#শীতল অনুভবে তুমি
#লেখনীতে মারিয়া
#পর্ব ১
” কালই আমার বিয়ে।দাওয়াত রইল।”
চমকে যায় কুহু।নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে এমন কথা শুনে যে কারোরই ধাক্কা লাগবে।সেটাই হয়েছে কুহুর ক্ষেত্রে।কুহু ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে অধরদ্বয় ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
” এ,এসব কি বলছো ইশান?ত,তোমার বিয়ে মানে?”
সামনে থাকা প্রতীয়মান ব্যক্তিটা বিরক্ত হয়ে বললো,
” হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি বলছি।তোমাকে এতদিন ধরে বলতে চাইছিলাম কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি।”
কুহু কি বলবে বুঝতে পারেনা।
” তা,তাহলে আমাকে যে আশা দিয়েছিলে?তার কি হবে?এত সহজে ভুলে গেলে ইশান?এই ছিল তোমার ভালোবাসা?”
” স্টপ ইট কুহু!আর কত পুরনো পিরিতি মার্কা কথাবার্তা বলবে?আজকাল কি কোন রিলেশন বিয়ে পর্যন্ত যায়?যায় না!আর তোমাকে এখন আর আমার ভালো লাগেনা।আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রায় ১ মাস হয়ে যাচ্ছে।কাল ফিক্সড ডেট।তোমার দাওয়াত রইল।”
” সে কি পারবে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে?” থেমে থেমে বলে কুহু।
” কিসব বলোনা তুমি?তোমার চেয়েও স্মার্ট ও।বুঝতে পেরেছো?ও তোমার মতো ক্ষ্যাত না যে খালি এইসব থ্রি-পিস পড়ে বসে থাকে।সে আল্ট্রা মর্ডান মেয়ে।তার গেট আপ একদম ইউরুপ আমেরিকানদের মতো।”
” তাহলে আমার গেটআপ নিয়েই তোমার সমস্যা তাইতো?”
” উফ!তোমার সব কিছু নিয়েই আমার সমস্যা।তোমাকে আর ভালো লাগছে না ডিড ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”
” ইয়াহ্!ঠিক আছে।তুমি যা চাও তাই হবে।শুভ কামনা রইল।আর অবশ্যই বিয়েতে যাবো মিস্টার অয়ন রশিদ ইশান।”
” থ্যাংক ইউ কুহু।”
” হুম..!ইউ আর ওয়েলকাম মিস্টার ইশান।”
বলেই চলে যেতে থাকে কুহু।বার বার গলা আটকে আসছে কিন্তু ইশানের সামনে সে সেটা বুঝতে দেবে না।তাড়াতাড়ি বাসায় এসে রুমে ঢুকেই দরজা আটকে দিল।এদিকে তার এমন আচার-আচরণ দেখে আহান রহমান আর আশা ওয়াহিদ বেশ অবাক হন।এসে দরজা ধাক্কান।কিন্তু ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
” আমি পড়ছি আম্মু।ডিস্টার্ব করো না প্লিজ।”
তারা আর কিছু বলেনা।ভাবল হয়তো পড়ার চাঁপে এমন করছে।কিন্তু তারা জানেনা তাদের মেয়ে দরজার উপারে কতটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।হ্যাঁ!ইশানের সামনে না কাঁদলেও সে অগোচরে খুব কাঁদছে।এই তার ভালোবাসা?দীর্ঘ ২ বছরের ভালোবাসা সে এভাবেই শেষ করে দিল?কি করে পারল সে?হয়তো সে তাকে কখনো ভালোবাসেই নি।শুধু সময় পাস করে গেছে।অনেক্ষণ কাঁদার পর কুহুর মন টা এবার শক্ত হলো সামান্য।সে উঠে দাঁড়াল।আঁখিদ্বয় মুছে নিল।তারপর মনে মনে বলল,কুহু এত দুর্বল নয়।আর এত সস্থাও নই যে তার মতো দু পয়সার মিথ্যে ভালোবাসার জন্য কাঁদবো তার কাছে হাত পাতবো।আমি আহান আর আশার মেয়ে।আমি কুহু!আমি কেন কাঁদবো?আমিও তাকে দেখিয়ে দেব যে আমি তাকে ছাড়া খুব ভালো আছি।
নীলাদ্রি রহমান কুহু।আহান রহমান আর আশা ওয়াহিদের প্রথম সন্তান।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।আহান রহমান একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।কুহুরা যৌথ পরিবার।আহান রহমানরা তিন ভাই।আহান রহমান মেঝ ভাই।বড় ভাই আতাউর রহমান আর তার স্ত্রী হুরাদ্রি জাবিন।এবং ছোট ভাই জাওয়াত রহমান এবং তার স্ত্রী রোদেলা আহমেদ।এবং কুহুর দাদী আয়েশা আফরিন।এক সাথেই থাকে।
____________
কুহু গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নেয়।তাকে শক্ত হতে হবে এবং ইশানকে দেখিয়ে দিতে হবে।তারপর পড়তে বসে।হঠাৎ দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় প্রবল বেগে।কুহু বিরক্ত হয়,
” কে?”
ওপাশ থেকে দলবদ্ধ চিৎকার ভেসে আসে,
” দরজা খুলো!”
কুহু বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।গিয়ে দরজা খুলে দেয়।সাথে সাথেই হুরহুর করে ঢুকে পড়ে তিনজন।শুভ,তাসনি আর নিরব।
” কি হয়েছে আপু?এভাবে দরজা আটকে বসে আছো কেন?” নিরব প্রশ্ন করে।
” কিছু না রে।” কুহু বলল।
” নাহ্!কিছুতো হয়েছে।নাহলে এমন কেন চেহারা?” তাসনি বলল।
” আপুনি বলো না।তুমি না বললে আম্মুকে দিয়ে বের করাবো।” শুভ বলল।
” ওরে বাবারে এত সব একসাথে কোনটার উত্তর দেব?”
তাসনি অতশি রহমান।ক্লাস এইটে পড়ে।
শুভ শিহাব রহমান।ক্লাস ফোর এর ছাত্র
আর নিরব হাসনাত রহমান।ক্লাস সেভেনের ছাত্র।
তাসনি আর নিরব জাওয়াত রহমানের সন্তান।আর শুভ কুহুর আপন ছোট ভাই।
তাসনি আবার প্রশ্ন করল,
” আপু কি হয়েছে বলো?ইশান ভাইয়া কিছু বলেছে নাকি?”
কুহুর বাবা মা এসব বিষয়ে না জানলেও তার ভাই বোনেরা জানে।তাদের সাথে সবই শেয়ার করে সে।
তাসনির কথা শুনে ঢুকরে কেঁদে উঠে কুহু।তার শক্তপোক্ত করা মনটা আবারো নরম হয়ে যাচ্ছে।বাকিরা অবাক হয়।তাসনি বুঝতে পারে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।তারপর কুহুর মনে পড়ে যায় তার নিজের প্রতি কথা প্রতিজ্ঞার কথা।সাথে সাথে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয় সে।
” স,সে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।”
” মানে?” তিনজন এক প্রকার চিল্লিয়ে উঠে।
” হ্যাঁ রে!তার নাকি কাল বিয়ে।আমাকে দাওয়াতও দিয়েছে।”
” এখন কি করবে?” তাসনি প্রশ্ন করে।
” যাব আমি তার বিয়েতে।”
” এসব কি বলছো?তুমি তাকে না আটকিয়ে তার বিয়েতে যাবে?” নিরব বলল।
” কেন আটকাবো বেহায়ার মতো?আমি এত সস্থা নাকি যে তার দু পয়সার ভালোবাসার জন্য তার পায়ে পড়ব?হ্যাঁ যাব আমি তার বিয়েতে।আর তাকে দেখিয়ে দেব যে তাকে ছাড়া আমি ভালো আছি।”
” হ্যাঁ!তোমার এটাই করা উচিত।আমি তোমাকে এটাই বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু তুমি আগেই নিয়ে নিয়েছো।” তাসনি বলল।
” হুম..!”
” সবাই খেতে আয়!”
দূর থেকে অস্পষ্ট স্বরে ভেসে এল আতাউর রহমানের স্ত্রী হুরাদ্রি জাবিনের বলা বাক্যটি।তারা এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে ৪ জন ডাইনিং রুমে উপস্থিত হয়।আশা ওয়াহিদ,রোদেলা আহমেদ আর হুরাদ্রি জাবিন খাবার সাজাচ্ছেন টেবিলে।আর আতাউর রহমান সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন।এই ঘরে সব নিয়ম অনুযায়ী চলে।হুরাদ্রি রহমানকে তারা খুব সম্মান করে।শুধু তাকেই না এই বাড়ির সকল বড় সদস্যদের তারা মান্য করে।আর বেশ ভয়ও পায়।
কুহু যতসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখছে।হুরাদ্রি জাবিনের বিষয়টা চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি।তিনি বললেন,
” কি ব্যাপার কুহু?চেহারা এমন লাগছে কেন?”
” ও কিছু না বড় আম্মু।এমনি কাল রাতে ঘুম হয়নি তো তাই।”
” কিন্তু বিকালে যখন দেখলাম তখন তো ঠিকই ছিলি।”
” আব….আ…”
কিছু বলার আগেই তাসনি বলে উঠে,
” চোখে পানি দিয়েছিলো।”
কুহু তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।হুরাদ্রি জাবিনও ভ্রু কুঁচকে তাসনিকে প্রশ্ন করেন,
” চোখে পানি কেন দিতে যাবে?”
তাসনি আবার বলে,
” ও আসলে..আমরা ভিডিওস বানাচ্ছিলাম।তাই চোখে পানি আনার জন্য দিয়েছে।আর বার বার পানি দেওয়াতে এমন লাল হয়ে আছে।”
হুরাদ্রি জাবিন কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
” তুই কি এখনো ছোট নাকি পোলাপানদের সাথে এসব ভিডিও বানাবি?”
তাসনি আবার বলে উঠল,
” আরে না!আমরা জোর করে আপুর সাথে খেলেছি।”
” ওহ্ আচ্ছা।তোদের মেঝ চাচা আর ছোট চাচাকে ডেকে নিয়ে আয়।আর রুবিনাকেও ডাক গিয়ে।”
” আচ্ছা বড় আম্মু।”
তাসনি আর কুহু গেল আহান রহমান আর জাওয়াত রহমান কে ডাকতে।তাদের ডেকে গেল রুবিনার রুমে।গেমসে মত্ত সে।রুবিনা আহিয়া রহমান।আতাউর রহমানের মেয়ে।তাসনি গিয়ে তার কানের কাছে জোরে চিল্লিয়ে বলে,
” রুবি আপু..!!!”
লাফিয়ে উঠে রুবিনা।তারপর স্বাভাবিক হয়ে তাকে ধমক দিয়ে বলে,
” বজ্জাত!কি সমস্যা তোর?এভাবে চিল্লালে তো যে কেউ হার্ট অ্যাটাক করবে।”
” যাক গে তুমি তো করোনি।”
” চুপ শয়তান।”
” আচ্ছা আচ্ছা খেতে ডাকছে।”
” আচ্ছা আসছি যা।আরে কুহু!তুই চলে এসেছিস?কবে আসলি?”
” অনেক আগেই আসলাম।”
” কিন্তু তুই না বলেছিলি আজ রাতের আগে ফিরবি।তাহলে?”
” যে কারণে গিয়েছিল তার উল্টোটা হলো জানো?” তাসনি বলল।
” কি হয়েছে?” রুবিনা প্রশ্ন করে।
” ব্রেক-আপ হয়ে গেছে ওদের।ওই ইশানের বিয়ে নাকি কালকে।দাওয়াতও করেছে।” তাসনি বলল।
” কিহ্!আমি বলেছিলাম তোকে।ওই ইশানের মধ্যে প্রবলেম আছে।তুই শুনিস নি।”
” যাক বাদ দাও এসব।এসব মনে করে আর ডিপ্রেশনে পড়তে চাইনা।” কুহু বলল।
” তোহ্!বিয়েতে যাচ্ছিস?”
কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” হুম..!”
” কেন?”
” দাওয়াত যেহেতু দিয়েছে যেতে তো হবেই।তাকেও আমি দেখিয়ে দেব আমি তাকে ছাড়া খুব ভালো আছি।”
” হুম..!রাইট ডিসিশন।”
আবারো অস্পষ্ট স্বরে ভেসে এল হুরাদ্রি জাবিনের গলা,
” তোরা কোথায় গেলি?”
তারা দ্রুত সব ফেলে দৌড় লাগাল।
_____________
সন্ধ্যা ৭ টা।কুহু রেডি হচ্ছিল।তখন তাসনি প্রবেশ করে।কুহু জামা চুজ করতে পারছিল না।তাসনিকে দেখে কুহু বলে,
” ভালো হলো এসেছিস।এই দেখতো কোনটা পড়বো!”
তাসনি একটা কালো গাউন বেছে দিল।
” এটাতে তোমাকে একদম হান্ডু আই মিন হান্ডি লাগবে।হিহি!”
কুহু ভ্রু কুঁচকে বলে,
” হান্ডু হান্ডি এসব কি আবার?”
” আরে জানো না?হ্যান্ডসামকে হান্ডু বলে আরকি।তুমি তো মেয়ে।তাই হান্ডি বললাম।”
” বাপরে!তোকে আসলেই বুঝতে পারিনা।”
তারপর কুহু চেঞ্জ করতে গেল।চেঞ্জ করে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল।তারপর চুল আচড়াতে লাগল।পেছন থেকে তাসনি বলল,
” আপু শুনোনা!”
” হুম বল।”
” আমিও যাবো তোমার সাথে।আমায় নিয়ে চলো প্লিজ।”
কুহু তাসনির দিকে ঘুরে বলে,
” তুই যাবি?তুই ওখানে গিয়ে কি করবি?”
” একটু দেখবো ওই ইশান আর ওর বউকে।আর তোমাকে দেখে ওর রিয়েকশন কেমন তা দেখবো।আর তুমি কিভাবে ওকে দেখাবে যে তুমি ঠিক আছো সেটা দেখবো।প্লিজ প্লিজ আপু!”
কুহু কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।তাকে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না।কথা বলার মতো একটা মানুষ পাবে।
” ঠিক আছে যা।ছোট আম্মুর থেকে পারমিশন নিয়ে আয়।”
” ইয়েস!আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।”
খুশিতে গদগদ হয়ে তাসনি বেরিয়ে গেল।কুহু হেসে তার কাজে মন দিল।
” তুই নাকি কোথাও যাচ্ছিস কুহু?” রোদেলা আহমেদ জিজ্ঞেস করে কুহুকে।
কুহু তার দিকে না তাকিয়েই হালকা হেসে বলে,
” হ্যাঁ চাচী।একটা ফ্রেন্ডের বিয়েতে যাচ্ছি।তাসনিকেও সাথে দাও না।”
” আচ্ছা!সাবধানে রাখবি আর বেশি রাত করবিনা।৯ টার আগেই চলে আসবি।”
” ওকে মাই সুইট চাচী।যাও তুমি এবার।তাসনিকে পাঠিয়ে দাও।”
একটু পরেই তাসনি চলে এলো।তারপর দুজন সবার থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
চলবে,,,,