#রূপবানের_শ্যামবতী
#১৮তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
মায়া মায়া আদল, শ্যামবর্ণী মেয়ে বউ সাজে দাঁড়িয়ে আছে। তাসফিয়া মনোযোগ দিয়ে দেখছেন মেয়েটিকে। এ যেন নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখছেন তিনি। ৩০ বছর আগের নিজেকে এবং নিজের ঘটনাকে। এভাবেই তো তিনিও বউ সাজে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ওই দরজাটাই। কিন্তু এর পরবর্তীতে যা যা ঘটেছিলো…
তাসফিয়া আর ভাবতে পারেন না। তখনই গুলবাহারের চিৎকার শোনা গেলো।
–এই মেয়েএএএ… এই মেয়ে এই বাড়িতে কেন এসেছে? কেন ঢুকেছে সে?
আহরার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে গুলবাহারের দিকে। দাদীজান হঠাৎ এমন ব্যবহার কেন করছেন?
গুলবাহার ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে এসে অরুনিকার হাত চেপে ধরেন শক্ত করে। টেনে নিয়ে যেতে থাকেন দরজার দিকে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অরুনিকা তাকিয়ে আছে গুলবাহারের দিকে। হুট করে কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে তা বুঝে ওঠার সময়টুকুও পাচ্ছেনা সে। গুলবাহার তাকে ঠেলে বের করে দেওয়ার পূর্বমুহূর্তেই আটকে যান তিনি। ফিরে তাকিয়ে দেখেন আহরার অপর পাশ থেকে ধরে রেখেছে অরুনিকার আরেকহাত।
ভিষণ শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে আহরার,
–দাদীজান, সে আমার স্ত্রী। আপনি তাকে এভাবে বের করে দিতে পারেন না।
গুলবাহার থেমে যান। ছেড়ে দেন অরুনিকার হাত। হঠাৎ তার মাথায় আসে, এ তিনি কি করতে যাচ্ছিলেন? রাগের মাথায় এখুনি তো একটা বড় ভুল করে ফেলছিলেন। চোখ বুজে বড় বড় শ্বাস নেন তিনি। ভেতরের রাগটাকে প্রশমিত করার চেষ্টায় বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে থাকেন। অতঃপর চোখ খুলে সর্বপ্রথম অরুনিকার দিকে তাকান। আগাগোড়া ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এবার আহরারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
–দাদুভাই, তুমি এমন একটা কাজ করবে আমি আশা করিনি।
–দাদীজান, আমি তো আপনাকে বলেছিলাম অরুনিকার কথা। আমি খুব তাড়াতাড়িই আপনাদের নিয়ে পারিবারিক ভাবেই ওকে বিয়ে করে আনার চিন্তা ভাবনা করেছিলাম। তবে ভাগ্য অন্যরকম ছিলো। তাই এভাবেই হুট করে হয়ে গেলো বিয়েটা।
ধীরপায়ে গুলবাহার সোফার কাছে গিয়ে বসে পড়েন। আরো একবার অরুনিকাকে দেখে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেন,
–আমি ভেবেছিলাম তোমার পছন্দ হবে তোমার মতোই সুন্দর। কিন্তু তুমি.. একবারো কি তাকিয়ে দেখোনি এই মেয়েকে তোমার সাথে, তোমার পাশে আদৌও মানায় কিনা।
গুলবাহারের কথা শুনে আহরার অরুনিকার দিকে তাকায়। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরুনিকা। হয়তো চোখে পানি টলমল করছে। ভয়ে। অপমানে। আহরার দৃষ্টি ফেরায় গুলাবাহারের দিকে। প্রশ্ন করে,
–আপনার কাছে “সৌন্দর্য” মানে কি দাদীজান?
গুলবাহার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকান আহারারের মুখের দিকে। আহরারের প্রশ্ন শুনে তিনি যে বেশ বিরক্ত হয়েছেন তা তার মুখভঙ্গিমা দেখলেই বোঝা যায়। তিক্ত কন্ঠে জবাব দেন,
–এ আবার কেমন প্রশ্ন, দাদুভাই। সৌন্দর্য মানে কি তা তুমি জানোনা? যা দেখলেই মানুষের ভালো লাগে, দেখে শান্তি পাওয়া যায়..
