শেষটা সুন্দর ২ পর্ব-১২+১৩

0
513

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।

অগত্যাই সারাজের জন্য চা বানাচ্ছে পুতুল। চোখে মুখে তার মহা বিরক্তি। চা বানানো আহামরি কোনো ব্যাপার না। কিন্তু, এই সহজ কাজেও খুব একটা পটু না সে। আবার তার হাতের চা যে খুব বেস্বাদ হয়, তেমনও না। কোনোরকমে চালিয়ে দেওয়া যায় আরকি। তবে এই কোনোরকমে চালিয়ে দেওয়াটাকেও আরো জঘন্য করার পাঁয়তারা করছে সে। এক কাপ চায়ের জন্য চার চামচ চা পাতা দিয়েছে। তাতেও মন ভরেনি। আরো এক চামচ দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। অনেকক্ষণ ধরে পানি ফুটাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। মনে মনে ততক্ষণে ভেবে নিল, এই তরল পানীয়কে আরো কীভাবে জঘন্য বানানো যায়।

‘চা করছিস কার জন্য?’

মায়ের গলা পেয়ে ঘাড় কাত করে তাকায় পুতুল। বলে,

‘তোমার আদরের ছেলের জন্য।’

‘বাহ, ভালো।’

মেহুল খুশি হয়েছে। খুশি হওয়ারই কথা। বিয়ের আগেই স্বামীর এমন একটু আধটু যত্ন নেওয়া শিখে রাখা ভালো।
মেহুল এগিয়ে এসে বলল,

‘নামিয়ে ফেল না, হয়ে গিয়েছে তো।’

পুতুল চায়ের পাতিলের দিকে চেয়ে বলল,

‘নামাব নামাব। অত তাড়া দিও না। আজকে ভীষণ স্পেশাল একটা চা বানাচ্ছি বুঝলে।’

পুতুলের হাবভাব দেখে কপাল কুঁচকায় মেহুল। জিজ্ঞেস করে,

‘এই, উল্টাপাল্টা আবার কিছু করবি না তো?’

‘আরে না মা, স্পেশাল মানেও বুঝো না? খুব মজা করে বানাব। যেন একবার খেলে আর খেতে ইচ্ছে না করে।’

পুতুলের শ য়তানী মাখা হাসি দেখে মেহুল ঠিক বুঝল, মেয়েটার মাথায় কিছু চলছে। যা পাজি হয়েছে না। বিয়ের পর যে সারাজ একে কী করে সামলাবে কে জানে।

‘মা, বাবা কখন আসবে বলেছে?’

‘হ্যাঁ। কল দিয়েছিলেন; বললেন রাস্তায় আছেন।’

‘আচ্ছা, তুমি তাহলে বাকি নাস্তা বানাও। আমি চা টা সারাজ ভাইকে দিয়ে আসি।’

‘কিরে, চিনি না দিয়েই নিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

‘দিয়েছি মা, তুমি খেয়াল করোনি।’

বলেই দ্রুত পায়ে রান্নাঘর ছাড়ল পুতুল। মেহুল চোখ পিটপিট করে মনে করার চেষ্টা করল, আদৌ পুতুল চায়ে চিনি দিয়েছে তো?

সারাজকে খুঁজতে খুঁজতে পুতুল গেল তার স্টাডি রুমে। এই রুমটা সারাজের জন্যই বরাদ্দ। তাই নিজের মতো রুমকে সে গুছিয়ে নিয়েছে। সে না আসলে এই রুম লক করা থাকে। কারোর প্রবেশের অনুমতি নেই, পুতুলেরও না।

দরজায় নক করল পুতুল। বলল,

‘সারাজ ভাই, আসব?’

‘আয়।’

সারাজের অনুমতি পেয়ে মৃদু ছন্দে ভেতরে প্রবেশ করল সে। গিয়ে দেখল সারাজ তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বই পড়ছে। পেছন থেকে বার কয়েকবার উঁকি ঝুঁকি মেরে অতঃপর পুতুল বলল,

‘তোমার চা।’

‘নিয়ে আয়।’

পুতুল চোখের মনি ঘুরিয়ে ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। চা টা এসেও নিতে পারছে না। যেন কোন মহারাজা। সারাজের মুখের সামনে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘নাও।’

সারাজ বই রেখে কাপটা হাতে নিল। পুতুল যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সারাজ বলে উঠল,

‘কোথায় যাচ্ছিস? আমি বলেছি চলে যেতে?’

