রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি বোনাস পর্ব (২)

0
3358

#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#বোনাস_পার্ট(২)
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy rahman)

অন্ধকার ঘর!বাইরের রাঙা গোধূলি থেকে হালকা আলোতে কাব্য ভাইয়ার রক্তলাল চোখদুটো দেখতে পেলাম৷ উনি আমার একদম কাছে!একদম অনেক কাছে৷ তার নিশ্বাসের সাথে আমার নিশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে৷ নিশ্বাস গুলো যেন ফিসফিস করে কিছু একটা বলে চলেছে৷ যা তাদের গোপনীয় আলাপ৷ সেই আলাপ থেকে বের হয়ে আমার চোখে মুখ ছুয়ে দিচ্ছে তারা৷ আমার নিশ্বাসও হয়তো কাব্য ভাইয়ের চোখ-মুখে কোনো গোপন আলাপে লিপ্ত৷ অস্বস্তি! এযেন এক ভয় মেশানো ভালোলাগার অস্বস্তি৷ উনি এখনো আমার হাত দেয়ালের সাথে চেঁপে ধরে রেখেছেন৷ হাতে ব্যাথার অনুভব হচ্ছে কিন্তু বলতে পারছি না৷ কথা গুলো গলায় আটকে গিয়ে আমার কানে কানে বলছে,
‘ এইভাবে সব থাক আজ!ভয়ের সাথে কেমন ভালো লাগছে তো তোর৷ ‘

কিন্তু মন মস্তিষ্কের কাছে হেরে যাচ্ছে৷ আমি ব্যাথাতুর আর ভয় মেশানো কন্ঠে বললাম,
–‘ আমার হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ান৷ এইভাবে কেও দেখলে কি ভাববে কাব্য ভাই? জিনিয়া বা ফুঁপি আসলে….

উনি আমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চেঁপে ধরলেন৷ রাগ মিশ্রিত কন্ঠে হিসহিস করে বললেন,
–‘ আমার বউয়ের সাথে পারসোনাল টাইম স্পেন্ড করছি আমি! এতে কার কি ভাবার আছে? ‘

আমি উনার বাঁধন থেকে ছোটার জন্য চেষ্টা করলাম৷ তাতে উনি আরো কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ তার আর আমার মাঝে একচুল জায়গাও বাকি নেই৷ যতটা কাছে থাকলে হৃদপিন্ডের প্রতিটা বিট শোনা যায় অতোটা কাছে৷ তার শরীর কাঁপছে সাথে তার জাম রাঙা ঠোঁট৷ আচ্ছা!ছেলেদের ঠোঁট বুঝি এতোটা সুন্দর হয়? হ্যাঁ,হয়৷ মেয়েদের চেয়ে বেশি হয় ,তার উদাহরণ কাব্য ভাইয়া৷ পাঁকা জাম গাছ থেকে পড়ে ফেঁটে গেলে যেই রঙ হয় একদম সেই রঙ তার ঠোঁট জোড়াতে৷
–‘ আপনি স্মোকিং করেন? ‘

আমার অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে সরু চোখে তাকালে উনি৷ আমি নিজের অদ্ভুত কথার রেশে নিজেই লজ্জিত৷ ছিঃ!সে কি ভাবছে৷ তার উত্তর না পেয়ে আমি স্বস্তি পেলাম৷ আবারও তার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ভাবে বললাম,
–‘ প্লিজ ছাড়ুন আমায়৷ আপনার সাথে আমাকে এইভাবে কেও দেখলে উল্টাপাল্টা ভাববে সবাই৷ ‘

–‘ তোর বর হই আমি৷ কে কি ভাবলো তোর না ভাবলেও চলবে৷’

উনার বেখেয়ালি উত্তর শুনে রাগ হলো আমার৷ চেঁচিয়ে বললাম,

–‘ কিসের বর৷ কোনো বর টর না আপনি আমার৷ আমার বিয়ে ভাঙার জন্য নাটক করেছিলেন এইটাই সত্যি৷ আর কোনো কিছু আমি বিশ্বাস করি না৷ ‘

উনি নীরব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ হাতের বাঁধন ধীরে ধীরে আলগা হতেই আমি হাতের দিকে তাকাই৷ ভেবেছিলাম উনি ছেড়ে দিবেন৷ কিন্তু না!আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন৷ তার এহেন কাজে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই৷ করছেন কি উনি? আমায় চুপ থাকতে দেখে উনি ওইভাবেই আমাকে ধরে সামনে আগাতে থাকেন৷ আমি মাথা ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকাই৷ তার দৃষ্টি সামনে থাকা কাবার্ডের দিকে৷ সুন্দর মন মাতানো সুগন্ধ আসছে তার থেকে৷ সব কিছুতে তার সৌন্দর্য৷ ছেলেদের বুঝি এতো সুন্দর হতে হয়?
এক পাঁ এক পাঁ করে আগাতে আগাতে আমকে নিয়ে কাবার্ডের সামনে এসে দাঁড়ান৷ সামনে থাকা আয়নায় তাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেলি৷ কখনো এমনটা হয় নি৷ তবে আজ তাকে সুন্দর লাগছে !সবচেয়ে বেশি সুন্দর৷ উনি আমাকে ধরে রেখেই কাবার্ড খুলে একটা ফাইল বের করলেন৷ এইটা তো সেই ফাইল!যেটা বিয়ের দিন নিয়ে গিয়েছিলেন উনি। ফাইল আমার হাতে দিলেন৷ আমি না ধরাতে পরে যেতে নিলেই উনি আমার হাতের নিচে হাত রাখেন৷ আমি চমকে আয়নার দিকে তাকাতেই উনি চোখ দিয়ে ইশারা করেন ফাইল খুলতে,,আমি কি করবো ভেবে পাই না৷ ফাইল খুলেই বা কি হবে?উনি নিজেই ফাইল খুললেন৷ আস্তে করে বললেন,
–‘ তোর সমস্ত উত্তর আছে এতে৷ ‘

তার হাতের উপর দিয়েই আমি ফাইল খুলে একটা কাগজ পাই৷ কাগজ খুলতেই বড় বড় অক্ষরে উপরে লিখা নিকাহ্ নামা৷ আমি চোখ বড় বড় করে তাকাই উনার দিকে৷ উনি হাসেন! আমি কাগজ খুলে পড়তে থাকি৷ বরের জায়গায় তার নাম দেওয়া আর কনের জায়গায় আমার৷ ওইদিন অস্থিরতার জন্য কোনো কিছু পড়ে দেখি নি৷ তবে আজ ,কাগজটা মিথ্যা নয়৷ কোর্টের রেজিস্ট্রি পেপার৷ তারমানে সেদিন ভার্সিটি যাওয়ার আগের ঘটনা সত্যি৷ সেইদিন উনি আমাদের রেজিস্ট্রি করেছেন৷ আমি কাগজ নিয়ে কি করবো ভেবে পাই না৷ উনাকে গম্ভীর ভাবে বললাম, ‘ আমাকে ছাড়ুন৷ ‘

এইবার উনি ছেড়ে দিলেন আমায়৷ আমার হাত থেকে কাগজ কেড়ে নিয়ে বললেন,
–‘ বিশ্বাস হয়েছে এইবার? আইন মোতাবেক তুই আমার বউ৷ ‘

আমার দৃষ্টি ওই কাগজে নিবদ্ধ৷ আমি তার বেডের উপর বসে পড়লাম৷ মাথা হাতের উপর ঠেকিয়ে তার হাতের ওই কাগজের দিকে তাকিয়ে বললাম,

–‘ তাহলে কিসের শর্ত? ‘
উনি আমার পাশে বসে আমার কাধে হাত রেখে বললেন,
–‘ তোর থেকে দূরে থাকা৷’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
–‘ দূরে কোথায় আছেন? আর দূরে থাকলেই বা কি? আমার জীবন তো শেষ করে দিয়েছেন৷ ‘
–‘তোর জীবন যাতে শেষ না হয় এই জন্যই তো দূরে থাকার শর্ত দিয়েছে আমায়৷ ‘
–‘ মানে? ‘
–‘ তুই এখনো বড্ড ছোট নীতু! তোর বাবা আর আমার বাবা চায়, তুই যেন নিজের পায়ে দাঁড়াস৷ আর আমি নিজের ক্যারিয়ার গুছাই৷ ‘
আমি তার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,
–‘ তাহলে আপনি মন থেকে কিছু করেন নি? আর চলে যাবেন কেন? ‘
উনি আমার মুখ উঁচু করে ধরে বলেন,
–‘ জার্মান যাবো আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোর্স শেষ করার জন্য রে বাবা৷ আর তোর কাছে অধিকার চেয়েছি আমি? যা হচ্ছে হতে দে৷ ‘

আমি তেতে উঠে বললাম,
–‘কেন হতে দিবো? আমার জীবন আমার মর্জি৷ আর এই বিয়ে টিয়ে আমি মানি না৷ “আমিরের” কাছে থেকে বাঁচানোর জন্য এতো কিছু তাই না? ‘

উনি ছোট করে ” হুম ” বলতেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে উনার থেকে কাগজ নিতে যাই৷ উনি কাগজ উঁচু করে ধরে বললেন,

–‘ নীতু বাড়াবাড়ি করবি না একদম৷ এই কাগজের উপর তোর আর আমার সম্পর্ক ডিপেন্ড করছে না কিন্তু৷ তুই আমার বিয়ে করা বউ এইটা সবাই জানে৷’

আমার কান্না পাচ্ছে খুব৷ চোখে পানির অস্তিত্ব টের পেলাম৷
–‘ এতো কিছু আমি মেনে নিতে পারছি না কাব্য ভাইয়া৷ সত্যিই মেনে নিতে পারঁছি না৷ আপনাকে দেওয়া শর্ত আমি বুঝি না৷ ‘

উনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন৷ উঠে দাঁড়িয়ে ফাইল কাবার্ডে রাখলেন৷ ড্রেসিং টেবিল থেকে নিজের ঘড়ি হাতে পড়তে পড়তে বললেন,

–‘ মামু আর বাবার শর্ত ভিত্তিহীন নয়৷ আচ্ছা তুই বল আমাকে এইভাবে মেনে নিতে পারছিস তুই?’
আমার হেঁচকি উঠে গেছে৷ উনি পানির গ্লাস এনে বললেন,
–‘ প্রথমত,
আমিরের সাথে বিয়ে না হওয়ার জন্য মামু তোকে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে বলেন৷ বাট আমি তাকে বলি, আমির কে যেন গিয়ে বলে তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ কিন্তু মামু বললেন, পরবর্তীতে তোকে বিয়ে দিতে গেলে এই কথাটার ইফেক্ট তোর উপর পড়বে৷ আশা করি বুঝতে পেরেছিস? ‘

আমি পানিটুকু খেয়ে নিলাম৷ তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম,
‘কিন্তু আপনি ….
–‘হ্যাঁ মিথ্যা বলেছিলাম বাট সেটা সত্যি করেই তোর বিয়ের আসরে প্রমাণ দিয়েছি । ‘
–‘প্রমাণ দেওয়ার দরকার কি ছিলো….
উনি বিরক্ত হলেন আমার কথা শুনে । বিরক্তি ভঙ্গিতে বললেন,
–‘ বারবার এক কথা কেন বলছিস তুই? বারবার বলছি এককথা তাও বুঝেও না বোঝার মতো করছিস । তোর বাবা আর আমার বাবার প্রব্লেম হলো তারা আমাকে শর্ত দিয়েছে আর তোর প্রব্লেম হলো সব বুঝেও অবুঝের মতো করা।’

আমি ভয়ে ভয়ে আবার বললাম,
–‘আমার থেকে দূরে কেন যেতে বলে তারা? ‘
উনি মুচকি হাসলেন। আমার সামনে হাটু মুড়ে বসে বললেন,
–‘তাহলে তুই চাস আমি তোর সাথে থাকি ?’
আমি পিছনের দিকে পিছিয়ে বললাম,
–‘একদম না ।’
–‘ তাহলে?’
–‘ আপনি হ্ঠাৎ এতো ভালো হলেন কি করে! মানে বাবা আর ফুঁপার কথা মেনে নিচ্ছেন যে?’
উনি আমার দিকে ঝুকে বললেন,
–‘মেনে কই নিচ্ছি । আমি তো তোর সাথেই আছি । নেহাৎ,জার্মান যাওয়া আমার সপ্ন তাই যাচ্ছি….তা না হলে,,,
আমি আরো পিছিয়ে বললাম,
–‘তাহলে কি? আর ফুঁপা কিসের কথা বললেন তখন,আপনি তার কথা ভুলে গিয়েছেন।’
–‘তোর সাথে রুড বিহেভ যেন না করি এইটাও একটা শর্তের মধ্যে পড়ে । তুই ভালো মতো পড়াশোনা যেন করতে পারিস!তোর নিজের যেন একটা ভবিষ্যৎ থাকে ।’

আমি ভাবলাম গভীর ভাবে । সত্যিই ,এখন সংসার নামক বেড়াজালে আবদ্ধ হলে আমার সব সপ্ন শেষ হয়ে যাবে । উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার দিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,
–‘ আপনি আমায় ভালোবাসেন ?’
উনার হাসিমুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো । উনি উঠে দাঁড়ালেন । গম্ভীর ভাবে বললেন,
–‘ আমার যাওয়ার ডেট পাঁচদিন পর ।তুই নিজেকে সময় দে।’

আমি পিছন থেকে তাকে ডাকলাম সে পিছন না ফিরেই বললেন,
–‘ তোর পারসোনাল লাইফ আছে সেইটা নিয়ে ভাব । আর অপেক্ষার ফল সব সময় ভালো হয় ।’

আমি তার ঘরের মেঝেতে বসে রইলাম৷ বিয়েটা সত্যি হয়েছে৷ তার মানে সে আমার স্বামী৷ কয়েকবার টেনে টেনে উচ্চারণ করলাম স্বামী নামক বর্ণটাকে৷ আচ্ছা এই শব্দটা আজ এতো ভালো লাগছে কেন? তাহলে কি আমিও এই শব্দটার মায়ায় পড়ে যাচ্ছি!
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে