লতাকরঞ্চ (৩)
৫ টা মেয়ের সাথে একটা ছেলের আড্ডাবাজি দেখতেছি রিক্সায় বসে বসে। অনেক কষ্টে একটা রিক্সা জোগাড় করেছিলাম। শপিংমলের সামনে পৌঁছেই লক্ষ্য করে দেখলাম ৫ টা মেয়ের মাঝে থাকা ঐ একটা ছেলে হচ্ছে প্রান্তিক ভাই। বাহ্!
এই যে আমি, মিস লতা এভাবে রাগ করে চলে গেলাম এইজন্য তো তার সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ নেই_ই তদুপরি কি চলছে? তুমুল হাসি-ঠাট্টা! বাহ্!
– আফা নামেন। (রিক্সাওয়ালা)
নেমে পড়লাম। প্রান্তিক ভাই একবার তাকিয়ে সিউর হয়ে নিয়েছেন যে আসলেই আমি আসছি কিনা।
এই একবার যে তাকালো আর ফিরেও তাকালো না। আমি কিভাবে আগে কথা শুরু করবো ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছিনা। ফুফাতো ভাই হলেও ভাইয়ার সাথে আমার দুরুত্ব তৈরী হয়ে গেছে নানান কারণে।
আমি ভাইয়ার পিছন বরাবর গেলাম। যাতে উনি বুঝতে পারে যে আসলে আমি উনার জন্যই আবার এতদূর ছুটে এসেছি। কিন্তু না। ভাই ঐ মেয়েদের সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। আমি যে তার পিছনে আসতে পারি বা তার জন্যই আবার মৃতপ্রায় হয়ে ছুটে আসতে পারি; এমন কিছু হয়তো মানুষটা ভাবেইনি।
আমি ভাইয়ার আরো কাছে গেলাম। ডাক দিবো তখনি শুনলাম তাদের কথোপকথন…
একজন বলছে,
– কিরে প্রান্তিক? শোভাকে আর কয়দিন এভাবে ঝুলায়ে রাখবি? বেচারি তো তোর জন্য বিয়ে ও করতে পারতেছেনা.. মেয়ে হয়ে তোকে প্রপোজ করলো আর তুই কিনা চুপ করে আছিস!!
ভাই মুচকি মুচকি হাসি দিচ্ছে শুধু।
ভাইয়ের পাশেই গা ঘেষে বসে আছে যে মেয়েটা ঐ মেয়েটার অবস্থা সীমাহীনমাত্রার সৌন্দর্যে ভরপুর।
মেয়েটার ড্রেস আপ, জুয়েলারি, চুল সবই চরম শৌখিনতায় ঠাঁসা। একদম পাক্কা ঢাকাইয়া, ফ্যাশনাবল মেয়ে বলা চলে।
মেয়েটা একটু বেশিই ক্লোজ হয়ে বসে আছে ভাইয়ার সাথে। ভাইয়াও নড়ছে না। মেয়ে কি বলি, আপুই হবে। নির্ঘাত আমার চেয়ে বড় হবে, শারীরিক গঠন ও তাই বলে।
এটলিস্ট ভাইয়াতো একটু সরে বসতে পারতো।
তাহলে এই মেয়েটাই কি শোভা?
কিছুক্ষন পরে অন্য একটা মেয়ে ধাক্কা দিয়ে যখন আমার সন্দেহ করা সেই মেয়েটির প্রতিই ইঙ্গিত করে বললো যে,
– কিরে শোভা? বল, ঠিক বলছিনা? তখনি বুঝতে পারলাম ব্যাপারখানা।
শোভা নামের মেয়েটা কথাটা শুনেই মাথা নিচু করে হাসতে লাগলো। ব্যস!
আরকি? বুঝা হয়ে গেলো সব আমার। ভাইয়ার তাহলে অলরেডি গার্লফ্রেন্ড আছে।
আমি লিমা আপুকে কল করে আপুর কাছেই চলে গেলাম। শপিং শেষে নিস্তব্ধ হয়েই বাড়ি ফিরে এলাম। আপু পথে একবার জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে মন খারাপ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
– না না।
মঞ্জু ভাই আপুর পাশেই বসেছে। বসে বসে কত কথাই না বলছে.. একটু গাঁধা টাইপের তবে ভালোই।
আপুকে একটা রিং আর কানের দুল গিফট করেছে নাকি।
আমার জন্যও নাকি কি কি কিনেছে কিন্তু আমার সেদিকে মন নেই। জানিনা কেন এত মন খারাপ লাগছে। মঞ্জু ভাই হেসে বললো,
– লতা, চকোলেট খাবি? কত খেতে চাস? এই দেখ তোর জন্য কতগুলো চকোলেট এনেছি।
আমি মৃদ্যু হাসি দিয়ে বললাম,
– থ্যাংক ইয়্যু ভাইয়া।
আর কিছুই বের হলোনা মুখ থেকে।
অত:পর বাসায় ফিরে এলাম।
______________
এতদিন প্রান্তিক ভাইয়ের প্রতি সামান্য দূর্বলতা ছিলো আমার। ফেসবুকের সার্চ লিস্টে সবার আগে উনার নামটাই ছিলো। দিন রাত মিলিয়ে কয়বার করে যে এই একাউন্টে আমি ঢু মেরে আসতাম তা বলাই বাহুল্য। এক কথায় অগণনীয়।
•°•
এতদিন একটা চাপা রাগ ছিলো ভাইয়ার প্রতি আমার। কারন উনি আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়নি।
উনার স্ট্যাটাস, পোস্ট সবকিছুতেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েদেরই কমেন্ট, লাভ রিএকশন পড়ে বেশি।
যদি ও সবগুলো মেয়ে রিপ্লাই পায় ও না। তবে প্রশ্রয় পাচ্ছে এরা তা বুঝা যাচ্ছে। কমেন্টে রিপ্লাই না থাকলেও ইনবক্সেও যে চ্যাট হচ্ছে না তা আমি জানবোই বা কি করে। জানার কথাও না।
আমি রোজ নিয়ম করে একবার দেখে আসতাম ভাইয়ার ভার্চুয়াল জগত। রীতিমত সেলিব্রেটি উনি.. কত ফ্যান, ফলোয়ারস উনার..
এদিকে আমি যে এক কোণায় পড়ে আছি তার ইয়েত্তাই নেই..
থাকবেই বা কেন? কে আমি!
বাড়িতে ফিরেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফেলি। খুব কান্না পাচ্ছে।
কারন জানা নেই। আমি কি তাহলে প্রান্ত ভাইকে মনে মনে পছন্দ করতাম?
এত কষ্ট কোথা থেকে সাপ্লাই হচ্ছে! এদ্দিন(এতদিন) কই ছিলো!
গায়ের জামা-কাপড় গুলোও ছাড়িনি, এগুলো নিয়েই শুয়ে পড়লাম। মাঝখানে আম্মা চিৎকার চেঁচামেচি করে দরজা খুলিয়ে ভাত খাইয়ে গেলো; একরকম জোর করেই। আম্মা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই প্রচন্ড মাথাব্যাথা শুরু হলো। প্রচণ্ড ব্যাথা।
আমার আবার সহসা মাথাব্যাথা হয়না কিন্তু একবার হলে আর ছাঁড়েনা।
আজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। বমি করে সব ভাসিয়ে দিলাম। কিছুটা কমেছে কিন্তু ঘুম আসছে না।
মাথায় নানা রকমারি প্রশ্ন আর চিন্তারা ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে অনবরত। ঝিম ধরে আছে মাথাসহ পুরো শরীর। চোখ বন্ধ করলেও ঐ শোভা নামের মেয়েটিকে দেখি, খোলা রাখলেও তাই..
বিছানার এপাশ-ওপাশ গড়াচ্ছি কেবল।
খুব হিংসা হচ্ছে..
মেয়েটাকি সত্যিই আমার থেকে বেশি সুন্দর?
সেদিন রাতে পুরোপুরিভাবে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। সারারাত ছটপট ছটপট করতেছিলাম।
____________
সকালটা অবশ্য খুব সুন্দর করেই শুরু হয়েছিলো।
আমি আব্বাকে ভীষণরকমভাবে পছন্দ করি।
সকালটা তার মুখ দেখেই শুরু হলো।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আব্বা মিষ্টি, পায়েস সামনে নিয়ে বসে আছে। হাতে একটা ম্যাগাজিন বা পত্রিকা দেখা যাচ্ছে। আমাকে উঠতে দেখেই আব্বা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– অবশেষে আমার রাজকন্যার ঘুম ভাঙলো!
এতক্ষন ধরে আমার ঘুম ভাঙার জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিলো।
আমি আব্বার হাতে মিষ্টি,পায়েস দেখে চমকে গেলাম। আব্বা আবার আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেনিতো?
আমি তোঁতলাতে তোঁতলাতে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হইছে আব্বা?
আব্বা হাতে থাকা পত্রিকাটা এগিয়ে দিলেন আমার সামনে।
আব্বা আবার গল্প,কবিতা লিখেন মাঝেমধ্যে; শখের বশত। রিটায়ার্ডের পর এইটার প্রতি আব্বার এক অভাবণীয় আসক্তি জন্মেছে। আব্বার লিখা গল্প পত্রিকার জন্য সিলেক্ট হয়েছে,ছাপানোও হয়েছে। সেই খুশিতে আব্বা কালুকে দিয়ে দোকান থেকে কুমিল্লার মিষ্টি আনিয়েছে।(কালু বাড়ির কাজের লোক।)
আম্মাকে ভোরে উঠিয়ে দিয়ে পায়েসও রান্না করিয়েছে। দুপুরের জন্য কাচ্চি বিরিয়ানীর আয়োজন হচ্ছে। সেই বিরিয়ানীর গন্ধে মৌ মৌ করছে সারা বাড়ি। আমাদের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান, বিয়ে ছাড়াই মাঝেমধ্যে এরকম খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দের শোরগোল দেখা যায়।
সবই আব্বার ইচ্ছা, খুশি মোতাবেক হয়।
আব্বা যেকোনো রকমের সুসংবাদ বা সামান্য খুশিতেই হৈ চৈ শুরু করে দিয়ে সারা বাড়ির সবাইকে মাতোয়ারা করে ফেলে।
অল্পেই তুষ্ট হওয়া একজন নিতান্তই নীরব প্রকৃতির ভালো মানুষ আমার আব্বা।
আব্বার মিষ্টি গল্পের সাথে সাথে সকালের পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি আর মিষ্টি পান দিয়েই আমার সকালটা সমাপ্ত হলো।
•°•
আব্বা চলে যাওয়ার পর আবার মনে পড়ে গেলো ওসব বাজে-বিদঘুটে মুহূর্তগুলো।
দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে, মোবাইলটা হাতে নিয়ে আবার ফেসবুকে ঢুকে প্রান্তিক ভাইয়ের একাউন্টে গেলাম।
দেখলাম এখনো আমার রিকুয়েস্টটা ফিজরাপুলের আসামির ন্যায় ঝুলে আছে।
খুব খুব রাগ হলো।
১২ ঘন্টা আগেই দেখা যাচ্ছে উনি ফটো আপলোড করেছেন। ক্যাপশনে দেওয়া,
” কিছু সুন্দর মুহূর্ত, কিছু সুন্দর সুন্দর বান্ধবীদের সাথে! ”
ঐ পাঁচটা মেয়ের পাশাপাশি শোভা নামের মেয়েটা আর প্রান্ত ভাইয়ার আলাদা করে তোলা কিছু সেলফিও দেখা যাচ্ছে।
দুজনের হাসিভরা সেলফি দেখে এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। গা কুঁকড়ে উঠলো।
মেয়েটা দেখতে সুন্দরই হয়তো কিন্তু আমার কেন জানিনা ওকে এখন দেখলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি- অস্বস্তিভাব লাগে। অথচ গতকাল হয়তো সব জানার আগে ভালোই লাগছিলো।
মেয়েটা আমার চেয়েও বেশি শিক্ষিত, সুন্দরী। আচ্ছা। কিন্তু আমি এত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ছি কেন?
এইতো সেদিন ও তো মনে মনে ভাবছিলাম নিজের বোনের সাথেই বিয়ে দিয়ে দিবো..
তাহলে কি আমি মনে মনে…..
কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে সোজা ভাইকে ব্লক করে দিলাম। লাগবেনা আমার কাউকে।
_____________
কিছুক্ষন এভাবেই চুপ করে বসে রইলাম জানালার পাশের সেই ছোট্ট পুকুরটার দিকে তাকিয়ে….
হঠাৎ জোরে জোরে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেলাম।
এতটাই অন্যমনষ্ক ছিলাম যে কড়া নাড়ানোর আওয়াজটা টেরই পেলাম না!
দরজার ওপাশ থেকে লিমা আপু বলছে,
– লতা, এই লতা। দরজা খোল। কিরে? আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি? দেখ দেখ তোর সাথে দেখা করার জন্য কে আসছে। জলদি খোল!
•°•
আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম বিছানায়।
চোখের কোণায় জমে থাকা জলগুলো মুছে ফেলতে ফেলতে ভাবলাম,
– প্রান্তিক ভাই নয়তো?
চলবে…
(আসলে আজকে গুরুতর একটা কারণে নেটওয়ার্কের বাইরের একটা জায়গায় চলে আসতে হয়েছে আমার। তাছাড়া পড়াশোনার কিছু চাপের তাগিদে ও নানান সমস্যা থাকার কারণে দেরী হয়ে যাচ্ছে এই ধারাবাহিক গল্পটা দিতে। এর জন্য আমি বিশেষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি সবার কাছে। দু:খিত। আর #লতাকরঞ্চের প্রতি আপনাদের অগাধ ভালোবাসা আমার লিখায় আরো উৎসাহ ও প্রাণস্পন্দন জুগিয়েছে। ধন্যবাদ পাঠকগণ। এভাবেই পাশে থাকুন। ফিয়ামানিল্লাহ্।)
#ফারজানা_রহমান_তৃনা।