‘থেকে যেতেও তো বলোনি।’

সারাজ ভ্রু কুঁচকাতেই পুতুল দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,

‘চা টা খেয়ে বলো না কেমন হয়েছে।’

সারাজ তারদিকে চোখ রেখেই চায়ের কাপে চুমুক দিল। সেই তরল বিদঘুটে পানীয় গলা অবধি গিয়েই আটকে গেল যেন। ফেলে দিলে ভালো হতো। এই জঘন্য জিনিস গেলা যায় না। তবে, সারাজ ফেলল না। পুতুলের মুখের দিকে চেয়ে থেকেই টুপ করে গিলে ফেলল সেটা। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মাঝে। এমন একটা কুৎসিত জিনিস গিলেও কী করে এত স্বাভাবিক সে? পুতুল ভেবে পেল না। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে গভীর মনোযোগে চেয়ে রইল সারাজের মুখের দিকে। মূলত তার মুখের অবয়ব বোঝার চেষ্টা করছে। যার মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। সারাজ খেয়াল করল পুতুলের ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে থাকাটা। তার তখন দৃষ্টি গেল পুতুলের কামড়ে ধরা অধরের দিকে। দাঁতের চাপ পড়াতে জায়গাটা কেমন লালচে হয়ে আছে যেন। ঢোক গিলল সারাজ। সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিদঘুটে স্বাদের চায়ের কাপে আবার বড়ো করে একটা চুমুক দিয়ে দিল। এক চুমুকে অনেকটা চা খেয়ে ফেলল সে। পুতুল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। লোকটা কী সাংঘাতিক! এমন একটা জিনিস তার হজম হচ্ছে কী করে?
টেবিলে চায়ের কাপটা রেখে সারাজ মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘চা টা তুই বানিয়েছিস?’

পুতুল আলগোছে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘হ্যাঁ। কেন, মজা হয়নি?’

সারাজ চোখ তুলে একবার চাইল। পরে আবার টেবিলে রাখা বইটা তুলে বলল,

‘মারাত্মক হয়েছে। এখন থেকে প্রতিদিন আসলে এইভাবেই চা বানিয়ে দিবি।’

‘কী?’

হতভম্ব পুতুল। এই জঘন্য একটা জিনিস কারোর কী করে পছন্দ হতে পারে? তার তো মাথাতেই ঢুকছে না কিছু। পুতুলকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সারাজ কপাল কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘কী হলো, বিশ্বাস হয়নি? না হলে তুই নিজেই খেয়ে দেখ না, কেমন চা বানিয়েছিস।’

সারাজের কথা মতো পুতুল চায়ের কাপটা হাতে নিল। ধীরে ধীরে ঠোঁট এগিয়ে চুমুক বসাল তাতে। জিভ তার চায়ের টেস্ট বুঝতেই মারাত্মক রকম তেতিয়ে উঠে মস্তিষ্ক সিগন্যাল পাঠাল, এটা একটা জঘন্য জিনিস। এক্ষুনি মুখ থেকে বের করে এটাকে। কিন্তু, এখন মস্তিষ্কের কথা ভুলেও শোনা যাবে না। সারাজের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। তাই উপায়ান্তর না পেয়ে গিলে ফেলল সেটা। সঙ্গে সঙ্গে যেন শরীর অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। কী খেল এটা। করলার জুসের চেয়েও খারাপ।

সারাজের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেশ। প্রশ্ন ছুড়ল,

‘কিরে, দারুন না?’

‘হ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ, দারুণ দারুণ। ভীষণ দারুণ হয়েছে। এমন চা আর কোথাও পাবে না। আমার হাতের স্পেশাল চা। দারুণ না হয়ে উপায় আছে?’

সারাজ ঠোঁটের হাসি বহাল রেখে বইয়ের দিকে চাইল। এক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে বলল,

‘তবে, আজ থেকে তোর চা বানানোর চাকরিটা কনফার্ম। ঠিক এইভাবেই প্রতিদিন চা বানাবি, মনে থাকবে তো?’

পুতুল বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে এল সেখান থেকে। এতকিছু করেও কোনো লাভ হলো না। সেই তাকে সারাজের কাছে পরাস্ত হতে হলো। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আছে তার। রান্নাঘরে ফিরে এসে বলল,

‘মা, নাস্তা লাগবে না। আমাকে খালি এক কাপ চা দাও।’

‘সারাজ তোর হাতের চা খেয়ে কী বলল?’

মায়ের প্রশ্নে বিরক্তির মাত্রা যেন আকাশ ছুঁলো। বিক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘বলেছেন, এমন চা নাকি জীবনেও খাননি। আমি যেন এরপর থেকে প্রতিদিন উনাকে এভাবে চা বানিয়ে দেই।’

মেহুল খুশি হয়ে বলল,

‘তাই নাকি, এত ভালো হয়েছে? কই, আমাদের তো কখনও এত ভালো চা বানিয়ে খাওয়াসনি; আজ তাহলে তোর বাবা আসলে আমাদেরকেও তোর স্পেশাল চা টা বানিয়ে খাওয়াস।’

পুতুল হম্বিতম্বি দেখিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,

‘পারব না আমি। নিজের চা নিজে বানাও। আমি জীবনেও আর কারোর জন্য চা বানাব না।’

বলেই চটাস চটাস পা ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। মেহুল অবাক হয়ে মনে মনে ভাবে, “মেয়েটা হঠাৎ রাগল কেন, আশ্চর্য!”

________

রাবীর অফিস থেকে ফেরার পর সারাজ তার সাথে আলোচনায় বসে। মূলত সে বাবার অফিস আর রাবীরের দেওয়া দায়িত্ব দুটোই একসাথে সামলাতে চায়। রাবীর বারণ করে। বলে, দুই নৌকায় একসাথে পা দিয়ে চলা যায় না। শেষে দুই দিকই হারাতে হবে। কিন্তু, বুঝতে চায় না সারাজ। সে তার মতো রাবীরকে বুঝিয়ে নেয়। সারাজের যথোপযুক্ত কথার বিপরীতে রাবীরের সব মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। সারাজের কষ্ট হলেও সে দুদিক সামলে নিবে।
মেহুল, রাবীর দুজনেই চিন্তায় পড়ে খুব। সবদিক বিবেচনা করে মেহুলও চাইছে না, সারাজ রাজনীতি করুক। এই নিয়ে সারাজকে বুঝিয়েও ছিল। কিন্তু, সারাজ তার কথাকে আমলে নেয়নি। আর নিবে বলেও মনে হচ্ছে না। এইদিকে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ভবিষ্যতে এই নিয়ে আরো ঝামেলা হবে। সারাজের মাথা থেকে রাজনীতির ভূতটা বের করা দরকার। নয়তো দুই পরিবারের মাঝে আবার ঝামেলা হবে, ফাটল ধরবে। এমনটা মেহুল চায় না। আপাতত সারাজের মাথা থেকে রাজনীতির ভূত সরাতে অন্যকিছুর চিন্তা মাথায় ঢুকাতে হবে। এই নিয়ে পরিকল্পনা করাও হয়ে গিয়েছে তার। এখন ঠিকঠাক অভিনয়টা করতে পারলেই হয়।

বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনা শেষে বসার ঘরে এখন পিনপতন নিরবতা। পুতুল সিঁড়িতে বসে বসে এতক্ষণ সারাজ আর রাবীরের কথা শুনছিল। সবার কথাই বেশ যুক্তিযুক্ত। এখন যে ঘটনা কোনদিকে গড়াবে কে জানে। অতশত চিন্তা তার ছোট্ট মাথা নিতে পারবে না। আপাতত তাকে নববর্ষের প্রোগ্রাম নিয়েই ভাবতে হবে। অলস ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ মায়ের কথায় পা সেখানেই আটকে যায় তার।

মেহুল সমস্ত নিরবতার মাঝে যেন বোম্ব মেরে বসল। সে বলল,

‘জানেন তো, আমি কয়দিন ধরেই না পুতুলের বিয়ের কথা ভাবছিলাম। আজ সকালেই রিতা ফোন দিয়ে বলল, সে নাকি একটা ভালোর ছেলের সন্ধান পেয়েছে। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দেখতেও নাকি রাজপুত্র। বলল, আমাদের পুতুলের সাথে নাকি বেশ মানাবে। এখন আপনি কী বলেন? কথা আগাব?’

আকস্মিক এমন ঝটকা পুতুল নিতে পারল না। ধপ করে আবার বসে পড়ল পূর্বের জায়গায়। রাবীর হকচকিয়ে উঠেছে যেন। মেহুল এখন এসবের মাঝে পুতুলের বিয়ের কথা কীভাবে উঠাল? মাথাটা কি খারাপ হয়েছে তার? অন্যদিকে সারাজ স্তব্ধ। বারবার একটা কথাই মস্তিষ্কে বাজছে, “পুতুলের বিয়ে? তার পুতুলের বিয়ে? তাও আবার অন্যকারোর সাথে?”

চলবে…

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।

পুতুলের মাথা ঘুরাচ্ছে। যেন ভনভন করে ঘুরছে চারপাশ। বুকের ভেতরেও ধপধপ করছে। হৃদপিন্ড এত কেন লাফাচ্ছে? চারপাশ এমন ঘোলাটে লাগছে কেন? সে কি চোখে ঝাপসা দেখছে? ঐ তো তার সামনে তার সারাজ ভাই, শান্ত স্বাভাবিক। তবে তার কেন এমন লাগছে? পুতুল মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট করে বলে,

‘মা, এখানে আমার বিয়ের কথা কোথ থেকে আসছে?’

মেহুল প্রসন্ন হেসে বলল,

‘ওমা, মেয়ে বড়ো হচ্ছে, এখন তো বিয়ে নিয়ে ভাবতেই হবে, তাই না?’

অসন্তোষ রাবীর। তার এসব মারাত্মক বিরক্ত লাগছে। চোখে মুখে সেই বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মেহুল কেন এসব বলছে সে বুঝতে পারছে না। তবে এইটুকু বুঝতে পারছে, নির্ঘাত এর পেছনে কোনো জটিল কারণ আছে।

রাবীর শান্ত গলায় বলল,

‘মেহুল, এখন কি পুতুলের বিয়ে নিয়ে কথা বলার সময়? আর ওর তো এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। বাচ্চা মেয়ে, আপনি হুট করে এখন কেন এসব বলছেন?’

মেহুলের ঠোঁটে হাসির রেশ। বলল,

‘আহা, এখনই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। আপনি আপাতত ছেলের ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিন। সবকিছু পছন্দ হলে তারপরই না হয় আমরা আগাব।’

না, আর সহ্য করতে পারছে না পুতুল। এবার সে জ্ঞান হারাবে। বুকে ব্যথা করছে। যেকোনো সময় অ্যাটাক ফ্যাটাকও করে ফেলতে পারে। চোখ ঘোলা হয়ে উঠে স্বচ্ছ জলের আবেশে। টুপ করে সেটা গাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ে। অথচ, তার সারাজ ভাই এখনও স্বাভাবিক। এই দৃশ্য বড্ড বেদনার। সে আর না পেরে এবার চেঁচিয়ে উঠল,

‘মা, আমি বিয়ে করব না। শুনেছ তুমি? আমি বিয়ে করব না। আজকের পর থেকে এই বাড়িতে আর কখনও আমার বিয়ে নিয়ে কোনো কথা উঠবে না। উঠবে না, মানে উঠবে না। বুঝেছ তোমরা?’

দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যায় পুতুল। আর সম্ভব না। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। শ্বাস ফেলতে পারছে না। সবথেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে, এতকিছুর পরেও তার সারাজ ভাই একটা টু শব্দও করেননি। উনার কি কষ্ট লাগছে না? একটুও বুক পুড়ছে না? তাহলে কি, পুতুলের ভাবনা সব মিথ্যে? সারাজ ভাইয়ের মনে তার প্রতি কোনো অনভূতি নেই? তাই তিনি এতটা স্বাভাবিক? পুতুলের গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। এভাবে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? সে তার সারাজ ভাইকে পাবে না? তার জীবনে অন্য কেউ চলে আসবে? না না, সে আর নিতে পারছে না। দরজা আটকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। বালিশে মুখ চেপে অঝোরে কাঁদতে আরম্ভ করে। এই দুঃখ সে সইতে পারবে না। মরে গেলেও পারবে না।

রাবীর বিরক্ত হয়ে বসার ঘর ছেড়ে উঠে গেল। বসে রইল কেবল সারাজ। তার ভাবমূর্তি এখনও আগে মতো। মনে কী চলছে বাইরে থেকে ঠাহর করা মুশকিল। মেহুল তাকিয়ে আছে। দেখছে, ভাবছে; কিন্তু সারাজের অভিব্যক্তি বোঝা মুশকিল। তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই কেন? সে কি তবে সত্যিই এখন পুতুলকে পছন্দ করে না?

প্রশ্নগুলো বড্ভ চিন্তায় ফেলে মেহুলকে। আরেকটু ঘাটাতে হবে ব্যাপারটাকে। এই ভেবে সোফায় বসল মেহুল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

‘বুঝলি তো সারাজ, কেউ আমাকে বুঝতেই চাইছে না। আমি কি আমার মেয়ের খারাপ চাই, বল? মেয়ে একটু বড়ো হলে মায়েদের যে কত চিন্তা সে কি আর মেয়েরা বোঝে? বোঝে না। এই যেমন আমার মেয়েও এখন বুঝছে না। সারাজ বাবা, ওকে তুই একবার বুঝাবি? আমরা তো আর এখনই বিয়ে দিব না; দেখে শুনে আস্তে ধীরে হবে সব। তুই একটু ওকে সবটা বুঝিয়ে বল না, বাবা। আমি নিশ্চিত, তোর কথা ও কখনোই ফেলতে পারবে না।’

সারাজ চোখ মুদে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। মাথায় প্যাচ লেগে গেছে। এতকিছু একসাথে মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। তার একটু সময় লাগবে। প্রতিটা কথা বুঝতে সময় লাগবে। এভাবে সবকিছু হতে পারে না। তাকে কিছু করতে হবে। চোখ মেলল। রিক্ত দৃষ্টি বর্তাল মেহুলের পানে। নিরেট গলার স্বর তার। তাও কষ্ট সমেত বলল,

‘এখনই ওর বিয়ে নিয়ে এত তাড়া দিচ্ছো কেন, মা? কেবল তো অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে; অন্তত অনার্সটা শেষ করতে দাও।’

মেহুল অধৈর্য গলায় বলল,

‘আহা, তুই বুঝতে পারছিস না। সবসময় কি ভালো ছেলে পাওয়া যায়? বিয়ে না হোক, অন্তত কাবিন করিয়ে তো রাখা যাবে। আমার বেলাতেও তো তাই হয়েছিল। তুই বোঝা ওকে। তুই বোঝালে ও বুঝবে।’

উঠে পড়ল সারাজ। মেহুল বুঝল না কিছু। জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে?’

‘কিছু না। বাসায় যাচ্ছি। মাথা ধরেছে আমার।’

‘ওমা, চলে যাবি? রাতে খেয়ে যা।’

‘না, ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে ঘুমাতে হবে। আসছি।’

গটগট করে বেরিয়ে যায় সারাজ। মেহুল আশ্বস্ত হয়। না, এখনও টান আছে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে হবে।

____________

‘আম্মু, আম্মু।’

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে সারাজ। চোখ মুখ ভয়ানক লাল তার। রাগে কপালের বাম দিকের শিরা ফুলে উঠেছে। মাথার ভেতরে ধপধপ করছে। ছেলের চিৎকারে রুম থেকে ছুটে আসে রিতা। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

‘কিরে, কী হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’

রাগে জ্বলে উঠল সারাজ। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘তুমি কি সবকিছু ছেড়ে এখন ঘটকালি শুরু করেছো? বাবা জানেন এসব?’

রিতা ভ্যামাচ্যাকা খায়। কী বলছে সারাজ? তিনি অবুঝ কন্ঠে বললেন,

‘কী বলছিস এসব? আমি ঘটকালি করতে যাব কেন?’

‘সেটা তো তুমিই ভালো জানো। কী দরকার ছিল, পুতুলের জন্য পাত্র দেখার? পাত্র আবার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। খুব পছন্দ হয়েছে তাই না? এখন কি বিয়ে দিয়ে দিবে? ব্যস, শেষ সবকিছু? আশ্চর্য আমি। পুতুলের বিয়ের কথা কেন উঠছে, আম্মু? ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে? হয়নি। বাচ্চা মেয়ে ও। আমার ছোট্ট পুতুল। তোমরা ওর বিয়ের কথা ভাবছ কী করে? শুনো আম্মু, পুতুলের বিয়ে হচ্ছে না। আমি না চাওয়া অবধি পুতুলের কোনো বিয়ে হবে না। আর আমার কথার হেলফেল হলে তো জানোই আমি কী করতে পারি।’

শরীর কাঁপছে সারাজের। দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল সে। এখানে থাকলে মাথা আরো গরম হবে তার। তাই নিজের রুমে গিয়েই ঘাপটি মারল।

