লতাকরঞ্চ (৬)
অনেকদিন হলো কিশোর ভাই আমাদের বাড়িতে আসেনা। আব্বা এ নিয়ে পাঁচ,ছয়বার কল করেও তাকে আমাদের বাড়িতে আনাতে পারলোনা। তার সাথে আমার কিছুদিন ফোনে কথা হয়েছিলো এখন তাও হয়না। জানিনা কি হয়েছে তার। এদিকে লিমা আপু আবার আরেক কাহিনী শুরু করে দিয়েছে। ওর সমস্যা হচ্ছে, ও ওর মাথায় নির্দিষ্ট কোনো একজনকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনা। হয়তো ওর সমস্যা হয় বা অন্যকিছু।
যখনি কথা হবে তখনি নানান ছেলের নানান কাহিনী বলবে। জানিস লতা, এই ছেলের এটা ভালো লাগছে, ঐ ছেলেটার এটা ভালো লাগেনি…ইত্যাদি ইত্যাদি!
মানে ওর এক-এক জনের এক-একটা জিনিস ভালো লাগে। নির্দিষ্ট একজনের মধ্যেই সে তার সবগুলো চাওয়ার সমাহার দেখতে পায়না, এটাই তার সবচেয়ে বড় দু:খ বা অপ্রাপ্তি বলা যায়।
•°•
লিমা আপু দেখতে আমার চেয়ে ফর্সা,মর্ডান। আমি ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটাই মর্ডান করে রেখেছি নিজেকে। খুব বেশিও না আবার খুব কম ও না। দুটোর মাঝামাঝি। এক কথায় চলনসই। আসলে, আমাকে আল্লাহ যতটুকু দিয়েছে ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি.. অনেক অসহায়দের তো তাও দেয়নি।
আপু প্রায়ই বলে,
– এই গাঁধা তুই একটু পার্লারে আমার সাথে যেতে পারিস না? হেয়ার ট্রিটমেন্ট, মুখে ফেসিয়াল করাতে পারিস না?
আমি মনে মনে বলি,
ধুর তুমিই করো ওসব..অতো সময় নেই আমার। তোমারতো কতজনই আছে,আর আমার? হাহ্ হা।
আপুর বর্তমান ক্রাশ আশিক ভাইয়া। উনি আপুর চেনাজানা। কিভাবে যেন তাদের পরিচয় প্লাস মেকি প্রেম-ভালোবাসা হয়ে গিয়েছিলো তা আমার বোধগম্য নয়। অবশ্য হওয়ার কথাও না। কারণ আপু সব শেয়ার করেনা আমার সাথে। নিতান্তই অল্পকিছু করে তাও একদম হিডেন কিছু না। ভুলেও বলে না ওসব। এতদিন আশিক ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিলো এখন আর নেই। কিন্তু আপুর বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আপু তাকে পছন্দ করে নিয়েছিলো। ব্যাপারগুলো আমি জেনে যাচ্ছি কিভাবে সেটা বলছি..
আপুর ফোন সর্বদাই সাইলেন্ট থাকে।
কিন্তু একদিন টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সোফায়..
সেদিন ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো না।
তাছাড়া ছোট বোন-ভাইদের কাছে কোনোভাবেই বড় ভাইবোনদের ফোনের সিকিউরিটি কোড গোপন থাকে না; রাখা সম্ভবই না! এটা তারা যেভাবেই হোক, জেনে নেয়। আর আমি তো আমিই। আমিও কোনো না কোনোভাবে জেনে নিয়েছিলাম। তা আর বলছি না। তারপর,
আপু ঘুমানোর কিছুক্ষন পরেই আপুর ফোনে পর পর কয়েকটা কল,মেসেজ আসতে লাগলো।
আমি আর ভদ্র সেজে বসে থাকতে পারিনি ফলফ্রসূ ঢুকেই পড়েছিলাম। মিনিটখানেকের মাঝেই ঘটনাচক্র ক্লিয়ারড…
আশিক ভাইয়ের ছোট বোন আবার লিমা আপুর ক্লাসমেট। সেই সুবাদে আপু মাঝেমধ্যে রাত কাটাতে যায় সেখানে। জানিনা এই রাতটা আসলে কিভাবে কাটে। আমাদের বলে যায় বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত আছে তাই যাচ্ছে; আসলে যে কিসের দাওয়াত বা কাজ সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। আব্বাকে আগে ভয় পেলেও এখন মুখে মুখে তর্ক করে আপু।
যখন আব্বা আম্মা আপুকে বুঝাতে যায় তখন আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আমাকে এখনো দুধের বাচ্চা বলেই তারা মানে।
তাই গজাননের কোলের সেই ভাইয়ের ন্যায় আমাকে ও আড়ালে রেখেই তাদের সব কথাবার্তা- কাজকর্ম চলে। এটা অসহ্যকর। আমিও এডাল্ট, আমিও বড় হয়েছি! এটা কেন তারা বুঝেনা?
তবুও কৌতূহলপরবশ হয়ে মাঝেমধ্যে গিয়ে কান রাখি দরজার পাশে। যদি কিছু শোনা যায়…
কিন্তু আমার আব্বা এতটাই চালাক যে উনারা মিনমিনিয়েই কথা বলে, হয়তো বকেও এভাবেই। মিনমিনিয়ে। আমার ধারণা আব্বার এই মিনমিনিয়ে বকার মাঝে কিছু কমাঙ্ক ও চিৎকার ধ্বনি যোগ করা উচিত। তবেই না আপু শান্ত হবে। কই আমার বেলায় তো এমন না! চিৎকার করে বকাঝকা করে, তখন অবশ্য আমি কানে হেডফোন দিয়ে রাখি। আর আমার সামনে এত লুকোচুরি কেন? আমি কি বাইরের মানুষ?
পরিবারের কোনো ডিসিশনেই আমাকে গণনা করা হয়না দেখে আমি নিজেকে খুব ছোট মনে করি।
প্রতিবাদ করতে গেলে ও শুনি বকাঝকা।
কালুকে দিয়ে এখন আমি সব কথা জেনে নিচ্ছি। লিমা আপুর কির্তীকলাপ সবই কিন্তু কালু জানে। কারণ তাকে তো আর আড়াল করে রাখা যায় না। আমার আব্বা আম্মার বড়ই বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক এই কালু। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে কাজ করে সে। তাছাড়া কালুর চোখ-কান খোলা থাকে সসবসময়ই। আমি ডাকি কুমড়োপটাস, যদিও সে অতটা মোটা নয়।বাতাসের সাথে পড়ে যাওয়ার মতই একজন মানুষ।
হাস্যকর ব্যাপার হলো,
কালুর একটা বউ ও টিকে না। কারণ সবার সামনে সে ভালোই সেজে থাকে। কিন্তু বউদের সাথে যে কি হয় মানে এডজাস্ট করতে পারেনা বেচারা। ঝগড়াঝাঁটি মারামারি পর্যন্ত চলে যায়। শুধু যে সেই মারে তা কিন্তু নয় সে নিজেও কিন্তু খায়। চিকনা-চাকনা তো তাই…কত মলম, ঔষধ যে সাপ্লাই দিয়েছি আমরা…
এখন ৩ নাম্বার জন হয়তো আছে। তাও শুনেছি বিবাদ চলছে.. যেকোনো সময়ই পাখি পগারপারে। (মানে বউ পালাবে)
কালুই খবর এনে দেয়, দিচ্ছে।
লিমা আপু এই এই কাজ করেছে আর এখন এই এই কাজ করবে। লিমা আপুর সাথে আশিক ভাইয়ার মনমালিন্য চলতে চলতে এখন ব্রেক-আপ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আশিক ভাই ক্যারেক্টারলেস। যাকেই একটু বেশি আকর্ষণীয় দেখে তার প্রতিই তার লোভাতুর দৃষ্টি চলে যায়। আপু অনেক চেষ্টা করেও পাল্টাতে পারেনি। আশিক ভাইকে সম্প্রতি একটা ইভটিজিং কেসের জন্য এরেস্ট করা হয়েছে; কে জানে কাল হয়তো করা হবে ধর্ষণের জন্য!
তাই নাকি লিমা আপু আবার আব্বাকে জানিয়েছে যে সে মঞ্জু ভাইকে বিয়ে করতে রাজি। মঞ্জু ভাই সবটাই জেনে গিয়েছিলো অবশ্য। তবুও আব্বার কথা শুনে সে খুশিতে টলমল হয়ে গিয়েছিলো। কারণ সত্যিই হয়তো লিমা আপুকে ভালোবাসে সে।
___________
______
প্রান্ত ভাইকে নিয়ে আমার এখন আর দু:শ্চিন্তা হয়না। কারণ উনার তো আবার শোভা নামের কেউ একজন আছে…
অবশ্য আমার কিই বা আছে। কিছুই নেই।
তাছাড়া আমার মনে এখন কেউই নেই।
সেদিনের পর থেকে বুঝেছিলাম যে প্রান্ত ভাইয়ের প্রতি আমার দূর্বলতা ছিলো। কিন্তু এখন আর তাও নেই। আসলে আমি কি? আমি কিচ্ছু না।
আমার সাথে কাউকেই যায়না। এটাই সত্যি। কথাগুলো ভাবছি আর বিষণ্ণতায় ভুগছি।
প্রান্ত ভাই ও নেই, কিশোর ভাইতো নিঁখোজই।
জানিনা কিশোর ভাই কেন এভাবে উধাও হয়ে গেলেন তবে আমি তাকে খুব করে চাচ্ছি এই মুহূর্তে। কত কথা জমা হয়ে গিয়েছে। কাকে বলবো এসব? আর কে_ই বা শুনবে আমার এসব (কষ্ট, দু:খ আর না বলা কাহিনীগুলো) এতটা গুরুত্ব দিয়ে; যতটা গুরুত্ব দিয়ে শুনতো কিশোর ভাই… সবসময় সে ধৈর্য্য ধরে সবটা শুনবে। তারপর প্রাণসঞ্চারণী এমন এক-একটা কথা বলে দিবে যেটা ক্রমশ হৃদয়ে দোলা দিতে থাকবে। লোকটার কি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে!
•°•
ব্লকটা খুলে দিলাম প্রান্ত ভাইয়ার।
অনেকদিন পর আবার উঁকি মেরেছি তার ঝাঁকঝমকপূর্ণ একাউন্টে।
সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে শোভা নামের মেয়েটির একাউন্ট পেলাম।
তার একাউন্টে ঢুকেই তার প্রোপাইলে আবিষ্কার করলাম প্রান্ত ভাইকে!
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আচ্ছা, আমি শোভার একাউন্টে আছি না প্রান্ত ভাইয়ের একাউন্টে আছি?
ভালো করে দেখলাম নামটা, ” তাসনুভা শোভা ” -ই একাউন্ট নেইম। কই নাতো! এটাতো শোভার একাউন্ট_ই!
আশ্চর্য! এই মেয়ে ভাইয়ার ছবি স্ব-প্রোপাইলে এভাবে দিয়ে রাখলো কেন! রাখার অর্থই বা কি!
কত ঢং যে আরো দেখতে হবে….কে জানে…
ক্যাপশন দেখে আরো চমক পেলাম।
” শুভ জন্মদিন জানপাখি “(পাশে লাভ ইমুজি)
– এটা লিখা।
•°•
ওহ্হো!
আজ তাহলে এই রাগী ভাইটার জন্মদিন!
বেশ বেশ!
আহারেএ..!
যাই গিয়ে উইশ করে আসি।
টাইপ করলাম, ” Happy Birthday “।
পাঠানোর জন্য চাপ দিবো অমন সময় কালু এসে ডাক দিলো।
– আফা, আমনেরে ডাকে। কইছে অখনই যাইতেন।
আব্বার রুমে ঢুকেই আমি আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়ি। একি!
দেখলাম আব্বার পাশেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বসে আছে শোভা নামের মেয়েটা। এই মেয়েটা এখানে আসলো কোন সুখে!
প্রান্ত ভাই কোথায়!
কোথাও দেখছিনা কেন!
নিশ্চয়ই শোভাকে বিয়ে করবে বা করতে চায় এটা জানানোর জন্য এসেছে!
চলবে…
ধন্যবাদ। ]
#ফারজানা_রহমান_তৃনা।