#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৮
#মেহরিন_রিম
_আমি ঠিক ই বলছি,তোর বাসার আশেপাশের লোকেরা তো তাই বলছে যে তুই বিয়ে করতে গ্রামে গেছিস। এমনকি তোদের বাসায় যে আন্টি কাজ করে সেও তো এই কথাই বললো।
বন্ধুর কথা শুনে যেনো অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো অপূর্ব। অস্থির কণ্ঠে বললো,
_ক কিন্তু এমনটা কি করে হতে পারে! মানুষ মিথ্যে কথাই বা বলবে কেন? আমরা এতটা তাড়াতাড়ি এসেছি যে কাওকে তো কিছু জানাতেও পারিনি।
_আমি কি করে জানবো বল তো? আমার তো সন্দেহ হলো বলেই তোকে ফোন করলাম। তুই হিমিকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবি,আমার তো বিশ্বাস ই হয়নি। এখন আরো শিওর হয়ে গেলাম।
অপূর্ব কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ভাবলো এমন গুজব কে ছড়াতে পারে। অত:পর মাথায় কিছু একটা চিন্তা আসতেই তার চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো। মুখ থেকে অস্ফূটস্বরে বেড়িয়ে এলো,
_মা..
_কিছু বললি?
বন্ধুর কথা কানে আসতেই ধ্যান ভাঙলো অপূর্বের। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
_হ্যা..না কিছুনা। তোকে অনেক অনেক থ্যাংকস দোস্ত,কথাটা জানানোর জন্য।
_সেটা ঠিক আছে,কিন্তু এই খবরটা কে ছড়ালো বুঝতে পারছিস?
_হয়তোবা।
_মানে?
_আমি তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি।
কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলো। দ্রুত পায়ে হেটে মাকে খুঁজতে লাগলো,কিছুক্ষন এর মধ্যেই তাকে পেয়েও গেলো।
ফরিদা বেগমের পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো,
_মা..
ছেলের কণ্ঠ শুনে নিজের কাজ রেখে ঘুড়ে দাড়ালেন ফরিদা বেগম। আঁচলে হাত মুছে ছেলের সামনে এসে বললেন,
_হ্যা বল।
অপূর্ব কিছুক্ষন তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সরাসরি বললো,
_তুমি সবাইকে বলেছো যে আমি এখানে বিয়ে করতে এসেছি?
অপূর্বের প্রশ্ন শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লেন ফরিদা বেগম। বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন অপূর্বের দিকে। মাকে চুপ থাকতে দেখে অপূর্ব আবারো গম্ভীর গলায় বললো,
_চুপ করে থেকোনা মা,উত্তর দাও।
ফরিদা বেগম আশেপাশে তাকিয়ে নিচের নজর লুকোনোর চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললেন,
_আ আমি ক কেনো বলতে য যাবো।
_তোমার কথার ধরণই বলে দিচ্ছে মা যে এই কাজটা তুমি ই করেছো।
ফরিদা বেগম বুঝতে পারলেন তার ছেলে সবটাই বুঝে গেছে। চোরের ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। অপূর্ব এবার জোড়ে জোড়ে হাততালি দিয়ে বললো,
_বাহ মা বাহ, কি অসাধারণ কাজ করেছো তুমি। তার মানে এই সবটাই তোমার পূর্বপরিকল্পিত।
_দেখ অপু তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।
_আর কি বুঝবো মা? সবটা তো আমার কাছে একদম পরিষ্কার। তুমি আগে থেকেই জানতে হিমি হাটতে পারে না, আর সেটা জেনেই তুমি ওকে বাড়িতে আনতে বলেছিলে যেন তুমি ওকে অপমান করতে পারো।
ফরিদা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে,অপূর্ব যে এতকিছু বুঝতে পেরে যাবে সেটা তিনি ভাবতেও পারেন নি। অপূর্ব আবারো বলতে লাগলো,
_আমার আগেই সন্দেহ হচ্ছিল, হুট করে এই সময়েই কেন জমিজমা নিয়ে ঝামেলা হবে? আবার সামান্য কিছু পেপারের কাজেই বা এতদিন সময় লাগছে কেন? এখন বুঝতে পারছি সবটাই তোমার প্লান।
ফরিদা বেগম অপূর্বের গায়ে হাত বুলিয়ে করুণ সুরে বললেন,
_অপু,বাবা আমার কথাটা একটু শোন।
অপূর্ব এক ঝটকায় মায়ের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
_কি শুনবো মা? তুমি যানো সেদিনের ঘটনার পর হিমি সু*ই*সা*ই*ড করতে গিয়েছিলো!
ফরিদা বেগম অবাক চোখে তাকালেন অপূর্বের দিকে,যার অর্থ তিনি কিছুই জানেন না। অপূর্ব আবারো বলতে লাগলো,
_সেদিন যদি ওর কিছু হয়ে যেতো? আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম মা? পারতাম না, এই অপরাধবোধ শেষ করে দিতো আমাকে। আমি যে হিমিকে কতটা ভালোবাসি সেটা তুমি নিজেও জানো মা, তবুও তুমি এমন কাজ করতে পারলে?
ফরিদা বেগম অপরাধীর ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন,তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অপূর্ব তার কাছে এসে বললো,
_তোমার কথা অনিযায়ী একটা পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করে আমি ভালো থাকতে পারবোনা, আচ্ছা যদি এমন কোনো দূর্ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটতো তাহলে?
_অপু! এমন কথা বলতে নেই বাবা।
_তাহলে আর কি বলবো মা? আচ্ছা ঠিক আছে আমার সাথে না হোক, আমি একটা সুস্থ সবল মেয়েকেই বিয়ে করলাম। বিয়ের পর যে তার সঙ্গে কোনো দূর্ঘটনা ঘটবে না, তার কি গ্যারিন্টি দেবে তুমি?
ফরিদা বেগম চুপ করে দাডিয়ে আছেন। ছেলের প্রশ্নের কোনো উত্তর তার জানা নেই। অপূর্ব এবার কিছুটা দূড়ে সরে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_ব্যাস,অনেক হয়েছে মা। আর না, আর তুমি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি হিমিকে,আর কষ্ট দিতে পারবো না আমি ওকে। আমি আজ এখনি চলে যাবো এখান থেকে,তুমি যদি চাও তাহলে চলো আমার সঙ্গে। আর না যেতে চাইলে আমি একাই যাবো।
কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে গেলো অপূর্ব। ঘরে গিয়ে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো,
_আমি আসছি হিমি, তুমি আমাকে যে শাস্তি দেবে তাই আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তবুও তোমার অভিমান আমি ভাঙাবোই।
কথাটা ভাবতে ভাবতে অপূর্বের ফোনে হিমির কল এলো। তবে সে কলটা ধরতে গিয়েও ধরলোনা,মনে মনে ভাবলো,
_না এভাবে নয়,আমি সামনাসামনি তোমার সঙ্গে কথা বললো। আর একটু অপেক্ষা করো হিমি, জাস্ট আ লিটেল মোর টাইম…
____
শেষ রিংটাও হয়ে গেলো,কিন্তু অপূর্ব ফোনটা তুললো না। হিমি এবার কিছুটা উচ্চস্বরেই কেঁদে ফেললো। ফোনটাকে বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
_আমি কি অপরাধ করেছি অপু?কেনো আমার সঙ্গে এমনটা করলে তুমি,কেন?
ড্রইং রুমে অর্নব সহ তার পরিবার এর সকলে বসে আছে। হুর এসে হিমিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে,যদিও তার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা তার। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সে। অর্নব এর কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে হিমির,লোকটা যে ওকে ভিষণ ভালোবাসে সেটা বুঝে গেছে সে। কিন্তু হিমি যে এখনো নিজের সবটা দিয়ে অপূর্ব কেই ভালোবাসে। এই দ্বিধা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য শেষবারের মতো কল করেছিল অপূর্ব কে, তবে এবারো সে কলটা রিসিভ করলোনা।
কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে কান্না থামিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলো হিমি। রিপা রুমে এসে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। রিপা হিমির সামনে এসে খাটে বসলেন। হিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,
_আমি আজও তোমায় জোড় করবোনা হিমি। শুধু একটা কথা মাথায় রেখো, সত্যিকারের ভালোবাসা কিন্তু সবাই পায়না। এমন সিদ্ধান্ত নিওনা,যার কারণে তোমাকে পরবর্তীতে অনুশোচনায় ভুগতে হয়।
রিপা মায়ের দিকে তাকালো, সে তো অপূর্বের চোখেও নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছে। রিপা এবার হিমিকে নিয়ে ড্রইং রুমে এলো। তাকে ধরে সোফায় বসালো। অর্নব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিমির দিকে, তবে হিমির সেদিকে কোনো নজর নেই। সে স্থির দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অর্নবের পরিবার এর সঙ্গে হিমির বাবা মা আরো কিছু কথা বললো,তবে তার কিছুই যেন হিমির কানে গেলোনা। পরিশেষে রিপা হিমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
_হিমি, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি?
হিমি চুপ করে রইলো,অর্নব হিমির দিকে তাকিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার উত্তর শোনার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে যাওয়ার পর মানিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,
_আমাদের মেয়ে যদি রাজি না থাকে তাহলে…
_আমি রাজি বাবা।
অশ্রুসজল চোখে কথাটা বলে চোখের পলক ফেলতেই জমে থাকা জলটুকু গড়িয়ে পরলো হিমির।
অর্নবের চোখেমুখে যেন বিশ্বজয়ের আনন্দ ফুটে উঠলো। মুচকি হেসে হিমির দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
_ব্যাস,এইটুকুর ই প্রয়োজন ছিলো আমার হিমপরি। তোমার এই চোখের জল আমি ঠিক মুছিয়ে দেবো, আর কোনো কষ্টের ছোঁয়াও লাগতে দেবোনা তোমার জীবনে। এবার তুমি আমার হবে হিমপরি,শুধুই অর্নবের।
#চলবে