রিতা হতবিহ্বল। ঘটনা আগা মাথা সে কিছুই জানে না। সারাজ কেন এত রাগ দেখাল? পুতুলের বিয়ের প্রসঙ্গ আসল কোথ থেকে? কী থেকে কী হয়ে গেল, মাথায় ঢুকছে না তার। ভড়কে যাওয়ার দৃষ্টিতে একবার এদিক ওদিক তাকাল সে। না, বুঝতে পারছে না কিছুই। মেহুলকে জানানো ছাড়া উপায় নেই। রুমে ফিরে এসে মেহুলকে কল করল। রিসিভ হলো সঙ্গে সঙ্গেই। রিতা আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘দোস্ত, জানিস কী হয়েছে?’

ওপাশ থেকে শান্ত গলায় মেহুল জবাব দিল,

‘জানি, তোর ছেলে পাঁচ মিনিটে ঘৃর্ণিঝড় বইয়ে দিয়েছে। সমস্যা নেই, সময় আসলে ঘূর্ণিঝড়ের তেজ আপনাতেই কমে যাবে।’

‘কীসব বলছিস? আর পুতুলের বিয়ের কথা আসছে কোথ থেকে? তাও আবার আমি নাকি ঘটকালি করছি? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না।’

‘আরে বাবা, আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করছি। ভুলে গেলি নাকি?’

‘ওহহো, না ভুলিনি তো। কিন্তু, তুই হুট করেই সব শুরু করে দিবি, বলবি না আমায়। আমি তো সারাজের প্রতিক্রিয়া দেখে বেকুবের মতো চেয়ে ছিলাম। আচ্ছা, তাহলে এই হলো কারণ?’

‘জি হ্যাঁ, ম্যাডাম। এবার অন্তত এটা ভেবে নিশ্চিন্ত যে সারাজ এখনও পুতুলকে আগের মতোই পছন্দ করে।’

‘হ্যাঁ, ও বাসায় এসে যে হম্বিতম্বি দেখিয়েছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। শোন, এবার আর দেরি করব না। সারাজ সব স্বীকার করলেই বিয়েটা দিয়ে দিব।’

‘হু, আমিও তাই ভাবছি। সারাজের মাথায় পুতুলের চিন্তা ঢুকালে রাজনীতির চিন্তা থেকে ও কিছুটা হলেও দূরে থাকতে পারবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। এবার পরবর্তিতে আমাকে আর কী করতে হবে বল।’

‘শোন, বলছি….’

_____

দুহাতে মাথা চেপে বসে আছে সারাজ। অসম্ভব মাথা যন্ত্রণা করছে। বুকেও ব্যথা করছে খুব। পুতুলের পাশে অন্য কোনো পুরুষকে সে সহ্য করতে পারবে না। তার পুতুল কেবল তার। তার নিজস্ব সম্পত্তি। এই সম্পত্তিতে সে অন্য কারোর ভাগ বরদাস্ত করবে না। কখনোই না।

রাগের চোটে বিছানার বালিশটা ছুড়ে নিচে ফেলল। তার পরিবারের মানুষ পুতুলের সাথে অন্যকারোর বিয়ের কথা ভাবছে কী করে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে সে সবাই জানিয়ে এসেছে, এই ছোট্ট পুতুল তার। আজও তার। আজীব তারই থাকবে। তাহলে, কেন উনারা তার থেকে তার পুতুলকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে? কীসের অপরাধে?

সারাজ মাথার চুল টেনে চোখ বুজে। ক্রমাগত জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। ফোনটা বেজে উঠে তখন। হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিনে পুতুলের নাম, সাথে ওয়ালপেপারে তার হাস্যজ্জ্বল এক ছবি। এই ছবি দেখেই প্রতিবার সারাজের পরাণ জুড়ায়। তবে আজ এই মুখের সেই হাসি যেন সারাজের বক্ষস্থলে গিয়ে তীরের মতো বিঁধল। রক্তক্ষরণ হলো সেই স্থান থেকে। অথচ কেউ দেখল না, কেউ না।

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল কারো কান্নাভেজা বিধ্বস্ত স্বর,

‘সারাজ ভাই, আমি বিয়ে করব না। তুমি মা’কে বোঝাও না, প্লিজ।’

সারাজ নির্লিপ্ত সুরে শুধাল,

‘কেন বিয়ে করবি না?’

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে