#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।
পুতুল নাক টেনে জবাবে বলল,
‘আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।’
সারাজের কর্ণকুহরে কথাটা বিষের মতো গিয়ে ঠেকল। মস্তিষ্ক ঠিক নিতে পারল না। ভেতরটা মূর্ছে উঠল যেন। পুতুল অন্য কাউকে পছন্দ করে? সে কি আদৌ ঠিক শুনছে?
বুকের ব্যথা ততক্ষণাৎ বেড়ে গেল। রাগ চড়ে বসল মাথার ব্রহ্মতালুতে। গলার স্বর পাল্টে সে শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘তুই অন্য কাউকে পছন্দ করিস?’
পুতুল আজ জড়তা দেখাল না। সহজ গলায় বলল,
‘হ্যাঁ।’
সারাজ চোয়াল শক্ত করে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,
‘কাকে?’
‘সেটা সময় এলে তোমাকে বলব। আগে তুমি মা’কে বোঝাও। আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আর আমি জানি, তুমি বললে মা তোমার কথা শুনবেন।’
‘ফাজলামি পেয়েছিস? সামনে পেলে থাপড়াতে থাপড়াতে তোর গাল লাল করে ফেলতাম। অন্য কাউকে পছন্দ করিস? তাই বিয়ে করবি না? এখন আমাকে আবার বলছিস তোর হয়ে উকালতি করতে? এত সাহস হয় কী করে তোর? অনেকদিন ধরে থাপ্পড় খাচ্ছিস না। তাই দিন দিন সাহস বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। আর তোর পছন্দ করা আমি বের করছি। এক্ষুনি আমি সব মা’কে বলব। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তোমার মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। তোমাদের আর ওকে পড়াতে হবে না। বিয়ে দিয়ে দাও, সেটাই ভালো।’
‘সারাজ ভাই।’
করুণ সুরে ডাকল পুতুল। তাতে আরো বেশি তেতে উঠল সারাজ। পুতুল অন্য কাউকে পছন্দ করে এটা যেন সে মেনেই নিতে পারছে না। সে চেঁচিয়ে বলল,
‘চুপ। আর একটা কথাও আমি শুনছি না। তোর বিয়ে হবে। আমি যার সাথে চাইব, তার সাথেই তোর বিয়ে হবে। বুঝেছিস?’
পুতুলের মন অস্থির। এতকিছুর পরেও সারাজ ভাই কেন বলছেন না, বিয়েটা তিনি করবেন। তিনিই পুতুলকে ভালোবাসেন। এই এক কথা শুনতেই তো এতকিছু। পুতুল অস্থির গলায় বলল,
‘তাহলে আমার পছন্দের কী হবে, সারাজ ভাই?’
সারাজ দাঁতে দাঁত পিষছে। পাগল পাগল লাগছে সবকিছু। তার পুতুল অন্য কাউকে পছন্দ করে? তাকে পছন্দ করে না? কবে হলো এসব? তবে কি তার শাসন আর ঝগড়াই তার পুতুলকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে? পুতুল কি তবে তার হবে না?
চোখ বুজতেই মনে হলো শ্বাস আটকে যাচ্ছে তার। এই নির্মম সত্য সে কোনোভাবেই মানতে পারবে না। তার পুতুল তাকে ব্যতিত অন্য কাউকে পছন্দ করতেই পারে না।
সারাজ কল কেটে দিল। মাথা কাজ করছে না। স্নায়ুতন্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছে হয়তো। কোনো অনুভূতি আর কাজ করছে না। সুখ দুঃখ কিছুই টের পাচ্ছে না সারাজ।
এসব কখন হলো? পুতুল তার জায়গা অন্য কাউকে কী করে দিয়ে দিতে পারল? এতটা স্বার্থপর তার পুতুল কী করে হলো, কী করে?
