#লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
খন্ডঃ১০
এত সাত সকালে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনলেন যে? ঘড়িতে দেখেছেন এখন কয়টা বাজে?
-দেখেছি৷ এখন পাঁচটা একচল্লিশ।
শায়লা নাক ফুলিয়ে তার চড়া মেজাজের জানান দিয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চটার উপরে ধপাস করে বসে বলল, মাঝেমধ্যে এমন পাগলামি করেন আপনি! মনে হয় চার বছরের একটা বাচ্চা আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
খাইরুল সাহেব আহ্লাদের হাসি হেসে শায়লার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আদা-লবঙ্গ দিয়ে বানানো কড়া লিকার চা৷ ধীরেধীরে খাও, নয়তো ঠোঁট-জিহ্বা পুড়বে৷
শায়লা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো বলল, ঘুমটা কেন ভাঙালেন! এমনি গতরাতে ঘুমিয়েছি রাত তিনটার দিকে, তার উপর মানসিক অস্থিরতা।
-তুমি তো এত রাত জাগো না! আর অস্থিরতাই কিসের?
শায়লা চায়ের কাপে সাবধানী চুমুক দিয়ে বলল, দুটো বিস্কুট নেন তো, খিদে লেগেছে।
খাইরুল সাহেব বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে নিজে বয়াম খুলে চারটে বিস্কুট এনে শায়লার দিকে এগিয়ে দিতেই শায়লা বিস্কুটে কামড় বসিয়ে বলল, লীলা আপার ছেলেটাকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে৷ ছেলেটা বন্ধুদের সাথে চট্টগ্রাম গিয়েছিল ঘুরতে, সাথে দুটো মেয়েও ছিল৷ একটা মেয়েকে খুন করেছে ছেলেটার দুই বন্ধু আর বাকি মেয়েটা মিলে। এখন লীলা আপার ছেলেটা মাঝখান দিয়ে ফেঁসে গেল বন্ধুদের খুনের দায়ে। যারা খুন করেছে তারা সবাই উধাও, ধরা পড়ল কেবল লীলা আপার ছেলেটাই!
– তুমি এতটা নিশ্চিত হচ্ছো কী করে লীলা ম্যাডামের ছেলে খুন করেনি?
শায়লা বিস্কুটটা আর চাবায় না, গিলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে যে উনার ছেলেই করেছে?
-এই দেখো তুমি রেগে যাচ্ছো! আসলে তুমি লীলা ম্যাডামকে খুব পছন্দ করো, প্রিয় মানুষের অন্যায়,দোষ আমরা চোখে না দেখা অবধি বিশ্বাস করতে চাই না৷ আমরা ভাবি প্রিয় মানুষটাই ঠিক, বাকিসব ভুল।
শায়লা খানিকটা জুড়িয়ে আসা লিকার চা দ্রুত চুমুকে খেয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ উনাকে খুব পছন্দ করি, এটাও চাই উনার ছেলেটা যাতে দ্রুত বেরিয়ে আসে। যাইহোক, আপনি কী কারণে ডেকে এনেছেন সেটা বলেন, মিনু আপার জ্বর, রান্নার দায়িত্ব আজ আমার উপরে।
-চলো হাঁটতে হাঁটতে বলা যাক।
ভোর সকালের রাস্তায় মৃদু বাতাসে শায়লার পাশাপাশি খাইরুল সাহেব হেঁটে চলেছে। খাইরুল সাহেব থেমে থেমে বলল, আমি বাড়িতে বড্ড একা হয়ে গেছি শায়লা। আমার যেন কেউ থেকেও নেই৷ বাঁচিই বা আর কটা বছর তাই সাহস করে তোমাকেও কিছু বলতে পারি না। তুমি মাঝেমধ্যে আমার বাসায় তো আসতেই পারো, আমার একটু ভালো সময় কাটে তুমি থাকলে।
শায়লা মাথা গুঁজে নেয়, মাথা গুঁজে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে, কী যেন ভাবছে কিংবা কোনো দোটনার সমীকরণ মেলাচ্ছে। খাইরুল সাহেব ব্যস্ত গলায় বলল, তোমার আপত্তি, অসুবিধে থাকলে আসতে হবে না শায়লা। ছাদে ফুলের বাগান করবো, দুটো পার্সিয়ান বিড়াল কিনব আর মস্ত বড় একটা আ্যকুরিয়াম, অনেক মাছ রাখব। এসব নিয়েই দিন কেটে যাবে আমার।
শায়লা আর হাঁটে না, থমকে দাঁড়ায়। খাইরুল সাহেবের চোখে চোখ রেখে নিচু গলায় বলল, আমাকে এতটা সমীহ কিংবা সম্মান কেন দেন আপনি? আমি এটার যোগ্য না তো। আমার মতো মেয়েকে মানুষ কেবল তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, হুকুম দিতে জানে৷ কেউ ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছার অপশন রাখে না আমার জন্য, কোনদিন রাখেওনি।
-এমন করে কেন বলছো শায়লা? তুমি আমার কাছে খুব কাছের কেউ, যার কাছে সব বলা যায়। এই কমলা লেবুর মতো চ্যাপ্টা পৃথিবীতে মানুষ একাকীত্বে ভোগে অকেজো কথা বলার মতো মানুষের অভাবে, যার সাথে অপ্রাসঙ্গিক কিংবা যা ইচ্ছে তাই বলা যায়। কাজের কথা বলার মতো মানুষের অভাবে মানুষ একাকীত্বে ভোগে না। তোমাকে আমি যা ইচ্ছে তাই বলতে পারি। তুমি খুব দামী জিনিস আমার কাছে।
হা হা হা। এইযে এত দাম দিচ্ছেন তার কিছুটা কি আপনার স্ত্রীর চেহারার সাথে আমার চেহারার আশ্চর্যজনক মিলের কারণে। তাই না ?
-সেটা প্রথমে দিতাম, তবে এখন তোমাকে আলাদা মানুষ হিসেবে মানি, জানি।
কথা বলতে বলতে কখন যে বোর্ডিং এর গেটের সামনে চলে এলাম টেরই পেলাম না! খাইরুল সাহেব, আপনার সবচেয়ে ভালো দিক কী জানেন?
-না।
আপনি মানুষটা মিথ্যে বলেন না, জীবনকে সহজভাবে দেখেন। তবে আমি জীবনকে বড্ড বক্র আর কঠিনভাবে দেখি। যাইহোক, আমি যাই, আপনি বাসায় যান, নাস্তার সময় হয়ে আসছে আপনার।
-শায়লা, আসবে তো?
না।
-আমি জানি তুমি আসবে।
হা হা। আপনি মাঝেমধ্যে খুব ভারী কথা বলে ফেলেন, সেটা আপনার খোলস কেবল, ধার করা আলাদা একটা ছাপ চেহারার উপর। আসলে আপনি দুইয়ের ঘরের নামতার মতো খুব সহজ। আসি এখন।
বোর্ডিং এ মানুষের অভাব নেই, অনেক মানুষ। তবুও যেন কানিজ, শ্রাবণীদের আজকাল মনে হয়, বোর্ডিংটা জনশূন্য। কেয়া নেই, জুঁই নেই। মোনাটা সেই যে চরাঞ্চলে গেল বন্যা দুর্গতদের সাহায্য করতে, তার ফেরার খবর নেই। আর রুবাইয়া আজকাল বেশিরভাগ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই থাকে, এদিকটায় আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে হুট করেই।
শায়লা আর শিরিন আপার একসাথে রান্নার কথা থাকলেও শিরিন আপা সকাল থেকে দরজা লাগিয়ে বসে আছেন। শায়লা ডাকতে গিয়েছিল, শিরিন আপা কানিজকে ডেকে নিয়ে রাঁধতে বলেছে। শায়লা কানিজকে ডাকতে যায়নি আর, কানিজ কোনোদিনও কিচেনে যায়নি, এ কথা শায়লার অজানা নয়।
শ্রাবণীকে ডেকে শায়লা সকাল-দুপুরের রান্না সেরে নিচ্ছে। বুটের ডাল, সরপুঁটি ঝোল আর আলু ভাজি, এই হলো আজকের দুপুর পর্যন্ত খাবার তালিকা। রাতে খিচুড়ি রাঁধা হবে।
কানিজ ল্যাপটমে মুভি প্লে করে রেখেছে ঘন্টা খানেক ধরে অথচ মুভিতে তার মন নেই। কানিজ বারবার ভাবছে তার বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত কি না, তার বাবা গত তিনদিন ধরে বিছানায় পড়া, যে মহিলার সাথে কানিজের বাবা লিভ টুগেদার করত সেই মহিলা মাস খানেক আগে নাকি অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে অন্য একজনের সাথে। এ সমস্ত খবর দিয়ে গেছে কানিজের মামা মিজান সাহেব। কানিজের ঘোর কাটে জান্নাতের উপস্থিতিতে। জান্নাতকে দেখামাত্রই কানিজ আর গম্ভীর হয়ে থাকতে পারল না, ফিক করে হেসে উঠে বলল, তুই বোর্ডিং এর ভেতরেও বোরকা পরা শুরু করেছিস! এখানে তোকে কে দেখছে রে?
-হাসান মামা সেদিন হুট করে তোমাদের রুমে চলে এলো, আমার সারা রাত ঘুম হয়নি ওদিন। উনি হুট করে আসলে যাতে আর পর্দার খেলাপ না হয় তাই তোমাদের রুমে এবার থেকে বোরকা পরেই আসব।
কানিজ এবার আর হাসে না। জান্নাতের হাত ধরে বলল, খুব অস্থিরতায় আছি রে। কাল রাত থেকে বাবার জন্য মন খারাপ। বাবা খুব বড় অন্যায় করেছে, তবুও তার অসুস্থতার কথা শুনে মন কাঁদছে, তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– আল্লাহ পাক তার ঐ বান্দাকে বেশি ভালোবাসেন যেই বান্দা আল্লাহ পাকের অপর বান্দার ভুল,ত্রুটিকে ক্ষমা করে দেয়। আর আল্লাহ পাকের প্রিয় তিনটি কাজের একটি হচ্ছে বাবা-মায়ের খেদমত করা। এখন তুমি ভেবে দেখো আপু, তুমি আল্লাহ পাকের প্রিয় কাজ করে, আল্লাহ পাকের ভালোবাসা চাও কি না। তবে হ্যাঁ, তোমার আব্বার কিছু হয়ে গেলে ঐ মুখটা আর দেখতে পাবে না কিন্তু। একবার ক্ষমা করে দেখোই না সে তোমাকে মাথা চড়িয়ে রাখবে, সে অমন ভুল করবে না আর।
কানিজ জান্নাতের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে। জান্নাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই খুব গুছিয়ে কথা বলিস রে। আচ্ছা তোর চোখ দুটো অদ্ভুত রকমের সুন্দর রে! এটা জানিস?
– আমার সমস্ত শরীর ঢাকা থাকায় কেবল চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে, তাই চোখ দুটো সুন্দর লাগছে। আমার সবকিছুই সুন্দর, হা হা হা।
কানিজ তবুও যেন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না, সে তাদের বাড়িতে যাবে নাকি যাবে না।
তিন চারবার নক করার পর দরজা খুললেন শিরিন আপা। হাসান মামা কাচুমাচু করে বলল, আপা, সাজু নামের এক লোক আসছে আপনার সাথে দেখা করতে। আমি বারবার বলছি আপনে দেখা করতে চান না, তবুও সে যায় না। সে বলছে সে দেখা না করে যাবে না। কী করব এখন?
শিরিন আপা চোয়াল শক্ত করে বললেন, ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দেন তার দুই গালে। পারবেন না? না পারলে তাকে গিয়ে বলেন, বোর্ডিং এর মেয়েরা তাকে ইভটিজার বলে ঐ রাস্তার মাঝেই পিটাবে, সেটা চায় কি না সে। আর এটা আমি বলেছি গিয়ে সেটাও জানাবেন। গিয়ে দুটোর যেকোনো একটা করে আসুন যান।
হাসান মামা “জ্বে আইচ্ছা” বলে মাথা নাড়িয়ে গেটের বাইরে চলে যেতেই শিরিন আপা আবার দরজা লাগিয়ে দিলেন, যেন সবকিছু থেকে তিনি পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছেন।
সবাই একসাথে টেবিলে খেতে বসেছে, এই রাতেই কেবল বোর্ডিং এর সবার দেখা মেলে। সকাল কিংবা দুপুরে সবাইকে একসাথে পাওয়া যায় না। ডিম ভাজি, খিচুড়ি আর জলপাইয়ের আচার দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে ধীরেধীরে খেয়ে চলেছেন শিরিন আপা। শিরিন আপার মুখটা বেশ ভারী হয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। খাবার মাঝেই শিরিন আপার ফোনে কল আসলো। কল রিসিভ করে শিরিন আপা খানিকক্ষণ কেবল শুনে গেলেন, মুখে খাবার তুলতে গিয়েও নামিয়ে নিলেন। ফোনের ওপাশ থেকে কে কথা বলছে কানিজরা তা বুঝতে পারল না। এপাশ থেকে শিরিন আপা কেবল দুবার বললেন, “আচ্ছা….আচ্ছা”। ফোন কল কেটে দিয়ে শিরিন আপা প্লেটে রাখা অর্ধেক খিচুড়ি, অর্ধেক ডিম ভাজা আর না খাওয়া আস্ত জলপাইটা রেখেই উঠে তার রুমের দিকে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। জান্নাত নিচু গলায় কানিজকে বলল, শিরিন আপার চোখে পানি ছিল, খেয়াল করেছ?
চলবে…..
লেখকঃ Borhan uddin