#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
#সূচনা_পর্ব
“একটা মানুষ কতডা নোংরা মস্তিষ্কের হইলে নিজের মাইয়ার বয়েসি কাউরে বিয়ার প্রস্তাব দেয়, তাও আবার অন্ধকারে পথ আটকাইয়া। পথ ছাড়ো মেম্বার কাকা, নইলে তোমার নামে অভিযোগ নিয়া আমি থানায় যামু। অনেক সহ্য করছি, আর না।”
“কি কইলা? অভিযোগ করবা? থানায় রোজ চা খাইতে যাই আমি। পুলিশ নিয়া আমার চলাফেরা। কিছু মালপানি দিলে পুলিশ নিজে তোমারে আমার বাড়ি তমেত দিয়া যাইবো। আমারে দেহাও পুলিশের ভয়? তাও আবার একলা এই অন্ধকারে?”
“আচ্ছা পাঠাইয়েন পুলিশ, এহন যাইতে দেন পথ ছাড়েন আমার তাড়া আছে।”
“রাইত বাজে প্রায় নয়টা, গেরামের অর্ধেক মানুষ ঘুমে বিভররর… এই সময় তোমারে যদি উঠাইয়াও নিয়া যাই, কাকপক্ষীতেও টের পাইবো না। ডাইনে বিল, বায়েও বিল, সামনে পিছে লম্বা পথ। যাবা কোথায় সুন্দরী?”
“কথাডা নিজের মাথায় খেলে না? ডাইনে বিল, বায়েও বিল। যদি আমি ধরি মেম্বার, বিয়ার সাধ সারাজীবনের জন্য ঘুচাইয়া দিমু। আমারে চিনতে এহনও বাকি আছে তোমার।”
“চিনি আবার না….আহ্হারে। বুকে লাগেরে গুটি, বুকে লাগে। এতো তেজ তর, কবে যে মুড়াইয়া খামু তরে। আর পারতাছিনা। কন্টোল অয় না আর। শেষবারের মতো জিগাই, ভালয় ভালয় গলায় মালা পড়াবি না কেরামতি দেহান লাগবো? বুঝিস গুটি, তোরে যদি সসম্মানে না পাই, অসম্মান ছাড়া কিচ্ছু চোক্ষে দেখপি না।”
“কন্ট্রোল হয়না না? জন্তু-জানোয়ার, বিশেষ কইরা রাস্তার কুত্তা আউট অফ কন্ট্রোল হইলে কেমনে কন্ট্রোল করে জানা আছে তো?”
বীরেন মেম্বার এপর্যায়ে রেগে গুটির হাত চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
“জানোয়ার না আমি? আমি কুত্তা? আয় দেহাই জানোয়ারগিরি কারে কয়। এই বিলের মধ্যে কোন হালার পুত তরে বাঁচায় আমি দেহুম। দুই মাস পা দোয়াইছি তর আর তর বাপের। আইজ দেহামু বীরেন মেম্বার কি জিনিস।”
দু’জনের মাঝে কয়েক মুহুর্ত ধস্তাধস্তি হলো। কামিসে হাতে পেঁচিয় সালোয়ারে হাত দিতেই গুটি পেছনে তাকিয়ে হটাৎ চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
“সরণদা আপনের বাপে…”
বীরেন মেম্বার ছেলের নাম শুনে হকচকিয়ে পিছু ফিরলে লাথি মারলো গুটি। অপ্রস্তুত বীরেন মুখ থুবড়ে পড়লে সেই ফাঁকে ব্যাগ হাতড়ে কিছু বের করলো গুটি। এতো রাতে একা একা বের যখন হয়েছে, খালি হাতে বেরোনোর মেয়ে তো গুটি নয়। মরিচ গোলানো জল ভর্তি কৌটা বের করে ছুঁড়ে মারলো তার চোখেমুখে। বীরেন মেম্বার দু’হাতে চোখমুখ আঁকড়ে ধরে চিৎকার শুরু করলে রাস্তার পাশ থেকে আস্ত এক ইট তুলে মারলো পুরুষাঙ্গ বরাবর। বীরেন মেম্বারের দম যেন যায় যায়। এক হাতে পুরুষাঙ্গ চেপে ধরে আরেক হাতে গুটির চুলের মুঠি চেপে ধরলে এবার গুটি বীরেন মেম্বারের হাত খামচে ধরে লাথি মারলো পুরুষাঙ্গেই। এবার আর টিকতে পারলো না বীরেন মেম্বার। দু’হাতে চেপে ধরলো দু’পায়ের মাঝখানটা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও চিৎকার যেন গলা দিয়ে তার বেরোচ্ছে না। গুটি রাগে জ্ঞানশূন্য। মাটিতে লুটানো বীরেন মেম্বারের অন্ডকোষ বরাবর অনবরত লাথি মারতে লাগল। বীরেন মেম্বারের নড়চড়ের শক্তিও লোপ পেল খুব শীগ্রই। চোখ দু’টো যেন বেরিয়ে আসবে। দম যেন ফুরিয়ে প্রায় শুন্য। রক্তে সাদা পায়জামা লাল হয়ে উঠলেও গুটির তৃষ্ণা মিটলো না। দু’টো মাস যাবত জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এই লোকটা। উঠতে বসতে নোংরা কথা শুনতে শুনতে জন্তু জানোয়ারের থেকেও নীচ মনে হয় এই লোকটাকে। বীরেন মেম্বার জ্ঞান হারিয়েছে টের পেলে উঠে দাঁড়ালো গুটি। সত্যিই জ্ঞান হারালো না প্রাণ, তা পরখ করলো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে থুতু মারলো বুকের উপর। ব্যাগ থেকে বাকি মরিচ গুলানো জল বের করে ঢেলে দিল দু’পায়ের মাঝখানে। লোকটার জ্ঞান থাকলে নিশ্চয়ই লাফিয়ে উঠতো চিৎকার করে? গুটি তখন যদি জিজ্ঞেস করতে পারতো, কেমন লাগছে মেম্বার? বুকের ভেতরটা নাজানি কত শান্তি পেত! উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপলেও দৃষ্টি দ্বিধাহীন, অটল। অনুশোচনার রেষ মাত্র নেই। মাঝারি মাটির রাস্তা, এপাশ ওপাশ দু’পাশেই থৈথৈ জল। মাঝখানে লম্বা মাটির পথখানা বড় রাস্তা থেকে গ্রামের ভেতর অব্দি চলমান। অন্তত বিশ মিনিট হাঁটলে এ রাস্তা ফুরোয়। বর্তমানে বিলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে। একপাশে নামলো চোখেমুখে জল দিয়ে পা ধুয়ে নিতে। জলদি এখান থেকে পালাতে হবে। কেউ চলে আসলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। তবে ভাবতে দেরি হলেও কেলেঙ্কারি ঘটতে দেরি হলো না, ঘটেই গেল। হটাৎ টের পেল বড় রাস্তা থেকে ভ্যান আসছে এদিকে। ভ্যানের সামনে ছোট্ট টিমটিমানো লাইট যেন চিৎকার করে বিপদের আগাম বার্তা দিচ্ছে। পিলে চমকে উঠলো গুটির। বাবার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সাথে সাথে জলে ঝাপ দিয়ে নিজেকে মিলিয়ে নিল শাপলা পাতার ভীড়ে। হাত-পা সাঁতারে সচল হলেও হৃদযন্ত্র ভয়ে অচল প্রায়। মাথা তুলে যখন দেখল, ভ্যান বেশ কিছুটা কাছে চলে এসেছে বীরেন মেম্বারের। তখন সাঁতারের গতি কমালো গুটি। এমনিতেও শেওলা-ছাতা, শাপলা আর লতাপাতা ঠেলে দ্রুত সে এগোতে পারছে না। জলের ভেতর কারও উপস্থিতি যেন বিন্দু পরিমান টের না পায় তার প্রচেষ্টায় একেক ডুবে প্রাণপন চেষ্টা করছে সর্বোচ্চ দূরে যেতে। কিন্তু এতো বড় বিল পার হয়ে ওপার তো সে একশো ডুবেও যেতে পারবে না। এভাবে সাঁতরাতে থাকলে অন্তত দেড় দুই ঘন্টা সময় লাগবে পারে পৌঁছাতে। গা ছমছমে পরিবেশ। মনে হচ্ছে জলের নিচ থেকে এক্ষুনি কেউ পা টেনে ধরবে। কোথাও কোথাও জলের উচ্চতা কম হওয়ায় সে দাঁড়াতে তো পারছে, কিন্তু যে করেই হোক বিল সাঁতরে ওপার না পৌঁছাতে পারলে ধরা সে পরবেই। এতোক্ষণে ভ্যানচালক চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আন্দাজবশত বিলের আশেপাশে টর্চ ধরে ধরে দেখছে কারও উপস্থিতি টের পাওয়া যায় কিনা। তাজা রক্ত বলে দিচ্ছে ঘটনা খুববেশি আগের নয়। ফোনে কারও সাথে কথাও বলছে। গুটি টর্চের আলো অনুসরণ করে একটু পরপর ডুব দিতে গেলে পরে গেল বিপদে। পায়ে কিছু একটা পেঁচিয়ে ধরেছে। হাত দিয়ে ছাড়াতে গিয়ে টের পেল লতার সাথে সাপও ছিল। পায়ে অনুভব হলো সাপের বিষদাঁতের অস্তিত্ব। টের পেতেই শরীর যেন অবশ হয়ে এলো গুটির। সাপটা কি বিষধর ছিল? সেকি তাহলে মরে যাবে? যেই বিল সাঁতরে বড় হলো, সেই বিলেই মিইয়ে যাবে সে? সাপের কামড়ে ভয়ের তাড়নায় অসাবধানতার বশে হুট করে মাথা তোলায় জলে শব্দ করে উঠলো। তৎক্ষনাৎ এপাশে জলের ভেতর কারও উপস্থিতি টের পেয়ে গেল ভ্যানচালক। ততক্ষণে আরও দু’টো ভ্যান প্রায় এসে পড়েছে। তৎক্ষনাৎ সে চিৎকার করে কাউকে বলে উঠলো,
“জলে কেউ আছে, তোমরা তাড়াতাড়ি আহো। আমি টর্চ দিয়া দেখতাছি তুমি হগ্গলরে নিয়া আহো এহনি। আমি গেলাম জলে।”
ফোন রেখে ভ্যানচালক জলে ঝাপ দিলো। গুটি বেপরোয়া হয়ে উঠলো ভয়ে। আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। রাস্তার ওপাশের বিলে ঝাপ দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে পারে পৌঁছে যেত। আর পারে পৌঁছাতে পারলে পালাতে বেগ পেতে হতো না। এপাশের বিল বিশাল বড়। সাঁতরে পার হওয়া বড্ড কঠিন। প্রাণপনে এগোতে লাগল গুটি। শাপলার হাতছানি আর বিভিন্ন লতার ভীড়ে ঠেলে সাঁতরাতে লাগল সামনে। পিছু ফিরে ভ্যানচালককে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে প্রায় অসার গুটি। টের পেল এরমধ্যেই আরও একজন জলে ঝাপ দিয়েছে।
এদিকে বিলে এখন একজন কিংবা দু’জন নয়, বেশ কয়েকজন নেমে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মোটরসাইকেল এসে পড়লো কয়েকটা। বিলের পাড়ে একে একে জড়ো হতে লাগলো পুরো গ্রাম। মুখে মুখে রটতে লাগল দুর্ঘটনার খবর। গুটি জলের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত একবার চোখ বুলিয়ে ঠিক করলো পারের দিকে যেতে লাগলে জলদি ধরা পরে যাবে তাই তাকে পূর্ব দিকে যেতে হবে। অন্ধকারে এতো বড় বিলের পুরোটা জুড়ে টর্চ মেরে কেউ দেখতে পারবে না। বাঁচতে হলে বিলের মধ্যেই গা ঢাকা দিতে হবে। পারে যাওয়া বিপদজনক। তবে সামনে না এগিয়ে বামদিকে মোর নেওয়াও বেশ বিপদজনকও বটে। যে কারও হাতে চলে আসতে পারে। তবুও চেষ্টা তাকে করতেই হবে। ওদিকে শেওলা-ছাতাও বেশি। গুটি পথ বদল করে এক ডুবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো বামদিকে এগোনোর। একবার মাথা তুলে শ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় ডুব দিতেই টের পেল কেউ টেনে ধরেছে তাকে। পিলে চমকে উঠলো গুটির। তাহলে কি সব চেষ্টা বৃথা গেল? ধরা পরে গেল সে?
চলবে।