#রূপবানের_শ্যামবতী
#২০তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এসে উঁকি দিলো অরুনিকা। আহিয়ার কাছে শুনেছে রান্নাবান্নার কাজ বাড়ির বউদেরই করা লাগে। এদিকে বাড়ির দুটো বউ এর কেউই আজ রান্না করার মতো অবস্থায় নেই। তাই অরুনিকাই এসেছে। তাছাড়া মা বলেছিল, বাড়ির বউ রান্নাঘরের কাজে সর্বদা নিয়োজিত থাকতে হবে, কারো আদেশের অপেক্ষা না করেই। মায়ের কথা মনে করে বিয়ের পরদিন সকালেই রান্নাঘরে এসে হাজির হয়েছে অরু। দ্বিধান্বিত মনোভাব নিয়ে ধীরপায়ে ভেতরে এগিয়ে গেলো সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছে সবকিছু। কি নেই এই রান্নাঘরে। আধুনিক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি সকল রান্নার সামগ্রী সবকিছু সুন্দর পরিপাটিভাবে সাজানো। অরুনিকা কি দিয়ে কি শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো।
— ওমা! নতুন ভাবি, আফনে এইহানে ক্যান?
চমকে উঠে অরু। পেছনে ফিরে আমেনাকে দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলো সে। এগিয়ে এসে নিচুস্বরে বলে উঠে,
— আমেনাবু, আমাকে একটু দেখিয়ে দেবে কোথায় কি আছে? আর একটু বলে দাও কি কি রান্না করা লাগবে আজ? সকালের খাবারের জন্য কি কি করতে হবে?
অরুনিকার বুবু বলে সম্বোধন আর তার বিনয়ী ব্যবহার আমেনাকে মুগ্ধ করলো। তার বেশ মায়া হলো মেয়েটার জন্য।
— নতুন ভাবি, আফনে করবেন রান্না? ভালোই হইলো। আইজ বড় ছাছীর অবস্থাও ভালা না, ছোডো ছাছীও অসুস্থ। আমি তো ম্যালা ট্যানশনে আছিলাম। আইজ রান্নাবান্না কি হইবো।
— ঠিকাছে তবে। আমাকে একটু সাহায্য করো। বাকিটা আমি করে ফেলছি।
আমেনা খুশিমনে অরুনিকাকে সবকিছু দেখিয়ে দিলো। কে কি খায়, কার জন্য কেমন রান্না করতে হবে সবটা বুঝিয়েও দিলো। অরুনিকা সেই অনুযায়ী সবটা করতে লাগলো।
রান্নাবান্না প্রায় শেষের পথে। সবটা গুছিয়ে নিচ্ছে, এমন সময় দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো তাসফিয়ার কন্ঠস্বর,
— কি ব্যাপার তুমি এখানে কি করছ?
থেমে যায় অরুনিকার সব কাজকর্ম। সোজা সটসট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। শুকনো ঢোক গিলে ফিরে দাঁড়ায়। এক পলক সামনে তাকিয়ে পরক্ষণেই মাথা নিচু করে নেয়। আমেনাই আগে কৈফিয়তের সুরে বলতে থাকে,
— ছোডো ছাছী আমিই কইছিলাম নতুন ভাবিরে রান্না করনের কতা। কেউই তো নাই। বেলাও হইয়া যাইতাছিল।
আমেনার কথা শুনে তাসফিয়া তার দিকে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে শান্তভাবে একবার অরুনিকাকে দেখে নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও আটকে যান। আহরারের ডাক শোনা যাচ্ছে। তাসফিয়া ছুটে যান ড্রয়িংরুমের দিকে। তার ঘুম ভেঙেছে আজ অনেক বেলা করে। গতকাল রাতে জ্ঞান হারানোর পর তার তো আর কিছুই মনে নেই। ফারহা বসে আছে সোফায় হেলান দিয়ে। তার ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে চোখ যেতেই তিনি ছুটে এসে বসে পড়েছেন পাশে।
— কিরে, কি হয়েছে? তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন ফারহা?
সিঙ্গেল সোফাটায় বসতে বসতে আহরার উত্তর দিল। রাতের ঘটনাটা বলতেই তাসফিয়া ফারহার দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে থাকেন।
— এমন একটা কাজ কেন করলি মা?
এবারও উত্তরটা আহরার দিল,
— কেন করল সেটা একটুপরই খোলাসা হয় যাবে মা। আগে সবাইকে আসতে দাও। আগে বলো, তোমার শরীর এখন কেমন?
আহরারের কথা শেষ হতে না হতেই সকলে চলে এলো। তাসফিয়া উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ পেলেন না। ফারজানা এসেই মেয়ের কাছে বসে মেয়েকে আগলে নিলেন বুকে। গুলবাহার হা হুতাশ করতে করতেই মুখোমুখি রাখা সোফায় বসেন আর বলতে থাকেন,
–আহারে, আমার এতো আদরের নাতনিটা। এক রাতেই তার সুন্দর মুখখানার এ কি অবস্থা।
আফতাব সাহেবও এসে বসেন। আহিয়া, আয়াজ দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।
–এখন কেমন আছিস ফারহা মা?
আফতাব সাহেবের প্রশ্নে হালকা হেসে উত্তর দিলো ফারহা,
–এইতো ছোটো আব্বু অনেকটা বেটার।
আহরার বলে,
–হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই তবে টানা ১ সপ্তাহ বেড রেস্ট এর কড়া হুকুমও জারি করা হয়েছে। এর যেন নড়চড় না হয়।
–রেস্ট? কি করে রেস্ট নিবে আমার ফারহা দাদুমনি। যার জন্য আজ ওর এ অবস্থা তাকে এ বাড়িতে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলে মেয়েটা সুস্থ হবেনা বরং আরো খারাপ হবে ওর অবস্থা। এ কথা কি তুমি বুঝতে পারছো না দাদুভাই?
গুলবাহারের কথার জবাবে ফারহা কিছু বলতে গেলে আহরার হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয়। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলে ওঠে,
–কার জন্য ওর এ অবস্থা দাদীজান?
–কেন? ঐ কালো বিচ্ছিরি মেয়েটা যাকে তুমি বিয়ে করে এনেছো?
–সেই মেয়েটা কি করেছে? যার জন্য ফারহার অবস্থা খারাপ হবে?
–কি করেছে মানে? তুমি কি আমার সাথে মজা করছো দাদুভাই? তোমার স্ত্রী হওয়ার কতো স্বপ্ন বুনেছিলো আমার ফারহা দাদুমনি, কিন্তু ওই মেয়ে সেই জায়গা কেড়ে নিলো। আমার দাদুমনি কি করে ভালো থাকবে তুমি বলো?
আহরার হাসলো। খানিকটা শব্দ করেই হাসলো। কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে পুনরায় বলে ওঠে,
–ফারহা কেন আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে দাদীজান যেখানে আমি বিয়েটাতেই রাজি ছিলাম না। আমার এই বিয়েতে অসম্মতি সেই সাথে নিজের পছন্দের কথা আমি তো সাথে সাথেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। তবে ফারহাকে তো আপনারই জানিয়ে দেওয়ার কথা বিষয়টি। তাই নয় কি?
চুপসে যান গুলবাহার। তাকে কেমন ভীত দেখাচ্ছে। আশপাশে তাকান। সকলে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতে করে আরো বেশি ভড়কে যান গুলবাহার। কিন্তু তিনি দমবার পাত্রী নন। নিজেকে সামলে নেন। কঠোর স্বরে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করান,
–কেন বলবো আমি এ কথা ফারহাকে? আমি তখন তোমার সামনে ব্যপারটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে আমি তা মেনে নিতে পারিনি। কারণ আমি কিছুতেই চাইনা ফারহা দাদুমনি এ বাড়ি ছেড়ে যাক। ওকে এই বাড়িতে, এই পরিবারের সাথেই রেখে দেওয়ার জন্য এ ছাড়া আর কি বা উপায় ছিলো? আর তাছাড়া আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তুমি কোথাকার কোন এক গ্রামের মেয়েকে পছন্দ করেছো। এসব গ্রামের মেয়ে কখনো ভালো হয়না। তারওপর মেয়ের গায়ের রং যা তোমার সাথে একেবারেই বেমানান। এমন মেয়েকে আমি কিভাবে মানবো? তাই আমি ফারহাকে জানাইনি কিছু। কারণ আমি ঠিক করেই নিয়েছিলাম আমি ওই মেয়েকে কিছুতেই মানবো না।
রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলো অরুনিকা। গুলবাহারের কথা শুনে কষ্টে, অপমানে তার চোখে অশ্রু এসে ভিড় করে। আলগোছে তা মুছে নিয়ে সামনে চাইতেই আহরারের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় তার।
দৃষ্টি তার দিকে রেখেই আহরার জবাব দেয়,
–অরুনিকা আমার কাছে এমন একজন মানুষ যাকে আমি কখনোই কোনো কিছুর বিনিময়েই ছাড়তাম না। আর সেই মানসিকতা এখনো বিদ্যমান।
চোখ ফিরিয়ে গুলবাহারের দিকে তাকায় আহরার। পুনরায় প্রশ্ন করে,
–আপনার কেন মনে হলো দাদীজান, আপনি না মানলে আমি অরুনিকাকে ছেড়ে ফারহাকে বিয়ে করে নিবো?
–আমার কথা অমান্য করার সাহস এ বাড়িতে কার আছে?
–আপনার কথা ততক্ষণ পর্যন্ত মান্য দাদীজান, যতক্ষণ তা ন্যায়সঙ্গত। অন্যায় আদেশ হলে আর যাই হোক আমি আহরার তাতে কখনোই সায় জানাবো না।
একটু থেমে সামনে সরে আসে আহরার। হাঁটুর ওপর কনুই রেখে ঝুঁকে বসে সরাসরি গুলবাহারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–কি বলুন তো দাদীজান, আমি আফজাল বা আফতাব নই। আমি আহরার।
–আহরার, নিজের দাদীর সাথে এ কেমন ব্যবহার তোর?
মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকায় আহরার। কিছুটা কড়াসুরে জবাব দেয়,
–অরুনিকাকে গ্রহণ করতে তোমার কিসের ভয় ছিলো মা? শুধু কি দাদীজান না মানার কারণে নাকি অন্য কোনো ব্যপার আছে?
চুপ হয়ে যান তাসফিয়া। আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। এই কথার কোনো জবাব নেই তার কাছে। হয়তো আছে তবে সাহস নেই বলার।
আহরার উঠে দাঁড়ায়। চলে যেতে গিয়েও পিছিয়ে আসে আবার। গুলবাহারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আর কি যেন বলছিলেন দাদীজান? গ্রামের মেয়েরা ভালো হয়না?
একবার অরুনিকাকে দেখে নেয় সে, অরুনিকা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আহরার পুনরায় দাদীর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ওঠে,
–আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, আপনিও কিন্তু গ্রামেরই মেয়ে। রইলো বাকি গায়ের রং? মেয়েটার ওই গায়ের রং শুধুমাত্র গায়েরই রং মনের রং নয়। যাই হোক, সবকিছু পজিটিভলি মেনে নিন সবাই। হ্যাপি ফ্যামিলি হয়ে হ্যাপিলি থাকুন। দেখবেন শান্তিপূর্ণ ভাবে জীবন কেটে যাচ্ছে।
কথা শেষ করে আহরার গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেলো নিজের ঘরের দিকে। পেছনে রেখে গেলো কতগুলো বিস্মিত চাহনি।
~~~
ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা সমানে পায়চারি করে যাচ্ছেন তাসফিয়া। আফতাব সাহেব ঘরে ঢুকে তাসফিয়ার এমন অস্থিরতা দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে ডেকে ওঠেন,
–তাসু।
স্বামীর ডাকে থেমে যান তাসফিয়া। সামনে ফিরে তাকান। আফতাব সাহেব এগিয়ে এসে দুহাতে তাসফিয়ার মুখটা আগলে নিয়ে কোমলস্বরে বলেন,
–কি হয়েছে তাসু? এতোটা চিন্তিত হয়ে আছো কেন?
তাসফিয়া কোনো জবাব দেননা। কেবল করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এই দৃষ্টি অনেক কিছুই বলে দেয়। যা আফতাব সাহেবের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়না।
–আচ্ছা, তুমি এসো। এদিকে এসে বসো তো।
আফতাব সাহেব তাসফিয়াকে বিছানায় বসিয় নিজেও পাশে বসেন। তাসফিয়ার একহাত সযত্নে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলেন,
–অরুনিকাকে নিয়েই ভাবছো তো? কি করবে না করবে তা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্ব?
চোখ তুলে তাকান তাসফিয়া। এই মানুষটা বরাবরই তার মনের কথা বুঝে নিতে দক্ষ। না বললেও কিভাবে যেন সবটা বুঝে নিতে পারেন তিনি। একারণেই তো তিনি এতো অত্যাচারিত হয়েও দিনশেষে সবটা ভুলে গেছেন এই মানুষটার মুখের দিকো তাকিয়েই। আফতাব সাহেব পুনরায় বলে ওঠেন,
–অরুনিকাকে মেনে নাও তাসু। তোমার ছেলের সুখ মেয়েটা। ছেলের কথা ভেবে হলেও মেনে নাও।
–কিন্তু আমার যে বড্ড ভয় হচ্ছে গো? যে দিনগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি সেসব যদি আমার ছেলের জীবনে ঘটে?
–যদি ঘটে তবে সবচেয়ে বেশি কিন্তু অরুনিকাকেই ভুগতে হবে। ঠিক যেমনটা তোমাকে ভুগতে হয়েছে।
আফতাব সাহেবের কথা তাসফিয়াকে আটকে দেন।
–তাসু, ভেবে দেখো যা কিছু হয়েছিলো সব কষ্ট তোমাকেই বেশি সইতে হয়েছে। কিন্তু তখন তোমার পাশে আমি ছাড়া কেউ ছিলো না। লড়াইটা তাই অনেক কঠিন ছিলো তোমার জন্য। তবে আমাদের ছেলে-বউমার লড়াইটা কঠিন হতে দেবো না আমরা। আমরা যদি ওদের সাথে থাকি লড়াইটা মোটেও লঠিন হবেনা।
তাসফিয়া ভাবনায় পড়ে যান। আফতাব সাহেব আবারো বলেন,
–বিয়েটা স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আহরারের সাথে অরুনিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তুমি আমি চাইলেই তা অস্বীকার করতে পারবোনা। তাই আমাদের উচিত এটা মেনে নিয়ে ওদের পাশে থাকা। ওদের পথটা সহজ করতে সাহায্য করা। তুমি আর মুখ ফিরিয়ে থেকো না তাসু।
তাসফিয়া ভাবেন, “সত্যিই কি তার মেনে নেওয়া উচিত?”
~~~
কেটে গেছে সপ্তাহ খানেক। বাড়ির পরিবেশ এখন অনেক শান্ত। সেদিনের পর থেকে গুলবাহার বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। শান্ত মেজাজে থাকছেন সবসময়। কারো সাথে কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য করেন না। আশ্চর্যের বিষয় হলো এখন অরুনিকা তো দূর তাসফিয়াকেও কটু কথা শোনান না আর। এটা সত্যিই পরিবর্তন নাকি এর ভেতরে রয়েছে অন্যকোনো রহস্য? তা সকলের অজানা।
ফারহা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবে কাটা জায়গাটা পূরণ হতে আরো সময় লাগবে। সে অরুনিকার সাথে খারাপ ব্যবহার না করলেও খুব একটা কথা বলেনা। মূলত সে সকলের সাথেই কম কথা বলছে ইদানীং। নিজের মতো ব্যস্ত থাকে। মনকে ঠিক রাখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তার।
তাসফিয়া সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। অরুনিকার সাথে ঠিকঠাকভাবে কথাবার্তা চালালেও চোখে মুখে এক আলাদাই গাম্ভীর্যতা ফুটিয়ে রাখেন সর্বদা। অবশ্য এ নিয়ে অরুর কোনো অভিযোগ নেই। সে কেবল এ বাড়ির যোগ্য বউ হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ফারজানার কোনো কিছুতেই কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি খোলা মনের মানুষ। সকলের সাথে মিলেমিশে ভালোভাবে থাকতেই পছন্দ করেন তিনি। তাই অরুনিকার প্রতি কোনো বিরূপ আচরণ নেই তার। বাড়ির বাকি সদস্যদের মতোই দেখেন তিনি অরুনিকাকে।
আহিয়া রীতিমতো “ভাবি পাগল” হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণ শুধু “অরুভাবি, অরুভাবি” করতে থাকে। নিজের মনের কথা উজার করে বলার মতো একটা মনের মতো মানুষ পেয়েছে সে। তবে আয়াজও বা কম কিসের? সে ও ভাবিভক্ত হয়ে বসে আছে। ভাবিকে দলে টানতে দুজনে প্রতিযোগিতাও করতে থাকে।
আফতাব সাহেব তো শুরু থেকেই ঠিক আছেন। অন্যদিকে আফজাল সাহেব প্রথমে মেয়ের কথা ভেবে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলেও অরুনিকার ব্যবহার তার মনকে বিগলিত করে দিয়েছে। অরুনিকাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখতে শুরু করেছেন তিনি। একদিন তো বলেই বসলেন, “অরুমার মতো মেয়ে যে বাড়িতে থাকবে সত্যিই সে বাড়ি আলোকিত হয়ে যাবে।”
বলতে গেলে, আপাত দৃষ্টিতে খান পরিবার এখন একটি সুখী পরিবার হয়ে রয়েছে। তবে এই সুখের স্থায়ীত্ব কতকাল তা-ই দেখার বিষয়।
___
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে আহরার। একটু পর অরুনিকাও চলে আসে। ক্লান্ত শ্রান্ত মুখ। সারাদিন ব্যস্তময় সময় কাটে তার। সংসারের কাজের ধকল সামলে সারাদিন শেষে এই রাতটুকুই বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয় তার।
এ কটা দিন আহরারের সাথে খুব একটা কথা হয়ে ওঠেনি। আহরারও এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলে না। নিজেই ছেড়ে রেখেছে অরুনিকাকে। কারণ সে কোনোকিছুই অরুনিকার ওপর চাপিয়ে দিতে চায়না। সে চায় অরুনিকা নিজের মতো সব সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক করে নিক। তার সাপোর্ট তো আছেই সবসময়।
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো অরুনিকা। আহরারের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। অরুনিকা কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকে খানিকক্ষন। তারপর চিরুনিটা হাতে নিয়ে চুল আঁচড়ানোতে মনোযোগ দেয়। ওদিকে সামনে ফোন থাকলেও আহরার আড়চোখে বারবার অরুনিকার দিকেই দেখছে।
–দেখলে সরাসরি দেখুন। ওমন চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন কেন?
থতমত খেয়ে যায় আহরার। এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। কি করবে না করবে দিশা হারিয়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলানোর প্রয়াস চালায়। ফোনটা একেবারে চোখের সামনে নিয়ে এসে তাতে এমনভাবে মনোযোগ দেওয়ার অভিনয় করছে যেন সে অরুনিকার কথা শুনতেই পায়নি। তা দেখে অরুনিকা মৃদু হাসলো। বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আহরারকে আরো একটু বিব্রত করতেই বলে ওঠে,
–থাক, আর ফোনে মনোযোগী হওয়ার অভিনয় করতে হবেনা। দেখেছেন তো দেখেছেন। নিজের বউকেই তো দেখেছেন। এতে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
অবাক হয়ে আহরার বড় বড় চোখ করে তাকায় অরুনিকার দিকে।
–কি বলছো তুমি অরু?
–কেন কি বলেছি?
সত্যি সত্যি অস্বস্তিতে পড়ে গেলো আহরার। কি আজব! হুট করে তার কি হলো? এমন লজ্জা পাচ্ছে কেন সে?
অরুনিকা ঠোঁট টিপে হাসছে। আহরার দু একবার গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে সামলানোর প্রয়াস করলো। তারপর কিছু বলতে যাবে হঠাৎ টিপটিপ করে বৃষ্টির আওয়াজ কানে ভেসে এলো তার। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দেখলো, সত্যি সত্যি বৃষ্টি নেমেছে। চোখ বুজে বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে থাকে সে। অরুনিকাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। না দেখেও তা বুঝতে পারলো আহরার। অরুনিকার দৃষ্টি আহরারের দিকে।
–আপনার বৃষ্টি ভালো লাগে?
চোখ খুলে অরুনিকার দিকে তাকায় আহরার। হালকা হেসে জবাব দেয়,
–ভিষওওওণণ।
আহরারের ইচ্ছে হলো একবার বলতে, “চলো দুজনে মিলে ভিজি একসাথে।” কিন্তু বললো না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–তোমার?
–নাহ।
অরুনিকার উত্তরে মন খারাপ হয়ে গেলো আহরারের। অরু বৃষ্টি পছন্দ করেনা। তবে একসাথে ভেজার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে যাবে?
–একটু ছাদে চলুন তো।
–কেন?
–আহহা! চলুন না।
অরুনিকা আগে আগে হাঁটতে লাগলো। আহরার অরুনিকাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে। ছাদে এসে দরজা মেলে দিতেই বৃষ্টির ছাটা এসে গায়ে লাগে দুজনের। আহরারের মনটা স্নিগ্ধ আবেশে ভরে গেলো যেন। অকস্মাৎ তাকে একরাশ বিস্ময়ে ফেলে দিয়ে অরুনিকা ছুটে চলে গেলো ছাদের মাঝখানে। পিছু ফিরে একগাল হেসে বলে ওঠে,
–কি হলো? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এদিকে আসুন।
আহরার রোবটের মতো এগিয়ে গেলো। বিস্মিত নয়নে নিষ্পলক চেয়ে আছে কেবল অরুনিকার পানে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে এসে লাগতেই আহরার নিজের ধ্যান ছেড়ে বেরিয়ে আসে। একবার আকাশের দিকে তাকায়। অন্ধকার আকাশ। হয়তো মেঘে ছেয়ে আছে। যা এখন দৃশ্যমান নয়। চোখ নামিয়ে সামনে তাকায়। আরো এক দফা বিস্মিত হয় অরুনিকাকে দু হাত মেলে বৃষ্টি উপভোগ করতে দেখে। সত্যি কি অরুনিকা বৃষ্টি অপছন্দ করে? নাকি মজা করে বলেছিলো? গাঢ় স্বরে ডেকে ওঠে,
–অরু..
অরুনিকা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় আহরারের হতভম্ব মুখের দিকে। আহরারের কথা আটকে আছে। শব্দমালা হারিয়ে গিয়েছে। কিছুই যেন কন্ঠ গলে বেরোতে চাইছে না। অরুনিকা তা বুঝতে পারে।মোহনীয় হাসি হেসে কাছে এগিয়ে আসে। দূরত্ব ঘুচিয়ে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে সম্মোহনী কন্ঠে বলে ওঠে,
–আমি সত্যি বৃষ্টি অপছন্দ করি। তবে যেই মানুষটা আমার জন্য নিজের আকুল ইচ্ছে প্রশমিত করে নেয় তার জন্য এই একটা অপছন্দ কেন, নিজের পুরো জগতটাই পাল্টে নিতে রাজি আমি।
আহরার অবাক হচ্ছে না আর। অদ্ভুত শীতলতায় ভরে গেছে তার মন। এই বর্ষণ আজ এতো সুখ সুখ অনুভূতি দিচ্ছে কেন? প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা প্রেমময় ছন্দতাল ফুটিয়ে তুলছে তার মনের গহীনে। ধুয়ে মুছে দিচ্ছে আহরার-অরুনিকার দূরত্ব। একটু একটু করে পরিপূর্ণতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে আহরারের ভালোবাসা।
চলবে….