#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-২
গুটি পথ বদল করে এক ডুবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো বামদিকে এগোনোর। একবার মাথা তুলে শ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় ডুব দিতেই টের পেল কেউ টেনে ধরেছে তাকে। পিলে চমকে উঠলো গুটির। তাহলে কি সব চেষ্টা বৃথা গেল? ধরা পরে গেল সে?
গুটি অনুভব করলো তাকে টেনে ধরা মানুষটা খিঁচে ধরে উপরে টেনে তুললো তাকে। জলের উপর মাথা তুলতেই গুটি অচেনা আগন্তুককে দেখল। অন্ধকারে চেহারা স্পষ্ট না হলেও পুরুষ অবয়ব ভয়ঙ্কর রকমের ভীতি দিলো মনে। আর আগন্তুক ছেলেটি দেখল একটি নারী অবয়ব। তবে কি যেন হলো, ছেলেটি মুহুর্তের মধ্যে গুটিকে টেনে পুনরায় জলের নিচে নিয়ে গেল। বিস্ময়ে হাত-পা নেড়ে সাঁতার কাটতে ভুলে গেল গুটি। ভেবেছিল হয়তো চিৎকার করে লোক জানাবে নিজের জয় প্রকাশ করে। কিন্তু উল্টো হাত টেনে ধরে সাঁতরে যাচ্ছে সামনের দিকে। এদিকে সাঁতরালে তো কোন কুল কিনারা পাওয়া যাবে না, উল্টো কিছুদূর গেলেই নদী। লোকসমাগম বেশি না হলে আর লোকজনের হইহট্টগোল বেশি না হলে নিশ্চিত দু’জনের ধপ করে মাথা তোলার শব্দে তাদের খোঁজ পেয়ে যেত গ্রামের লোক। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে এগোনোর পর গুটি অনুভব করলো ছেলেটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতরাতে পারছে না আর। ছেলেটির আগেই তার দম খাটো হয়ে আসছে। বারবার হাত টেনে উঠতে হচ্ছে জলের উপর শ্বাস নিতে। আমাবস্যা গেল গতকাল, ঘুটঘুটে অন্ধকারে দিক চেনা মুশকিল। বেশ কিছুদূর গিয়ে সাবধানে মাথা তুলে দেখল লোকজন থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছে দু’জন। তবে ওদিকে এখন ভীড় বেড়ে গিয়েছে চার গুণ। হইহট্টগোল আর গ্রামের মানুষের ভীড়ে টইটম্বুর পুরো রাস্তা যেন ভাসমান এক নৌকা। গুটি আর বেশি দেখতে পারলো না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পা ব্যাথায় ভার হয়ে উঠছে ক্রমে। হাতে টান পড়ায় পুনরায় তলিয়ে গেল জলে। বিল যেখানে নদীর সঙ্গে মিশেছে সেখানটা পার হয়ে নদীর স্রোতে গা ভাসাতেই গুটির ভয় বেড়ে গেল। এদিকে হাত-পা ভেঙে আসছে। অবশ হয়ে আসছে শরীর। এরমধ্যেই ছেলেটি গুটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। নদীর স্রোতে আলাদা হয়ে গেলে এই অন্ধকার হাতড়ে পুনরায় এক হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই একসাথে থাকতে হলে জাপ্টে ধরেই ভাসতে হবে। গুটি জলে ডুবে অস্বস্তিতে ডোবা ভুলে যায়নি। ছেলেটির জাপ্টে ধরে থাকা তাকে আকাশ সমান অস্বস্তি আর অসহায় অনুভূতি দিচ্ছে। সাথে দিচ্ছে ভয়। এদিকে হাত-পা নেড়ে এগোনোর অক্লান্ত প্রয়াস করতে হচ্ছে না আর, তবে নদীর স্রোত অনুযায়ী নির্দিষ্ট গতিতে আর নির্দিষ্ট দিকে ভাসতে হচ্ছে এবং ভেসে থাকার চেষ্টা করতে হচ্ছে। সামনে কি হতে চলেছে জানে না গুটি, তবে ছেলেটি কে এবং তাকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই কেন বাঁচালো তা ভাবার ফুসরত যেন পেয়ে গেল শরীর অস্বাভাবিকভাবে নিভে আসার মাঝামাঝিতেও। ছেলেটি এবার প্রথম বার কথা বলল। গুটিকে বলল,
“শুধু স্রোতে ভাসলে হবে না, স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। স্রোত কম না হলেও খুব বেশিও না। আমরা চেষ্টা করলেই পাড়ে উঠতে পারবো। স্রোত ঠেলে বামদিকে যাওয়ার চেষ্টা করবো, সহযোগিতা করো আমাকে।”
গুটির কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্টে বলে উঠলো,
“আমি পা নাড়াতে পারছি না আর। আর পারছি না।”
এতোক্ষণ সাপে কাটার কথা মস্তিষ্কের বাইরে ছিল গুটির। এবার মনে পড়তেই আতঙ্কে নীল হয়ে উঠলো। ছেলেটি গুটির অস্বাভাবিকভাবে নেতিয়ে পড়া খেয়াল করে উঠতে পারলো না। সে পাড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। চেষ্টা করছে স্রোত ঠেলে সাঁতরাতে। কোনমতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে পায়ে?”
গুটি কোনমতে সাপের কথা বলতে বলতেই জ্ঞান হারালো। ভারসাম্য হারিয়ে হাত ছুটে গেল ছেলেটির থেকে। আকস্মিকতায় ছেলেটি বিস্মিত। চমকে তৎক্ষনাৎ ডুব দিলো। খুঁজতে লাগলো অচেনা নারী অবয়বকে। স্রোতে স্থির থাকা অসম্ভব। ভাসতে ভাসতেই প্রাণপণে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেল। কিন্তু এই স্রোতে একবার হাত ছাড়লে খুঁজে পাওয়া কি এতোই সহজ? রাগে দুঃখে চুল টেনে ধরে অদ্ভুত শব্দ করে রাগের বহিঃপ্রকাশ করলো সরণ। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ে উঠে গেল। পাগলের মতে এদিক সেদিক পায়চারি করতে করতে এক পর্যায়ে ডেকে উঠলো,
“শুনছেন?”
এভাবে বেশ কয়েকবার ডেকে অতঃপর হতাশ হয়ে বসে পড়লো মাটিতে। চারপাশে নজর বুলিয়ে অনেকটা দূরে একটা দোকান নজরে এলো। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সাথে ফোন বা ওয়ালেট কিচ্ছু নেই। আরও কয়েক মুহুর্ত এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে শেষমেশ হাঁটা দিল দোকানটার দিকে। এক পা দুই পা করে প্রতিটা পদক্ষেপ যেন পিছু পিছু কেউ টানতো লাগল। মেয়েটির সাথে কি হলো? আদৌ বাঁচতে পারবে? বিষধর সাপে কামড়ালে যত জলদি সম্ভব চিকিৎসা প্রয়োজন। এন্টি ভেনম নিতে হবে। বিষধর সাপে যদি নাও কামড়ায়, ভয়েও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাপে কাটা হাজারও রোগী এমনও আছে, যারা বিষহীন সাপের কামড়েও শুধুমাত্র প্যানিক আ্যটাকের কারণে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বন্ধ হয়ে মারা৷ যায়। এমনিতেই মেয়েটার পরিস্থিতি ভীষণ ভয়ানক, তারওপর সাপের কামড়। মেয়েটার সাথে তার বাবা কি করেছে তাও তো জানে না। কোন ক্ষতি করেনি তো? সরণ অপরাধবোধ আর দুশ্চিন্তায় চিৎকার করে শুন্যে পা তুলে লাথি মারলো। অনেকটা পথ আসতেই টের পেলো দোকানদার দোকান বন্ধ করছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড় লাগালো। ছুটে গিয়ে দোকানদারকে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“চাচা, মোবাইল হবে? একটা জরুরি কল করবো। জাস্ট একটা কল।”
বৃদ্ধ ছোট্ট একটা বাটন ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“টাহা নাই বাজান। তয়, কর্জ করবার পারো। বিশ টাহা ভরছিলাম, কর্জের টাহা কাইট্টা নিছে। আবার করন যাইবো।”
সরণ নিজের বন্ধু মানিককে পরপর দু’টো মিসড কল দিলো। মিসড কল দেওয়ার মতো কয়েক পয়সা ছিলো একাউন্টে। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
“কাপুর চুপুর ভিজা তোমার, কোন বিপদে পড়ছো বাজান? আমারে কইবার পারো।”
এরমধ্যেই মানিক কল ব্যাক করলে সরণ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“নো থ্যাংকস চাচা। ফোনটা দিয়েই অনেক বড় উপকার করেছেন।”
বলতে বলতেই কল রিসিভ করে অধৈর্য গলায় বলে উঠলো,
“বাইক নিয়ে এক্ষুনি বড় রাস্তায় আয়। ব্রিজের এপার আসবি। ব্রিজ পার হয়ে কিছুদূর এগোলে সিঙ্গেল একটা দোকান আছে না? সেখানে আছি আমি। জলদি আয়। আর হ্যাঁ, কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি খুঁজে পাচ্ছিস না।”
দশ মিনিটের মধ্যে মানিক চলে এলো বাইক নিয়ে। সবার আগে নিজের ফোন চেয়ে নিল সরণ। কিছু একটা ভাবল সময় নিয়ে। অতঃপর কন্টাক্ট লিস্ট ঘেঁটে কাউকে কল করলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হলে বলল,
“স্থানীয় গভার্মেন্ট হসপিটালে এন্টি ভেনম এভেইলআবল কিনা এক্ষুনি খোঁজ নিয়ে আমায় জানান। যদি এখানে এভেইলআবল না হয় তাহলে কোথায় হবে সেটাও খোঁজ নিন ইমিডিয়েটলি।”
কল কেটে আরও কয়েকজনকে কল করলো। মানিককে বলল ব্রিজের সামনে বাইক দাঁড় করাতে। একেকজনকে একেক দায়িত্ব দিয়ে অতঃপর নিজে গেল ব্রিজের নিচে। সাথে গেল মানিকও। নামতে নামতে সংক্ষেপে অচেনা মানবীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালো সরণ। নিচে নেমে দ্রুত ফ্ল্যাশ অন করে মাছের জন্য পাতা ফাঁদ বাঁশের চাইয়ের ওপাশে নেমে গেল। যদি মেয়েটা স্রোতে ভেসে চলে আসে তাহলে এখানে এসেই ঠেকবে। কপাল ভাল থাকলে এখানেই পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি পেয়েও যায়, মেয়েটা বেঁচে আছে তো?
এক বুক আশা নিয়ে সরণ নামলেও উঠে এলো হতাশা নিয়ে। পেলো না অচেনা মানবীর হদিস। মানিক ভরসা দিলো৷ সরণ উঠে এসে মাথায় হাত চেপে বসে পড়লো পাড়ে। মানিককে বলে উঠলো,
“বীরেন তালুকদার কি বেঁচে আছে?”
“এখনও বেঁচে আছে, তবে অবস্থা ক্রিটিকেল। হসপিটালাইজড করা হয়েছে, তবে বাঁচবে বলে মনে হয়না। আঘাত কিন্তু খুবই গুরুতর।”
“মেয়েটা একলা ওই লোকের এই হাল করলো কিভাবে? আমার মাথায় আসছে না। আর মেয়েটা…”
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো সরণ। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছটফট করতে করতে বাইকে উঠে বসলো। এরমধ্যেই কল এলো ফোনে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল কাঙ্ক্ষিত শব্দ।
“ভাই যে লোকেশন বলছেন সেই লোকেশন থেকে একটু দূরে একটা মাইয়া পাইছি। পাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পইরা ছিল। এলাকার পোলা সিফাত ছিল লগে, ওয় বলতাছে মাইয়ারে ও চিনে। নাম নাকি গুটি।”
সরণ চমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ। গুটি? গুটি ছিল ওটা?
(চলবে)