#লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
খন্ডঃ০৬
একটা মেয়ের গায়ের রঙ বিচ্ছিরি রকমের কালো, মাথায় চুল নেই বললেই চলে, বকের মতো লম্বা হাত-পা। এই জিনিসটাকে আগে অভিশাপ মনে হত, আজকাল এটাকেই আশীর্বাদ মনে হয়। তোমার কখনো এমন মনে হয়েছে আপু?
কানিজ কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে রেখে তীক্ষ্ণভাবে রুবাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, না কখনো মনে হয়নি। মেয়ে মানুষের গায়ের রঙ সাদা না, লম্বা চুল নেই, কোমলতা নেই – বরং এগুলোকেই একটা মেয়ের জন্য অভিশাপ মনে হয়।
রুবাইয়া প্লেটে থাকা শেষ বিস্কুটটা মুখে পুরে দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বলল, কালা গায়ের রঙ, রুক্ষতা আমার জন্য আশীর্বাদেরই। পানির পট কোথায় রেখেছ?।
-খাটের নিচে আছে দেখ।
রুবাইয়া ঢকঢক করে পটের অর্ধেক পানি খেয়ে নিয়ে ডান হাতের কনুইতে মুখটা মুছে নিয়ে বলল, এইযে মন্ত্রীরা পার্টির সুন্দরী মেয়েরদের রাতে ডেকে নিয়ে যায়, কখনো আমার মতো কালো, কুৎসিত মেয়েদের যেতে দেখিনি জানো। একটা মেয়ের ইজ্জত তার গায়ের রঙের জন্য বেঁচে যাচ্ছে, এটাকে আশীর্বাদ ছাড়া কী বলব বলো।
– বিয়ের বাজারে এটাই আবার অভিশাপ। যাবি কোনদিকে?
তা ঠিক বলেছ। যাবার জায়গা নেই বলেই এই উদ্ভট গ্রহে পুতুল হয়ে বসে আছি।
-তুই কিন্তু বেশ সুন্দর করে কথা বলিস, জানিস এটা?
রুপের ক্ষতিপূরণ দিতে মিছে সান্ত্বনা দিচ্ছো না তো?
– হা হা, তা না রে বোকা। সত্যিই বললাম। আচ্ছা এসব ছাড়। একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?
কী?
-শায়লা আপু ইদানীং কিন্তু একদম শুদ্ধভাবে কথা বলছে! কোনো আঞ্চলিকতা নেই আগের মতো।
না, এটা খেয়াল করিনি। তবে আমি খেয়াল করেছি উনি প্রায় ওয়াশরুমে, ছাদে যেয়ে কাঁদেন। আমাদের সামনে যখন আসেন তখন হাসিখুশি, তবে কান্নার রেশটা চোখে থেকে যায়। খেয়াল করেছ এটা?
– না তো, এবার থেকে তবে খেয়াল করতে হয় যে। আসলে আমি লক্ষ্য করেছি, উনি কেমন যেন মেকি হাসি হাসেন, জোর করে নিজেকে পরিপাটি রাখার অভিনয় করেন। তবে উনার মন ভালো, নির্জলা জলের মতো মন উনার।
তা হতে পারে। আচ্ছা আপু, শ্রাবণী আজকাল কম কাঁদছে মনে হচ্ছে, ওকে তো ইদানীং কাঁদতেই দেখি না। হা হা।
-শায়লা আপুর সাথে ইদানীং তার বেশ খাতির হয়েছে। আমরা যেটা বছরখানেক ধরে পারিনি, শায়লা আপু সেটা পেরেছে। শ্রাবণী হুট করেই যেন খুব প্র্যাক্টিক্যাল হয়ে উঠেছে। ঐ দেখ, কীভাবে এই গরমের ভেতর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে!
তাই তো দেখছি। যাক, ওর এই বদলে যাওয়া দরকার ছিল। আচ্ছা থাকো, ঘুমাতে যাই। রাত হলো।
সকাল সাতটার দিকে কে যেন বেশ খানিকক্ষণ ধরে গেটে নক করে চলেছে। এত সকালে লীলা বোর্ডিং এ কেউ আসে না বলেই হাসান মামা বেলা নয়টা অবধি নাক ডেকে ঘুমান। হাসান মাম বেশ বিরক্ত হয়েই গেট খুললেন৷ পঁচিশ-ছাব্বিশে পা দেয়া এক যুবক নির্ঘুম লাল চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। হাসান মামা হাই তুলতে তুলতে বললেন, কার কাছে আইছেন? কারে চান?
-শিরিন আপা আমাকে আসতে বলেছিলেন।
শিরিন আপার নাম শুনতেই হাসান মামা খানিকটা সিরিয়াস হয়ে বললেন, আচ্ছা আপনি দাঁড়ান, আমি আপাকে জিজ্ঞেস করে আসি৷
হাসান মামা দ্রুত পায়ে শিরিন আপার ঘরের সামনে এসে নিচু গলায় বললেন, আপা, আপনি কাউরে আসতে বলছিলেন?
ঘরের ভেতর থেকে শিরিন আপা জোর গলায় বলে, হ্যাঁ বলেছিলাম৷ সাকিব নামের একটা ছেলের আসার কথা, সে আসছে নাকি?
-জ্বি আপা একটা ছেলে আসছে, তবে নাম জিজ্ঞেস করি নাই।
আচ্ছা, সাকিব আসলে তাকে গেস্ট রুমে বসতে দেন।
সাকিব গেস্ট রুমে এসে বসেছে, জুঁই সাকিবকে সঙ্গ দিতে গেস্ট রুমে এসে বসেছিল। শিরিন আপার ডাকে জুঁই মিনিট কুডি আগে শিরিন আপার রুমে গিয়েছে, রুম থেকে বের হবার নামগন্ধও নেই। দেয়ালে দুটো পেটমোটা টিকটিকি কী নিয়ে যেন ঝগড়া করে চলেছে, সাকিব মনোযোগের সাথে ওদের ঝগড়া দেখে চলেছে।
জুঁইয়ের সাথে মোনা গেস্ট রুমে ফিরেছে মস্ত বড় দুটো ট্রে নিয়ে। ট্রেতে গরম পরাটা, মুরগির কষা ঝাল মাংসা, ডিম ভাজা, সেমাই, পাকা আম আর এক গ্লাস দুধ। সাকিব গতকাল রাত থেকেই না খাওয়া, মেসের তরকারি বাসি হয়ে যাওয়ায় রাগ করে আর কিছুই মুখে দেয়নি। এত খাবার সাত সকালে সামনে দেখে সাকিবের ইচ্ছে করছে খপ করেই পরাটা ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করতে। সম্মানের দিকে তাকিয়ে সেটাও সম্ভব না।
শিরিন আপা রুমে ঢুকতেই জুঁই আর মোনা বেরিয়ে গেল। শিরিন আপা হয়তো আগে থেকেই জুঁইকে বলেছিলেন সাকিবের সাথে তিনি একা কথা বলতে চান। সাকিবের নার্ভাসনেস বাড়তে শুরু করেছে।
শিরিন আপা সোফায় বসতে বসতে বললেন, কেমন আছো এসব ফর্মাল কোয়েশ্চেন করব না। আমি শেষ কবে চুলোর কাছে গিয়েছি মনে পড়ে না, নিজের চা টা পর্যন্ত মিনু আপা করে দেন। তোমার জন্য সব নিজের হাতে করেছি সেই ফজরের আযানে উঠেই। নাও, খাওয়া শুরু করো।
সাকিব বেশ অপ্রস্তুত হয়ে আছে, খাবে কি খাবে না, কিংবা শিরিন আপাকেও খেতে বলবে কি না সেই সাহস করে উঠতে পারে না।
শিরিন আপা মেকি হাসি হেসে বললেন, আরে খাও তো, এত অপ্রস্তুত হতে হবে না। তুমি খাও, আমি জুঁইদের সাথে খাব পরে।
সাকিব বেশ দ্বিধাদ্বন্দের পর খাওয়া শুরু করেছে। একটু একটু করে পরাটা ছিঁড়ে মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে খেতে শুরু করেছে।
শিরিন আপা খানিকক্ষণ সময় নিয়ে সাকিবের খাওয়া দেখলেন। সাকিবের খাওয়া এখন মাঝপর্যায়ে। এই সময়ের অপেক্ষ করছিলেন তিনি। কৃত্রিম কাশি দিয়ে শিরিন আপা বললেন, তোমাদের সম্পর্কটা অনেকদিনের। অনেক স্মৃতি আছে তোমাদের। তুমি বিসিএসটা হয়ে গেলেই জুঁইকে বিয়ে করে নেবে এমন আশ্বাস দিয়েছ, তাই না?
সাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল।
তোমাকে তেতো কিছু কথা বলি সাকিব, যা খুব শক্ত ধরনের সত্য। আমরা মানুষেরা দ্রুত বদলে যাবার ক্ষমতা রাখি। তুমি একটা চাকরির আশা দেখিয়ে জুঁইকে ধরে রেখেছ কিংবা সে তোমার একটা চাকরির আশায় ধৈর্য ধরে আছে। ধরো তোমার কোনো ভালো চাকরিই হলো না আগামী দু তিন বছর, তখন? জুঁইয়ের বিবর্ণ হওয়া যৌবনে তোমার হাতে টাকা, চাকরি আসার সময়ে তোমার তো তাকে ভালো লাগতে নাও পারে। শেষমেশ মেয়েটাকে ধুনফুন বুঝিয়ে কিংবা ছুঁড়ে ফেলে বাবা মায়ের পছন্দে যৌবনের রঙে টইটম্বুর হওয়া কাউকে বিয়ে করে নিলে। জুঁইটা তখন যাবে কোথায়?
সাকিব পরাটা আর চাবাতে পারে না, গিলে নেয়। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমরা একসাথে তিনবছর ধরে আছি আপা। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারি না। পারবোও না।
– আমরা বর্তমানে অনেক কিছুই পারি না সাকিব। আমাদের কাছে আজ যা খুব দরকারী, কাল তা সস্তা হয়ে উঠতেই পারে। জগতের সব নেশাই মানুষ একজীবন ধরে করে যায়। মদখোরের মদের নেশা, সিগারেটখোরের সিগারেটের নেশা একজীবন ধরে থেকে গেলেও টেস্ট বদলায়, ব্র্যান্ড বদলায়। মেয়ে মানুষের রুপের নেশাটাও পুরুষের বেশিদিন থাকে না , বদলে নিতে চায় পুরুষেরা। হোক সেটা জানিয়ে কিংবা গোপনে। রুপের নেশা খুব কাছে গেলেই ফিকে হয় যায়, অরুচি ধরে। তবে হ্যাঁ সম্পর্ক টিকে থাকে অন্য কিছুর জোরে, সেটা খুব দামী, সবার থাকে না।
সাকিব মাথা উঁচু করে থেমে থেমে বলল, জুঁইয়ের ফর্সা গায়ের রঙ, ভরাট শরীরের চাইতে জুঁইয়ের ভেতরের মানুষটা, সঙ্গীর দুঃসময়ে পাশে থাকা, ধৈর্য, আপোষহীন ভালোবাসার দাম আমার কাছে বেশি আপা। এই জিনিস হারাবার দুঃসাহস আমার নেই।
– তোমার আব্বাকে ঢাকায় আসতে বলো, এই সপ্তাহে। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।
সাকিব এবার বেশ ঘাবড়ে গেল, খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আব্বার আমাকে নিয়ে অনেক আশা, এখন এসব জানলে ভাববে তাদের কষ্টের চেয়ে, তাদের স্বপ্নের চেয়ে একটা মেয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তারা কখনোই জুঁইকে বিচার করতে পারবে না।
– সেটা আমি দেখব। তোমার আব্বাই খুশি হবেন, তিনি ভুল বুঝবেন না। আমার উপর ভরসা রাখো। এই সপ্তাহেই আসতে বলো, বলবে তো?
সাকিব সেমাইয়ের বাটিতে বেশ কয়েকবার চামচটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল, আচ্ছা বলব আসতে।
– সব দায় আমার। চিন্তো করো না। জুঁইয়ের মামারা বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে তার বাবাকে, জুঁইয়ের বাবার অবস্থাও তেমন ভালো না।
সাকিব হুট করেই ধাক্কা খায়, শিরিন আপার দিকে ভয় নিয়ে তাকায়।
– তুমি কিছু ভেবো না। আমি আছি তো। ভালোবাসার লাল দাগে বাতাস স্তব্ধ হয়, কলমে কাঁপুনি ধরে, গোল চাঁদটা ফিকে হয় আর গোটা দুনিয়াকে পানসে লাগে। আমি এই সূত্র বেশ জানি, জুঁইকে আমার মেয়ের মতো দেখি। ওর এক চিমটি অপমান, কষ্ট আমি মেনে নিতে পারব না। ওর জন্য বোর্ডিং এর খাবার খরচ কমিয়ে এনেছি, যাতে ওর টাকা দিতে সমস্যা না হয়। আমি চাইলে ওর কাছ থেকে হাজার খানেক কিংবা পুরো টাকাটাই ছাড় দিতে পারতাম। দেইনি৷ কেননা মেয়েদের আত্নসম্মান নিয়ে বাঁচাটা জরুরি, করুণা নয়৷ করুণায় মেয়েরা দাসী হয়ে ওঠে, মানুষ না।
সাকিব সম্মান, শ্রদ্ধায় মাথা নত করে বলল, আমি জুঁইয়ের চাইতেও আপনার সম্মানের কথা আগে ভাবব আপা। কোনো ভুল হবে না।
শিরিন আপা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সব খেয়ে যাবে, রাখবে না কিছু। আর হ্যাঁ, সারা রাত জাগবে না, ঘুমাবেও। রাত জাগা নির্ঘুম চোখ চিনি আমি, আয়নায় দেখি তো প্রায়ই। বাবাকে নিয়ে এসো, দুপুরে একসাথে খাব আমরা।
শ্রাবণীকে নিয়ে খাইরুল সাহেবের বাড়ি এসেছে শায়লা। খাইরুল সাহেব দরজা খুলেই প্রশস্ত হাসি হেসে বললেন, আমি জানতাম তুমি আসবেই! উনি কে? শ্রাবণী না?
-হ্যাঁ শ্রাবণীই।
আসো আসো ভিতরে আসো।
মস্ত বড় বাড়িতে কোনো মানুষের বালাই নেই এক খাইরুল সাহেব ছাড়া। শ্রাবণী ফিসফিস করে শায়লাকে বলল, উনি আমাকে চেনে কীভাবে?
-আমি তোমার কথা আগেই বলেছিলাম।
উনি কে আপু?
-আমি যেই ডে-কেয়ারে কাজ করি উনি সেটার মালিক। চলো কিচেনের দিকে যাই৷
খাইরুল সাহেব বিরিয়ানি রান্নার সব মাল-মশলা কিচেনে রেখে দিয়েছেন গত রাতেই। শায়লা আলু কাটতে ব্যস্ত আর শ্রাবণী সমস্ত বাড়ি ঘুরে দেখছিল। হুট করেই শ্রাবণীর চোখ যায় একটা ফটো ফ্রেমের দিকে। শ্রাবণী কিচেন থেকে শায়লাকে জোর করেই টেনে এনে ছবিটার সামনে দাঁড় করায়। শায়লা অবাক হয়ে একবার ছবিটার দিকে তাকায় আরেকবার শ্রাবণীর দিকে। শ্রাবণী বিস্ময় নিয়ে শায়লাকে জিজ্ঞেস করে, উনি কে আপু?
লেখকঃBorhan uddin