______
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ গত বিশ মিনিট যাবত ক্রমাগত হয়েই যাচ্ছে। তবে ভেতর থেকে কোনো রা নেই। রিতা এবার চিন্তিত স্বরে ডাকল,
‘সারাজ, বাবা দরজাটা খুল না।’
বরাবরের মতোই ভেতরে নিশ্চুপ। রিতার এবার চিন্তা হচ্ছে। ছেলেটা আবার বেশি সিরিয়াস হয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে বসেনি তো? দরজার ধাক্কানোটা বাড়াল সে। থামল না। পরপর আঘাত করতেই থাকল।
বেশ অনেকক্ষণ পর দরজাটা খট করে খুলে গেল। খুলেই দৃশ্যমান হলো এক লম্বা সুঠামদেহী পুরুষ। ছেলেটা যা লম্বা হয়েছে, রিতাকে উপর দিকে চেয়ে কথা বলতে হয়। সে বলতেই নিল,
‘কিরে, এতক্ষণ দরজা খুলছিলি না…’
মাঝপথেই থামতে হলো তাকে। সারাজের চোখ মুখ দেখে আঁতকে উঠল সে। তারপর গালে হাত দিয়ে ভীত সুরে বলল,
‘কী হয়েছে, বাবা? তোর চোখ মুখ এমন হয়ে আছে কেন?’
সারাজ চুলে আঙ্গুল চালিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে গুছিয়ে বলল,
‘কই, কিছু হয়নি তো। তুমি দরজা ধাক্কাছিলে কেন, কিছু বলবে?’
‘হু? হ্যাঁ হ্যাঁ। রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিলাম তোকে। খাবি আয়।’
সারাজ জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল। গলার স্বর কেন যেন কাঁপছে তার। কষ্ট করে বলল,
‘আমাকে একটু খাইয়ে দিবে, মা?’
ভীষণ কাতর শোনাল এই স্বর। রিতার বুকের ভেতরে ধক করে উঠল যেন। তারা কি সত্যি জানতে গিয়ে ছেলে মেয়েগুলোকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে?
রিতা ঢোক গিলে বলল,
‘তুই রুমে যা, আমি খাবার নিয়ে আসছি।’
‘সাত আটটা কাচা মরিচ সাথে এনো।’
রিতা বিচলিত হয়ে পড়ল। না না, এবার হয়তো বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছে তারা। মেহুলের সাথে কথা বলতে হবে। এত ভেবে আর কাজ নেই, ছেলে মেয়ে দুটোকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। তারপর বাকিটা ওরাই সামলে নিবে।
রিতা খাবার নিয়ে আসার আগে সারাজ দ্রুত তার রুমটা গুছিয়ে নিল। সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মা এসে এসব দেখলে হয়তো আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়বে। তাকে প্রশ্ন করতে করতে মাথা খাবে। কিন্তু সারাজ জানে, জবাব দেওয়ার জন্য আজ সারাজের ঝুলিতে কোনো উত্তর নেই।
এক লোকমা শেষ হতে না হতেই সারাজ চারটা কাচা মরিচ শেষ করে ফেলল। প্রচন্ড ঝাল এই মরিচ। ইতিমধ্যেই তার নাক মুখ লাল হয়ে উঠেছে। রিতা ছেলের কর্মকান্ড দেখে হতভম্ব। আরেকবার লোকমা মুখে তুলে দিল। সেটা গিলেই আরো দুইটা মরিচ খেল সারাজ। রিতা এবার তার হাত থেকে মরিচটা কেড়ে নিল। চিন্তিত সুরে বলল,
‘পাগল হয়েছিস তুই? এভাবে মরিচ খাচ্ছিস কেন?’
ততক্ষণে সারাজের নাকে মুখে পানি চলে এসেছে। সে নাক টেনে হেসে বলল,
‘আসলে মাথা ধরেছে, মা। একটু ঝাল খেলে মাথা ধরাটা ছেড়ে দিবে।’
রিতা আরেক লোকমা মুখে দিতে দিতে বলল,
‘মাথা ধরেছে তো মাথা ধরার ঔষধ খা। তাই বলে এভাবে মরিচ খাবি? একটু পর পেট খারাপ করলে?’
‘কিচ্ছু হবে না, মা। আমার ঝাল খেয়ে অভ্যাস আছে।’
বলেই আরেকটা মরিচ হাতে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা হাত থেকে নিয়ে ফেলে দিল রিতা। সারাজ ক্ষান্ত হলো। মুখ কালো করে শান্ত হয়ে বসল। চোখ মুখ মরিচের ঝাঁঝে আরো রক্তিম হয়ে উঠেছে। রিতা অসহায় চোখে চেয়ে আছে ছেলের দিকে। তার ঝাকড়া চুলগুলোতে হাত রেখে বলল,
‘কী হয়েছে, বাবা? কোনো কিছু নিয়ে কি কষ্ট পাচ্ছিস? মা’কে বল, মা সব ঠিক করে দিব?’
সারাজের এলোমেলো দৃষ্টি মায়ের উপর বর্তাল। ভীষণ বিধ্বস্ত ঐ চোখের দৃষ্টি। দেখলে মায়া হয়। সেই নিরেট গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘আমি কি খুব খারাপ, মা?’
রিতা অবাক হলো এই প্রশ্নে। সে সিক্ত চোখে চেয়ে জবাব দেয়,
‘এসব কী বলছিস? আমার ছেলে তো লাখে এক। তোকে কেউ খারাপ বলতেই পারবে না।’
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সারাজ বলে,
‘তাহলে মানুষ আমায় কেন পছন্দ করে না?’
‘মানুষ পছন্দ করে না? কোন মানুষ পছন্দ করে না? কার কথা বলছিস?’
এদিক ওদিক চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সারাজ উত্তরে বলল,
‘না, কারোর কথা না। খাইয়ে দিবে না? ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’
রিতা বুঝতে পারছে, ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে। এই কষ্ট যে পুতুলের জন্য সেটাও সে নিশ্চিত। কিন্তু, হঠাৎ এই প্রশ্নে খানিকটা নড়ে উঠে সে। মানুষ তাকে পছন্দ করে না? সে কোনো মানুষের কথা বলছে, পুতুলের?
_______
থমথমে অন্ধকার চারদিক। আকাশ শূন্য। চাঁদ নেই। তারাও খুব বেশি একটা চোখে পড়ছে না। বাতাসেরও নাম গন্ধ নেই। আছে কেবল এক বিশাল নিরবতা আর নিস্তব্ধা।
‘আমি তখনই বুঝেছিলাম, মাথায় আপনার অন্যকিছু চলছে।’
মেহুল হেসে বলল,
‘জি। সারাজকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে এর থেকে আর ভালো কোনো উপায় নেই।’
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল রাবীর। বলল,
‘ছেলেটাকে ওর মতো করে ভালো থাকতে দিবেন না, তাই না? ঠিক আছে, যা খুশি করুন। আমি এসবের মাঝে নেই।’
মেহুল হতাশ হয়ে বলল,
‘আহা, আপনি এভাবে কেন বলছেন? সারাজ রাজনীতিতে গেলে অযথাই ঝামেলা বাড়বে। তার চেয়ে বরং সে সাদরাজ ভাইয়ের ব্যবসায় যোগ দিয়ে বিয়ে শাদি করে সংসার করবে, সেটাই ভালো।’
‘হ্যাঁ, খুব ভালো। তবে আর দেরি কেন; বিয়ে দিয়ে দিন ওদের।’
মেহুল জানে তার কথা মোটেও রাবীরের পছন্দ হচ্ছে না। তাতে আজ তার কিছু যায় আসে না। ভালো মন্দ সেও কম বোঝে না। আপাতত সারাজ পুতুলের বিয়েতেই সবার মঙ্গল।
_______
‘এই যে শুনো।’
প্রচন্ড গরম পড়েছে আজ। রোদে ঠিক মতো চোখ মেলেও তাকানো যাচ্ছে না। গরমে ঘেমে গেয়ে একাকার। তার মাঝে কারোর এমন কর্কশ গলার স্বর শুনে মেজাজটা এবার পুরোপুরিই হারাল লীনা। নাক মুখ কুঁচকে পেছন ফিরে চাইতেই মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘আসসলামু আলাইকুম, ভাইয়া। ভালো আছেন?’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। হ্যাঁ, ভালো। আসলে, তোমার সাথে একটু কথা ছিল। সময় হবে?’
‘জি, ভাইয়া। বলুন।’
সারাজ এক পল সময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘পুতুল কি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে?’
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫।
লীনা ভড়কে গেল সারাজের প্রশ্নে। পুতুল কোনো ছেলেকে পছন্দ করে না, এটা সে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে। কিন্তু, চিন্তার বিষয়, সারাজ ভাই কেন এই প্রশ্ন করছেন? লীনার নিরবতা দেখে সারাজ বিরক্ত হচ্ছে। আশ্চর্য! এত সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে এত সময় লাগে? সে ভ্রু কুঁচকাল। লীনা বুঝতে পারল সারাজের অভিব্যক্তি। সে দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘না, ভাইয়া। পুতুল কোনো ছেলেকে পছন্দ করে না।’
‘তুমি শিওর?’
‘জি, অবশ্যই। এমন কিছু হলে ও আগে আমাকে বলতো।’
সারাজ ঠোঁট জোড়া চেপে এক পল কিছু ভাবল। লীনা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু কি হয়েছে, ভাইয়া? কোনো সমস্যা? পুতুলও তো আজ এখনও ভার্সিটিতে আসেনি।’
‘না না, কোনো সমস্যা না। তুমি ক্লাসে যাও। পুতুল চলে আসবে।’
লীনা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা হেলিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে।’
সারাজ ভাবছে। পুতুল তাকে মিথ্যে বলেছে? নাকি, লীনা তাকে এখন মিথ্যে বলছে? সারাজ ঠিক মেলাতে পারছে না কিছু। কেউ একজন তো ঠিক মিথ্যে বলছে। হয় পুতুল, না হয় লীনা। কিন্তু, সে বুঝবে কী করে, কে মিথ্যে বলছে?
সারাজ বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ হয়ে যায়, পুতুলকে দেখতে পায় না। পুতুল কি আজ তবে ভার্সিটিতে আসবে না?
একটু পরই কালো রঙের গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল পুতুল। সারাজ রাস্তার ওপারে, পুতুলের দৃষ্টির বাইরে। অথচ সারাজের সম্পূর্ণ দৃষ্টি পুতুলের উপরই। মেয়েটা আজ সাদা লাল মিশ্রিত একটা কামিজ পরেছে। এই সামান্যতেই নজর আটকে গেল সারাজের। ওড়ানাটা ভালো মতো টেনে গেইটের দিকে পা বাড়াল পুতুল। সারাজ চেয়ে রইল। তার ছোট্ট পুতুল বড়ো হয়ে গিয়েছে। তার এখন বিয়েও হয়ে যাবে। অন্য কারোর সাথে। কলিজা ধক করে উঠল তার। তার পুতুল অন্য কারোর হতেই পারে না। এই হাত দুটো দিয়ে সে সবসময় তার পুতুলকে আগলে রেখেছে। যত্নে রেখেছে। হ্যাঁ, সে হয়তো কঠোর। কিন্তু, এই সবটা কঠোরতা কেবল তার পুতুলের ভালোর জন্য। পুতুল কি সেটা বুঝতে পারেনি? অভিমান করে দূরে সরে গেল?
সারাজ কিছু সময় পর ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করে। এখন ক্লাস টাইম। তাই মাঠে ছাত্র ছাত্রীদের আনাগোনা কম। সে অডিটরিয়ামে দিকে পা বাড়াতেই ফোন বেজে উঠল,
‘হ্যালো, আব্বু। বলো।’
‘তোমার না আজ অফিস জয়েন করার কথা ছিল? কোথায় তুমি?’
‘আব্বু, আমি একটা কাজে এসেছি। অফিসে যেতে একটু লেইট হবে।’
বিরক্ত হলো সাদরাজ। বলল,
‘অফিসের প্রথম দিনই লেইট করে আসবে? কীসের এত কাজ তোমার? রাবীরের অফিসে নয়তো?’
‘না, আব্বু। আমি অন্য কাছে এসেছি। কাজ শেষ করেই দ্রুত চলে আসব। রাখছি এখন।’
কল কেটে আবারও পা বাড়াল আগের রাস্তায়।
অডিটরিয়ামে বেশ কয়জন ছাত্র ছাত্রী আছে। তারা যার যার মতো গান নাচ নিয়ে ব্যস্ত। সে এদিক ওদিক চেয়ে ভালোমতো দেখল সব। পুতুল এখানে নেই। নিশ্চয়ই এখন ক্লাসে আছে। সে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল,
‘আপনি সারাজ আহমেদ না?’
অপরিচিত গলা পেয়ে ঘুরে তাকাল সারাজ। তার মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে সে চিনল না। তাও স্বপ্রতিভ হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘জি। কিন্তু, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’
ছেলেটা মুচকি হেসে সারাজের দিকে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। আমোদ গলায় বলল,
‘হাই, আমি মাহাত। এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমাকে আপনি না চিনলেও, আমি আপনাকে চিনি। আমাদের মন্ত্রী সাহেবের সাথে ছবি দেখেছি।’
সারাজ এতক্ষণে ভালো মতো হাসল। বলল,
‘ওহ, আচ্ছা। তা আপনি কোন ইয়ারে আছেন?’
‘এবার ফোর্থ ইয়ার। আপনি কি মন্ত্রী সাহেবের এসিসট্যান্ট?’
সারাজ অপ্রস্তুত হেসে বলল,
‘ঐ বলতে পারেন আরকি।’
‘চলুন তাহলে আপনার সাথে একটু চা খাওয়া যাক।’
‘এখন চা খাবেন?’
‘জি, যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে। ওহ, আপনার এখানে আসার কারণটাই তো জানা হলো না।’
‘একটা কাজে এসেছিলাম। কাজটা যদিও হয়নি, কিন্তু তাও চলে যেতে হবে।’
‘আমি কি আপনাকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারি?’
সারাজ মনে মনে ভাবল, এই ছেলে আর কী’ই বা জানবে। মন্ত্রীর মেয়ে বলে সবাই তো আর তার খবর নিয়ে বসে থাকে না। মানুষের আরো অন্য কাজও আছে।
সারাজ নিশ্বাস ছেড়ে নরম গলায় বলল,
‘নো, থেংক্স। আমি কাজটা পরে এসে করে নিব। আর অন্যদিন এসে আপনার সাথে চাও খেয়ে যাব। আজ আসি তবে।’
‘ভাইয়া, আমি আপনার ছোট। আপনি আমাকে আপনি না বলে তুমি ডাকলে আমি বেশি খুশি হব।’
সারাজ মৃদু হেসে ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে বলল,
‘ঠিক আছে। পরের বার দেখা হলে তুমি করেই বলব, আর অবশ্যই চাও খাব।’
ছেলেটা প্রসন্ন হাসল। জবাবে মাথা দুলাল কেবল।
সারাজ দরজার বাইরে এসেও আবার কিছু একটা শুনে থমকে দাঁড়াল। ভেতরে কেউ একজন হঠাৎ বলে উঠল,
‘ভাই, পুতুল মেয়েটা দলীয় সঙ্গীত দিচ্ছে নাকি একক?’
‘একক সঙ্গীত। তুমি উনাকে আলাদা সিরিয়ালে রাখো। গুলিয়ে ফেলো না সবকিছু।’
সারাজ ঘুরে চাইল। মাহাত নামের ছেলেটা অন্য একটা ছেলের সাথে এই ব্যাপারেই কথা বলছে। সারাজ এগিয়ে যায়। মাহাতকে ডেকে বলে,
‘এই মাহাত, শুনোতো।’
‘জি ভাই, কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ, পুতুলকে তুমি চেনো?’
ছেলেটা মৃদু হেসে বলল,
‘মন্ত্রীর মেয়ে হিসেবে তো কম বেশি সবাই চিনে। তবে আমাদের ভার্সিটিতে গানের জন্যও উনার বেশ খ্যাতি আছে। বেশ ভালো গান করেন উনি। এই যে সামনের প্রোগ্রামেও নাম দিয়েছে।’
‘ওহ, আর কিছু জানো ওর সম্পর্কে?’
ছেলেটা বুঝল না ঠিক। জিজ্ঞেস করল,
‘আর কিছু বলতে?’
‘না মানে, ভার্সিটির কারো সাথে ওর কি কোনো প্রেম টেম আছে? চোখে পড়ে কিছু।’
প্রশ্ন শুনে ছেলেটা কেমন যেন ইতস্তত বোধ করছে। সে কি মানুষের প্রেম দেখে বেড়াই নাকি? সে কী করে বলবে?
‘ভাই, আমি তো এসব জানি না। উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার উনিই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু, আপনি হঠাৎ উনার কথা জিজ্ঞেস করছেন যে?’
সারাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘একটা সিক্রেট বলব, কাউকে বলবে না তো?’
মাহাত মুখ ভঙ্গি ভীষণ সিরিয়াস করে বলল,
‘একদম না।’
‘আমার হবু বউ পুতুল। তাই বিয়ের আগে একটু খোঁজ খবর নিতে এলাম। শোনো, এই কথাটা যেন সিক্রেট থাকে। পুতুল ও যেন কিছু জানতে না পারে। মনে থাকবে তো?’
প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই হাসল মাহাত। স্বাভাবিক ব্যাপার। বিয়ের আগে এমন একটু আধটু খোঁজ খবর নিতেই হয়। এটাতে খারাপের কিছু নেই। তাই সে সারাজকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘চিন্তার কিছু নেই, আমার পেট থেকে সহজে কোনো কথা বের হয় না। আর বের হলেও আমি ঠিক সবটা কাটিয়ে নিতে পারব।’
‘সত্যি বলছো তো?’
‘একেবারে হান্ড্রেট পার্সেন্ট, ভাই। ডোন্ট ওয়ারি।’
‘আরেকটা কাজ করতে হবে। ওর উপর একটু নজর রাখবে। আই মিন, একটু চোখে চোখে রাখবে আরকি; দেখবে কোনো ছেলের সাথে বেশি গদগদ হয়ে কথা বলেছি কি-না। এমন হলে সাথে সাথেই ফোন করে আমাকে জানাবে। পারবে না?’
‘অবশ্যই পারব।’
‘চিন্তা নেই, তোমাকে কাজটা ফ্রি তে করাব না। অনার্স শেষ করে আমাদের কম্পানিতে চাকরির সুযোগ পেয়ে যাবে, উইদ আউট এনি ইন্টারনভিউ। মনে থাকবে তো সব?’
‘জি জি, ভাই। অক্ষরে অক্ষরে সব মনে থাকবে।’
সারাজ হেসে পুনরায় ছেলেটার পিঠে চাপড়ে মেরে বলল,
‘দ্যাট’স দ্যা স্পিরিট, মাই ম্যান।’
সারাজ বেশ নিশ্চিন্ত মনে অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসে। ভার্সিটির কোনো ছেলে হলে অবশ্যই সে এই খবর পরে হলেও পেয়ে যাবে। কিন্তু, ছেলেটা যদি বাইরের কেউ হয়? আবার পা থামল সারাজের। বাইরের ছেলে? পুতুল তো তেমন কোনো ছেলের সাথে কথা বলেনি। অন্তত তার চোখে তো কখনও পড়েনি। ধুত, চিন্তায় চিন্তায় এখন তার মাথা ব্যথা আরম্ভ হয়েছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে গিয়ে একটা আছাড় মেরে জিজ্ঞেস করতে, “এই বল, কোন আহাম্মককে পছন্দ করিস? আমিও তোর সেই পছন্দের আহাম্মককে একবার দেখি। দেখি সে কোন দেশের রাজপুত্র।”
সারাজ অস্থির পায়ে ভার্সিটির ক্যান্টিনে গিয়ে বসে। সেখানে অনেক ছাত্র ছাত্রী। সবাই ব্যস্ত খাওয়া আর গল্প নিয়ে। এর মাঝেই কোথ থেকে যেন একটা মেয়ে এসে তার পাশে চেয়ারে বসে পড়ল। সারাজ বিরক্ত হলো মেয়েটার কাজে। এত জায়গা থাকতে তার পাশেই কেন বসল?
মেয়েটা হেসে গদগদ গলায় বলল,
‘আমি আপনাকে চিনি। সেদিন টিভিতে দেখেছিলাম আপনাকে। কালো একটা শার্ট পরেছিলেন। জানেন, আপনাকে প্রথম দেখেই আমি ক্রাশ খেয়েছিলাম।’
বলেই ওড়নাতে আঙ্গুল পেঁচাতে আরম্ভ করে মেয়েটা। যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছে সে। সারাজের বিরক্তির মাত্রা বাড়ল এবার। এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তার উপর এই মেয়ের ব্যবহারে এখন আরো বেশি মেজাজ বিগড়াচ্ছে তার। সে উঠে যেতেই মেয়েটাও চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘চলে যাচ্ছেন?’
‘জি।’
‘ইয়ে মানে, আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে?’
সারাজ এবার ভীষণ চটল। মেয়েটার দিকে ঘুরে রাগে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই সে থেমে গেল। ক্যান্টিনের ভেতরে পুতুল ঢুকছে। পাশেই লীনা, কিছু একটা নিয়ে দুজন খুব গুরুতর আলোচনা করছে। পুতুলকে দেখেই সারাজের ভাবমূর্তি পাল্টে গেল। সামনে চেয়ে দেখল অপরিচিত সেই মেয়েটা তার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। ততক্ষণাৎ দারুণ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। সঙ্গে সঙ্গেই মুচকি হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে।
চলবে….