#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৩
“ভাই যে লোকেশন বলছেন সেই লোকেশন থেকে একটু দূরে একটা মাইয়া পাইছি। পাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পইরা ছিল। এলাকার পোলা সিফাত ছিল লগে, ওয় বলতাছে মাইয়ারে ও চিনে। নাম নাকি গুটি।”
সরণ চমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ। গুটি? গুটি ছিল ওটা? সরণ তড়িঘড়ি ছেলেটাকে বলল,
“চেক হার লেগ, ইমিডিয়েটলি। পা কি ফুলে আছে?”
“ভাই, মাইয়া মানুষ। পড়নে সেলোয়ার। কোতায় দেখমু আর কেমনে দেখমু কন? আপনে আহেন, বাইকে আইলে দশ মিনিটও লাগবো না। তারপর দুই মিনিটের আাটাপত(হাঁটা পথ)। আপনে আইহা চেক দেন।”
সরণ কল কেটেই রওয়ানা হলো। দশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে পার করে বাইক রেখে দৌড়াতে লাগল উঁচু মাটির পথ বেয়ে। নদীর পাড়ে পৌঁছে এক মুহুর্ত ব্যয় করলো না। সবাইকে কিছুটা দূরে দাঁড়াতে বলে গুটির সেলোয়ার হাঁটুর কিছুটা নিচ অব্দি গুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পায়ের অবস্থা। পা ফুলে একাকার। সরণ বোধ করলো শরীরও কিছুটা ফুলে উঠেছে। কামড়ের দাগ বলছে সাপটা বিষাক্ত ছিল। রক্তপাতও হচ্ছে। সরণ তৎক্ষনাৎ কোলে তুলে হাঁটা দিল সামনে। ততক্ষণে মানিক এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির। এম্বুলেন্স তাদের সঙ্গেই ছিল। এম্বুলেন্সে করেই ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে সে। সরণ খোঁজ লাগিয়েছিল যার দ্বারা, সে জানিয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে সাপে কামড়ানোর চিকিৎসা মিলবে না। এখানে এভিএস এর ব্যাবস্থা নেই। জেলা শহরে যেতে হবে। তাই প্রায় এক ঘন্টার পথে রওয়ানা হলো সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সরণ ভীষণ চিন্তিত গুটিকে নিয়ে। কি থেকে কি হয়ে গেল। আর একটা রাত কোনমতে পার হয়ে গেলেই তো সব ঠিক হয়ে যেত। কিংবা হয়তো ঠিক হতো না, তবে এতোটা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিও নিশ্চয়ই হতো না।
“আচ্ছা, যে মেয়েটার সঙ্গে তোর ফোনে কথা হতো এটাই যে সেই মেয়ে তা তুই শিওর? গুটি তো অন্যকারও নামও হতে পারে।”
ঘোর চ্যুত হলো সরণ। চিন্তার জাল চিঁড়ে বেরোতেই জড়িয়ে গেল নতুন জালে। সত্যি তো, এই মেয়ে কি সেই মেয়েই? সেই গুটি? সেই তেজস্বিনী? মানিককে বলল,
“আই ডোন্ট নো। আমি যেই গুটিকে চিনি এই মেয়ে সেই গুটি কিনা তা চেনার উপায় নেই। খোঁজ নেওয়ারও সুযোগ নেই।”
“তাহলে এতো হাইপার হচ্ছিস কেন তুই? তাও একটা অচেনা মেয়ের জন্য। সাহায্য করবি কর, বাট এভাবে নিজের জীবন বাজি রেখে…”
“আমি জলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আততায়ীকে ধরবো বলেই। তখন ভেবেছিলাম আততায়ী আমার চেনা কেউ। কিন্তু বীরেন তালুকদারের আক্রমণকারী হিসেবে একটা নারী অবয়বকে পেয়ে বুঝে গিয়েছিলাম ভিক্টিম আসলে বীরেন তালুকদার নয়, ভিক্টিম ওই মেয়েটা। নিশ্চিত নোংরামি করতে চাচ্ছিলো, মেয়েটা দিয়েছে মেইন পয়েন্ট ফাটিয়ে। মেয়েটাকে বাহবা দেওয়া উচিত। পাড়ের লোকগুলো মেয়েটাকে পেলে ছিঁড়ে খেতো, তাই মেয়েটাকে বাঁচাতে নদীর দিকে নিয়ে এসেছি। অন্ধকারে মুখও দেখতে পাইনি তখন। আর নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করার মতো সিচুয়েশনেও ছিলাম না।”
“এখন কি করবি?”
“আগে মেয়েটার চিকিৎসা হোক। তারপর দেখা যাবে।”
“তোর বাবাকে দেখতে যাবি না?”
“বেঁচে আছে?”
মানিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আছে। তবে অবস্থা ক্রিটিকেল।”
“তোর কি মনে হয়? বাঁচবে?”
“মনে হয় না।”
“তাহলে যাবো। আগে গুটি একটু সুস্থ হোক।”
মানিক আর কথা বাড়ালো না। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে বসে রইলো চুপচাপ। সরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল গুটিকে। গোলগাল মুখজুড়ে মায়াবী প্রলেপ, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গায়ের রঙে রোদে পোড়া কালচে আভা, নাকটা সরু, ঠোঁট জোড়া পাতলা। সারামুখে একটাও তিল নেই। তিল না পেয়ে সরণ যেন খানিক হতাশ হলো। মেয়ে মানুষের মুখে আবার তিল থাকবে না কেন? এমন হয় নাকি? গালে ঠোঁটে চার পাঁচেক তিল তো থাকা চাই। যদি তার চেনা সেই গুটি হয়, তাহলে সুস্থ হলে বলবে,
“তিল ছাড়া মেয়ে মানুষ আমার পছন্দ নয়। একদম না।”
মনে মনে কথাটা বলে দ্বিগুণ অস্থির হয়ে উঠলো সরণ। পায়ের অবস্থা ভালো নয়। খুব বাজেভাবে ফুলে উঠেছে। রক্তক্ষরণও বাড়ছে। বিষ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাঁচাতে পারবে তো?
এক ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে সদরে নেওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হলো গুটির। ক্ষানিক পর জানা গেল বিষ প্রায় পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। পায়ের অবস্থাও ভালো নয়। সাপে কামড়ানোর পর ক্ষতস্থান নাড়াচাড়া করতে নেই। স্থির রাখতে হয়। নয়তো রক্ত চলাচলের মাধ্যমে দ্রুত বিষ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু গুটিকে অনবরত সাঁতার কাটতে হয়েছে পা নেড়ে। তাই দ্রুত বিষ ছড়িয়েছে, আর ফুলেছে সময়ের তুলনায় চারগুণ বেশি। অবস্থা তাই ভীষণ খারাপ।
রাতের মতো রাত বাড়তে লাগলো। গুটির অবস্থার কোন উন্নতি নেই। উল্টো অবনতি হচ্ছে। মানিক রাত একটার দিকে বাবাকে দেখতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলো সরণকে। সরণ বলল,
“আমি যে গ্রামে এসেছি তা কেউ জানে?”
“তুই যাদের জানিয়েছিস তাদের বাইরে কেউ জানে না।”
“আমাকে ঝাঁপ দিতে কেউ দেখেছে?”
“না। তুই তো অনেকটা দূর থেকে জলে নেমেছিলি।”
“তাহলে দেখতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। সো, দেখতে যাওয়া ক্যান্সেল। যদি বেঁচে থাকে, কাল ভাববো কি করা যায়।”
মানিক অবাক হলো না। স্বাভাবিকভাবেই মাথা নেড়ে সায় জানালো।
রাত পার হলো আপন গতিতে। সকাল বেলা ডাক্তারের কাছ থেকে খবর পেলো গুটি এখন বিপদমুক্ত। তবে শরীরের অবস্থা আগে থেকেই দুর্বল থাকায় তুলনামূলক বেশি নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে মানিককে কিছু ফল আর খাবার আনতে পাঠিয়ে গুটির সঙ্গে দেখা করতে গেল সরণ। কয়েকটা বেড পার করে গুটির মাথার পাশে দাঁড়াতেই চোখ খুলে তাকালো গুটি। চোখ ভর্তি জল ছিল, তাকাতেই গড়িয়ে পড়লো জলটুকু। সরণ জিজ্ঞেস করলো,
“ব্যাথা করছে বেশি? কাঁদছো… কাদছেন কেন?”
গুটি উঠে বসার চেষ্টা করলে সরণ বাঁধা দিয়ে বলল,
“পা নাড়াবেন না। রাইট নাও, ইট’স ব্যাড ফর ইউর হেলথ। আমি কি ডাক্তার ডাকবো? বেশি খারাপ লাগছে?”
“উহুম। আমি ঠিক আছি। আমি আপনার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই। সুযোগ হবে?”
“এখানে সম্ভব নয়?”
“না।”
আধঘন্টার মধ্যে ভেতরের দিকে শিফট করা হলো গুটিকে। মোটে ছয়টা বেড ভেতরেট রুমে, ছয়টাই খালি। ভেতরটা টাইলস বসানো নয় আর রঙচটা বলে বাইরেটা রোগী দিয়ে পরিপূর্ণ না হলে এখানে রোগী রাখা হয় না। লোক দিয়ে যথাযথ দায়িত্বের সাথে পরিষ্কার করিয়ে তারপর গুটিকে আনা হয়েছে।
“ফিলিং কমফোর্টেবল নাও?”
গুটি জবাব না দিয়ে দুর্বল কন্ঠে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি আমাকে বাঁচালেন কেন?”
সরণ ভ্রু কুঁচকে বলল
“বাঁচিয়ে ভুল করেছি বলছেন?”
“আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না। কিন্তু যেখানে পুরো গ্রাম আমাকে খুঁজছিল মেম্বারের আততায়ী রূপে, আপনি সেখানে আমাকে পেয়েই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন আততায়ী আমিই। তাহলে গ্রামের মানুষদের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে বাহবা না কুড়িয়ে এতো ঝুঁকি নিয়ে বাঁচালেন কেন? আমরা একে অপরকে চিনিও না। অন্ধকারে নিশ্চয়ই আমার মুখটাও দেখতে পাননি। হয়তো শুধু টের পেয়েছিলেন আততায়ী একটা মেয়ে, কোন পুরুষ নয়…”
“এতো ডিটেইলস বলতে হবে না। প্রশ্ন বুঝতে পেরেছি। জবাব দেওয়ার মতে স্পেশাল তেমন কিছু নেই। ইচ্ছে করেছে, বাঁচিয়েছি। ব্যাস।”
“কোন প্রশ্ন নেই?”
“বীরেন মেম্বারের ভবিষ্যৎ ছেঁচে অন্ধকার করা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তবে আপনাকে নিয়ে আছে।”
লজ্জা পেল গুটি। মাথা নত করে বলল,
“কি প্রশ্ন?”
“নাম কি আপনার?”
অদ্ভুত চোখে তাকালো গুটি। আশংকা করেছিল না জানি কোন গোপন প্রশ্ন করে বসবে। বিস্ময় আড়াল করে নাম বলল,
“গুটি।”
নাম শুনে আশ্বস্ত হলো সরণ। দ্বিগুণ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“শুনেছিলাম, মেম্বার নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল? জোরজবরদস্তি করছিল দু’মাস হলো?”
সরণ প্রশ্নটা করে মুখিয়ে রইলো জবাবের আশায়। গুটি মাথা নেড়ে সায় জানাতেই চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। এই গুটি তবে সেই গুটিই। কোন ভুল হয়নি তাহলে। তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এতো রাতে বিলের মধ্যে কি করছিলেন?”
গুটি ধীর গলায় বলল,
“বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলাম।”
এই পর্যায়ে মুখটা ছোট হয়ে গেল সরণের। বিস্মিত চাহনি দিয়ে আশাহত কন্ঠ বলল,
“কার সাথে? কাউকে ভালোবাসেন?”
(চলবে)