শূন্য অনুভূতি পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
1600

#শূন্য_অনুভূতি
#রোকসানা_ইয়াসমিন
#পার্ট:”এগারো(শেষ পর্ব)”

আজ আমাদের কোম্পানির পঁচিশ বছরের পূর্তিতে অফিসে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে।পুরো অফিস ডেকোরেট করা হয়েছে।অফিসের স্টাফরা সবাই নিজেদের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।ইতিমধ্যেই গেস্ট রাও সবাই আসতে শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু এতো সব কিছুর মাঝেও আমার চোখ শুধু একজন কেই খুঁজছে।আমি রেডী হয়ে আসার পর একবারের উনাকে দেখতে পাইনি।গেল কোথায় লোকটা।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক উনাকে খুঁজছি।এমন সময় আমার নজর গেল অফিসের অন্যপাশে।ওখানে দাঁড়িয়ে উনি গেস্ট দের সাথে কথা বলছেন।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটা যে উনি কথা তো বলছেন অন্য কারো সাথে কিন্তু দৃষ্টি আমার দিকে রয়েছে।আমার বুক টা ধক করে উঠল।কেন জানি না উনার এই চাহনি আমাকে এলোমেলো করে দেয়।আমি উনার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।তবে যাই হোক,উনাকে আজ সত্যিই অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।চোখ সরানোই দায় হয়ে পরেছে।আমি আবার আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম।
“এ কি সৃষ্টি!তুমি আজও সেই শাড়ি পরেই চলে এসেছ।”
হঠাৎ করে কথাটা কানে আসতেই আমি পেছনে ফিরে তাকালাম।মায়া দাঁড়িয়ে আছে।একটা ব্ল্যাক হাঁটু বের করা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে।আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই ও আবার বলে উঠল,
“ইউ নো না,সাহিত্য আধুনিক যুগের ছেলে।এসব শাড়ি টারি ওর মোটেও পছন্দ নয়।তোমার উচিৎ ছিল ওর বউ হিসেবে ওর মন রেখে সাজার তাই না?”
কথাটা বলেই মায়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে আমার পাশ কাটিয়ে উনার কাছে চলে গেল।আর লক্ষ্য করলাম উনিও বেশ তৃপ্তি নিয়ে ই মায়ার সাথে কথা বলছেন।উনার রাগ চরম পর্যায়ে পৌছালো।শাড়ি যদি পছন্দ ই না হয় তো সেটা আগে বললেও তো পারতো।তাহলে আর এতো কষ্ট করে উনার জন্য শাড়ি পরতে হতো না আমায়।আমি ছলছল চোখে আবার উনার দিকে তাকালাম।ছোট ছোট কাপড় পড়া মেয়েদের খুব পছন্দ উনার তাই না?তাহলে উনার বউ হয়ে আমি ই বা কী করে উনার পছন্দের বাইরে যেতে পারি।আমি আমার শাড়ি ছড়ানো আঁচল গুটিয়ে নিলাম।বিষয় টা আমার জন্য অসস্থিদায়ক হলেও উনার জন্য হয়তো স্বস্তি দায়ক।আমি ওভাবেই চিত্রার কাছে গিয়ে ওর সাথে কথা বলা শুরু করলাম।আর বারবার উনার দিকে তাকাতে লাগলাম।
উনি গেস্টদের সাথে কথার ভাঁজে আমার দিকে তাকাতেই এবার উনার চোখ মুখ পাল্টে গেল।মনে হলো খানিক টা রেগে গেছেন।ভ্রু ভাঁজ হয়ে এসেছে।আমি ওনার দিকে লক্ষ্য করতেই উনি গেস্ট দের ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।উনাকে এভাবে আসতে দেখে আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম।এখনি কিছুতেই উনার হাতে ধরা পরা চলবে না।তাই আমি চট জলদি চিত্রার কাছ থেকে সরে অন্য জায়গায় এসে দাড়ালাম।বলতে গেলে এরকম পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।এরই মাঝে হট স্টেজে কারো এনাউন্সমেন্ট শুনে থমকে গেলাম।স্টেজে তাসরিফ মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথমে ই নিজের গলা পরিষ্কার করে নিল।তার পর কিছুটা সংকোচ বোধ নিয়েই বলে উঠল,
“আব,আমি আজ আপনাদের সবার সাথে আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত শেয়ার করতে চাই।যদি….যদি স্যার আমায় অনুমতি দেন তো?”
কথাটা শেষ হতেই স্টেজ থেকে দূরে থাকা সাহিত্যের ওপর লাইটের আলো এসে পরল।উনি সময় নষ্ট করে বলে উঠলেন,
“হুম!কান্টিনিউ…..।”
কথাটা বলেই উনি আবার এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।আমি জানি উনি আমাকেই খুঁজছেন।কিন্তু আমি অন্য পাশে স্টেজের সামনে ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছি।আর এই মূহুর্তে আমি তাসরিফের কথায় বেশি মনোযোগ দিলাম।তাসরিফ পেছনের মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে উঠল,
“বুঝতে পারছি না কথাটা কী করে শুরু করবো।কারণ এতোদিন যাবৎ আমি শুধু ওর ভুল দিকটাই ওর সামনে তুলে ধরেছি যদিও ওর ওই ভুলটাই আমার জীবনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এক মূহুর্ত বলে মনে হতো।জানি না আমার এই কথাটা বলার পর ওর মুখের অবস্থা কি হবে তবে আমি জানতে চাই।”
কথাটা বলেই তাসরিফ হালকা দম নিল।এরই মাঝে আমাদের অফিসের সবাই তাকে চিয়ার আপ করতে লাগল।সবার মুখেই হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে।তাসরিফ একটু দম নিয়ে আবার বলে উঠল,
“চিত্রা…….. আই লাভ ইউ।”
কিছুক্ষণ এর জন্য সবকিছু থমকে ছিল।কিন্তু পরক্ষণেই সবার করতালিতে পুরো অফিস ভরে উঠল।কিন্তু অবাক করার কথা হচ্ছে চিত্রা কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সবাই এদিক ওদিক খোঁজার পর ও কোথাও খুঁজে পেল না।এমন সময় হঠাৎ করেই অফিসের এক কোনে লাইটের আলো জ্বলে উঠল।চিত্রা অফিসের এক কোণে হুটু মুড়ে বসে কাঁদছে।লাইটের আলো পরায় সে চোখ তুলে সবার দিকে তাকালো।চিত্রাকে এভাবে কাদতে দেখে তাসরিফ স্টেজ থেকে নেমে এসে চিত্রার থেকে কিছুটা দূরত্বে এসে দাঁড়ালো।ততক্ষণে অশ্রু জড়িত চোখে চিত্রাও উঠে দাঁড়িয়েছে।তাসরিফ প্রশ্নবোধক চোখ নিয়ে তার দিকে তাকালে চিত্রা কাদো কাঁদো হয়ে বলে উঠল,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্য কাউকে প্রপোজ করতে যাচ্ছেন।”
চিত্রার এমন কথায় হঠাৎ ই ফিক করে হেসে উঠল তাসরিফ।
_____________________________________
অফিসের পঁচিশ তম বছরের উৎযাপনে সবার সাথে কেক কাটা হলো।এই কেক কাটার ভীড়ের মাঝেই হঠাৎ করে কেউ একজন আমার কোমড় বাজে ভাবে স্পর্শ করে চলে গেল।আমি চট করে এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্দেহ জনক কাউকে না পেয়েই আমি ওখান থেকে সরে পরলাম।কেক কাটার অনুষ্ঠান শেষ হতেই সবাই কাপল ডান্সে মেতে উঠল।কিন্তু আমি খুজছি উনাকে।উনি কোথায় গেলেন।আমি প্রায় অনেক্ষন ধরে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ ই আমার চোখে গেল অফিসের এক জনশূন্য স্থানে উনি নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে কাউকে একটা মেরেই চলেছেন।এরকম একটা ঘটনা গান বাজনার কারণে কেউ টের ও পায় নি।আমি দৌড়ে তাদের কাছে গেলাম।লোকটা রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পরে আছে।
“কী করছেন কি?আপনি উনাকে এভাবে মারছেন কেন মরে যাবেন তো উনি।ছাড়ুন উনাকে।ছাড়ুন বলছি।”
আমি উনাকে আটকাতে গেলাম।কিন্তু উল্টো ফ্যাসাদে আমিই পড়ে গেলাম।উনি ওই লোক টাকে ছেড়ে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন।আমি ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে যেতেই উনি ওই লোকটার উপর থেকে উঠে এসে আমার এক হাত শক্ত করে ধরে আমায় টানতে টানতে অফিসের বাইরে নিয়ে এসে গাড়িতে এক রকম ভাবে ছুড়ে দিলেন।আমি কোনোরকম গাড়ির সিটে বসতেই উনি ড্রাইভিং সিটে বসে ফুল স্পীডে গাড়ি চালাতে লাগলেন।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে।জানি না উনার এই রাগের পরিমান কত বড় হয়ে আমার ওপর এসে পরবে।আমি মনে মনে হাজার বার আল্লাহ কে ডাকতে লাগলাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বাড়ি চলে এলাম।উনি কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে আমার দিকে এসে দরজা খুলে সোজা আমায় ঘাড়ে তুলে নিলেন।উনার এমন কাজে আমি সপ্তম আকাশে।বাড়িতে বাবা আছে আর উনি আমায় এই অবস্থায় বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন।আমি পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলাম।
“আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি।কি করছেন এসব আপনি।ছাড়ুন আমায়।বাবা ভেতরে আছে প্লিজ ছাড়ুন আমায়।”
কিন্তু আমার এতো ছোড়াছুড়ি করেও কোনো লাভ হলো না।উনি আমায় নিয়ে সোজা ঘরে চলে এলেন।ভাগ্যিস বাইরে বাবা ছিল না।আমাকে ঘরে এনেই সোজা বেডে ছুড়ে দিলেন।মূহুর্তের মধ্যেই আমার চারিদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম।নিজেকে সামলে যখন সামনে তাকালাম দেখি উনি দরজা বন্ধ করে শার্ট খুলতে খুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।আমি ভয়ে মৃত প্রায়।উনাকে আজ হিংস্র হিংস্র লাগছে আমার।আমি পিছিয়ে গেলাম।
“আআআ আপনার কী হয়েছে?আপনাকে এমন লাগছে কেন।প্লিজ এভাবে এগোবেন না আমার ভয় করছে।”
বলেই আমি কেঁদে দিলাম।কিন্তু আমার কান্না উনার ব্যবহারের কোনো পরিবর্তন ঘটলো না।উনি নিজের শার্ট খুলে ছুড়ে ফেলে বেডের ওপর এক পা রেখে এক হাতে আমার পা টেনে আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে গেলেন।আমি উঠে সরে আসতে যাবো তখনই উনি আমার শাড়ির আচল টেনে ফেলে দিলেন।এবার আমি কোনো উপায় না পেয়ে আচমকা উনাকেই নিজের আত্মরক্ষার জন্য জড়িয়ে ধরলাম।বলা হয় ভয় যেখানে ভয়ের নিষপত্তি ও সেখানেই।আমি উনাকে জড়িয়ে ধরেই আমি জোড়ে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।আমার এমন হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় উনিও কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন।তারপর ধীরে ধীরে আমার কানে নিজের মুখ নিয়ে এসে জোড়ালো কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“এ রকম স্পর্শ তোমার খুব পছন্দের তাই না।এজন্যই তো ওভাবে নিজের শরীর খোলামেলা রেখে দিয়েছিলে যাতে এরকম স্পর্শ পেতে পারো।”
ওনার কথায় আমি থ মেরে গেলাম কি বলছেন উনি।
“কিন্তু একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকানোর সাহস করলেও আমি তার চোখ উপড়ে ফেলবো।”
কথাটা বলেই উনি আমাকে বেডে ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।আমি ধীরে ধীরে উঠে বসে শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিয়ে উঠে দাড়ালাম।
“কেনো?আমাকে অন্য কেউ স্পর্শ করলে আপনার কী।আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না।বাবার পছন্দে আমায় বিয়ে করে এনেছেন আপনি এই যা।তাহলে আমায় কে স্পর্শ করল না করল তাতে …….”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই উনি আমার দিকে ফিরে আমার দুই বাহু চেপে ধরে বলে উঠলেন,
“সহ্য হয় না আমার তোমার দিকে কেউ বাজে নজরে তাকালে।ইচ্ছে করে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলি।হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তোমাকে ডেডের পছন্দে বিয়ে করে এসেছিলাম।কিন্তু এখন তুমি আমার প্রয়োজন হয়ে উঠেছ।তোমাকে আমার প্রয়োজন।আমার ভালো থাকার জন্য তোমাকে আমার প্রয়োজন।”
কথাটা বলেই উনি আমায় খুব শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
“আমি চাই না তোমার ক্ষতি হোক।আমি আমি খুব বেশি রেগে গিয়েছিলাম অফিসে তোমাকে ওভাবে দেখে।আম সরি।”
আমার এক ফোঁটা জল উনার বুকে গড়িয়ে পরল।বুকের ভেতর শীতল বাতাস বয়ে গেল।আমি পেছন থেকে উনাকে জড়িয়ে ধরে উনার খালি বুকে মাথা রেখে উনার হৃদ স্পন্দন গুনছি।আজ থেকে স্পন্দন গুলো গোনার অধিকার শুধুই আমার।বাবা ঠিকই বলেছিলেন,যখন সত্যি ই কাউকে ভালোবাসবো তখন বুঝবো উনি কেন মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে বসাননি।কারন ভালোবাসার মানুষটার জায়গায় অন্য কাউকে বসানো সুখের থেকে অনেক বেশি কষ্ট দায়ক।আমি একটু নড়তেই উনি আরো গভীরভাবে আমায় জড়িয়ে ধরলেন।উনার এমন কাজে আমি ফিক করে হেসে দিলাম।
……………..সমাপ্ত…………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে