#লাভ_ফাইট
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(কন্ঠ)
#পার্ট৮
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষেধ)
সেদিন শুক্রবারে আমার একটা আশা অন্তত পূরণ হয়েছিলো।বিকালের দিকে হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায় সেদিন।হাল্কা শীতল ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগে।আমি আর ফালাক তাড়াহুড়ো করে ছাদে যাই কাপড় আনতে।ঘরে এসে কাপড় গুলো রাখতে না রাখতেই ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়।আমি ফালাকের দিকে করুণ চোখে তাকাই,,,
” বৃষ্টিতে ভিজার দরকার নেই।ঠান্ডা জ্বর হলে!”
” আমি ডাক্তার না তুই ডাক্তার?”
” সবে মেডিকেলে পা দিয়েছো।এমতাবস্থায় নিজেরে গর্বের সহিত ডাক্তার ভাবা বোকামি।”
” তুই বেশি কথা বলিস।”
কথাটা বলেই আমি ওর হাত ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে যাই।ফোনটা ওর হাতে দিয়েই বৃষ্টিতে ভিজতে নেমে পড়ি।ও ছাদের প্রবেশদারে দাঁড়িয়ে আছে।আমি বৃষ্টিতে ভিজছি।চিৎকার করে ওকে বললাম ছবি তুলতে।ও ছবি তুলতে লাগে।হঠাৎই ডাক দিয়ে ইশারায় চুল খুলতে বলে।আমি বলদের মতো চিৎকার দিয়ে বলি,,,
” চুল তো খোলাই।”
ফালাক কপাল চাপড়ায়।আমি মাথায় হাত দিয়ে দেখি খোঁপা করা চুল।কাটা খুলে দিতেই খোঁপা আলগা হয়ে যায়।আমি হাত দিয়ে আলতো করে চুল গুলোকে ছাড়িয়ে নিই।তারপর ফালাক আবার ছবি তোলায় মন দেয়।পার্সোনাল ফটোগ্রাফার। শুধু শুধু কী বিয়ে করেছি? বৃষ্টি আরও তীব্র হচ্ছে।আমি ফালাকের কাছে গিয়ে ফোনটা সিঁড়ির এক কোণে রেখে ফালাককে নিয়ে আসি।
ফালাকের চোখে মুখে খানিক রাগ আর বিরক্তির ছাপ পাই আমি।আমি সেগুলো পাত্তা না দিয়ে লাফাতে লাগি ছাদের ওপর জমে থাকা পানির ওপর।হঠাৎই খেয়াল করি ফালাকের চোখে মুখে রাগ বিরক্তির ছাপ আরও তীব্র হয়েছে।এখনই যেন আমাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেবে।ওর রাগ কেমন আমি জানি।অনেকটা আকষ্মিক ঝড়ের মতো।সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।আমি ভীত বেড়ালের মতো থেমে যাই। আমার আচরণ দেখে ফালাক ফিক করে হেসে দেয়,,,
” থামলে যে!বৃষ্টিতে ভিজবা না?”
” না থাক।”
ভীত কন্ঠে বলি আমি।ও হেসে দিয়ে আমার মতো ছাদে জমে থাকা পানিতে লাফাতে থাকে।আমি অবাক চাহনিতে হেসে দিই।তারপর আমিও ওর সাথে লাফাতে লাগি। খুব ইচ্ছা ছিলো আমার।ফালাকের সঙ্গে এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।ঢাকায় আসার পর প্রতিবারই যখন বৃষ্টি হতো আমি আনমনে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতাম।কবে সেই দিন আসবে।আমি আর ফালাক এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।ওপরওয়ালা অবশেষে আমার ইচ্ছাটা পূরণ করেই দিলেন।ছাদে থাকা গাছগুলো থেকে একটা অলকানন্দা ফুল ছিড়ে এনে ফালাক আমার কানে গুজে দেয়।আলতো করে চিবুকে ধরে হেসে বলে,,
” ফুলের সাথে আগাছা।”
আমার মুখ মলিন হয়ে যায়।অভিমানী কন্ঠে বলি,,,
“আমায় আগাছা বললা?”
ফালাক আবার কপাল চাপড়ায়,,
” আমি তোমায় আগাছা বলতে যাবো কোন দুঃখে?”
“ওইযে,তিনবেলা নুডলস ঠেলি।এই দুঃখে!”
“খাইতে খারাপ লাগে না তোমার নুডলসের নতুন নতুন রেসিপি।”
” হইছে তেল দিতে হবে না।”
” তেলই তো দাও।তাই তো আগাছা বললা।”
“ওরে! আমি তোমার কানে গুঁজে থাকা জিনিসটাকে আগাছা বলছি।তুমি তো আমার ফুল। তোমায় আগাছা বলবো কেন?”
” হাউ লুমান্টিক জামাই।”
আহ্লাদী কন্ঠে কথাটা বলেই আমি ফালাককে জড়িয়ে ধরি। আজকের দিনটা যেন ওপর ওয়ালা আমার জন্যই বানিয়েছিলেন।সন্ধ্যার আগ দিয়ে বৃষ্টি থামে আর পশ্মিমাকাশে সুর্য মামা দিনের শেষ দেখা দেওয়ার জন্য ঘন মেঘের পর্দা ঠেলে উঁকি দেন। ঠিক তার বিপরীতে দক্ষিণ পুর্বাকাশে অর্ধ বৃত্তের সাত রঙের রঙধনুর দেখা পাই আমরা।একই দিনে বৃষ্টিবিলাস আর রঙধনু দর্শন।
________
দুজনের ব্যস্ততায় ছোট ছোট খুশীর মুহুর্ত নিয়ে ভালোই যাচ্ছিলো আমারদের টোনাটুনির সংসার।আমার নিঃসঙ্গতা কাটাতে ফালাক আমায় একটা বেড়ালের বাচ্চা এনে দেয়।এনে দেয়ও বলা যায় না।ভাগ্যক্রমে রাস্তায় মুমূর্ষু অবস্থায় পরে থাকতে দেখে ফালাক।মায়া হয় আর বাসায় নিয়ে আসে।ও জানে আমার বিড়াল কত্তটা পছন্দের।বিড়ালের বাচ্চাটার তখনও চোখ ফোটেনি।গায়ে ছিলো অসংখ্য পোকা।নিয়ে আসার তিনদিন পর বাচ্চাটার চোখ ফোটে।ক্যাম্পাস কাছে থাকায় ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এসে ওর যত্ন নিতাম।একদিন ক্লাস করে এসে দেখি কাটনের বাক্সে বসে মায়া ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি গিয়ে আলতো করে ওকে উঠিয়ে নিই।ও মিউ করে ডাক দেয়।বাচ্চাটা আনার পর অলস সময়গুলো আমার ওকে নিয়েই দিব্বি কেটে যায়।যেহেতু বুঝতে পারিনি বাচ্চাটা ছেলে নাকি মেয়ে তাই নাম রাখা নিয়ে বিড়ম্বনায় ছিলাম।অবশেষে আদর করে ওর নাম রাখি ‘বিলাই’।সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস নাম।
চড়ুই পাখির সাইজের বাচ্চাটা ধীরে ধীরে বড় হয়।ওর চাঞ্চল্যতা বাড়ে।বাসায় যতক্ষণ থাকি সর্বক্ষণ সে আমার পেছন পেছন ঘুরে। একদিন ও চেয়ারে জমে থাকা ফালাকের সারাসপ্তাহের কাপড়ের ওপর ও পটি করে দেয়।এমনিতে বিলাই বাথরুমে গিয়ে পি পটি কুরে।ফালাকের সাথে ঝগড়া হয়েছিলো সেদিন।তাই বোধহয় ফালাকের জামায় কাজ সেড়ে নিয়েছিলো সে।কিন্তু সেদিন কি নিয়ে যে বিড়াল প্রাণীটা কিউট হলেও এর পটি অনেক দুর্গন্ধ যুক্ত হয়।ফালাক সেদিন বাসায়ই ছিলো।কি একটা কাজে যেন বাইরে গিয়েছিলো।আমি রান্না ঘরে ছিলাম।ফালাক তো বাইরে এসেই দুর্গন্ধ পায়।গন্ধকে অনুসরণ করে দেখে ওর জামা কাপড়ে বিলাই পটি করে রেখেছে।সে তা দেখেই মুখ চেপে ওয়াশরুমে চলে যায়।বের হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে সে বাসা মাথায় তুলে নেয়।আমি ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বের হই।
” কি হয়েছে।এত চিৎকার চেঁচামেচির কি আছে?”
” চিৎকার চেঁচামেচির কি আছে মানে?তুমি কি নাকে তুলো গুজেছো?গন্ধ পাও না কিছুর?”
আমি লম্বা শ্বাস নিই।মুহুর্তেই আমার চেহারার ভাব ভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে হয়ে যায়।আমি মুখ বাংলার পাঁচের মতো করে বলি,,
” ছি ছি ছি। দুইদিন পরে বাচ্চার বাপ হবে এখনো এমন বিদঘুটে দুর্গন্ধ যুক্ত বায়ু ত্যাগ করো।শেষে সেই দুর্গন্ধে পাগল হয়ে আমায় ডাকো।”
পাশে তাকিয়ে দেখি ফালাক আমার দিকে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।হাত ধরে টানতে টানতে কাপড়ের স্তুপটার পাশে নিয়ে যায়।গন্ধের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।নাক মুখ ছেপে ফালাক আঙুল দিয়ে ইঙ্গিতে কাপড়ের স্তুপের ওপর কিউট বাদরটার কর্মকাণ্ড দেখায়।আমি বিলাইয়ের দোষ ফালাকের ওপর চাপাই।
” আল্লাহ! ফালাক তুমি এই খানে….ছি ছি ছি।ফালাক তুমি কি মীনা কার্টুন দেখো নাই?মীনা বলছে,স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার না করলে আমগো হজ্ঞলের ডায়রিয়া হইতে পারে!”
” দোয়েল দিস ইজ টু মাচ।”
হুংকার দিয়ে বলে ফালাক।আমি শুকনো ঢোক গিলে বলি,,,
” পরিষ্কার করতেছি।চিল্লাইয়ো না।”
” নেক্সট টাইম যদি তোমার পিরিতের বিলাই এই কাজ করে ওরে লাথি দিয়ে বের করে দিবো।”
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বলি না।পরে সুযোগ পেলে ঝাড়বো।
বাথরুমে কাপড় পরিষ্কার করছিলাম।হঠাৎই বিলাই এসে গা ঘেষতে লাগে।যদিও ও আমার কথার কোনো জবাব দেবে না।তারপরও ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগি,,,
” এই কাজ কেন করলি?”
ও ভারী গলায় “মেও মাও মেও মাও” বলে ওঠে।আমি শুনে বলি,,,
” আব্বু আমার সাথে ঝগড়া করেছিলো বলে তুই পটি করে দিবি?এখন তো কষ্ট আমারই হচ্ছে।”
বিলাই আবার মেও মেও আওয়াজ করে। ফালাক আমার কথা শুনে ফেলেছিলো।ও ধমক দিয়ে আমায় বলে,,,
” আমি বিলাইয়ের আব্বু হইলাম কিভাবে?”
” ঠিক যেভাবে আমি আম্মু হলাম।”
” এহ,দুইদিন পর বাচ্চার মা হবে তাও বাচ্চামি যায় না।”
” মা হইছিই তো।বিলাইয়ের মা।আর তুমি বিলাইয়ের বাপ।”
প্রতিটা ওনারের কাছেই তার পেট অর্থাৎ পোষ্য তার সন্তান সমতুল্য। হাজারো মায়া মমতা জড়িয়ে থাকে পোষা প্রাণীটার প্রতি।পোষা প্রাণীর জন্য ভালোবাসা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা।
এ ভালোবাসা অভিমান আছে, খুনসুটি আছে, ভালোলাগা আছে, শুধু নেই আঘাত।
তারা ছেড়ে যায় আয়ু শেষে,তবে বিশ্বাসঘাতকতা করে না! আর বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ সবচে স্বার্থপর প্রাণী।এরা প্রয়োজনে প্রিয়জন বানায়।স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে,প্রয়োজন মিটে গেলে এদের চেনা মুখটা অচেনা হয়ে যায়।
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