শেষটা সুন্দর ২ পর্ব-০৩

0
780

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩।

মুখ গোমড়া করে বসে আছে পুতুল। সা সা বাতাসে চোখ মেলে তাকাতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলো জ্বালিয়ে মারছে তাকে। হঠাৎ ব্রেক পড়ল। আলগোছে বসে ছিল বিধেয় পুতুল হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারাজ পিঠের উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় পুতুল নাকে খুব ব্যথা পায়। পিঠ তো না যেন আস্ত এক লোহার খন্ড। পুতুল নাক ঘষতে ঘষতে বিরক্ত গলায় বলল,

‘এভাবে কেউ ব্রেক কষে? আরেকটু হলেই তো নাকটা যেত আমার।’

সারাজ ঘাড় কাত করে চেয়ে ধমক দিয়ে বলে,

‘সমস্যা কী তোর? বলেছি যে ধরে বসতে, কানে কথা যায় না? পড়ে মরার ফন্দি আঁটছিস নাকি? একদম এসবের মাঝে আমাকে জড়াবি না। আমার বাইক থেকে পড়ে মরলে তোর বাপ আমাকে ধরবে। দেখা গেল, পড়ে সত্যি সত্যিই সে তার রাজকন্যার মৃত্যুর দায়ে আমার গর্দান নিয়ে নিল। এত রিস্ক আমি নিতে পারব না। বসতে হলে সুন্দর করে ধরে বস। নয়তো নেমে যা। এমনিতেও সব কাজ ফেলে অযথা তোর পিছে সময় নষ্ট করতে এসেছি। নেহাতই বাবা বলেছিল, তাই।’

পুতুল রাগে দাঁতে দাঁত পিষে। যেন তাকে বাইকে এনে দুনিয়া উল্টে ফেলেছে। সেও কি আসত নাকি? এই লোকের সাথে কেউ ফুচকা খেতে বের হবে, জীবনেও না। আস্ত একটা জল্লাদ। ফুচকা খেতে গিয়েও শান্তি নেই। একশোবার মামাকে বলবে, মামা মরিচ কম দিবেন। মামা, হাত ধুয়েছেন? মামা, প্লেন পরিষ্কার তো? পানি কোথ থেকে নিচ্ছেন? বেশি টক দিয়েন না। তার সাথে তো চোখ রাঙানো আছেই ফ্রি। অথচ বাবা এত মানুষ রেখে এই লোকের সাথেই তাকে পাঠাল। একটু যে শান্তিতে ফুচকা খাবে, সেই উপায়ও আর রইল না।

পুতুলের নিরবতা দেখে সারাজ কপাল কুঁচকে বলল,

‘কথা কানে গিয়েছে, নাকি আবার রিপিট করতে হবে?’

পুতুল জোরে শ্বাস টানে। ইচ্ছেমত কিছু কথা শোনাতে পারলে মন শান্তি পেত তার। কিন্তু, এত সাহস তার আদৌ আছে নাকি? এখন কোনো ত্যাড়া কথা বললে, দেখা গেল তার সাথে আরো মশলাপাতি মিশিয়ে মা’র কাছে বিচার দিয়ে বসবে। আর মাও হয়েছে এক, এই ছেলের সব কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। মাঝে মাঝে তার তো মনে হয়, উনি রিতা মামনির ছেলে না, তার মায়ের’ই ছেলে।

নিজেকে শান্ত করল। এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে সারাজের আরেকটু কাছে গিয়ে বসল। হাতটা পিঠে রাখতে অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাইকে উঠলেই এমন হয়। এই যে এত কাছাকাছি, এত নিকটে দুই জন। অথচ তাতেও মনে শান্তি নেই। একটু কাছাকাছি হলেই বুকের ভেতরে কেমন কেমন যেন করে। মনে হয় ভেতরের হৃদপিন্ডটা ধরাস ধরাস করে লাফাচ্ছে। লাফাতে লাফাতে হয়তো বুক চিরে বেরিয়ে আসবে। মাঝে মাঝে তো তার ভয় হয়, তার হৃদপিন্ডের এই ভয়ানক কম্পন যদি আবার সারাজের কানে চলে যায়। এই যে এখনও তো হচ্ছে। দূরে গিয়েও শান্তি নেই, কাছে এসেও ঠিক শান্তি নেই। সবদিকেই মসিবত।

পিঠে হাতের স্পর্শ পেতেই সারাজ আবার বাইক স্টার্ট দেয়। লুকিং গ্লাসটা একটু বাঁকা করে। পুতুলের প্রতিবিম্ব সেখানে স্পষ্ট। সারাজ দৃষ্টি সেদিকেই। হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। পেছন থেকে পুতুল তার মুখ সারাজের ঘাড় পর্যন্ত এগিয়ে জোরে শ্বাস টানে। তারপর আবেশে চোখ বুজে ফেলে। তা দেখে মুচকি হাসে সারাজ। অতঃপর পুনরায় সামনের রাস্তায় মনোযোগ দেয়।

______

‘মামা, কম ঝাল দিবেন।’

ঐ আবার শুরু। পুতুল বিরক্ত চোখে সারাজের দিকে চেয়ে বলল,

‘ফুচকা ঝাল ছাড়া খেতে মজা না। খেতে হলে ঝাল দিয়েই খাব, নয়তো খাবোই না।’

‘না খেলে চল। অযথা দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।’

পুতুল ক্ষুব্ধ হলো। রাগে জ্বলে উঠল অন্তর। এই লোকটা এত অভদ্র, অসভ্য কেন? তবে সে জানে, এখন রাগকে প্রশ্রয় দিলে তার আর ফুচকা খাওয়া হবে না। তাই বোকা বোকা হাসল সে। বলল,

‘না থাক। ঝাল ছাড়াই খাব।’

পুতুলকে পরাজিত করতে পারলে সারাজের মনে রাজ্য জয়ের আনন্দ হয়। এখনও হচ্ছে। তবে তার কঠিন গাম্ভীর্যতা ভরা মুখে সেই আনন্দের রেশ পাওয়াও মুশকিল।

.

সারাজ বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন দেখছে। ফুচকার স্টলের সামনে একটা চেয়ারে পুতুল বসা। হাতে ফুচকার প্লেট। দৃষ্টি নিমজ্জিত সারাজের উপর। একটা একটা ফুচকা মুখে পুরছে আর সারাজকে এমন ভাবে দেখছে যেন, ফুচকা না আস্ত সারাজকেই গিলছে সে। কিন্তু, ঐ ভদ্র লোকের আদৌ সেই ব্যাপারে কোনো হুঁশ ব্যথা আছে নাকি? এই যে তাকে দেখে একটা ছোট্ট হৃদয়ে ঝড় উঠে, সেই ঝড়ে যে ভেতরের সব লন্ড ভন্ড হয়ে যায়; সেই খবর কি আদৌ আছে উনার? থাকলে নিশ্চয়ই পুতুলকে এত ক্ষেপাত না।

ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুতুলের দিকে চাইতেই পুতুল থতমত খায়। মারাত্মক লজ্জা পায়। এতক্ষণ যেভাবে হ্যাংলার মতো সে চেয়ে ছিল, এখন নির্ঘাত এই লোক তাকে আবার পচাঁতে আসবে। ইশ, অস্বস্তিতে গায়ে কাটা দিচ্ছে তার। তবে সারাজ তাকে কিছুই বলে না। বরং স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘খাওয়া শেষ?’

পুতুল খানিক হাসার চেষ্টা করে। বলে,

‘হ্যাঁ। তবে, আরেক প্লেট খেতে ইচ্ছে করছে।’

পুতুল জানে অপরপক্ষের উত্তর নাকচ আসবে। সবসময় যে এমনটাই হয়ে এসেছে। তবে আজ হঠাৎ, প্রকৃতি তার নিজের রূপ দেখাতে ভুলে গিয়েছে। সব কেমন উল্টো হলো। তার বজ্জাত লোকটা আজ রাজি হয়ে গেল। মামাকে বলল,

‘মামা, এখানে আরেক প্লেট দিন।’

বলেই আবার ফোন দেখায় মনোযোগ দিল সে। এমন অসম্ভব কাজ আগে হয়নি। সারাজ ভাইকে নিয়ে ফুচকা খেতে এসে জীবনেও সে এক প্লেটের বেশি দু প্লেট খেতে পারেনি। অথচ আজ? বিস্মিত হলো পুতুল। মনে মনে খুশিও হলো ভীষণ।

পরের ফুচকার প্লেটটা নিয়ে সে সারাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা ফুচকা সারাজের মুখের সামনে ধরে বলে,

‘নাও।’

সারাজ চোখ উঠিয়ে তাকায়। বলে,

‘আমি এসব খাইনা, জানিসই তো।’

‘একটা খাও। না খেলে মজা বুঝবে কী করে।’

সারাজ খেল না। বলল,

‘এসব উদ্ভট খাবারের মজা আমাকে বুঝতে হবে না। তুই’ই খা।’

পুতুলের মনক্ষুন্ন হলো। একটা খেলে এমন কী হবে? মুখ কালো করে নিজের খাবারে মন দিল আবার।

সন্ধ্যার পর এখন চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার ছেঁয়ে আছে। সে অন্ধকার চিরে ধাপিয়ে চলছে সারাজের বাইকের হেড লাইটের আলো। বাতাসের পরিমান এখন বিকেলের তুলনায় বেশি। পুতুলের চুল বরাবরের মতোই অবাধ্য। তবে পুতুলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে তো তার অস্থির মনকে সামলাতে ব্যস্ত। সারাজের কাছে আসলেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায় সে। সেই ঘ্রাণে বুকের অস্তিরতা যেন আরো বেড়ে যায়। শরীরের প্রতিটা লোমকূপে যেন কেমন শিহরণ জাগে। এখনও এমন হচ্ছে। পেছন থেকে সারাজের পিঠে কপাল ঠেকায় সে। সারাজ হালকা ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করে,

‘কিরে, শরীর খারাপ লাগছে।’

‘না। ঘুম ঘুম পাচ্ছে।’

সারাজ গতি খানিকটা স্লো করে। নরম গলায় বলে,

‘ভালোভাবে ধরে বস। ঘুমে ঢলতে ঢলতে আবার পড়ে যাস না।’

এই সুযোগ পুতুল কী করে উপেক্ষা করবে। মস্তিষ্ক বারণ করলেও, মন শুনছে না। সে কোনো কিছু না ভেবেই দু হাত দিয়ে সারাজের বুক পেট জড়িয়ে ধরল। পিঠে মাথা রাখল। ঐদিকে সারাজ, সে তো বলেও বিপদে পড়েছে। এই মেয়ে এভাবে তার সাথে লেপ্টে থাকলে সে তো আর বাইক’ই চালাতে পারবে না। পুতুলের একটা হাত তখন সারাজের বুকের ঠিক বা পাশে। হঠাৎই পুতুল আৎকে উঠে। সারাজের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘সারাজ ভাই, আপনার হৃদপিন্ড এভাবে লাফাচ্ছে কেন?’

সারাজ নিরব। মনে মনে পুতুলের উপর ভীষণ ক্ষেপল সে। যার জন্য হৃদয় ব্যথিত সে কাছাকাছি থাকলে তো হৃদপিন্ড অস্থির হবেই, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এই আহাম্মক, মূর্খ মেয়েকে কে বোঝাবে এই কথা। সারাজ দাঁত চেপে জবাবে বলল,

‘হৃদপিন্ড লাফাবে এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য তোর মতো এলিয়েনদের হৃদপিন্ড হয়তো লাফায় না। সেটা অন্য ব্যাপার। আমার মতো স্বাভাবিক মানুষদের হৃদপিন্ড এইভাবেই লাফায়।’

পুতুল এই কথার ধার ধারল না। সে আবার আগের মতো জড়িয়ে ধরল তাকে। হিসহিসিয়ে বলল,

‘এমন অস্বাভাবিক ভাবে কোনো স্বাভাবিক মানুষের হৃদপিন্ড কখন লাফায় সেটা কিন্তু আমি জানি, সারাজ ভাই। আমি আবার অতটাও মূর্খ না।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে