লুকোচুরি গল্প পর্ব-০১

0
684

#লুকোচুরি_গল্প
#সূচনা_পর্ব
#ইশরাত_জাহান

“আমার মতো এত কিউট গুলুমূলু একটি মেয়েকে তুমি ওই সুগার ড্যাডির সাথে বিয়ে দিতে পারো না আম্মু।”

মেয়ের কথা শুনে আড় চোখে তাকালেন মিসেস নাজনীন।মেয়ে তার বয়সের তুলনায় একটু বেশি পাকা।একজন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারকে সে সুগার ড্যাডি বলছে।প্রতিবাদ করে মিসেস নাজনীন বলে,”দ্বীপকে তোমার কোন দিক থেকে সুগার ড্যাডি মনে হয় বলবে নীরা?ওর বয়স মাত্র বত্রিশ।”

নীরা অবাক হয়ে বলে,”বত্রিশ এটা তোমার কাছে মাত্র মনে হলো আম্মু!আমার বয়স আর তার বয়স দেখো।”
“এই বয়স কোনো ফ্যাক্ট না।তোমার বাবার সাথে আমার বয়সের অনেক ফারাক।তাই না বলুন?”নীরার বাবাকে উদ্দেশ্য করে।
নীরার বাবা মিস্টার রবিন স্ত্রীকে কিছুটা ভয় পান।তাই তিনি বলে,”হ্যা হ্যা ঠিকই তো।বিয়েতে বয়স কোনো ফ্যাক্ট না।এজন্যই তো তোমার আম্মু আর আমি হলাম লাভ বার্ডস।”মেয়েকে চোখ টিপুনি দিয়ে।

নীরা জানে তার আব্বু তার আম্মুর কথার নড়চড় করবে না।যমের মতো ভয় পায় তিনি।নীরা মন খারাপ করে চলে গেলো ঘরে।

(নীরার পুরো নাম মুনজেরিন নীরা।এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে,বয়স আঠারো।ক্লাস টেনে একবার ফেইল করেছে তাই তার এই অবস্থা।বাবা স্বর্ণের ব্যাবসা করেন,মা গৃহিণী।নীরার বড় ভাই আছে।নাম নির্বাণ আহমেদ নীরব।এখন জার্মানিতে পড়াশোনা করছে ফুড নিউট্রিশন নিয়ে। আর মাত্র কয়েকমাস সময় আছে।তারপর দেশে চলে আসবে।)

ঘরে এসে নীরা তার মিনিকে(বিড়াল) কোলে নেয়।মিনিকে আদর করতে করতে কল দেয় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কেয়াকে।
(কেয়াও নীরার সাথে পড়াশোনা করে।সেও নীরার মত ক্লাস টেনে ডাব্বা প্রাপ্ত।পড়াশোনায় কেউই ভালো না। নীরাদের এলাকায় কয়েক বাসা পড়েই কেয়াদের বাসা।কেয়ার পুরো নাম কুহেলিকা কেয়া।কেয়ার বাবা একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন,মা গৃহিণী।কেয়ার কোনো ভাই বোন নেই।)

নীরার কল দেখে সাথে সাথে রিসিভ করে কেয়া।বলে,”হ্যা দোস্ত বল।”
কান্না কান্না ভাব করে নীরা বলে,”আর তোর দোস্ত।জানিস আব্বু আম্মু মিলে কি করেছে?”
“তুই না বললে জানবো কিভাবে?”
“আব্বু আম্মু আমার বিয়ে ঠিক করেছে।তাও কি না ওই সুগার ড্যাডির সাথে।”

বুঝে উঠলো না কেয়া।সুগার ড্যাডি আবার কে?সাথে সাথে বলে ওঠে,”এই সুগার ড্যাডি আবার কে দোস্ত?আংকেল আন্টি কি না শেষ পর্যন্ত তোকে ফিফটি প্লাস কারোর সাথে বিয়ে দিবে!এটা আশা করা যায় না।”

তেতে ওঠে নীরা।সে কোথায় বত্রিশ বছরের লোককে সুগার ড্যাডি বলছে আর তার বান্ধবী ভাবছে ফিফটি প্লাস কাউকে।নীরা নিচের ঠোঁট উচু করে বলে,”আমি ওই প্রতিবেশী খারুচ স্যারের কথা বলছি।যে কি না আমাকে ক্লাসে কান ধরে দাড় করিয়ে রেখেছিলো।”

কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে কেয়া বলে,”দোস্ত আমাদের ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টের আদনান কবির দ্বীপ স্যারের কথা বলছিস?”
“হ্যা”
“তুই না ওনাকে ক্যাডার সাহেব বলতিস! হঠাৎ সুগার ড্যাডি উপাধি দিলি কেনো?”

“ওই ছেরি বুঝোস না কেন বলি?আমার বয়স সবে আঠারো। আর উনি কি না বত্রিশ।হিসাব করে দেখ চৌদ্দ বছরের ডিফারেন্ট।ওনাকে আমি বিয়ে করবো না।”

নীরার নেকী কান্না বুঝতে পারে কেয়া।তারপরও শান্তনা দিতে বলে,”আচ্ছা দোস্ত শান্ত হ।তুই কিভাবে জানলি যে ওনার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

নীরা একটু আগের ঘটনা কেয়াকে বলে,”আমি ছাদে গিয়েছিলাম।ওই পুচকু অভ্র ছিলো সেখানে।বয়স মাত্র চার কিন্তু মুখে পাকা পাকা কথা।আমাকে ওদের ছাদ থেকে দেখে বলে,’ মামী।’
আমিতো অবাক কাকে ডাকছে না ডাকছে। পরে দেখি আমাকে ডাকছে।আমিও জিজ্ঞাসা করেছি,’ আমাকে কেনো মামী বলছো?’
অভ্র বলে,’ নানু বলেছে তুমি আমার মামী হবে।মামার সাথে তোমার বিয়ে দিবে।তোমার মা বাবাও এসেছিলো আমাদের বাসায়।’
অভ্রর কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ে।সাথে সাথে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করি।আম্মু স্বীকার করেছে সবকিছু।”

নীরার কথা শুনে কেয়া মিটিমিটি হাসে। জোরে হাসলে নীরা রাগ করবে। নীরাকে সান্তনা দিতে বলে,”আরে দোস্ত চিল কর।দ্বীপ স্যার যে রাগী আর বদমেজাজি উনি তোকে বিয়ে করবে না।”

সাথে সাথে খুশি হয় নীরা।বলে,”হ্যা রে,তুইতো ঠিক কথাই বলেছিস।উনি তো মেধাবী ছাত্র ছাত্রী বেশি ভালোবাসে।আমার মত ফেলটুশ উনি বিয়ে করতে চাইবে না।”
“বাহ,নিজের সুনাম নিজে কি সুন্দর ঝরঝর করে বলছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে।জানি এটা গর্বের বিষয় না।তাও আমার কাছে পড়াশোনা ভালো লাগে না।রাখছি এখন বাই।”বলেই কল কেটে দিলো।
এখন শান্তি পাচ্ছে নীরা।ওই ক্যাডার সাহেব তাকে নিজে থেকেই রিজেক্ট করবে।তাকে আর কষ্ট করা লাগবে না।ভেবেই লুঙ্গি ড্যান্স দিতে থাকে।

(আদনান কবির দ্বীপ পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার দিয়ে সফল হয়েছে।তাই তার বয়স একটু বেশি।ঢাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিকস এর লেকচারার।নীরার ডিপার্টমেন্টের স্যার অবসর প্রাপ্ত হওয়ায় দ্বীপ এই ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব নিয়েছে।এছাড়া দ্বীপ ও নীরা দুজন প্রতিবেশী।পাশাপাশি বাসা দ্বীপ ও নীরার।শুধু তাই না নীরার প্রাইভেট টিচার এই দ্বীপ।দ্বীপের বাবা মিস্টার সমুদ্র একজন ব্যাবসায়ী সাথে একটি রেস্টুরেন্টের মালিক।মা মিসেস সাবিনা একজন গৃহিণী।দ্বীপের বোনের নাম দীপান্বিতা দীপা।ঘরে বসে অনলাইনে জামা কাপড়ের ব্যাবসা করে।দ্বীপের একমাত্র আদরের ভাগ্নে অভ্র বয়স চার।)

নীরা ড্যান্স করছে আর নীরার মিনি এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে।ড্যান্সের তালে তালে নীরা গাইতে থাকে,”ক্যাডার আমায় করবে রিজেক্ট,শান্তি আমার তাতে।কে কি বলল ভাবিনা আমি, ঠেকা পড়েনি আমার শুনতে।ক্যাডার তুমি সুগার ড্যাডি।তোমায় ভালো বাসিনা আমি।”
গান গাইতে গাইতে আর নাচতে নাচতে পিছনে ফিরে দেখে মিসেস নাজনীন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

মাকে দেখে নীরা নাচ বন্ধ করে দেয়।শুকনো ঢোক গিলে বলে,”কি হয়েছে আম্মু?”
বাম ভ্রু উচু করে মিসেস নাজনীন বলে,”খুব মজা না দ্বীপ তোমাকে রিজেক্ট করবে বলে?”
মুখের বত্রিশ পাটি বের করে নীরা বলে,”না মানে ওই আরকি।”
মেয়েকে ওয়ার্নিং দিতে মিসেস নাজনীন বলে,”শুনো নীরা দ্বীপ কি করবে না করবে তা দেখার জন্য আমি আর তার বাবা মা আছি।তোমাকে যেনো আমি নাকোচ হতে না দেখি।পড়াশোনার অবস্থা তো খুবই খারাপ।কে বিয়ে করবে তোমাকে?মিসেস সাবিনা ভদ্রতার সাথে ভালোবেসে তোমাকে আপন করে নিচ্ছে।চুপচাপ বিয়ে করবে।তানাহলে রিক্সা চালক দেখে বিয়ে দিবো।”বলেই চলে গেলেন মিসেস নাজনীন।

মায়ের কথায় মুখ চুপসে এলো নীরার।তার মা কি ভালো পাত্র দেখে না? বেছে বেছে এই ক্যাডার সাহেব আবার এখন রিক্সা চালক।আচ্ছা রিক্সা চালক হ্যান্ডসাম দেখে কেউ কি আছে?থাকলে সে প্রেম করে বিয়ে করে নিবে।তার মা যে লেভেলের পিছে লেগেছে তাতে বোঝা যায় স্যার আর ছাত্রীর বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। ভাবা যায় বিষয়টি!স্যার বিয়ে করেছে তার ছাত্রীকে।তাও কি না সেই ছাত্রী যাকে কান ধরে দাড় করিয়ে রাখে।মাঝে মাঝে তো ঠাস করে গালেও কয়েকবার থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।তবে ওটা প্রাইভেট পড়ানোর সময়। কারো সামনে না।

আজকে শুক্রবার নীরার ছুটি।দ্বীপ পড়াতে আসবে না।বিকাল বেলা নীরা ছাদে যায় তার প্রিয় হলুদ গোলাপ ফুলগাছ গুলোর যত্ন করতে।নীরার গোলাপ গাছে কয়েকটি ফুল ফুটেছে।যেগুলো নীরার খুব ভালো লাগে।নীরা ফুল গাছে পানি দিতে থাকে।তখন তার পাশে আসে রিক।
(রিক নীরাদের বাসায় ভাড়া থাকে।রিকের বাবা লন্ডন থাকেন।রিকের বাবা ও মা বিয়ের পর লন্ডনে সেটেল হয়।ওখানেই রিকের জন্ম হয়।রিক ওখানেই বড় হয় কিন্তু রিকের নানু অসুস্থ হওয়ায় বাংলাদেশ আসতে হয়।তখন থেকেই রিক ও তার মা এই ঢাকা শহরে ভাড়া থাকে।রিকের বাবা যখন পার্মানেন্ট আসবে তখন ঢাকায় বাড়ি করবে তারা।রিক এবার মাস্টার্স ভর্তি হয়েছে।)

রিক নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”হাই কিউটি।”
“হাই”(ইশ এই রিককে কি আমার মায়ের চোখে পড়ে না?)মনে মনে বলে নীরা।
রিক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,”আমি তোমাকে সাহায্য করি?”
নীরা ঘাড় কাত করে হ্যা বোঝায়।মনে মনে বলে,”মেরে দিলমে লাড্ডু ফুটা দিয়া।”
রিক কাজ করে দেয়।টবের মাতিগুলো ঝুরঝুরে করে তাতে প্যাকেট থেকে জৈব সার মিশিয়ে বলে ওঠে,”কিউটি,একটি কথা বলবো তোমাকে?”
নীরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।
রিক দেখলো নীরার সম্মতি।তাই বলে,”তোমার বান্ধবী কেয়া আছে না?ওকে আমার খুব ভালো লাগে।কয়েকমাস ধরে ওকে আমি ফলো করি।যদি কিছু মনে না করো ওর নাম্বার দিতে পারবে?”
নীরার মনের মধ্যে এবার বিরহের গান বাজতে লাগলো,”লাড্ডু ফাট গায়া। খাতাম বাই বাই টাটা।”

রিক নীরার কোনো উত্তর না পেয়ে ভেবে নেয় নীরা কেয়ার নাম্বার দিবে না।অবশ্য বান্ধবীর অনুমতি ছাড়া কিভাবে দিবে?তাই রিক নিজে বলে ওঠে,”ওকে ফাইন, দেওয়া লাগবে না নাম্বার।শুধু এবার কেয়া তোমাদের বাসায় আসলে আমার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিও প্লিজ।আমার জীবনে ফার্স্ট লাভ এটা।যদি ওর আলাদা কোনো ভালোবাসার মানুষ না থাকে আমি ওকে পেতে চাই।”

নীরা আহত দৃষ্টিতে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়।রিক নীরার মুখের দুই পাশের গাল টেনে বলে,”থ্যাঙ্ক ইউ কিউটি। সো সুইট ইউ আর।”
হালকা ব্যাথা পায় নীরা।বাচ্চা নাকি যে এভাবে গাল টানবে।পেয়েছে কি এরা।এই গালে একজন থাপ্পড় দেয় তো আরেকজন গাল টেনে দেয়।সরকারি পেয়েছে তাকে?

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে