লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-০৭

0
1293

#লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
খন্ডঃ০৭

কেয়া টুলটার ওপর বেশ আরাম করে বসে বলল, মামা, একটা বেনসন আর এক কাপ লিকার চা নিয়া আসেন।

হাসান মামা কেয়ার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, দুচোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে বলল, আপনে খাইবেন? কেউ যদি দেইখা ফালায়?

আরে নাহ, কেউ দ্যাখবে না এত রাইতে। সব নাক ডেকে ঘুম দিচ্ছে। আপনার জন্যও চা-সিগারেট আইনেন। দুজনে মিইলা বিড়ি টানাতে সুখ আছে।

রাত প্রায় দেড়টা বেজে চলেছে। গলির কুকুরগুলো ক্লান্ত পায়ের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে, শহুরে কাকেরাও নিরুদ্দেশ। বোর্ডিং এর সামনের চায়ের দোকানটা বন্ধ থাকায় হাসান মামা বেশ ঘুরেঘুরে অন্য এক দোকান থেকে চা-সিগারেট নিয়ে ফিরল। হাসান মামা গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন সময় কানে এলো একজন নিচু গলায় গান গেয়ে চলেছে। হাসান মামা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল–

“চাঁদের মত নীরবে এসো প্রিয় নিশীথ রাতে।
ঘুম হয়ে পরশ দিও হে প্রিয়, নয়ন-পাতে।।

তব তরে বাহির-দুয়ার মম
খুলিবে না এ-জনমে প্রিয়তম,
মনের দুয়ার খুলি’ গোপনে এসো বিজরিত রহিও স্মৃতির সাথে।।

কুসুম-সুরভি হ’য়ে এসো নিশি পবনে,
রাতের পাপিয়া হয়ে পিয়া পিয়া ডাকিও বন-ভবনে।

আঁখি জল হয়ে আঁখিতে আসিও
বেণুকার সুর হয়ে শ্রবণে ভাসিও,
বিরহ হ’য়ে এসো হে চির-বিরহী আমার অন্তর-বেদনাতে”

গান শেষ হতেই হাসান মামা গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কেয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, এত দেরি হইলো যে মামা?

-আপনার গান শুনছিলাম।

হায়রে, কান পচে যায়নি তো? চেক করে দ্যাহেন পচছে কি না। আমার যে গলা।

-না আপা, কী সুন্দর গান করেন আপনে! যদিও গানের কথাগুলো বুঝি না তবে কেমন যেন মায়া মায়া লাগে শুনতে। এই গান আগে শুনি নাই, কার গান এইডা?

হা হা, কী যে কন মামা৷ এইটা নজরুল গীতি , নজরুল মানেই মায়া আর মায়া৷ আচ্ছা দেন সিগারেট দেন, চায়ে চিনি এক চামচ দিয়া আনছেন না?

– হ, আপা এক চামচই। আমারডায় চাইর চামচ।

কেয়া পাকা হাতে একবারেই দিয়াশলাইর কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে প্রথম টানটা চোখ বুজে, বুকে ভরেই দেয়। হাসান মামা বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে চিরচেনা মেয়েটার অচেনা রূপটা দেখে। সিগারেটে এক টান দিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, আহ মামা! চা টা দারুণ হইছে কিন্তু। হাসান মামা সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, হ তাইতো! দারুণ বানাইছে। তা আপা, আপনে সিগারেট কি নিয়মিত খান?

-হ্যাঁ তা খাই, দিনে দুইটা। বাথরুমে যাইয়া খাই, খাওয়ার পর সঙ্গে নেয়া বডি স্প্রেটা স্প্রে কইরা দিয়া আসি।

ও, আপনার ম্যাচ ধরানো দেইখাই বুঝছিলাম যে বিড়ি খাওনের অভ্যাস আছে আপনার। আচ্ছা আপা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

-হ্যাঁ, শিওর।

আপনের মন খারাপ? নাইলে কোনো সমস্যায় আছেন?

কেয়া হাসান মামার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সিগারেটে আরো দুই টান নাক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমার অসংখ্য প্রেমিক কোনোদিনও আমার মন খারাপ ধরতে পারে নাই, অথচ আপনি পারলেন মামা! ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত না? হ্যাঁ মন খারাপ, খুব খারাপ।

হাসান মামা লক্ষ্য করল কেয়া আজ আর মজা করে কথা বলছে না, প্রতিটা কথাই আজ শুদ্ধভাবে বলে চলেছে। হাসনা মামা আবদারী গলায় বলল,আমারে বলা যায়? কেন মন খারাপ?

-হ্যাঁ যায়। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মামা, সামনের মাসেই বিয়ে । এই লীলা বোর্ডিং এর গেস্টরুম, খাবার টেবিল, মিনু আপার হাতের রান্ধা, শিরিন আপা, কানিজ আপা আর লীলা আপার মতো মানুষদের ছেড়ে যেতে হবে। এই মানুষগুলো আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষদের মাঝে পড়ে। আমার বাইরের স্বভাব চরিত্র জানার পরও তারা কত স্নেহ ভালোবাসায় আগলে রাখল আমাকে! পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে যারা আমাদের বাজে স্বভাব জেনেও ভালোবাসে। এই কম মানুষদের আমি পেয়েও হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। এই ক্ষতিটা এই জীবোনে পুষিয়ে নিতে পারব না মামা।

বিয়ে তো করতে হইবোই আপা। মেয়ে মানুষের এর হাত থেইকা নিস্তার নাই তো।

– মামা, আপনি ভান করে কতক্ষণ হাসতে পারবেন? ভান করে কতক্ষণ ভালো থাকতে পারবেন? বড়জোর এক সপ্তাহ, এক মাস কিংবা এক বছর। এর বেশি পারবেন না। বিয়ের পর আমাকে যে গোটা জীবনটাই ভান ধরে কাটাতে হবে সেটা আমি জানি। এই ভান ধরার খেলায় স্বামী নামের নির্দোষ মানুষটাকে ঠকানো হবে মামা, এটা ভেবেই খারাপ লাগছে আরো বেশি। তবে তবুও বিয়েটা করতেই হবে, আব্বা-আম্মাকে কথা দিয়ে ফেলেছি।

ভানটা কিসের আপা?

-বছর পাঁচেক আগে যে ছেলেটাকে প্রথমবার ভালোবাসলাম তার কাছে বারবার নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম সবটা দিয়ে । ভালোবাসার মানুষ প্রতারণা জানে না, ঠকাতে জানে না, এই সরল বিশ্বাস ঐ ছোট্ট বয়সে ঐ ছেলেটাই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বছর না পেরোতেই সে জাপান চলে গেল, ওখানেই পরে বিয়ে করল। তারপর তো কতজনকে নিয়ে খেললাম। নিজেকে বাজারি মেয়ে মনে হয় আজকাল, বড্ড সস্তা মনে হয়। এই বোধটুকু যেদিন হলো সেদিন থেকে আমি ভালো নেই, ভালো থাকা ভুলে গেছি।

হাসান মামা খেয়াল করে দেখলেন কেয়ার হাতের সিগারেট ছাই হয়ে চলেছে, কেয়ার মন অন্য কোথাও। কাপের বাকি চা টুকুনও এতক্ষণে জুড়িয়ে এসেছে। হাসান মামা কী বলবে সে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

কেয়া সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে বলল, রান্নাঘরে দুটো ব্যাগ আছে। নিয়ে আসেন ব্যাগ দুটো, ঘন্টাখানেক পর ফ্রেন্ডের গাড়ি আসবে। আসলে গাবতলী চলে যাব, ওখান থেকে বাসে করে বরিশাল। আপনি শিরিন আপা, কানিজ আপাকে বুঝিয়ে বলবেন একটু।

একটু পরেই চলে যাবেন? আর আসবেন না আপা? কাউরে কিচ্ছু না বলেই চলে যাবেন?

কেয়ার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, চোখ দুটো হয়তো লাল হয়ে এসেছে। কেয়া হাতের তালুতে চোখ মুছে নিয়ে বলল, না মামা, কাউকে কিছু বলতে পারব না আমি। এতগুলো মানুষকে কাঁদতে দেখলে আমি বরিশাল যেতে পারব না, আমার পা এই লীলা বোর্ডিং এ আটকে থাকবে। ওদের হাসিমুখ দেখে সকাল শুরু হয়েছে, হাজারখানেক রাত কেটেছে, হুট করেই ওদের কালো মুখ, চোখের পানি সহ্য করতে পারব না।

হাসান মামার চোখ দুটো পানিতে চিকচিক করছে, গলাটা কেমন যেন ধরে এসেছে। হাসান মামা ধরা গলায় বলল, আপনে চইলা গেলা কাউরে আর গেট খুইলা বলতে পারমু না “মনু ডাইলে লবণ দেছো নাকি দিবা?”। তাই না আপা?

কেয়া উত্তর দেয় না, মাথাটা গুঁজে নেয়। চাঁদের আবছা আলো এসে পড়েছে লীলা বোর্ডিং এ, সেই আলোয় কেয়ার ফ্যাকাসে মুখখানা আজ বড্ড অস্পষ্ট । হাসান মামা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, কেয়ার মুখখানা সহ্য করার শক্তিটুকু হুট করেই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।

পেটে চর্বি জমে যাওয়ায় আজকাল শ্রাবণী ভোর সকালে চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে হাঁটতে বেরোয়, সঙ্গে শায়লাও যায়। ভোরের ফুরফুরে বাতাসের দুজন দ্রুত কদমে হেঁটে চলেছে ফুটপাত দিয়ে, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও হাতেগোনা। শ্রাবণী হাঁটতে হাঁটতে বলল, কাল ঐ খাইরুল সাহেবের বাড়িতে ফ্রেমের ঐ ছবি দেখে কিন্তু যে কেউ ভাববে ওটা তুমি, তাই না আপু?

-হ্যাঁ, আমি নিজেই অবাক। একদম আমি। ভাগ্যিস ওটা আমি না,খাইরুল সাহেবের মৃত স্ত্রী। আমি হলে মরে ভূত হয়ে এখন ঘুরে বেড়াতে হতো।

হা হা হা। তবে আপু, ভদ্রলোক কিন্তু খুব ভালো মানুষ, মৃত স্ত্রীকে এখনো কত ভালোবাসে!

-হ্যাঁ তা যায়৷ উনি ভালো মানুষ, এমন ভালো মানুষ আমি কমই দেখেছি। আচ্ছা শ্রাবণী, কাল দেখলাম শাওন নামে সেভ করা একটা নম্বর থেকে ত্রিশটা মিসড কল! ওটা কি সেই শাওন?

হ্যাঁ আপু, আমি ওরে পাত্তা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি তো মেলা আগেই, এখন সে নিজেই ফোন দেয়, কুয়ারা করে৷ গুলি মারি তোর প্রেমের মুখে, দরকার নাই তোর প্রেমের। এখন একটাই চিন্তা, ক্যারিয়ার ফার্স্ট, তারপর অন্যসব।

শায়লা মনেমনে বেশ হাসে, প্রশান্তির হাসি। স্রেফ দুটো দিনেই শায়লা অদ্ভুতভাবে শ্রাবণীকে বদলে দিল। শ্রাবণী এখন রাত জেগে পড়ছে, মুভি দেখছে, নিয়ম করে ঘুমাচ্ছে৷ এখন কেবল নিজেকে কীভাবে ভালো রাখা যায় সেটা নিয়েই ভাবছে! সবকিছু কত স্বচ্ছ!

সকাল দশটা বেজে গেলেও শিরিন আপা আজ আর কলেজের দিকে যায়নি। লীলা বোর্ডিং এর আজ মন খারাপ, সবকিছু থমথমে হয়ে আছে। হাসান মামা কানিজ, শিরিন আপাকে সবিস্তারে সব কিছু বর্ননা করেছে গতরাতের। কানিজ এই বোর্ডিং এর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত কেয়াকে, মেয়েটা ভালোবাসা আদায় করে নিতে জানে বলেই। কানিজ কেয়াকে বেশ কবার ফোন করে, কেয়ার ফোন সুইচ অফ৷ শিরিন আপা বাইরে বাইরে শক্ত হলেও ভেতরে তুলোর মতো নরম। কেয়ার এভাবে হুট করে চলে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারেন না। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে কলেজে না যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করেন বলেই আজ বোর্ডিং এ থেকে গেছেন কলেজ টাইমে।

রুবাইয়া, জান্নাত, শ্রাবণীরা মন খারাপ করে বসে আছে। পাঁচমিশালী সবজি, গরম পরোটা ঠান্ডা হয়ে আসে, কেউই ছুঁয়ে দেখে না৷ শায়লা ঝটপট দুটো পরোটা খেয়ে বেরিয়ে যায় ডে-কেয়ারের উদ্দেশ্যে। মানুষের হারিয়ে যাওয়া তো দূরে থাক, মানুষের মৃত্যুও টলাতে পারে না শায়লাকে। সে খবর বোর্ডিং এর কেউ তো এখনো জানতেই পারেনি, আর না জানতে পেরেছে খাইরুল সাহেব।

ডে-কেয়ারের সামনে রিক্সা থেকে নামতেই শায়লার দিকে অনেকটা দৌঁড়ানোর ভঙ্গিতে ছুটে এলো এক চল্লিশ ছুঁই ছুঁই পুরুষ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এই পলি! কিরাম আছির রে মনি? তোরে কতদিন পর দেখলাম! মামা বাড়ি থেকে পলাই আসলি কেন রে?

শায়লা কপাল কুঁচকে বলল, কে পলি? আপনার ভুল হচ্ছে ভাই, আমি শায়লা।

-এই মনি! ইয়ারকি করিস নে, তুই আমাগের পলি। আর আমি তোর সিরাজ মামা, আমারে ভাই ডাকিস কেন রে?

শায়লা হেসে বলল, আহ ভাই! আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও, আমি শায়লা। পলি নামের কাউকে চিনিই না আমি।

শায়লা খামাখা সময় নষ্ট ভেবে ডে-কেয়ারে ঢুকে গেল। অপরিচিত লোকটা খানিক্ষন, পলি পলি বলে ডেকে গেলেও শায়লা ফিরে এলো না আর।

সকাল থেকেই শিরিন আপার মন ভালো ছিল না। সন্ধ্যার দিকে মন খারাপের সাথে সাথে কৌতূহল জাগছে অন্য একটা বিষয়ে। মন খারাপ ছাপিয়ে এখন কৌতূহলটায় যেন বেশি করে পেয়ে বসেছে শিরিন আপার। সাকিব ফোন করে জানিয়েছে সাকিবের একটা বড় কোম্পানিতে মোটা বেতনের চাকরি জুটেছে। জয়েনিং লেটারের খামে বড়বড় অক্ষরে লেখা “From Shirin “। সাকিব, জুঁই দুজনেই খুশিতে আটখান এমন সুযোগ পেয়ে। শিরিন আপার মাথায় ঢুকছে না কে এই কাজটা করল তার নামে।

চলবে…..

লেখকঃ Borhan uddin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে