#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#সূচনা পর্ব
-“আপনার একটা বউ আছে আর একটা দুধের শিশু থাকতে আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন শিশির স্যার?”
রাতের কথা শুনে শিশির কিছু বললো না।আগের ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে সোফায় বসে আছে। রাত শাড়িটা তুলে বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়ালো। থমথমে গলায় বললো,
-“আমি কখনো মা হতে পারব না।এটা জানেন তো?”
বলতে গিয়ে গলাটা কেমন ধরে এলো রাতের। অন্যদিকে তাকিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো।শিশির এবার রাতের দিকে তাকালো। আবারো চোখ নামিয়ে বললো,
-“জানি।”
রাত শিশিরের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
-“এতকিছু জেনেও লোকটা কেন আমায় বিয়ে করলো?”
রাতের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে শিশির বলতে লাগলো,
-“কিন্তু তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। তুমি নামে মাত্র আমার বউ।কখনো আমার উপর অধিকার খাটাতে এসো না।”
রাত অবাক হয়ে বললো,
-” মানেহ?একে তো আপনার বউ থাকা স্বত্ত্বেও আপনি আমায় বিয়ে করেছেন। তার উপর আপনি আমাকে এসব বলছেন!”
শিশির উঠে দাঁড়ালো। অনুভূতিহীন ভাবে তাকিয়ে থেকে বললো,
-“তোমার দায়িত্ব শুধু আমার সায়ানকে দেখে রাখা।”
রাত অবাক হয়ে বললো,
-“কেন?আমি কেন দেখে রাখব?আর মিতালি আপু কোথায়?বিয়েতেও দেখলাম না!আপনার বউ উনি।আপনার বিয়ে আটকালো না কেন?”
শিশিরের কপালের রগ ফুলে উঠলো। জোরে জোরে পা ফেলে আলমারি খুলে টি-শার্ট বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
রাত সেদিকে তাকিয়ে রইলো।বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো।
শিশির তার অপরিচিত নয়। তাদেরই প্রতিবেশী।তাদের সাথে এক মাসের আলাপ। এমনকি শিশিরের বউ মিতালির সাথে রাতের বেশ ভাবও ছিল।দুজন বেশ গল্প-গুজব করে সময় কাটাতো। রাত এখানে নতুন এসেছে তার মা-বাবা আর এক মাত্র ছোট ভাইটিকে নিয়ে। তার বাবার ট্রান্সফার হয়েছে এখানে।কলেজের টিচার তিনি। ভাগ্যবশত শিশিরও সেই কলেজেরই টিচার।আর রাতও সেখানেই পড়াশোনা করে। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন বিপদের হাত থেকে শিশির তাকে বাঁচিয়েছে।মিতালি আর শিশিরের মাঝে ভালোবাসার কমতি ছিল না। তারই ফলসরূপ এই ১৫ দিন বয়সের সায়ান।
দরজা ধাক্কানোর শব্দে চিন্তা থেকে বেড়িয়ে এলো রাত।উঠে দাঁড়ালো সে।রাত তখন ১২ টা। দরজা খুলতেই শাশুড়ির অসহায় মুখটা দেখতে পেল সে। কোলে সায়ান কাঁদছে। রাত তাড়াতাড়ি করে সায়ানকে নিজের কোলে নিয়ে দুলাতে লাগলো। সায়ান তখনো কাঁদছে।ততক্ষণে শিশিরও চুল মুছতে মুছতে বের হয়েছে।রাতের শ্বাশড়ি চৈতি বেগম অসহায় গলায় বললেন,
-“তোদের বিরক্ত করলাম।আমি দুঃখিত।কিন্তু ছেলেটা এত কাঁদছিলো।”
রাত সায়ানকে দুলাতে দুলাতে কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে বললো,
-” আন্টি!মিতালি আপু কোথায়?উনি কি রাগ করে কোনো ঘরে বসে আছেন?কোথায় উনি?”
চৈতি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“কেন?তোমার বাবা-মা কিছু বলেনি?”
রাত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-” আমি তো বিয়ের কথা জানতামই না আন্টি। বলুন না!মিতালি আপু কোথায়?উনি কিভাবে এই বিয়েটা মেনে নিচ্ছেন?”
চৈতি বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সায়ান কেঁদে উঠলো। মাত্রই তো থেমেছিল।আচমকা পিছন থেকে শিশির সায়ানকে কোলে নিতে নিতে বললো,
-” মা!ওর কাছে আমার ছেলের থেকে ওর প্রশ্নগুলোর দাম বেশি। তাও তোমার ওকেই পছন্দ হলো!”
চৈতি বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
-“এই অবস্থায় সব মেয়েরই এই টেনশন থাকবে এটা স্বাভাবিক। আর ওর বাবা-মা ওকে কিছু জানায়নি।সময় টাই হয়তো পায়নি।”
রাত চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার দৃষ্টি কাঁদতে থাকা সায়ানের দিকে।শিশির তাকে ফিডার দিচ্ছে, বাট সে মুখে নিচ্ছে না। রাত হঠাৎ শিশিরের হাত থেকে ফিডারটা নিয়ে নিলো। শিশির ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাতের দিকে। রাত ফিডারে থাকা দুধের ফোঁটা হাতের পিঠে নিয়ে জিভ দিলো।চিনি কম,আর পাতলা জল মনে হচ্ছে।
রাত দুধটা ফেলে দিলো। নিজে সুন্দর করে বানাতে লাগলোতারপর সায়ানকে কোলে নিয়ে ফিডারটা আস্তে করে ধরে দু ফোটা দিতেই সায়ান খেতে লাগলো।রাত হেসে বললো,
-“এখন মজা না?”
সায়ান ভেজা চোখে তার নতুন মাকে দেখছে।রাত হাসছে।কেমন মা মা ফিল হচ্ছে। শিশির কি বলবে বুঝতে পারছে না।শুধু তাকিয়ে আছে।চৈতী বেগম শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“মেয়ে আমি বুঝেই এনেছি শিশির। তোর আনা মেয়ের থেকেও এই মেয়ে আমার সংসারকে আগলে রাখবে।দেখে নিস।”
শিশির মায়ের দিকে চাপা রাগ নিয়ে বললো,
-“এসব মেয়েরা কখনোই কাউকে আগলে রাখে না মা।সবাই ধোঁকাবাজ। ”
-“সবাই এক না। মিতালি তোর পছন্দ করা মেয়ে ছিল। রাত আমার পছন্দ করা মেয়ে। ওর বাবাকে #শর্ত দিয়ে রাতকে নিয়ে এসেছি আমি।”
-“আমি চাই আমার ছেলেটা ভালো থাক।”
-“আমিও তো তাই চাই বাপ।”
-“তা কি আর সম্ভব?”
চৈতী বেগম কিছু বললেন না।রাতের মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।যে কিনা সায়ানকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত। শিশির সেদিকে তাকিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আকাশপানে তাকিয়ে ভাবলো,
-“হে আল্লাহ!কিসের পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি আমার?আমার ভালোবাসাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে কি মিতালি বাঁধলো না?এভাবে চলে গেলো আমায় ছেড়ে?কেন?আমার ভালোবাসায় কি কমতি ছিল? যে ও আমার বন্ধুর সাথে….”
ভাবতেই শিশিরের চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।শিশির ঘনঘন পলক ফেললো।কান্না আটকাতে।সে আর কাঁদবে না। এমন বেঈমানের জন্যে সে কেন কাঁদবে? কখনো না!
এদিকে সায়ান আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে গেলো। রাত সায়ানকে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দিলো।কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে তাই না সায়ান?তোর মা টা যে কই গেল!নিশ্চয়ই আমার উপর ভীষণ রাগ করেছে। কিন্তু আমার তো কোনো দোষ নেই রে।আমি তো জানতামই না কিছু। বাবার আমায় বলে টলে বিয়ে দিয়ে দিলো।বিয়ের পর জানলাম যে শিশির স্যার আমার স্বামী। তোর বাবা কেন এমন করলো আপুর সাথে?”
বলেই রাত ঠোঁট উল্টালো।ভাবতে লাগলো, কিছু তো একটা হয়েছে।নাহলে এভাবে মিতালি গায়েব! আর বাচ্চার কান্না দেখেও কেউ রাগ করে থাকতে পারে?শিশিরও রেগে যাচ্ছে মিতালির কথা শুনে। কোনো তো কারণ অবশ্যই আছে।
ভাবতে ভাবতে রাত সেভাবেই ঘুমিয়ে গেল।কারোর ফোঁপানোর শব্দ শুনে চোখ খুললো রাত। সায়ান ঘুমাচ্ছে।ওরও চোখটা লেগেছে কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে উঠে বারান্দার দিকে গেলো।দেখতে পেলো শিশির দোলনায় মাথা নিচু করে বসে আছে।ওখান থেকে ফোঁপানোর শব্দ আসছে।রাতের কেমন মায়া হলো। এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“শুনছেন…”
রাতের উপস্থিতি টের পেয়ে শিশির কান্না থামিয়ে দিলো। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো,
-“কিছু বলবে?”
-” না মানে ঘুমাবেন না?”
শিশির উঠে দাঁড়ালো।আবারো গম্ভীর গলায় বললো,
-“সায়ান ঘুমিয়েছে?”
-“হ্যা।ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।”
শিশির আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যাও ঘুমাও।”
-“আর আপনি?”
শিশির কিছু বললো না। রাত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।শিশিরের থেকে উত্তর না পেয়ে আবারো শুধালো,
-“সায়ানকে ওর মায়ের কাছে দিলে বাচ্চাটা শান্তি পেত।”
শিশিরের মাঝে আবারো রাগ দেখা গেল। তবুও নিজেকে সামলে বললো,
-“ওর মা নেই।”
রাত অবাক হয়ে বলতে লাগলো,
-“নেই মানেহ! কই মিতালি আপু?”
-“এত মানে মানে করো না তো।”
বলেই শিশির চলে যাচ্ছিলো। আচমকা রাত পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরে বলতে লাগলো,
-“অনেক হয়েছে! এবার একটু দয়া করে বলবেন প্লিজ? মিতালি আপু কোথায়?উনি কিভাবে বিয়েটা মেনে নিচ্ছেন?”
শিশির রেগে হাতটা ছাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“নেই ও। চলে গেছে। পালিয়ে গেছে অন্য ছেলের সাথে।আরো কিছু? ”
রাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এই কথাটা সে আশা করেনি।এজনন্যই কি শিশির কাঁদছিলো?আর মিতালি কিভাবে পারলো এভাবে দুধের বাচ্চাকে রেখে চলে যেতে?আর শিশিরই বা কেমন। রাতকে বিয়ে করে নিলো?শিশির চলে যেতে নিলেই রাত বলে উঠলো,
-“আমাকে কেন বিয়ে করলেন?আমার জীবনটা নষ্ট করার কি খুব প্রয়োজন ছিল?”
শিশিরের ভীষণ রাগ উঠে গেল। এমনিতেও সে ভীষণ রাগী মানুষ।তার উপর রাতের এত প্রশ্ন। সে এবার রেগে বলতে লাগল,
-“তোমার মত বন্ধ্যা মেয়েকে যে বিয়ে করেছি তাই তো অনেক। বলো যে তোমার জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছি। মিতালি একটা ঠক,প্রতারক। তাই চলে গেছে। এটা জানানোর পরও এত প্রশ্ন কেন তোমার?তোমার বিয়ে হবে না জেনেই তোমার বাবা আমার মায়ের প্রস্তাব মেনে নিয়ে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন।তার মধ্যে তোমার এত দেমাগ থাকবে কেন?তোমাকে এনেছি আমার ছেলের দেখাশোনার জন্যে। ব্যস এতটুকুই। এরচেয়ে বেশি কিছু করতে চেয়ো না।”
বলেই শিশির সেখান থেকে চলে গেলো। রাতের চোখ থেকে পানি অঝোরে জরছে।সে কোনোদিন মা হতো পারবে না, কথাটা জানার পর একটা রাতও যায়নি যেদিন সে কাঁদেনি।কিন্তু আজ শিশিরের কথাগুলো তার বুকে লেগেছে। সে তো কখনো এসব কথা শুনেনি। তবে কি এভাবেই শিশির তাকে সারাটাজীবন শুনিয়েই যাবে?মিতালি কি তাকে এই ফ্যাসাদেই আটকিয়ে চলে গেলো!
কি হতে চলেছে রাত আর শিশিরের জীবনে?দুজনেই বয়ে চলেছে হাজারো কষ্ট। শিশিরের এই কষ্টের মাঝেই রাত নিজের সুখের অস্তিত্ব খুঁজে জায়গা করে নিতে পারবে তো?
চলবে কি?