লীলা_বোর্ডিং_১২১৫
খন্ডঃ০২
লেখকঃBorhan uddin
আপু, আমরা কেবল চারটা মেয়ে যাচ্ছি একটা ছেলের বিয়ে ভাঙতে, ব্যাপারটা খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে না? ঝামেলায় পড়ব এই তো বোঝা যাচ্ছেই।
কানিজ শ্রাবণীর কথার জবাবে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দেয় শ্রাবণীর এমন ভীরুতায় সে যারপরনাই বিরক্ত। পেছনের সিট থেকে কেয়া বলল, এই মাইয়্যা, তুই আরেকবার পটরপটর করলে লাত্থি দিয়া গাড়ি দিয়া হালাই দিমু। পেরেম করবা, মজা নিবা, বিয়ার বেলায় অন্য মাইয়্যা! হালার পুতের বিয়ার শখ জম্মের মতো মিটাই দিমু।
রুবাইয়া হো হো করে হেসে উঠে বলল, আল্লাহ! কার মুখে কী শুনি! তুই যে এতগুলো ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলি আর বিয়ের সময় অন্য ছেলেকে বিয়ে করবি সেটার বেলায়? কসাইর মুখে পশুপ্রেম মানায় না।
রুবাইয়ার এমন তীর্যক উত্তরে কেয়া আর কিছু বলতে পারে না। শ্রাবণী কেবল ঘাড় ঘুরিয়ে কেয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। কেয়া মুখ ঝামটি দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে দেয়৷
গাড়ি নরসিংদী পেরিয়ে ভৈরবের দিকে ঘন্টায় সত্তর কিলোমিটার বেগে চলেছে। বিরামহীনভাবে একই গান বেজে চলেছে,” আই ডোন্ট কেয়ার আ্যট অল….”। রুবাইয়া কেয়ার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, কেয়াও ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগে। শ্রাবণী খেয়াল করল কানিজ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে, কানিজের তালের শাসের মতো মস্ত বড় চোখ দুটো মুহূর্তেই লাল হয়ে এসেছে, চিবুক চুঁয়ে চোখের জল যেন বৃষ্টির পানির মতো ক্লান্তহীনভাবে গড়িয়ে পড়ছে। শ্রাবণী সাহস করে কানিজের বাঁ চোখের পানি মুছে দিতেই কানিজ দাঁতে দাঁত চিপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শ্রাবণী অসহায়ের মতো বলে, আপু গাড়িটা থামাও। না, কানিজ গাড়ি থামায় না, উল্টো গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। শ্রাবণী এবার আবদারের স্বরে বলে, আপু কেঁদো না প্লিজ, ভাইয়ার বিয়ে আমরা হতে দেব না দেখো।
কানিজ চোখ পাকিয়ে বলল, ঐ জানোয়ারের জন্য আমি কাঁদছি না। বেশি বুঝবি না, পাকনামি করলে থাপ্পড় খাবি। শ্রাবণী আর কিছু বলার সাহস করে না। লীলা বোর্ডিং এর সবার চেয়ে বয়সে ছোটো শ্রাবণী , কেবল অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। শাসন, আদরের ভাগের সবটাই তাই শ্রাবণীর কপালে জোটে৷ কেয়া, রুবাইয়া, শিরিন কিংবা কানিজ প্রায় তাকে এটা সেটা কিনে এনে দেয়, অসুস্থায় সবাই পাশে থেকে সুস্থ করে তোলে, ঐ স্নেহের খাতিরেই। শ্রাবণী ওদের স্নেহের গভীরতা বোঝে বলেই শাসনগুলোকে মাথা পেতে মেনে নেয়৷
খানিকক্ষণ পর কানিজ বাঁ হাতের তালুতে চোখ মুছে নিয়ে বলল, আমার মা লিভ টুগেদার করছে বাবার বিজনেস পার্টনারের সাথে, আর বাবা? সে লিভ টুগেদার করছে অন্য এক মহিলার সাথে। আমি তাদের বাচ্চা, তাদের অংশ, অথচ আমি কোথাও নেই! এইযে তোরা আমার সামনে তোদের মাকে ফোন দিয়ে বুক ভরে মা বলে ডাকিস আমার কতটা কষ্ট হয় জানিস! আমি গত চারটা বছর ধরে কাউকে বুক ভরে মা ডাকতে পারি না, বাবা ডাকতে পারি না৷ তোরা ছুটিতে বাড়ি যাস, ঈদ করিস, আমিও তোদের সাথে বেরোই, ব্যাগ গুছাই৷ সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে আবার লীলা বোর্ডিং এ চলে যাই, ওখানেই আমার ঈদ হয়, ওখানেই আমার ছুটি কাটে আর তোদের অপেক্ষায় থাকি। বাবা-মা মরে গেলে নিজেকে এতিম বলে বুঝ দেয়া যায়, বাবা-মা বেঁচে থেকেও নেই, এর বুঝ কীভাবে দিতে হয় রে? মায়ের গায়ের গন্ধটা ভুলে গেছি, বাবা বাসায় ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, “মাই প্রিন্সেস”!, কেউ আর আমাকে এখন জড়িয়ে ধরে বলে না, ” মাই প্রিন্সেস”৷ মাঝেমধ্যে খুব একা লাগে, খুব তুচ্ছ মনে হয় তখন চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি বেরিয়ে আসে এই যা।
কানিজ শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে দেখল, শ্রাবণী নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। কানিজ খানিকটা ধমকের সুরেই বলল, এই তুই কাঁদিস কেন? থাপ্পড় খাবি, চোখ মোছ। শ্রাবণী চোখ মোছে না, গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে । কানিজ এবার আদুরে গলায় বলে, কাঁদিস না রে সোনা, আমার খারাপ লাগবে তুই কাঁদলে। চোখ মোছ। শ্রাবণী চোখ মুছতে মুছতে বলল, তুমি এতদিন বলো নি কেন আপু?
এইযে তোকে আজ বলে দিলাম, এই তুই একদিন কথার ছলে আমার বাবা-মায়ের চরিত্র টেনে কথা বলবি, আমাকে আঘাত করার সুযোগ পেয়ে গেলি। তুই আমার নরম জায়গায় আঘাত করলে আমি সইতে পারব না, ভেঙে পড়ব৷ এটা ভেবেই কাউকে কখনো কিছু বলি না। আমার কষ্ট,ব্যথা, অভিমান সব আমারই থাকুক৷
শ্রাবণী অভিমানী গলায় বলল, তুমি আমাকে এমন ভাবো আপু? আমি এমন করব না কখনো।
কানিজ ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, আহ! ওটা তো উদাহরণ দিলাম রে বোকা। ওদের ডেকে তোল, ঐ যে রেস্টুরেন্টে দেখা যায়,খিদে লেগেছে।
ভৈরবের এই ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁর নাইট কোচের প্রায় সব বাস এসে থেমেছে। রাত একটাতেও দিনের মতো ভীড়, শোরগোল লেগে আছে। খুব পরিপাটি আর অভিজাত এই রেস্তোরাঁর এক কোণে বসেছে কানিজরা। ওরা কফি আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার দিয়েছে কেবল। কেয়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুল একপাশে ছেড়ে দিয়েছে, মুখ থেকে পানি টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে। রেস্তোরাঁর চোখ ধাধানো আলোতে কেয়ার মুখে লেগে থাকা ফোটা ফোটা পানির বিন্দুগুলোকে মুক্তোর মতো দেখতে লাগছে। কেয়া টের পাচ্ছে আশাপাশের টেবিলের পুরুষদের কেউ কেউ আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে আবার কেউ কেউ একবারে হা করেই। কেয়া এই ব্যাপারগুলো খুব উপভোগ করে। কেয়া টেবিলে বসতেই রুবাইয়া কপাল কুঁচকে বলল, তুই দেখি একবারে গোসল করে ফেলেছিস! এভাবে কেউ চুল,মুখে পানি দেয়! আনকালচারড কোথাকার।
কেয়া মুখ বাঁকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই কানিজ কেয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আহ রুবাইয়া! এগুলো কী! মানুষজন দেখছে। ঐ যে কফি আসছে, ঝটপট খেয়ে উঠতে হবে।
কানিজের কথায় কেয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে এ যাত্রায় রুবাইয়াকে ছেড়ে দেয়।
কফি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই শেষ হতেই সবাই নিচে গাড়িতে চলে এসেছে। কেয়া এখনো আসেনি। ফোন করলেও কেটে দিয়েছে। মিনিট দুয়েক পর কেয়াকে মুচকি হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেল৷ কানিজ ধমকের সুরেই বলল, কী করছিলি উপরে! তুই এত জ্বালা দিস কেন বল তো?
কেয়া অপরাধীর মতো বলল, ওয়াশরুমে গেছিলাম আপু, সরি।
শ্রাবণী, রুবাইয়া আগে থেকে গাড়িতে উঠে বসে ছিল। কানিজ মেজাজ দেখিয়ে বলল,যা গাড়িতে ওঠ, এমনিই দেরি হয়ে গেছে।
গাড়ি সিলেটের অভিমুখে চলেছে। কেয়া পেছন থেকে বলল, আপু তখন আমি আসলে ওয়াশরুমে যাই নাই । সামনের টেবিলে একটা পোলারে দেখলা না একটা মাইয়্যার মুখে তুইলা স্যুপ খাওইয়া দিচ্ছিল কুয়ারা কইরা? পোলার লগে আমার একুশ দিনের প্রেম আছিল।হালা কিপ্টার কিপ্টা! আমারে খাওয়ানোর সময় নীলক্ষেতের আশি টাকা দামের তেহরী খাওয়াইত! আর ঐ মাইয়্যারে চারশো টাকার স্যুপ! ইটস নট ফেয়ার। দিয়া আইলাম গিট্ট লাগাইয়া।
কানিজ হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুই কোনো আকাম করছিলি। তা কী গিট্টু লাগালি?।
হোনো, আমি যাইয়া ঠাস কইরা টেবিলে বইয়া পড়লাম। ঐ পোলায় তো কোনো কথা বলে না, মাইয়্যাডা আমারে কয়, “এক্সকিউজ মি, এটা আমাদের টেবিল”। মানে টেবিল তার বাপের! মেজাজ তো গেল আরো খারাপ হইয়া, আমি মাইয়ারল কথার উত্তর না দিয়া আসিফরে কইলাম, বাবু! এত হুগাইয়া গেলা ক্যামনে! বউয়ের হাতের রান্ধন ভালো না, না? তুমি আমারে বিয়াডা করলে আজকা দুইডা ভালোমন্দ খাইতে পারতা, বরিশাইল্যা মাইয়াগো হাতের রান্ধার উপরে কোনো রান্ধা আছে? বাপের মন রাখতে কোথাকার কোন ঢেঁকিরে বিয়া করছো আল্লাহই জানে, থাক, তবুও তোমরা সুখে থাকো, আগুন যা জ্বলার আমার বুকেই জ্বলুক,ভালো থাইকো বাবু।
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠল। রুবাইয়া ব্যস্ত গলায় বলল, তারপর কী হলো?
-তারপর আর কী, আমি চুপ কইর্যে উইঠ্যা চইল্যে আইলাম। আগুন তো হালার কপালে জ্বালাই আইলাম। খা স্যুপ ভালো কইর্যে। হালার পো হালা।
কানিজ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, এই শ্রাবণী, কিছু শেখ কেয়ার কাছ থেকে। ঐ ছেলেরে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে আবার ঐ ছেলের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে এলো। আর তুই মেয়ে সারাদিন কাঁদিস শাওন শাওন বলে।
শ্রাবণী ভয় ধরা গলায় বলল, আপু সামনে পুলিশের চেকপোস্ট দেখা যায়, ঐ দেখো।পেছনে আর কোনো গাড়ি নাই, যদি অসভ্যতা করে?
কেয়া পেছন থেকে নিচু গলায় বলল, ব্যাগে ছুরি আছে, কোনো হালায় অসভ্যতা করলে একছের চোখ দুইডা হাতে ধরাই দিমু।
কানিজ গাড়ি স্লো করতে করতে বলল, আহ! আমি দেখছি, রিলাক্স থাক।
দুজন পুলিশ টর্চ মেরে দেখল গাড়িতে চারটে মেয়ে কেবল। বাজখাঁই গলায় এক পুলিশ বলল, কই যাবেন আপনারা? ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে?
-জ্বি, আছে। কানিজ উত্তর দেয়।
অন্য পুলিশ ইশারায় আগেরজনকে কী যেন বলে কানিজকে বলল, গাড়ি থেকে নামেন আপনারা, গাড়ি চেক হবে।
কানিজ যেন প্রস্তুতই ছিল। ফোন বের করে পুলিশের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নেন কথা বলেন।
ফোনের স্ক্রীনে বড়বড় অক্ষরে লেখা “ABBU”, আর স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছে কানিজ। পুলিশ সাথে সাথে সালাম দিয়ে বলল, ম্যাডাম যান আপনারা।
গাড়ি বেশ কিছুদূর আসতেই শ্রাবণী বলল, আপু! অর্থমন্ত্রীর আপনার বাবা!!
কানিজ হি হি করে হেসে বলল, আরে না বোকা, ওটা ফটোশপ। ফোন ধরলে দারোয়ান হাসান মামা আমার বাবা সেজে কথা বলত।
শ্রাবণীরা এবার একসাথে শব্দ করে হেসে উঠল।
ঘন্টা দুয়েক পেরোতেই কানিজরা সিলেটে ঢুকে গেল। একটা ফাঁকা মাঠের কাছে গাড়ি থামিয়ে শ্যালো মেশিনের পানি থেকে তৃষ্ণা মেটাল। তরমুজ খেত থেকে তরমুজ তুলে এনে গাড়িতে এসে তরমুজ কেটে খেয়ে ভোর হবার অপেক্ষায় গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর হলে তারপর ঠিকানা খুঁজে বিয়ে বাড়িতে ঠেলে উঠবে ওরা।
বেলা এগারোটা নাগাদ কানিজের প্রাক্তন প্রেমিক নিয়াজদের বাড়ি খুঁজে পেল কানিজরা। বিশাল বড় বাড়িটা বাহারি রঙের আলোতে ঝলমল করছে দিনের আলোতেও। মস্ত বড় গেট বানানো হয়েছে বাড়ির সামনে, বাড়িতে অনেক মানুষের ভীড়, হিন্দি গান বেজে চলেছে একনাগাড়ে, বাবুর্চিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিশাল ডেকচিতে মাংস কষিয়ে চলছে। শ্রাবণী ভয়ে ভয়ে বলল, আপু, বিয়ে ভাঙতে পারব তো?
রুবাইয়া মিনারেল ওয়াটারের বোতল মুখ থেকে নামিয়ে বলল, বিয়ে ভাঙা তো ডালভাতের ব্যাপার, তুই বললে তোর সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দিতে পারব। ফোন দিয়েছি পার্টির জেলা পর্যায়ের নেতারা এসে পড়বে আধাঘন্টার ভেতর, পুলিশও আসছে। বাকি কাজ আপু আর আমরা করব।
শ্রাবণী রুবাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ভয় করছে আপু।
কেয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, হায়রে কপাল! বিলাইয়ের মতো মিউমিউ করলে একটা লাত্থি খাবি মাইয়্যা, আপু যখন বলবে ঐ পোলা আপুর সাথে বাটপারি করছে তহন মরা বাড়ির লাহান কান্দা শুরু করবি তুই, পারবি না?
কানিজ কেয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আহ! খামাখা ওকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন? নারে শ্রাবণী, তোর কাঁদতে হবে না। কাঁদবে তো নিয়াজ, আমরা গরুর ঝাল মাংস,খাসির রেজালা, মুরগীর রোস্টের রিভিউ দেব আর চুপচাপ বিয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেব।
চলবে