#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়(১১)
Sadia afrin nishi
____________________________
বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে সাক্ষর। আমি তার থেকে কিছুটা দুরে সিঙ্গেল সোফায় বসে আনমনে কিছু একটা নিয়ে ভাবছি।সকালের মতো দুপুরের খাবারটাও রান্না করাই ছিল।সাক্ষর ফ্রেশ হয়ে আসার পর ও আমাকে সাথে করে খাবার টেবিলে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি সকালের মতো সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করা কিন্তু আশেপাশে কোনো মানুষ নেই।আমি তখন কিছু না বললেও বিষয়টা আমাকে প্রচন্ড রকম ভাবাচ্ছে।খেয়ে এসে সাক্ষর ঘুমিয়ে গেছে আর আমি বসে বসে অনেক ভাবনাচিন্তা মনের আঙিনায় আঁকিবুঁকি করছি।
চিন্তাভাবনার সমাপ্তি করে উঠে পড়লাম আমার কলেজের ব্যাগটার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।ব্যাগটা থেকে একটা বই বের করে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলাম। এখন সকল ভাবনাচিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু পড়ায় মনোযোগ দিবো।বাকি প্রশ্নের উত্তরগুলো না হয় ধীরে ধীরে খু্ঁজে বের করা যাবে।
—————
বিকেলটা বই পড়তে পড়তেই কাটিয়ে দিলাম।সন্ধ্যার সাথে সাথে উঠে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। সাক্ষর এখনো ঘুমিয়ে আছে।হয়তো খুব ক্লান্ত। শরীরের যে অবস্থা তাতে তো ক্লান্ত হওয়ারই কথা।বইটা টেবিলে রেখে সাক্ষরের পাশ ঘেঁষে দাড়ালাম। লোকটার মুখটা কেমন জানি শুকিয়ে আছে। আচ্ছা ওনার আবার জ্বর-টর এলো না তো।তাড়াতাড়ি করে কপালে হাত রাখলাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই।জ্বরে গাঁ পুড়ে যাচ্ছে।তাই তো বলি ওনার মতো লোকের তো এতসময় অব্দি ঘুমোনোর কথা নয়। জ্বরের ঘোরে উঠতে পারছে না। কিন্তু আমি এখন ঔষধ কোথায় পাই।হুম ফার্স্ট-এইড বক্সে নিশ্চয়ই থাকবে জ্বরের ঔষধ।কিছুক্ষণ খোঁজার পরেই বক্সটা পেয়ে গেলাম।ওখান থেকে তাড়াতাড়ি ঔষধ বের করে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে সাক্ষরের কাছে গেলাম।কয়েকবার ডাকার পরেও যখন সাক্ষর চোখ মেলল না তখন আমি নিজেই ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে, মুখটা হাত দিয়ে মেলে ঔষধ খায়িয়ে দিলাম।তারপর ভালোভাবে কম্বল জড়িয়ে দিলাম ওনার গাঁয়ে।
রাত নয়টা নাগাদ সাক্ষরের জ্বর কমে এলো।সারা শরীর দিয়ে ঘাম ছুটতে শুরু করল।অস্বস্তি প্রকাশ করে চোখ মেলে তাকালো সে।গাঁয়ের কম্বল সরিয়ে উঠে বসে মাথা দু-হাতে চেপে ধরল। মাথায় হয়তো ব্যথা আছে এখনো।আমি তখন দরজা থেকে একটু দুরে দাড়িয়ে ওনার কান্ড কারখানা দেখছি।হঠাৎ আমার কী জানি হলো এক পা, এক পা করে হেঁটে একদম ওনার কাছে চলে গেলাম। নরম স্বরে বললাম,,
_”মাথা কী খুব ব্যথা করছে টিপে দেবো?”
আমার কথায় উনি একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর কোনোরুপ বাক্যবয় না করে আমাকে টেনে খাটে বসিয়ে দিয়ে আমার কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পরলেন।উপস্থিত ঘটনায় আমি হতভম্ব।আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বললেন,,
_কী হলো বসে আছো যে ?
_তাহলে কী করবো?
_”এইমাত্রই তো বললে মাথা টিপে দেবে তা এখুনি ভুলে গেলে ”
_ওহহ হ্যাঁ দিচ্ছি দিচ্ছি এক্ষুনি দিচ্ছি
আমি ওনার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম আর উনি পরম সুখে দুচোখ বুজে নিলেন।
————
খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেল আমার।ঘুম থেকে উঠে নিত্যদিনের মতো ওজু করে নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর খুব সুন্দর, ফুরফুরে মন নিয়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সাক্ষর এখনো ঘুমিয়ে আছে। তার জ্বর কমলেও শরীর দুর্বল আছে এখনো।আমি বসে বসে বই পরতে লাগলাম। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক পড়া পিছিয়ে গেছি সেগুলো এখন পড়ে পড়ে এগিয়ে নিচ্ছি।সাক্ষরের ঘুম ভাঙল সাড়ে আটটায়।ঘুম থেকে উঠেই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে চলে গেল। তারপর এসে ঝটপট রেডি হতে লাগল।আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,,
_আপনি কী কোথাও বের হচ্ছেন?
_হুম
_আপনার শরীর তো এখনো সুস্থ হয়নি তাহলে
_কোনো সমস্যা নেই আমি ঠিক আছি
_কিন্তু আমি তো দে….
উনি আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলেন।ব্রেকফাস্ট না করেই বেড়িয়ে গেল। আমি বরাবরের মতো খাবার টেবিলে সজ্জিত নানা পদের খাবার দেখতে পেলাম।লোকটা এই অসুস্থ শরীরে না খেয়ে বেড়িয়ে গেল তাই আমারও কেন জানি আর খেতে ইচ্ছে করল না। অগত্যা আমিও না খেয়েই বেড়িয়ে পরলাম কলেজের উদ্দেশ্যে।
রিকশা করে কলেজে যাচ্ছি এমন সময় রাস্তার মাঝখানে জনসম্মুখের ভীড়ে আমাদের রিকশাটা দাঁড়িয়ে পরল।আমি তখন রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,
_”কী হয়েছে মামা এখানে এতো ভীড় কেন”
রিকশাওয়ালা মামা বলল,,
_”জানি না তবে মনে হয় বড় কোনো ঝামেলা হইছে। আপনে বসেন আমি দেইখা আসি”
_আচ্ছা যান তাহলে মামা
অনেক সময় কেটে গেল। না ভীড় কমছে না রিকশাওয়ালা মামা আসছেন।আমার এবার খুবই বিরক্ত লাগছে।ওদিকে কলেজের টাইমও ওভার হয়ে যাচ্ছে।নাহ এভাবে বসে থাকলে কাজ হবে না। আমিও নেমে পরলাম রিকশা থেকে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তারজন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একটা লোক খুবই নৃশংস অবস্থায় পড়ে আছে।হয়তো মৃত।আর মৃত হবে নাই বা কেন তার যে কন্ডিশন যেকেউ দেখেই বলে দিতে পারবে সে মৃত।কেউ হয়তো তার দুচোখ তুলে নিয়েছে যার ফলে তার চোখের ক্ষত থেকে প্রচন্ড রক্ত ঝড়েছে। এখন অবশ্য বন্ধ হয়েছে হয়তো লোকটা মারা গেছে সেজন্য। দু’হাতের সবগুলো আঙুল কাটা,পায়ের রগ কেটে দেওয়া।মাথার চুল টেনে টেনে তোলা হয়েছে হয়তো যারজন্য কিছু কিছু জায়গায় চুল আছে আবার নেই।মোটকথা খুবই শোচনীয় ভাবে মার্ডার করা হয়েছে তাকে।
আমার চলার শক্তির হঠাৎই লোপ পেয়েছে মনে হচ্ছে।এই প্রথম নিজের চোখে কারো এতটা খারাপ অবস্থা অবলোকন করছি।মানুষ কতটা নির্দয় হলে এমন করে একটা মানুষকে খুন করতে পারে।আমার সারা শরীরে অগ্নিতাপ প্রবাহ হচ্ছে। নিজেকে ধাতস্থ করে তাড়াতাড়ি ভীড় ঢেলপ বাহিরে বেরিয়ে এলাম আমি।আমার পক্ষে আর এক মুহুর্তও এসব দেখা সম্ভব নয়। কলেজের টাইম হয়তো শেষ সাথে আমার অবস্থাও।তাই আর কোনোদিকে না তাকিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে ডেকে রিকশা বাড়ি পৌঁছে দিতে বলি।
রিকশাওয়ালা মামা হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলেন তাই তাড়াতাড়ি রিকশা চালানো শুরু করে দিলো।
————-
মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আছে। এমন করুন পরিণতি আমি জাস্ট ভাবতেই পারছি না। এসে থেকেই মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছি। সাক্ষর এসেছে একটু আগে। ফ্রেশ হয়ে কী একটা কাজ করতে অন্য একটা রুমে গেছে।আমি আর তেমন কিছু বলিনি ওনাকে।তবে উনি জিজ্ঞেস করেছিল আমার কী হয়েছে?আমি বলেছি,ঘুম হয়নি তাই মাথা ব্যথা। কলেজে যেতে গিয়ে এসব বাঁধিয়েছি শুনলে হয়তো রেগে যেতে পারে তাই আর বলিনি।আমি এখনো শুয়ে আছি।কিছুক্ষণ পরেই সাক্ষর রুমে এলো হাতে একটা মলম।মেইবি মাথা ব্যথার মলম।সাক্ষর আমার কাছে এসে মলমটা এগিয়ে দিয়ে বলল,,
_”এটা লাগিয়ে নাও পেইন কমে যাবে”
আমিও সাথে সাথেই নিয়ে নিলাম। ওনার সাথে বেশি কথা বলে ধরা খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।মলমটা লাগিয়ে একটু চোখ বুঝতে যাবো ঠিক তখনই মিতালীর ফোন।ফোন কানে নিতেই সে উদগ্রীব হয়ে বলল,,
_”কী রে কতদিন দেখি না তোকে। বিয়ে করে আমাকে ভুলে গেলি।তোর বাড়িতেও তো নিলি না। জিজুর সাথে আলাদা করে মিট করাও হলো না। কলেজে কেন আসিস না?”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো শেষ করল মিতালি। এখন সে হাঁপাচ্ছে। আমি ওর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললাম,,
_আগে দম ফেল তারপর আবার শুরু কর।একসাথে এতপ্রশ্ন কেউ করে। কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর দিবো শুনি।
_হুম বুঝলাম এবার বল কবে আসবি কলেজে
_আরে আজই তো যাচ্ছিলাম কিন্তু যা কান্ড ঘটল
_কী হয়েছে বল বল
_আরে বলবো কাল কলেজে গিয়ে এখন তোর জিজু শুনলে প্রবলেম আছে
আমার কথায় মিতালী মজা করে বলল,,
_হুম হুম খুব ভালবাসে না জিজু তোকে। খুব প্রেম করছো দু’জনে।তা হানিমুনে কোথায় যাচ্ছিস শুনি
ওর কথায় আমি অবাক হয়ে বললাম,,
_”হানিমুন”
_হ্যাঁ হানিমুন।এমন ভাব করছিস যেন এর আগে কখনো হানিমুনের নামই শুনিসনি
_না মানে আসলে
_এই সত্যি করে বল তো তোদের মধ্যে সবঠিক আছে তো
আমি এবার থতমত খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম,,
_অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ক ক ঠিক আছে সব
_মিথ্যে বলছিস তাও আবার আমাকে
ধুর এই মেয়েটা কীভাবে যেন সব বুঝে ফেলে।আর কিছু হয়তো ওর থেকে চেপে রাখতে পারব না।আমি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললাম,,
_কাল কলেজে গিয়ে সব বলবো
_আচ্ছা মনে থাকে যেন। এখন তাহলে রাখছি।কাল আসবি কিন্তু।ওকে বাই
_হুম আসবো বাই
ফোনটা কেটে পেছন ফিরতেই দেখি সাক্ষর কেমন ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।এই মরেছে কিছু শুনে ফেলল না তো। তাহলে তো এখনি চেপে ধরবে আমাকে। আমার ভাবনার মাঝেই সাক্ষর বলল,,
_কী এমন কথা হচ্ছিল তোমাদের মধ্যে যার ডিটেইলস কলেজে গিয়ে বলতে হবে ফোনে বলা যাবে না
_ও ওই আরকি তেমন কিছু না
_উহুম বললেই হলো তেমন কিছু না। কিছু তো অবশ্যই আছে তাড়াতাড়ি বলো কী হয়েছে।
আমি এবার মিনমিনে স্বরে বললাম,,
_বললাম তো কিছু না
পুরো ঘর ওনার ধমকে কেঁপে উঠল মনে হয় সাথে আমিও।ভয়ে ভয়ে একটা ডোক গিলে বললাম,,
_”বলছি বলছি”
অতঃপর কলেজে যাওয়ার পথের সব ঘটনা তাকে খুলে বললাম।সবকিছু বলার পর সাক্ষরের দিকে চোখ পরতেই আমি বিষ্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেলাম।ওনার এমন রিয়াকশনের কারণ আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না
চলবে,