#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১০।
‘কী দরকার ছিল সারাজকে সভাপতি বানানোর?’
‘আপনিও এভাবে বলছেন, মেহুল?’
রাবীর বিষন্ন গলায় শুধাল। মেহুল নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘না বলে উপায় আছে? এখন এসবের জন্য তো আপনাদের সম্পর্কটা খারাপ হচ্ছে। সেটা কী ঠিক, বলুন?’
‘আহা, এত অবুঝ কেন আপনারা? সভাপতি মানে আহামরি কিছু না। আমার দলের কাজের গুরুভার নিবে সে, এইটুকুই। ওকে তো আমি আর নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেইনি। সারাজ নিজ থেকেই বলছিল, ও আমার অফিসে কাজ করতে চায়। সেইজন্যই ভাবলাম, ওর যেহেতু ইচ্ছা আছে তখন ওকে আমি আমার সাথে রাখি। অন্তত, আমার কাজের হিসাবগুলো তো রাখতে পারবে। এছাড়া আর কিছুই না। অথচ, এক সভাপতি হওয়া নিয়ে তোমাদের একেক জনের চিন্তার শেষ নেই। বুঝে না বুঝে অযথা চিন্তা করছ। তবে ভবিষ্যতে ও যদি চাই, তবে অবশ্যই নির্বাচনে দাঁড়াবে। আমি নিজে ওকে সাহায্য করব। ও বড়ো হয়েছে, ওর ও একটা স্বাধীনতা আছে। সাদ ওর উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। এটা অন্যায়।’
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পুরোনো দিনের সেই কুৎসিত দিনগুলোর কথা মনে পড়ল তার। কী ভয়ানক শত্রুতা ছিল দুই বন্ধুর মাঝে। এখনও সেসব ভাবলে ভয় হয়। তাই বর্তমানের এই ঘটনাগুলো বড্ড ভাবেচ্ছে তাকে। ছোট্ট একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে আবার নতুন করে কোনো ঝামেলা না হয়।
রাবীর মেহুলের চিন্তিত মুখের দিকে চেয়ে বলল,
‘চিন্তা করছেন কেন? কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো।’
মেহুল মলিন সুরে বলল,
‘চিন্তা কী আর এমনি এমনি হয়? সেই অতীতের কথা মনে পড়লে এখনও ভয় হয়। আমি চাই না সেই দিনগুলো আবার আসুক। তাই প্লিজ, ঝামেলা তৈরি হবে এমন কোনো কাজ করবেন না; আর না সারাজকে করতে দিবেন। সাদরাজ ভাইয়া যখন চাইছেন না, তবে থাক। আপনিও ওকে বুঝিয়ে বলুন।’
‘ও কোনো বাচ্চা নয় যে, বুঝিয়ে বললেই বুঝে যাবে। ও এখন যথেষ্ঠ ম্যাচিউর। নিজের ভালো মন্দ বোঝার মতো ক্ষমতা ওর আছে। আমি তুমি বুঝিয়ে কোনো লাভ হবে না। ওর কাছে যেটা সঠিক মনে হবে, ও সেটাই করবে।’
রাবীরের ক্ষিপ্ত সুরের বিপরীতে মেহুল আর প্রত্যুত্তর করার সাহস পেল না। তাই নিরস মুখে সেখান থেকে উঠে চলে গেল রান্নাঘরে।
_____
রুম জুড়ে পুতুলের পায়চারি চলছে। সারাজ ভাইয়ের চোখ মুখ ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছিল তখন। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন হয়তো। ইশ, সাদরাজ চাচ্চু কীভাবে কথা শুনালেন। কেউ সারাজ ভাইকে একটুও বুঝল না। সবারই তো একটা স্বপ্ন থাকে। উনার স্বপ্ন না হয় রাজনীতি করবে। তাতে খারাপ কী?
সারাজের জন্য পুতুলের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে একবার কল দিবে কিনা। সারাজ ভাইয়ের মুড এখন অফ। কল দিলে যদি উল্টো ধমক দিয়ে বসে? তাতে কী? একটা ধমকই তো দিবে। ওসব ছোট খাটো ধমক খাওয়ার অভ্যাস আছে তার।
অবাধ্য মনের প্ররোচনায় পড়ে পুতুল সত্যি সত্যিই কল দিয়ে বসল। কলটা রিসিভও হলো সঙ্গে সঙ্গে। অবাক হলো পুতুল। লোকটা কি ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিলেন নাকি?
ফোনের অপর পাশটা একদম নিরব। থেমে থেমে নিশ্বাসের শব্দই কানে ঠেকছে কেবল। পুতুলও ইতস্তত বোধ করছে। কল তো দিয়ে ফেলেছে। এবার কী বলবে? সান্তনা দিবে, নাকি আশ্বাস? পুতুল কথা পাচ্ছে না। ঠোঁট কামড়ে ভেবে চলছে কেবল। ওপাশ থেকে তখন ভারী গলার স্বর ভেসে আসে,
‘কিরে, নিশ্বাসের শব্দ শোনানোর জন্যই কল দিয়েছিস?’
নড়ে চড়ে উঠে পুতুল। উদ্বেগ নিয়ে বলে,
‘তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, সারাজ ভাই?’
‘কেন, কষ্ট হবে কেন?’
‘না, সাদরাজ চাচ্চু না তখন বকলেন তোমায়। এখন নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছো, তাই না?’
‘উঁহু। কষ্ট কেন পাব? আমি তো অন্যায় কিছু করেনি। আমি যা করেছি, আমার চোখে সেটা সঠিক। আর সেই জন্য কেউ আমাকে কিছু বললে সেটা আমার একদম গায়ে লাগবে না।’
সারাজের কন্ঠে স্পষ্ট প্রতিবাদ। যেন কথাগুলো সে পুতুলকে না সাদরাজকে বলছে। পুতুল তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। সারাজ একপল চুপ থেকে বলল,
‘রাখছি।’
‘সারাজ ভাই?’
আটকে গেল সারাজ। ফোনটা আবারও কানে লাগাল। মেয়েটা কেন যে এত আকুতিভরা কন্ঠে ডাকে, কে জানে। সে মৃদু আওয়াজে বলল,
‘হু।’
‘আর কেউ থাকুক বা না থাকুক, আমি তোমার পাশে সবসময়ই থাকব।’
পুতুলের এইটুকু এক বাক্যে সঙ্গে সঙ্গেই সারাজের মনে প্রশান্তি বয়ে গেল। নিমিষেই সব রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ মন থেকে হাওয়া হয়ে গেল যেন। মেয়েটা আসলেই ম্যাজিক জানে। নয়তো তার এইটুকু একটা কথাতেই সারাজের মন ভালো হয়ে যেত না। সারাজকে নিরব দেখে পুতুল পুনরায় বলল,
‘আমি সত্যি বলছি। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।’
সারাজ হাসে। সেই হাসি নিঃশব্দ। তারপর বলে,
‘যদি পরিস্থিতি পাশে থাকতে না দেয়?’
পুতুল শক্ত গলায় বলে,
‘দুনিয়া উল্টে গেলেও তোমার পাশ থেকে আমাকে কেউ সরাতে পারবে না।’
কী জোর এই কথার মাঝে! সারাজ অবাক হয়। মেয়েটা তার ব্যাপারে এত কঠোর? কই, আগে তো কখনও এভাবে বলেনি। সবসময় তো কেবল ঝগড়াই করে গেছে। সারাজ তখন কন্ঠ খাদে নামিয়ে ডেকে উঠে,
‘পুতুল।’
বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠল পুতুলের। এভাবে কেন ডাকছে? এই কন্ঠস্বর মোটেও স্বাভাবিক না। ভীষণ রকম অস্বাভাবিক ঠেকছে তার। পুতুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। এখন আর গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। এর মাঝেই সারাজ আবার বলে উঠে,
‘তোকে যে আমার পাশে থাকতেই হবে, পুতুল। সবসময় থাকতে হবে। আজীবন থাকতে হবে। থাকবিনা, পুতুল?’
কী তৃষ্ণার্ত এই স্বর। পুতুলের মনে ঝড় বইছে। “থাকবিনা পুতুল?” হ্যাঁ, থাকবে তো। কেন থাকবে না? আজীবন সে সারাজের পাশে থাকবে। এক চুলও নড়বে না। কখনও না।
কিন্তু এই কথাটাই সে সারাজকে বলতে পারছে না। শব্দগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করেও সেগুলো আওড়াতে পারছে না। পুতুল বিরক্ত হচ্ছে নিজের উপর। কেন পারছে না কথাগুলো বলতে? কীসের এত জড়তা তার? যেখানে সারাজ ভাই চাইছে, সেখানে সে কেন বলতে পারছে না?
পুতুলের অবস্থা ফোনের অপর পাশে থেকেও ঠিক আন্দাজ করতে পারছে সারাজ। তার ভারী নিশ্বাসের শব্দ যে কানে বারবার বারি খাচ্ছে। ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল সারাজ। মেয়েটা অল্পতেই যা অস্থির হয়ে উঠে। এই মেয়েকে বাগে পেতে তাকে বেশ বেগ পোহাতে হবে।
কলটা যে কবেই কেটে গিয়েছে সেই খেয়ালই নেই পুতুলের। সে এখনও কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। তখন হঠাৎ মনে হলো, সব কেমন যেন নিস্তব্ধ। কোনো শব্দ নেই। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে দেখল, কলটা কেটে রয়েছে। আষাঢ়ের মেঘ জমে পুতুলের চোখে মুখে। আজ যে অন্য এক সারাজকে পেয়েছিল সে। আরেকটু কথা বললে কী এমন ক্ষতি হতো? এই সারাজকে তো সচরাচর দেখে না সে। সবসময় যাকে দেখে, সে তো রাগী, গম্ভীর, রগচটা সারাজ। তবে আজকে তার সারাজ ভাই ছিল অন্যরকম। বেশ একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব ছিল তার মাঝে। তখন চট করে একটা প্রশ্ন এল পুতুলের মাথায়, “আচ্ছা, সারাজ ভাইও আবার তার প্রেমে পড়ে যাননি তো?” নিজের করা প্রশ্নে নিজেই লজ্জায় মরিয়া হয়ে উঠল যেন। সত্যিই কি এমন কিছু? এইজন্যই সারাজ ভাই তার সাথে এভাবে কথা বলছিলেন? ইশ, লজ্জায় পুতুলের গাল নাক সঙ্গে সঙ্গেই লাল হয়ে উঠে।
_____
‘আব্বু, আসব?’
বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে ছিল সাদরাজ। ছেলের গলা পেয়ে উঠে বসে। গম্ভীর স্বরে জবাবে বলে,
‘আয়।’
সারাজ রুমে প্রবেশ করে। ঠিক বাবার পাশে গিয়ে বসে। সাদরাজের চোখ মুখ থমথমে। সারাজ জোরে নিশ্বাস ফেলে। এদিক ওদিক চেয়ে কী যেন ভাবে। সাদরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে বলে,
‘কিছু বলবি?’
সারাজ বাবার চোখে চোখ রাখে। প্রশ্ন করে,
‘আমার উপর এখনও রেগে আছো?’
সাদরাজ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
‘না।’
‘বললেই হলো। আমি তো বেশ বুঝতে পারছি, তুমি যে রেগে আছো।’
‘বুঝতেই যখন পারছো, তখন জিজ্ঞেস করছো কেন?’
সারাজ উত্তর দিল না। কয়েক পল নিরব থেকে বলল,
‘আব্বু, প্লিজ মেনে নাও না। তুমি এমন করলে আমাকে কে বুঝবে, বলো? সবসময় তো আমার সব কাজে পাশে থেকেছো। তবে আজ কেন এই বিরোধিতা? আমি তোমাকে প্রমিস করে বলছি, আমি রাজনীতিকে কখনও কোনো খারাপ কাজে ব্যবহার করব না। এইটুকু ভরসাও কি তোমার ছেলের উপর নেই, আব্বু?’
সাদরাজের কপালে ভাঁজ পড়ল। তীক্ষ্ণ চোখে চাইল সে। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘আবার সেই একই কথা। এই ভূত তোমার মাথা থেকে সহজে নামবে না দেখছি। শোনো, কালই তুমি আমার অফিসে জয়েন করবে। আর তুমি যদি আমার পুরো দায়িত্ব নিয়ে আমার অফিস একা সামলাতে পারো, তবেই আমি তোমাকে রাজনীতি করার অনুমতি দিব; তার আগে না।’
খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে সারাজের চোখ মুখ। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ঠিক আছে, আব্বু। তুমি যা বলবে তাই হবে।’
সাদরাজও খুশি হয়। ভাবে, “তোমাকে আটকানোর সমস্ত কাজ আমি করে ফেলেছি, সারাজ। এখন তোমার মাথা থেকে এই রাজনীতির ভূত নামবেই। তুমি নিজেই বাধ্য হবে সেটাকে ঝেরে ফেলতে।”
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।
সামনে ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। নববর্ষের প্রোগ্রাম। সেই নিয়ে ভার্সিটিতে বেশ তোড়জোড় চলছে। এক ঝাক ছেলে মেয়ে হৈ চৈ বাঁধিয়ে ভার্সিটির প্রাঙ্গন আলপনা করতে নেমেছে। কেউ কেউ আবার কাগজ দিয়ে অনেক রকমের শিল্প কর্ম তৈরি করছে। কেউ আবার প্রোগ্রামের বিভিন্ন কার্যবলীগুলো তালিকাবদ্ধ করছে। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। পুতুল আর লীনাও ব্যস্ত। প্রোগ্রাম নিয়ে তাদের পরিকল্পনারও শেষ নেই। নতুন বছরকে নতুন ভাবে বরণ করতেই যত আয়োজন তাদের। পুতুল ঠিক করল সে প্রোগ্রামের দিন গান গাইবে। তার গানের গলা বেশ ভালো। মায়ের কাছ থেকেই গানের হাতেখড়ি তার। তারপর এক দুবার কলেজ আর ভার্সিটির প্রোগ্রামে গানও গেয়েছে।
‘তুই কিছু একটাতে নাম দে।’
‘আমি? আমি তো কিছুই পারিনা।’
মুখ কালো করে বলল লীনা। পুষ্প তার বাহুতে হালকা করে চড় মেরে বলল,
‘বলেছে তোকে। তুই অনেক ভালো আবৃত্তি করতে পারিস। আবৃত্তিতে নাম দে। দাঁড়া, আমিই গিয়ে ভাইয়াকে বলে আসি।’
পুষ্প অডিটরিয়ামের এক কোণে বসা একটা ছেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ভাইয়া, আমার বান্ধবী আবৃত্তিতে নাম দিবে। আপনি ওর নামটা একটু আবৃত্তির লিস্টে লিখে ফেলুন।’
ছেলেটির চোখে মোটা গোল চশমা। সেই চশমার কাঁচ বেধ করে সে বিরক্ত চোখে পুষ্পর দিকে চাইল। বলল,
‘আপনার বান্ধবী কি নিজে এসে বলতে পারছেন না? উনার মুখ নেই?’
পুষ্প কপাল কুঁচকায়। এত ত্যাড়া ভাবে কথা বলার কী আছে? সে তার বান্ধবীর হয়ে বলেছে তো কী হয়েছে তাতে? ছেলেটার কথা পুতুলের পছন্দ না হলেও মুখে হাসির রেখা টেনে সে বলল,
‘দাঁড়ান, ওকে ডাকছি।’
পুতুল হাত নাড়িয়ে লীনাকে ডাকে। এগিয়ে আসে লীনা। চোখে মুখে সংকোচ তার। আবৃত্তিতে নাম দিবে কি দিবে না ভাবছে। পুতুল বলে উঠে,
‘এই যে আমার বান্ধবী, লীনা। এই লীনা বল, নাম দিবি না আবৃত্তিতে?’
ছেলেটিও চাইল লীনার মুখের দিকে। লীনা এখনও ভেবে যাচ্ছে। সে যে পরিমাণ ভীতু মেয়ে, স্টেজে গিয়ে না আবার সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। ছেলেটি কপালের ভাঁজ দৃঢ় করে বলল,
‘আপনি কি কালা? কানে শুনেন না? আপনাকে কেউ কিছু বলছে তো।’
ছেলেটার কথায় ভড়কে যায় লীনা। এগুলো কি তাকে বলছে? সে কালা? চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় সে। কিছু বলার আগেই ছেলেটা আবারও একই সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘নাম কি দিবেন আপনি? আশ্চর্য, কখন থেকে এক ভাবে দাঁড়িয়েই আছেন। বলুন কিছু।’
লীনা নাক ফুলিয়ে পুতুলের দিকে চাইল। পুতুল হে হে করে হেসে বলল,
‘জি ভাইয়া, ও নাম দিবে। আপনি লিখে ফেলুন।’
ছেলেটার বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। লীনার দিকে গরম চোখে চেয়ে মনে মনে কী কী যেন বিড়বিড় করল। তারপর আবার মনযোগ দিল খাতার দিকে। ক্ষিপ্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘নাম কী?’
পুতুল বলার জন্য হা করতেই ছেলেটা হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়। বলে,
‘উনার নামটাও কি আরেকজনকে বলে দিতে হবে?’
লীনার ছেলেটার উপর মাত্রাতিরিক্ত রাগ হচ্ছে। এই ছেলের তাকে নিয়ে এত কী সমস্যা? তার ইচ্ছে, সে বলবে না। তাতে, এই ছেলের কী?
লীনা তীব্র আওয়াজে বলল,
‘লীনা। আমার নাম লীনা।’
আবারও বিরক্ত হলো ছেলেটা। মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল,
‘আগে পিছে কিছু নেই? খালি লীনা আবার কেমন নাম?’
লীনা তেতে উঠল এবার। কর্কশ সুরে বলল,
‘লীনা আহমেদ। এবার হয়েছে?’
‘জি।’
লীনা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে আবার তার ডাক পড়ে। ছেলেটা ডাকে। বলে,
‘এই যে লীনা আহমেদ, আমার কথা শেষ করতে দিন।’
লীনা দাঁত খিচে চাইল। ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আর কী বলতে চান?’
‘শুনুন, নাম দিয়ে দিয়েছেন; এখন আর চাইলেও নাম কাটা যাবে না। এর আগেও অনেকে এমন করেছে। নাম দিয়ে প্রোগ্রামের দিন উধাও। এতে আমাদের সিনিয়রদের রেপুটেশন খারাপ হয়। ডিপার্টমেন্টে কথা আমরা শুনি। তাই আগেই সাবধান করছি। নাম দেওয়ার পর কোনো অজুহাত শোনা হবে না। আর ক্লাস শেষে প্রতিদিন অডিটরিয়ামে চলে আসবেন। প্র্যাক্টিস করতে হবে, বুঝেছেন?’
লীনা এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে অতঃপর নিশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘জি, বুঝেছি। আর কিছু?’
‘না। এবার আপনি আসতে পারেন। ক্লাস শেষ করে আবার চলে আসবেন।’
লীনা জবাব না দিয়েই পা বাড়াল। বিরক্তিকর ছেলে একটা। এই ছেলের ব্যবহার বরাবরই এমন। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই দেখেছে, ছেলেটা সবার সাথেই এভাবে কথা বলে; যেন সবার উপর ভীষণ বিরক্ত সে। কাউকেই তার পছন্দ না। এই ভার্সিটি, এই দায়িত্ব, কেউ বোধ হয় জোর করে তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তাই এই অবস্থা। একেবারে রসকষহীন একটা রোবট মানুষ।
‘ঐ লোকটাকে দেখলেই আমার রাগ হয়।’
‘আমার তো খারাপ লাগে না। সব প্রোগ্রামেই নিজ দায়িত্বে সবকিছু করে। আর উনার তদারকিতেই তো প্রোগ্রামগুলো এত সুষ্ঠুভাবে হয়। নাহলে, অন্য কোনো সিনিয়রদের এসব নিয়ে এত মাথা ব্যথা আছে নাকি।’
‘কই, আমার তো তা মনে হয় না। আমার তো মনে হয়, উনি বোধ হয় এসবে বিরক্ত। তাই দেখিস না, সবার সাথে কেমন ত্যাড়া ত্যাড়া করে কথা বলে।’
‘তা অবশ্য ঠিক। তবে কিছু মানুষ জন্মগত ভাবেই একটু ত্যাড়া থাকে। লাইক, সারাজ ভাই।’
বলেই ফিক করে হেসে দিল পুতুল। তার হাসি দেখে লীনাও হেসে ফেলল।
প্রোগ্রামের প্রস্তুতি নিতে নিতে বাসায় ফিরতে ফিরতে পুতুলের বিকেল হয়ে গেল। গাড়ি এসে গেইটের সামনে থামতেই পুতুল দেখল সারাজের বাইক। খুশি হলো সে। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে পা বাড়াল।
বসার ঘরে সারাজকে একাই পেল সে। মা বাবা কোথায় কে জানে। সারাজ সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বেশ আয়েশ করে ফোন দেখছে। পুতুল যে এসেছে সেই খেয়াল নেই তার। পুতুল এই সুযোগে ধীর পায়ে আস্তে আস্তে করে সোফার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক সারাজের মাথার পেছনের দিকটায়। দৃষ্টি তার সারাজের মোবাইলের স্ক্রিনে। কী দেখছেন সারাজ ভাই? বোঝার জন্য একটু ঝুঁকে আসে। ভালো মতো তাকায় ফোনের স্ক্রিনে। কী যেন পড়ছেন তিনি। কোনো ওয়েবসাইট থেকে থেকে হয়তো কোনো আর্টিকেল পড়ছেন। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চট করে তখন সারাজ বলে উঠে,
‘দেখা শেষ?’
হকচকিয়ে উঠে পুতুল। সারাজ ভাই তাকে দেখলেন কী করে? তবে এখন এই প্রশ্ন করার সময় না। এখন পালানোর সময়। সে সিঁড়ির দিকে দ্রুত পা বাড়াতে চাইলেই সারাজ ঘুরে তার হাত টেনে ধরে। থমকে দাঁড়ায় পুতুল। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে। আস্তে আস্তে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বোকা বোকা হাসি দেয়। সারাজ কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। পুতুল তার হাতের দিকে তাকায়। সারাজ এমন শক্ত ভাবে ধরে রেখেছে, যেন ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে।
‘জিজ্ঞেস করবি না, কীভাবে বুঝলাম?’
সারাজের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পুতুলের। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকায়। মনে প্রশ্ন এল, “সত্যিই তো, কী করে বুঝলেন?” তাই ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বলল,
‘তোমার নিশ্চয়ই পেছনেও দুইটা চোখ আছে।’
পুতুলের বোকা বোকা কথায় হাসে সারাজ। এই মেয়ে আদৌ বোকা, নাকি বোকার সাজার ভান করে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারে না। সে পুতুলের হাত ছেড়ে পুনরায় সোফাতে গা এলিয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
‘চোখ বুজেও মানুষ চেনা যায় কী করে জানিস?’
পুষ্প মাথা নাড়াল। সে জানে না। সারাজ বিদ্রুপের সুরে বলল,
‘আমার সাথে ঝগড়া করা ছাড়া তো তুই আর কিছুই জানিস না। (একটু থেমে) চোখ বুজেও মানুষ চেনা যায় তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা। প্রত্যেক মানুষের শরীরে নিজস্ব একটা ঘ্রাণ আছে। এই ঘ্রাণ কোনো পারফিউমের ঘ্রাণ না। এই ঘ্রাণ একান্ত তার ব্যক্তিগত। তাই এই ঘ্রাণের তীব্রতাও ব্যক্তি বিশেষে আলাদা। সেইজন্যই চোখ বুজেও ঘ্রাণের মাধ্যমে মানুষ ধরা যায় সহজে। এই যেমন এখন তোকে ধরে ফেললাম।’
পুতুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন। তার শরীরের ঘ্রাণ থেকে সারাজ তাকে চিনেছে? ছি, তার শরীর থেকে তো এখন নির্ঘাত ঘামের গন্ধ আসছে। পুতুল জামার কলারের কাছটা একটু তুলে নাকের কাছে ধরে। না তেমন কোনো ঘ্রাণ পাচ্ছে না সে।
‘নিজের শরীরের ঘ্রাণ নিজে পাবি না, বোকা। যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর এসে এক কাপ চা বানিয়ে দিস। আমি তো তোর বাবার অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। কবে আসবেন, কে জানে?’
‘মা’কে ডাকব?’
‘না, থাক। মা ঘুমাচ্ছেন। ঘুমাতে দে। আর তুই ফ্রেশ হয়ে জলদি নিচে আয়। কোনো ফাঁকিবাজি যেন না হয়।’
পুতুল বিরক্ত গলায় বলল,
‘ঠিক আছে।’
চলবে….