#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:১৩
সকাল থেকেই রাত বেশ নানাভাবে চেষ্টা করছে শ্বাশুড়ির মুখ থেকে কথা বের করবার। কিন্তু চৈতী বেগম চুপ করেই আছেন। উনি আজ মুখ খুলবেননা বলেই ঠিক করেছেন। রাত টেবিলে থাকা নাস্তা নিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই মিতালি আবার বলতে লাগলো,
-“রাত? সায়ানকে একটু দিয়ে যেয়ো তো।ছেলেটাকে সকাল থেকে দেখিনা।”
রাত কিছু বললো না। কারণ শিশিরের মত সেও এইসব চরিত্রহীনদের সাথে কথা বলতে চায় না। সে রুমে এসে দেখতে পেলো শিশির বেশ ভালো করেই হাঁটছে। রাত তা দেখে খাবারের ট্রে টা রেখে বললো,
-” বাহ!পা তো ঠিক হয়ে গেছে। ”
-“হ্যা।”(হেসে)
-“তাহলে কালকে ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন?”
-“দেখি। টাইম হলে।”
রাত খাবারের ট্রে টা নিতে নিতে বললো,
-“এবার চলুন নাস্তা করবেন।”
শিশির সায়ানকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
-“সায়ানের আড়াই মাস চলে।”
-“হুহ।”
-“ও দেখতে একদম আমার মত।”
-“উহু।আমার মত।”
শিশির চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো। রাত মুখ টিপে হেসে বললো,
-“আপনি কি খাবেন না? ”
-“না করলাম কখন!তুমিই তো খাইয়ে দিচ্ছো না।”
-“আপনি এখন পুরোপুরি সুস্থ। সো নিজেরটা নিজে খান।”
-“একদম না। আমি এখনো অসুস্থ। ”
-“খান তো৷ দুনিয়ার কাজ পড়ে আছে।”
-“তুমি খাইয়ে দিবে না?”
রাত মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। শিশির রাতের গাল টেনে দিলো। সায়ান কেঁদে উঠায় রাত সায়ানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।শিশির হেসে খেতে বসবে এমন সময় মনে পড়লো রাতও তো খায়নি। তাই সে নিজের মত করে রাতের মুখে রুটির টুকরো ধরতেই রাত অবাক হয়ে তাকায়। শিশির মুচকি হেসে বললো,
-“খাও?”
রাত খাবারটা মুখে নিয়ে বললো,
-“থ্যাংক ইউ। ”
-“কেন?”
-“এইযে কষ্ট করে খাইয়ে দিচ্ছেন।”
-“কষ্টের কি হলো! তারচেয়ে তুমি যে এই এক দুই মাসে আমাকে এত সেবা করলে সেটা আরো বেশি কষ্টের।”
-“আমার তো কষ্ট হয়নি। তখন আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিলো আপনার সুস্থ হওয়া।”
-“হুম জানি।”
শিশির রাতকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর রাতও খেয়ে নিচ্ছে। অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে রাতের!শিশির তাকে খাইয়ে দিচ্ছে!এই প্রথম বার।রাত শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“এবার আপনি খেয়ে নিন।”
-“হুম আগে তুমি।”
রাত কিছু বলতে যাবে তার আগে আবারো মিতালি হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো। শিশির এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
-“না বলে আসাটা যে কেমন নিয়ম সেটা আমি বুঝতেই পারি না।”
মিতালি রাতকে এভাবে খাওয়াতে দেখে রেগে গেল। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো,
-“আসলে আমি সায়ানকে দিয়ে যেতে বলেছিলাম।”
শিশির উঠে দাঁড়ালো। মিতালির দিকে এগোতে লাগলো। মিতালি পেছাচ্ছে।আর জোরপূর্বক হেসে বলছে,
-“কি করছো!”
শিশির মিতালিকে দরজার বাহিরে অবধি নিয়ে গিয়ে বললো,
-“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন,আমার বউ তোমার কাজের মহিলা না যে সে নিজের বাচ্চাকে তোমার কাছে গিয়ে দিয়ে আসবে।খেলতে ইচ্ছে করলে নক করে এসে ওর পারমিশন সহিত সায়ানকে কিছুক্ষণের জন্যে নিতে পারবে। নয়ত আমার রুমের কাছেও আসবা না।”
বলেই শিশির দরজাটা লাগিয়ে দিলো।মিতালি সেখানে দাঁড়িয়েই কটমট করতে করতে বললো,
-“দেখাচ্ছি মজা।”
বলেই সে চৈতী বেগমের কাছে গিয়ে রেগে বলতে লাগলো,
-“আপনি কি সায়ানকে এনে দিবেন নাকি আমি সব ফাঁস করে দিবো?”
-“দেখো মিতালি!এবার বেশি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর সায়ানকে লাগে তোমার? শিশির কিন্তু চাইলে তোমাকে পুলিশে দিতে পারে।”
-“আমিও ওটা ভাইরাল করে দিবো।”
চৈতী বেগম রেগে তাকিয়ে রইলেন। মিতালি এবার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“যাবেন নাকি আমি ভাইরাল করবো।”
চৈতী বেগম কোনোমতে কান্না আঁটকে রাতের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। রুমে গিয়ে দেখতে পেলেন শিশির বের হচ্ছে আর রাতকে বলছে,
-“সায়ানকে দেখে রেখো। আজ তোমার কলেজ যেতে হবে না। আর এসে আমরা দুজন মিলে হাসিব স্যারের এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠানে যাব।”
রাত সায় জানালো। তারপর শিশিরের পিছন পিছন দরজার কাছে যেতেই চৈতী বেগমকে দেখতে পেলো।চৈতী বেগমকে দেখে শিশিরই সবার প্রথম প্রশ্নটা করলো,
-“মা তুমি এখানে!কিছু বলবে?”
চৈতী বেগম কিভাবে বলবেন বুঝতে পারছেন না। তবুও নিজেকে সামলে বলে উঠলেন,
-“মিতালি সায়ানকে চাচ্ছে। দিলে না কেন রাত!”
রাত কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-“আন্টি,সায়ানকে এভাবে ঘন ঘন ওনার কাছে দেয়াটা..”
-“খেয়ে ফেলবে না। তাছাড়া সায়ানের মা মিতালি।”
বলেই চৈতী বেগম সায়ানকে নিয়ে চলে গেলেন। রাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখজোড়া ছলছল করছে।চোখ থেকে পানি পড়ার আগেই শিশির সেটা হাতে নিয়ে বললো,
-“এগুলো মায়ের মুখের কথা হতেই পারে না রাত। মা তোমায় এনেছে আমার বউ করে। মা তোমাকে এসব বলতেই পারে না।”
-“জানি।কিন্তু কষ্ট হচ্ছে।”(নাক টেনে)
-“আমাদের মায়ের সাথে কথা বলতে হবে।”
-“হুম।”
-“এভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারব?”(অসহায় গলায়)
রাত নিজেকে সামলে নিলো।কারণ শিশিরকে যাওয়ার আগে টেনশনে ফেলে দেয়াটা উচিত হবে না।তাই রাত কোনোমতে হেসে বললো,
-“আপনি নিশ্চিন্তে যান। বাসায় এসে দেখবেন মিতালি নেই।”
শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“এমনটা হলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হত না রাত।”
-“হবে হবে।”
শিশির রাতের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিদায় নিলো।রাত কোমড় বেঁধে নেমে পড়লো মিতালিকে বের করার কাজে।
((অনেকে না বুঝেই মন্তব্য করছে। আমি বলছি,এখানে মিতালিকে রাখার জন্যে রাত-শিশির রাজি না।চৈতী বেগম কসম দেয়ায় শিশির স্টেপ নিতে পারছে না।কিন্তু তারা ঠিকই মিতালির থেকে দূরে।আর মিতালি শিশিরের ফ্ল্যাটে না বরং চৈতী বেগমের ফ্ল্যাটে থাকে।তাই এটা নিয়ে অযথা ঝামেলার তো দরকার নেই যে ডিভোর্সের পরেও শিশিরের বাসায় থাকে আর এটা হিন্দি সিরিয়াল।মিতালি চৈতী বেগমকে কিছু করেছে যার জন্য উনি বাধ্য হয়ে মিতালিকে থাকতে দিচ্ছেন।মিতালি চৈতী বেগমের ফ্ল্যাটে থাকে শিশিরের না।শিশির রাতকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে।মিতালি একটা ঝামেলার চক্করে এখানে এসেছে ক্ষতি করতে।তারও কারণ রয়েছে যা পরে জানবেন। তবুও এত কথা কেন যে হচ্ছে!)
সর্বপ্রথম সে চৈতী বেগমের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখতে পেল মিতালি সায়ানকে নিয়ে সোফায় বসে আছে। পাশেই নুশান লেপটপ নিয়ে বসে। চৈতী বেগমকে দেখতে না পেয়ে রাত মিতালিকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“আন্টি কই?”
মিতালি একটা ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“কোন আন্টি?”
-“আমার শ্বাশুড়ি মা।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
-“ওহ!উনি তো রুমে।”
রাত একনজর সায়ানকে দেখলো।মিতালি তা দেখতে পেরে সায়ানকে লুকিয়ে নিলো।রাত রাগ কন্ট্রোল করে চৈতী বেগমের রুমের দিকে পা বাড়ায়।রাত চৈতী বেগমের রুমে গিয়ে ওনাকে ডাকতে শুরু করে। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে বারান্দার দিকে চলো যায়।গিয়ে দেখতে পায় চৈতী বেগম বেশ অন্যমনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাত ওনার কাঁধে হাত রেখে বলতে লাগে,
-“আন্টি?”
চৈতী বেগমের ধ্যান ভাঙে।রাতের উপস্থিতি টের পেয়ে চটজলদি নিজের চোখে থাকা পানিটুকু মুছে বলতে শুরু করে,
-“হ্যা বলো।”
-“তোমার সাথে আমার দরকারি কিছু কথা রয়েছে।”
চৈতী বেগম পিছনে ঘুরে বলে উঠেন,
-“তখন সায়ানকে তোর থেকে নিয়ে এলাম!আমি অনেক অনেক দুঃখিত রাত। আমার সাথে রাগ করিস না।”
-“না রাগ করিনি। আর তুমি যা যা বলেছো সেগুলো তোমার মনের কথা না। এটাও জানি আমি।”(মুচকি হেসে)
-“রাত আমি বাধ্য হচ্ছি এসব করতে। নয়ত মিতালিকে আমি সবার থেকে বেশি ঘৃণা করি।”
-” আন্টি?”
-“হুম।”
-“আমার সাথে কি সবটা শেয়ার করা যায় না? তোমার ছেলের সাথে নাহয় তুমি সবটা শেয়ার করতে পারবে না।কিন্তু আমার সাথে তো করায় যায়। তাই না আন্টি?”
-“না রাত। এটা কিভাবে বলি।লজ্জার কথা।”
বলেই চৈতী বেগম ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। রাতও এগিয়ে গেলো।রাত আজ সবটা জেনেই ছাড়বে। তাই ও চৈতী বেগমের পাশে বসে বলতে লাগে,
-“আন্টি আমি সবটা ঠিক করে দিবো।পাক্কা!তুমি শুধু বলো যে মিতালি তোমাকে কি নিয়ে ব্লেকমেইল করেছে। এই মেয়েটা যতক্ষন আছে,আমাদের শান্তি নেই। ওকে আমি পুলিশে দিবো।”
চৈতী বেগম ভরসা পেলেন।দরজাটা লাগাতে লাগাতে বললেন,
-“এইসব কথা যেন আমাদের মধ্যেই থাকে রাত।বাহিরের কেউ যেন জানতে না পারে। এটাতে আমাদের সম্মান মিশে আছে।
রাত মাথা নাড়ায়।চৈতী বেগম বিছানায় বসে রাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“মিতালিকে তো আমি কোনোদিনই মেনে নিতে পারিনি শিশিরের বউ হিসেবে।কিন্তু তবুও মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।কিন্তু প্রথম প্রথম ও আমার মনের মত ছিল না। এটা তো হবেই তাই না?প্রথম কয়েকদিন এমন হওয়ারই কথা।যেহেতু ওকে আমি শিশিরের বান্ধবী হিসেবেই পছন্দ করতাম না। একে তো ছোটখাটো ড্রেস পড়ত তার উপর সবসময় শিশিরের গলায় ঝুলে থাকত। তো বিয়ের পর ওর প্রধান কাজ ছিল দুদিন পর পর আমার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া।যেহেতু আমার ওকে পছন্দ ছিল না তাই ওর সাথে কথা বলতে চাইতাম না।কিন্তু পরে সব ঠিক হয়ে যায়। প্রথম ২ বছর ঠিকই যায়। সমস্যা শুরু হয় যখন সায়ান পেটে আসে। ও সবসময় আমাকে ফ্ল্যাট থেকে বাইরে রাখতে চাইত। আমাকে বারবার গ্রামের বাড়ি পাঠাত,একটু পর পর ছাদে কাপড় নাড়তে পাঠাত,যত কাজ ছিল সব করাত যেন আমি এসব ছেড়ে গ্রামে চলে যাই।এগুলোর কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু একদিন আমি নুশানকে ওদের ফ্ল্যাট থেকে দীর্ঘক্ষণ পর বের হতে দেখি। পরেই বুঝতে পারি যে এসব করেছে যেনো..”
বলেই চৈতী বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।রাত ঠোঁটে ঠোঁট চিপে বললো,
-“আর যেন ও নুশানের সাথে সময় কাটাতে পারে।”
-“হ্যা। কিন্তু আমি এই পুরো বিষয়টা কিছু কিছু বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু শিশির তো কখনোই আমার কথা শুনবে না।এতটা অন্ধ ছিলো ও মিতালির প্রেমে।কিন্তু ছেলের এমন পরিণতি তো আমার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না রে মা।কারণ আমি নুশানকে বারবার ফ্ল্যাটে আসতে দেখেছি।তারপর আমি এই পুরো বিষয়টা কেয়ার সাথে শেয়ার করি।
কেয়া আমাকে এ বিষয়টায় সাহায্য করতে চেয়েছিল।কারণ ও চাইছিল না যেন ওর ভাইয়ের জীবনটা নষ্ট হয়।
বলেই থেমে গেলেন চৈতী বেগম। রাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চৈতী বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
-“কিন্তু সাহায্য করতে গিয়ে আমার মেয়েটা বিপদে পড়ে গেছে। মিতালি ওকে নিয়েই ব্লেকমেইল করছে আমায়।”
বলেই উনি মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন।রাত অবাক হয়ে বললো,
-“তারমানে মিতালি কেয়ার সাথে কিছু একটা করেছে আর সেটা নিয়ে ব্লেকমেইল করছে তোমায়।”
অর্থাৎ এখানে এতদিন পুলিশি ঝামেলার বিষয়টা সম্পূর্ণ চৈতী বেগমের বানোয়াট ধারণা ছিলো এবং ভয় পাওয়াটা এক প্রকার নাটকের মতই ছিল।ওনার মূল ভয়টা হলো কেয়ার সম্মান নিয়ে!পুলিশি ঝামেলাটাকে উনি নিজেও কেয়ার করেননি তেমন।উনি শিশিরকে দিয়ে মিতালিকে পুলিশে ধরাতে পারতেন ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে মিতালি যা করার করে ফেলত।তাই চৈতী বেগম এই ভয়ে শিশিরকে কসম দিয়েছিল।বাকিটা নাহয় পরের পর্বে…
চলবে…..
(ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। একটা সুন্দর মন্তব্য উপহার দিয়েন☺️💌)