে রাখবো।
রাজনের কথায় মাজেদা বেগমের মেজাজ ক্রমশ আরও বিগড়ে যাচ্ছে।
তিনি চিৎকার করে বললেন,
– হায়রে কাপুরুষ অন্তত নিজের সন্তারের কথা তো ভাব। একদিকে বেচারি তুবা, নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছে, অন্যদিকে তুই!
একটা নষ্ট মেয়েকে নিয়ে বাসায় নষ্টামিতে মেতে উঠেছিস!
দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। তোর পাপী চেহারা আমি দেখতে চাই না।
তবে যাওয়ার আগে শুনে রাখ, নীলিমাকে আজকের মধ্যেই এ বাসা থেকে বিদায় করবি।
নয়ত আমাকে মা বলে কখনো ডাকবি না।
রাজন কিছু না বলে মাথা নিচু করে দোতলায় চলে গেলো।
মাজেদা বেগমের এই কথার উত্তর দিলো নীলিমা।
রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে মাজেদা বেগমকে বললো,
-আন্টি প্লিজ এতো উত্তেজিত হবেন না।
আমরা ভুল করেছি সেটা আমরা স্বীকার করি।কিন্তু আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি।
ভালোবাসা থেকে মানুষ কতোদিন মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে বলুন!
তবুও যেহেতু আমাদের দ্বারা ভুল হয়েই গেছে, আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করবো।
আমি এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো।
কিন্তু তারপর কি হবে আন্টি?
তুবা যখন জিজ্ঞেস করবে, আমি কোথায় গেলাম কেন গেলাম, তখন কি আপনি পারবেন তাকে সবটা খুলে বলতে?
বললেও বা তুবা বিশ্বাস করবে কোন ভিত্তিতে?
কোনো প্রমাণ আছে আপানার কাছে? প্রমাণ ছাড়া কিছু বলতে গেলে উল্টো আপনি দোষী হয়ে যাবেন।
আমি জানি আপনি তুবাকে অনেক ভালোবাসেন।
কিন্তু বর্তমানে তুবার এই অবস্থায় আমার মনে হয় না আপনার এসব বলা ঠিক হবে।
এতে আপনারই ভালো হবে।
নীলিমার কথা শুনে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকান মাজেদা বেগম। নীলিমার চেহারার শয়তানি ভাব ফুটে উঠেছে।
তার ইচ্ছে করছে চুল ধরে নীলিমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে এটা করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
তুবা সব জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে। একটার পর একটা আঘাত ও নিতে পারবেনা।
মাজেদা বেগম নীলিমাকে কিছু না বলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।
.
.
.
.
নিজ রুমে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মাজেদা বেগম।
চোখের কোণা বেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে।
কিভাবে নিজের ছেলেকে সৎ পথে আনবে, তুবার সামনে গিয়ে তিনি কিভাবে দাঁড়াবেন!
এমন হাজারও দুশ্চিন্তার মাঝে ডুবে আছেন তিনি।
“আমাকে কোনো দরকার ?”
হঠাৎ রহিম মিয়ার কন্ঠস্বরে মাজেদা বেগমের চিন্তায় ছেদ পরে।
তিনি চেয়ারে বসেই, চোখ বন্ধ অবস্থায় প্রশ্ন করেন,
-দুপুরে আমি বাসায় এসে আপনাকে পাইনি।
কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
রহীম সাহেব বলেন,
-রাজন স্যার জরুরি কাজে আমাকে একটু বাইরে পাঠিয়েছিলেন।
মাজেদা বেগম একটু চুপ থেকে আবার বললেন,
-আপনাকে একটা কাজ দেবো করতে পারবেন?
-একবার বলেই তো দেখেন মালিক। আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য।
মাজেদা বেগম এবার চোখে মেলে তাকালেন।
ইশারা করে রহীম সাহেবকে কাছে ডেকে, কি করতে হবে সেটা বললেন।
চেয়ার হতে উঠে আলমারির থেকে কিছু টাকা বের করে রহীম মিয়ার দিকে এগিয়ে দিলেন।
এতোগুলো টাকা পেয়ে রহীম মিয়া খুশিমনে রুম থেকে বের হয়ে যান।
.
.
.
পরদিন দুপুর।
হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করিয়ে রাজন আমাদের নিয়ে গাড়িতে উঠলো।
গতকাল রাত থেকে রাজন একটু বেশিই কেয়ার করছে আমার।
অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ কথাতেই আছে। তাই আমারও হঠাৎ রাজনের এতো কেয়ার সহ্য হচ্ছে না।
সবটাই যে রাজনের অভিনয় সেটা আমি ভালো করেই বুঝে গেছি,কিন্তু এমন করার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছি না।
কিন্তু নিজের চিন্তাভাবনা নিজের মধ্যেই চেপে রাখলাম। আমার শ্বাশুড়ি মা, আমার মা, বা রাজন কাউকেই আমি সত্যিটা এখন বুঝতে দিতে চাচ্ছি না।
রাজনের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত মেয়েটার পরিচয় ও আরও প্রমাণ যোগাড় করে আমি সবার সামনে রাজনের মুখোশ খুলে দেবো।
সবকিছু সবার সামনে রাখার পরে আমার ভাগ্যে যেটা আছে সেটাই হবে।
কিন্তু আমি কখনোই এই অন্যায় মেনে নেবো না।
আমাকে এবং আমার সন্তানকে ঠকানোর মাশুল তো তাকে দিতেই হবে।
.
.
.
বাসার ঢোকার সাথে সাথে রান্নাঘর থেকে নীলিমা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
আমি ওকে স্বান্তনা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
আমার মা আমাকে ধরে সোফায় বসিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
নীলিমা মার পাশে গিয়ে বললো,
-কেমন আছেন চাচী?
মা বাবা সবাই কেমন আছে?
নীলিমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মা আমার পাশে বসে পরলেন।
আমি আস্তে করে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-নীলিমার সাথে কথা বললে না কেন?
মা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
-তুই বোস, আমি তোর জন্য শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি। খুব গরম পড়েছে, বেশি বেশি পানি, শরবত না খেলে পানিশূন্যতা দেখা দেবে।
আমার কথা মা এড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না।
.
.
.
ঘড়িতে রাত ১০ টা বাজে।
বিছানায় একা একা শুয়ে আছি আমি।
রাজন এখনো বাসায় ফেরেনি, কল করে বলেছিল অফিসের ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।
এতো রাতে কি কাজ সেটা নিয়ে আমার একদমই মাথা ব্যথা নেই। রাজনকে আমি আর কখনোই হয়ত বিশ্বাস করতে পারবো না।
আমার দুশ্চিন্তা রাজন বাইরে আছে সেটা নিয়ে নয়, আমার চিন্তা হচ্ছে ও ফিরে এলে একই বিছানায় ওর সাথে শুতে হবে এটা ভেবে।
ওর সাথে এক বিছানায় শুয়ে আমার কখনোই ঘুম আসবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ লেগে আসছিল আমার।
আচমকা জানালার ওপাশে ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম।
বিছানা থেকে উঠে জানালা খুলে বাহিরে তাকাই।
অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেয়ে টর্চের আলো ফেলতেই আমি শিউরে উঠি।
জানালার পাশে একটা রক্তাক্ত দেহ দেখে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
আমার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এলেন আমার কাছে।
সবাই মিলে হাজারটা প্রশ্ন করছে। কিন্তু ভয়ে ভেতরটা আমার জমে গেছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে আমি ফ্লোরে বসে পরি।
.
.
.
চলবে
Tuba Binte Rauf