#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৩
নতুন বউ আঁধমাথা ঘোমটা টেনে, খাটের কিনারায় চুপটি করে বসে আছে। প্রতিবেশীরা একটু পর পর মাধুকে দেখতে আসছে! সকালে সবার খাওয়া হলেও এখনো মাধুকে কেউ খেতে ডাকেনি। পেটের ভেতর খিদেয় চু চু করছে। মাধুকে এতক্ষণ অভুক্ত রাখা? নিজের বাড়ি হলে, সারা পাড়া চিল্লিয়ে মাথায় করে ফেলত। তারপর মা পিছুপিছু ভাতের থালা নিয়ে ঘুরত। মাধু প্রথমে একটু রাগ দেখাত, গাল ফুলিয়ে অভিমান করত। তারপর মায়ের মন ভোলানো কথায় লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে নিত। এখানে তো কেউ ভুলেও মাধুর খাওয়ার কথা বলল না? অনুপম বা রিধীকাও আশেপাশে নেই। যে ডেকে একটু ভাত চাইবে! না কী শ্বশুরবাড়িতে কেউ খেতে দেয় না? কী জানি বাবা! এটাও বোধহয় একটা নিয়ম হবে হয়ত! এমনিতেই বিয়ের দুদিন উপোস ছিল মাধু। যদিও বড়দি লুকিয়ে চুকিয়ে এটা-সেটা খেতে দিয়েছিল!
সকাল পেরিয়ে বেলা গড়িয়ে গেছে। তখন মাধুর খাওয়ার জন্য ডাক পরল। ততক্ষণে পেটের অতিরিক্ত খিদেটাও মরে গেছে।
রন্ধনঘরে মাধুকে পিঁড়ি পেতে বসতে দেওয়া হলো। মাধুর আশেপাশে বাড়ির সব মহিলারাও খাওয়ার জন্য গোল হয়ে বসে গেল। এই বাড়িতে চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা আছে। তবে বোধহয় মেয়ে বউরা সেখানে বসে খায় না। মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে খায়। সকালে লুচি, ছোট ছোট মাংস পিছ করে বুটের ডাল ও সবজি রান্না হয়েছে।
বুটের ডাল সবার পাতে একহাতা.. একহাতা করে পড়লেও মাধুকে দেওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। মাধুর এত পছন্দের একটা খাবার, একটুও ভাগে পেল না মাধু। ভাবতেই খুব কান্না পেল। কান্না গিলে ফেলে, শুধু সবজি আর বাঁশি পায়েস দিয়ে দুটো লুচি খেল মাধু। রেণুবালা একপলক মাধুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হয়ত বেখেয়ালে নিজের তিক্ত অতীত মনে পড়ে গেল। খেতে খেতে মাধুকে শুনিয়ে শুনিয়ে জা’দের উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আমাদের শাশুড়ীমা বলত, “বউকালে জ্বালা, শাশুড়ীকালে সুখের ডালা।” কত সকাল বা রাত আমরা শুধু এক’দু মুঠো শুকনো মুড়ি আর ভরপেট জল খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি তাই না দিদি?
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই বিন্দুমাসি সব এঁটো থালাবাসন কলতলায় ধুঁতে নিয়ে গেল। রেণুবালা মাধুকে বলল,
-‘বড়বৌমা?
মাধু চোখ মেলে তাকাল। রেণুবালা বলল,
-‘আজ দুপুরের পর, সব অতিথিরা চলে যাবে। আজ সবাই তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে! সব পদ রান্নার দরকার নেই। এক দুই পদ রাঁধো!
মাধু শুকনো ঢোক গিলল। কম করে হলেও পঁচিশ, ত্রিশ জনের রান্না। এত রান্নায় কতটুকু তেল, মশলা দিতে হয়। তাইতো মাধুর জানা নেই। মাধু যে রান্না করতে পারে না। তা কিন্তু নয়। তবে এতগুলো মানুষের রান্না মাধু পারে না। মাধু তাও সাহস করে বলল,
-‘আমাকে মশলা পরিমাণ করে দেখায় দিলেই পারব মা।
রেণুবালা কটমটিয়ে তাকাল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘ঘটকমশাই যে বিয়ের আগে বলেছিল, মেয়ে রুপে লক্ষ্মী, গুনে সরস্বতী। মেয়ের এত প্রংশসা শুনেই তো ছেলে বিয়ে দিলুম। সারাজীবন তো হাত পুড়িয়ে রান্না করেই খেলুম। এবার তো আমাকে ক্ষমা দাও। তোমাকে যদি আমার রান্না শিখিয়ে দেওয়া লাগে তাহলে তো রান্নাটা আমিই করতে পারি বাপু। বিন্দু উনুন জ্বেলে ভাত, বেগুন ভাজা, শাঁক ভাজা রান্না করে নিবেক্ষণ। তুমি বরং শুধু ইলিশ ভাঁপা, খাসির মাংসকষা আর মাছের মাথা দিয়ে ঘন মুগডালটা করে নিবে। ব্যস। আমার কোমড়ের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। আমি একটু বিশ্রাম নেবো। কথাগুলো একদমে বলেই চাবিরতোড়া খানা হাতে নিয়ে, গালভর্তি পান চিবুতে চিবুতে রেণুবালা চলে গেল। এখন মাধুরও খুব ইচ্ছে করছে। একছুটে নিজের বাড়ি চলে যেতে। এত মানুষের রান্না কী করে রাঁধবে মাধু?
অনুপমের ছোটমামী মাধুর পাশে বসল। বলল,
-‘নতুন বউয়ের মন খারাপ?
-” না। তবে খুব টেনশন হচ্ছে।
-‘চলো আমি, তোমাকে হেল্প করে দেই!
মাধু একলাফে উঠে দাঁড়াল। খুশি হয়ে বলল,
-‘সত্যি?
-‘তিন সত্যি। আসলে অনুপমের মা। মানে আমার বড় ননাসটা একটু সেকেলে টাইপ, চড়া মেজাজী। ওনার কথায় তুমি কিছু মনে করো না নতুনবৌ।
মাধু জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল।
এতবড় কড়াইয়ে হাতা নাড়তে, চাড়তে মাধুর খুব কষ্ট হচ্ছে। এই শীতেও ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। মামী পরিমাপ করে মশলা, তেল দিয়ে দিলি। রান্নায় খুব সুন্দর কালার ও স্মেইল এসেছে! ইলিশ ভাঁপা, ডাল রান্না শেষ। মাংসকষাও হয়ে এলো বলে। মামী বলল,
-‘এখন আমি যাই। স্নান করব। তুমি বরং গরম মশলা বাঁটা দিয়ে, মাংসটা নামিয়ে নিও।
-‘আচ্ছা মামী।
মাধু সকালের পারা বরই দিয়ে, একটা টকের আইটেমও রেঁধে ফেলল।
দুপুরে সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে চেটেপুটে খেলো। সবাই মাধুর রান্নার খুব প্রংশসা করল। অনুপম একটু দরকারে হাঁটে গিয়েছিল। মাধু রান্না করেছে শুনে, এসেই হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল।
এই বাড়ির নিয়ম বউ, মেয়েরা সব ব্যাটাছেলেদের খাওয়ার শেষে খায়। অনুপম ইচ্ছে করে পাতে অনেকগুলো মাংস তুলে নিল। কিছু খেয়ে কিছু মাধুর জন্য রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠে পরল। কলতলায় যাওয়ার আগে , মাধুকে ডেকে জোরে জোরে বলল,
-‘তুমি বরং আমার এঁটো পাতে খেয়ে নিও মাধু। না হলে এতগুলো মাংস শুধু শুধু নষ্ট হবে। মাধু মাথা ঝাঁকাল।
রেণুবালা ছেলের চালাকি চট করেই ধরে ফেলল। নিমিষেই অশান্ত মনটা তিতা বিষে ভরে গেল। কই কখনো অনুপমের বাবা তো তার জন্য পাতে মাংস রেখে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়নি?
নিজে হাতে এত ভালমন্দ রান্না করলেও নতুন বউ থাকতে, তার ভাগে ভাল মাছ, মাংস কিছুই জুটত না। কত যে ভালমন্দ না খেতে পেরে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে। তার হিসেব কেউ রাখেনি। তাহলে এখন রেণুবালা কেন রাখবে?
সবাই চলে যেতেই অনুপমের এঁটো থালায় রেণুবালা ভাত বেড়ে নিয়ে গপাগপ খেতে লাগল। মাধুকে বলল,
-‘তুমি নতুন বউ। তোমাকে এঁটো খাবার খেতে হবে না। বিন্দু, বড়বৌমাকে ভাত বেড়ে দে?
এখনও মাধুর খেতে বসে প্রচণ্ড কান্না পেল। কড়াইয়ের তলায় একটা হাড্ডি আর ছোট ছোট দুটো গলা মাংস পরে আছে। ইলিশ ভাঁপা ফুরিয়ে গেছে। বহুকষ্টে একটু ডাল আর ওই ওতটুকু মাংসকষা দিয়ে মাধু খেয়ে উঠল। অথচ বাড়িতে মাধুকে সবসময় বেছে বেছে বড় মাছ, মাংস দিয়ে ভাত খেতে দিত মা। বাবাও খাওয়ার সময় মাধুকে নিজের পাত থেকে এটা-সেটা তুলে দিত।
সব আত্মীয়-স্বজন দুপুরে খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে। এখন বাড়িতে মাধুরা জনা দশেক মানুষ আছে। মাধুর শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ-স্বামী, জ্যাঠাশ্বশুর-জেঠীশাশুড়ী, বিন্দুমাসি আর টুলুদাদা। বিন্দুমাসি এই বাড়ির সব ফরমায়েশ খাঁটে আর বিন্দুমাসির ছেলে দেখতে বোকাসোকা টুলুদাদা হাঁট-বাজার করে দেয়, খেতে শাঁক-সবজির আবাদ করে।
অনুপম দুইবার এসে মাধুকে ডেকে গেছে।
রেণুবালা, মাধুকে দিনের বেলা ঘরে যেতে দিল না। বলল,
-‘দিনের বেলা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে, স্বামী-স্ত্রী একঘরে থাকবা। এটা কেমন দেখায়? যাও একবারে রাতে ঘরে যাবা। রিধীকার ঘরে গিয়ে একটু ভাতঘুম দাওগে!
মাধু হাতে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে মন খারাপ করে রিধীকার ঘরে চলে এলো। অনুপমকে এক পলক দেখার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছে।
অনুপম, মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে রিধীকার ঘরে এসে পেলো। বিষন্ন গলায় বলল,
-‘আমি এত ডাকাডাকি করলাম। তারপরও আমার ঘরে গেলে না মাধু? আমাকে এত অপছন্দ করো?
মাধুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। অনুপমের সুন্দর মুখখানি দেখে, হৃদয়ে সুখের দোলা দিল। তবে মুখে কিছু বলতে পারল না। অনুপম আবারও বলল,
-‘আমি আর তিনদিন পরই ঢাকা চলে যাব। বাড়িতে যেকটা দিন আছি। আমার কী ইচ্ছে করে না। আমার বউয়ের সাথে একান্ত সময় কাটাতে?
‘অনুপম চলে যাবে?’ মাধু আঁতকে উঠল।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল! ইচ্ছে করছে, অনুপমের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে। লজ্জায় কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অনুপম, মাধুর একহাত ধরে বলল,
-‘ ঘরে চলো?
মাধুর পুরো শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। এই স্পর্শর তীব্রতা এত গভীর কেন? অনুভবেও সুখ লুকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিলে বহুকষ্টে মুখে বলল,
-‘না’
-‘বেশ..
অনুপম জানালার ভারী পর্দা টেনে দিল। দরজা চাপিয়ে দিয়ে। মাধুকে একটানে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। ভাললাগার আবেশে মাধু বোধহয় একটু একটু বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। অনুপম, মাধুর ঢেউ খেলানো সুন্দর চুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিল। আবেগী কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমার অস্থিরতা বুঝো না তুমি?
(চলবে)