#লাভ_উইথ_মাই_বেটারহাফ
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৫
আমার মা যখন পাশের বাড়ির কাকুর সাথে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে তখন আমার বয়স মাত্র সাত বছর।
সাত বছর হলেও স্পষ্ট মনে আছে সেদিন স্যান্ডো গেঞ্জির সাথে নীল হাফ প্যান্ট পরেছিলাম।
বাবার ইনকাম খুব সীমিত ছিল, মায়ের ইচ্ছে তখন আকাশচুম্বী।গনগনে আগুনের মতোন ছিল আমার মায়ের শরীরের রঙ।রূপের আগুনে যে কাউকে পুড়িয়ে ফেলতো সে।
বাবা সামান্য ব্যবসায়ী। তবে ছিলেন সৎ এবং এক কথার মানুষ। মায়ের সব আবদার মেটাতে হিমশিম খেলেও মুখে হাসি দেখতাম। কিন্তু মা রইলেন না। কারণ দিনের বেলা তার ঘরে পরপুরুষের অগাধ চলাফেরায় একটা ঝামেলা ছিলাম মাত্র।
তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। চারের ঘরের নামতা ভুল করায় মা আমাকে বিবস্ত্র করে গেটের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
আজ পুরো আঠারো বছর পর, আমার মায়ের কিন্তু সেই রূপ নেই। চামড়া কুঁচকে গেছে। মাথায় চুলে সাদা রং।
আশ্চর্য হলেও সেই মা এখন আমার বাবার জন্য কাঁদে৷ বিগত সতেরো বছর সময় ধরেই কাঁদছে সে।
অথচ আমার বাবা বেচারা কতই না কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে চুপচাপ বসে রইল তৃষ্ণা। সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবক সম্পর্কে তার কেউ নয় কিন্তু অনেক কিছু।
একটা সময় তার কাছে টিউশন পড়তো তৃষ্ণা।
ব্যক্তিটার চোখে মুখে আলাদা এক জ্যোতি উপচে পড়ছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তৃষ্ণা বলল,
“রঙ্গান ভাই আমি এসব জানি।”
“তুই কী জানিস আমার নামের মানে কী?”
“তুমি মানেই তো রঙ, রংধনুর সাত রঙ৷ তাই হয়তো তুমি আশেপাশে থাকলে প্রত্যেকটা মানুষ বড্ড সুখী হয়।”
“আরশাদ কেন এমন করছে?তুই তো ওকে ভালোবাসিস৷”
“সোনাতেও খাঁদ পড়ে আর রইল ভালোবাসা….. ”
“সময় দে।”
“ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিয়েছে ও।”
“চাচাজান জানে?আর তোর ভাই?”
“না, কিছু বলিনি।”
“কী করতে চাইছিস?”
“জানি না।”
“আজ কী তোর অফ ডে?”
“টিচারদের অফডে হয় না।আজ সরকারি ছুটি।”
“তোদের ছুটি, আমার কী?আমার তো ভাই ছুটি নেই।রাতে ডিউটি।”
“তোমার কাছে রিভলবার আছে?”
“আছে।”
“সিভিলেও রাখো?”
“নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। কেন?আত্নহত্যা করবি না কী?দেখ ভাই ওসব ন্যাকামো আর না। সেবার কিন্তু বহুত প্যারা দিয়েছিলি।”
“চল তোকে ফুচকা খাওয়াই। তারপর আরশাদের সাথে দেখা করে সব’টা মিটমাট করিয়ে দিয়ে আসবো।তোদের কী যে হয় মাঝেমধ্যে!”
রঙ্গান কথাটা বলে বিল পে করতে উঠে দাঁড়ায়। তৃষ্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বলল,
“এক তরফা কষ্ট পেতে কেন চলে আসো প্রতিটা ডাকে?”
আমি যদি ঘড়ি চিনতে পারতাম,
ঘড়ির জুয়েল বদলাইতাম,
ঘড়ির জুয়েল বদলাইবো
কেমন যাই মিস্ত্রীর কাছে?
মন আমার দেহঘড়ি
সন্ধান করি, কোন মিস্ত্রী বানাইছে……
রঙ্গান যেন নিজের মাঝে নিজেই আস্ত এক দুনিয়া।কারোর কোনো কথা তাকে আঘাত করতে পারে না।কী সুন্দর না জীবনটা?কে বলবে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা রাতভর ডিউটি করে বিশ্রাম না নিয়ে ছুটে এসেছে তার একটা মাত্র কলে!
আপন মনে তখনো গান গেয়েই চলেছে রঙ্গান।গ্রামের বাড়ি একই এলাকার হওয়ায় তাদের পরিবারের সাথে বেশ ভালো সখ্যতা রয়েছে। এমনকি আরশাদ- তৃষ্ণার বিয়েতে দুই পরিবারের কাছে ঘটকের কাজ সে করেছিল।অথচ সচরাচর কেউ কী বুঝে?
সবার জীবনে রঙ লাগানো এই রঙ্গান নামের মানুষটার পুরোটা জীবন রঙহীন।
“দাঁড়িয়েই থাকবি?”
“বাইক এনেছো?”
“না গরুর গাড়ি। চলবে ম্যাম?”
“হুম।”
“মন খারাপ করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হয়তো।”
“তোর কী দাঁতে পোকা?”
“আমি ঠিক আছি। আমাকে হাসাতে এমন লেইম জোক্স বলিয়ো না।”
“আচ্ছা তবে চল।”
নিজে হেলমেট পড়ে একটা এগিয়ে দিলো তৃষ্ণার দিকে।তৃষ্ণা তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে।শুধু মনে মনে ভাবছিল
“এমন একটা মানুষকে স্বপ্ন ফিরিয়ে দিতে পারলো কী করে!”
তৃষ্ণাকে বাসায় না দেখে তেমন একটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনি আরশাদ। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে তাদের আড্ডা স্থানে।
আজ সরকারি ছুটির দিন। তাই পূর্ব প্ল্যান অনুযায়ী ছোটো একটা গেট টুগেদার হবে পাশের পিকনিক স্পটে।
বাসা থেকে বেরিয়ে বাইক নিয়ে প্রথমে আরশাদ চলে গেল ডিলারের কাছে। কচকচে কয়েকটা হাজার টাকার নোট বিনিময়ে নিলো
আরশাদ কোনো জবাব দেয় না। ফোন বের করে বার বার দেখছিল তৃষ্ণা কল দিয়েছে কী না।
কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও তৃষ্ণার কোনো কল এলো না।কিছুটা মন খারাপ হলেও সে নিজেই নিজেকে বলল,
সাত বছরের অভ্যেস সময় তো লাগবে। তৃষ্ণার অভ্যেস ছাড়তে পারলেই সোনালীকে আপন করে নিতে পারবে।
তৃষ্ণার মতো ব্যাকডেটেড মেয়ের সাথে আর যাই হোক বর্তমানে তাল মিলিয়ে চলা যায় না। সবার সাথে চলতে হলে সোনালীর মতোন খোলামেলা মনের মেয়ে প্রয়োজন। বুঝতে দেরি হলেও রাকিব তাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে।
এসব ভেবেই কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো আরশাদ। কারণ সামনে সোনালী তার ভবিষ্যৎ আর তৃষ্ণা প্রাক্তন।
চলবে
#লাভ_উইথ_মাই_বেটারহাফ
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৬
রঙ্গান হাতে একটা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণার সামনে।
তৃষ্ণা নাক সিটকে বলল,
“এসব খেতে তোমার কেমন লাগে ভাই?”
“দারুণ লাগে।”
“ভালো লাগে?”
“হুম। তাইতো বললাম দারুণ লাগে।”
“তুমি কী জানো দারুণ একটা নিনার্থক শব্দ?”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে না বোধক শব্দ হচ্ছে দারুণ। ভালো লাগার ক্ষেত্রে তুমি কখনো দারুণ ব্যবহার করতে পারবে না।করতে হবে খারাপ লাগার ক্ষেত্রে।”
তৃষ্ণার কথা শুনে বুকের কাছটায় আড়াআড়ি ভাবে হাত রেখে কপাল কুঁচকে রঙ্গান বলল,
“তুই প্রফেশনে টিচার। আমি জানি। তাই বলে এমন ছোটো খাটো বিষয়ে ভুল ধরিস না।”
“নিত্য দিনে ব্যবহার করছি।ভুলগুলো না শোধরালে কি হবে?”
“হয়েছে। বুঝেছি, তুমি ভীষণ ভালো কথা বলেছো। হয়েছে এবার থামো।”
“এই তো আবার ভুল বললে। ভীষণ শব্দটাও তো নিনার্থক।”
রঙ্গান হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আমার দাদী। মাফ চাই। হয়েছে। এই আমি মুখ বন্ধ করলাম।আর কিছুই বলবো না।চল তোর বাসায় যাবো।তোর শাশুড়ি মায়ের হাতের কড়া লিকারের দুধ চা খাই না অনেক দিন।”
“চা খাওয়া……..
তৃষ্ণা কথা শেষ করার পূর্বে রঙ্গান ওর মুখে জোর করে হাওয়াই মিঠাই ঠেলে দিয়ে বলল,
” আর একটা কথা বলবি তো ভালোবাসার গুলি দিয়ে এক্ষুণি ক্রসফায়ার করে দিবো।”
আরশাদ নিজের প্রতি নিজের রাগে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে।
সে কী করে এমন ভুল করতে পারলো?
ভুলে ভুলে সে সোনালীকে তৃষ্ণা বলে ডাক দিতে পারলো?
তার মন মস্তিষ্কে তৃষ্ণা ছেয়ে আছে। অবচেতন মন বার বার কেন তৃষ্ণাকে খুঁজছে।
রেস্ট রুমে এসে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আরশাদ।
ফোন হাতে নিয়ে দেখতে পেলো বেলা তখন তিনটে বেজে দশ মিনিট।
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আরশাদ ভাবতে লাগলো
জীবন এর মানে আদৌও কী?
সংসার মানেই বা কী?
ছোটো বেলা থেকে দেখেছে বাবা সারা দিন অফিস থেকে ফিরে এসে প্রথমে মায়ের মুখ দেখতো।
মায়ের যতই কাজ থাকুক না কেন বাবা আসার সময় হলে সে চিরুনিটা টেনে নিয়ে সামনের চুলগুলো আঁচড়ে নিতো।
হাত মুখ ধুয়ে চোখে পড়তো হালকা কাজল।শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিয়ে অপেক্ষা করতো স্বামীর জন্য।
আরশাদের বাবাও যেন কম ছিল না। তিনি সন্তানদের জন্য প্রতিদিন কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। এর কোনো ভুল হয় নি।
চাকরির শেষ দিন অবধি সে তার স্ত্রী সন্তানদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে এসেছেন।
যখন নতুন নতুন কোণ আইসক্রিমগুলো এদেশে এলো তখন তার বাবা তাদের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসার পর কী না কান্ড ঘটিয়েছিল তার মা।
ভেবেছিল কিছুক্ষণ পর খাবে, এদিকে আইসক্রিম গলে বিচ্ছিরি অবস্থা। দুই ছেলে মেয়ের আইসক্রিম খাওয়া তখন শেষ। স্ত্রী খেতে পারেনি বলে তার বাবা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়েছিল।
ভিজে চুপচুপে হয়ে যখন আইসক্রিম হাতে ফিরেছে তখন বাড়ির সবাই প্রায় ঘুমে। পরীক্ষা থাকায় আরশাদ পড়ায় ব্যস্ত ছিল।পানির জন্য উঠে এসে দেখলো
তার মা তার বাবার মাথার চুল নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে,হালকা স্বরে কঠিন দৃষ্টিতে চলছে শাসন।
আর তার বাবা আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়েছে তার মায়ের মুখের সামনে।
তবে কী ওটাই ভালোবাসা, ভালো থাকার টনিক ছিল?
মায়ের গায়ের ঘামে ভেজা গন্ধ,মাছের আঁশটের গন্ধ তো কখনো বাবার কাছে অসহ্য লাগেনি। কখনো মা যদি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেত বাবা তখন নিজ হাতে খাইয়ে দিতো।
তৃষ্ণাও তো ঠিক তার মায়ের মতোন। আরশাদ যখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তখন কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসে। হাতে থাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি।
আরশাদ যে অবধি তার মাথায় হাত না রাখে সে অবধি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
আরশাদ ভালোবেসে সে কাজটা এতদিন করতো।কিন্তু যখন থেকে রাকিব ওদের সাথে মিশতে শুরু করেছে তখন থেকে সে যেন তার তৃষ্ণাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
তৃষ্ণার তৃষ্ণায় আজ জান পরাণ বেরিয়ে যাচ্ছে আরশাদের।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল টের পায়নি।
যখন ঘুম ভাংলো তখন মনে হলো তার সারা শরীর ভিজে আছে। হ্যাঁ সে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে আছে।
হাত ঘড়িতে সময় দেখতে পেল রাত একটা বেজে বারো মিনিট।
ইচ্ছে হচ্ছিলো এক্ষুণি সে বাসায় চলে যাবে। কিন্তু বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যাওয়া সম্ভব নয়।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরশাদকে থেকে যেতে হলো।
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আনমনে আরশাদ গেয়ে উঠলো।,
“তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও—
আমি তােমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গাে
আমারো পরাণো যাহা চায়।
তুমি তাই, তুমি তাই গো…….
আমারো পরাণো যাহা চায়।”
সকাল হতে না হতেই আরশাদ ছুটলো তার বাড়ির দিকে। ফ্ল্যাটে এসে দেখতে পেলো তালা ঝুলছে তাদের দরজায়। পাশের ফ্ল্যাটের লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো সবাই হাসপাতালে।
কারণ আরশাদের জীবন থেকে হয়তো ততক্ষণে ভালোবাসার একটা অংশ মুছে যাচ্ছে।
চলবে।