আহরার শব্দ করে হাসে। অরুনিকার দিকে ফিরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–ঠিক বলেছেন দাদীজান। যা দেখলেই ভালো লাগে, দেখে শান্তি পাওয়া যায় তাই তো সৌন্দর্য।
কথাটুকু বলে থেমে যায় আহরার। গুলবাহারের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে ওঠে,
–আমিও অরুনিকাকে দেখে শান্তি পাই, দাদীজান। তাই আমার কাছে “সৌন্দর্য” মানে অরুনিকা। আমার পছন্দ আমার মতোই সুন্দর..
গুলবাহার গা এলিয়ে দেন সোফায়। চোখ বুজে রাখেন। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখতে হচ্ছে। সেই একই ভুল। যে ভুল একবার বাবা করেছে সে ভুল আজ ছেলেও করলো। কি করে সহ্য করবেন তিনি?
মায়ের সামনে মুখোমুখি এসে বসেন আফতাব। ধীরকন্ঠে বলেন,
–আম্মাজান! এই বিয়েটা আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছি। আহরার যাকে পছন্দ করেছে তাকে আমি বউমা হিসেবে মেনে নিয়েছি। কারণ আমার ছেলের পছন্দের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। তাই আপনার প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, এবারে অন্তত মেনে নিন। দয়া করে অরুনিকার সাথে সেসব করার চিন্তা করবেন না যা তাসফিয়ার সাথে করেছিলেন।
ঝট করে চোখ খুলে তাকান গুলবাহার। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন আফতাবের দিকে। আফতাব সাহেব ভড়কান না। মায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে উঠে পড়েন।
এদিকে ফারজানা তাসফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
–এসব হচ্ছেটা কি তাসফি? তোর ছেলের যেহেতু অন্য কাওকেই পছন্দ তাহলে আমার মেয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হলো কেন? একবারো ভাবলো আমার মেয়েটার কি হবে? ওর যে মনটা ভেঙে যাবে।
তাসফিয়া কোনো জবাব দেয়না। সে এখনো একদৃষ্টিতে অরুনিকাকেই দেখে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে পুরোনো স্মৃতি। অরুনিকার এ বাড়িতে পদার্পণ তাকে তার ক্ষতবিক্ষত অতীত মনে করিয়ে দিচ্ছে।
গুলবাহার নিজেকে শান্ত রাখার হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কিছুতেই পারছেন না। তেজিভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ান তিনি। ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলে ওঠেন,
–আহরার, একটা কথা ভালো করে শুনে রেখো, এই কালো কুৎসিত মেয়েকে আমি কিছুতেই তোমার বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা। তোমার দিকে তাকালে এই মেয়েকে মেনে নেওয়ার দুঃসাহস আমার হবেনা। কিছুতেই হবে না।
কথাগুলো বলেই তিনি গটগটিয়ে হেঁটে চলে যান নিজের ঘরের দিকে।
আফতাব সাহেব সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়েন। আহরারকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
–আহরার বউমাকে নিয়ে ঘরে যা। বিশ্রাম নে। অনেক ধকল গেছে।
আহরার মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। অরুনিকাকে নিয়ে এগিয়ে যেতেই হুট করে তাসফিয়া এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। আহরার কিছু বলার আগে তাসফিয়া বলে ওঠে,
–ওকে যেখান থেকে এনেছিস সেখানেই রেখে আয় আহরার।
আফতাব সাহেব কিছুটা উঁচুস্বরে বলে ওঠেন,
–কি সব ভুলভাল বলছো তাসফিয়া?
–আহরার, মায়ের কথা শোন। ভালো চাস তো মায়ের কথা শোন। এই ভুল আর নয়। তুই মেয়েটাকে রেখে আয়। রেখে আয়। ওকে এই বাড়িতে রাখা যাবেনা। সর্বনাশ হয়ে যাবে। মহাসর্বনাশ হবে। তুই যা ওকে রেখে আয়। যা.. যা…
বলতে বলতে আহরারকে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা করেন তাসফিয়া। কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো আচরণ করছেন তিনি। আহরার মাকে দুহাতে আগলে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাসফিয়া যেন একই বুলি আওড়াতে ব্যস্ত, “ওকে রেখে আয়, ওকে এ বাড়িতে রাখা যাবেনা।”
–মা, একটু শান্ত হও। ও এই বাড়ির বউ। এটাই ওর ঠিকানা। ওকে আমি রেখে আসতে পারবোনা। তুমি কেন এমন করছো? তুমি তো আমার পছন্দ মেনে নিয়েছিলে।
ক্ষেপে উঠলেন তাসফিয়া। ক্ষেপাটে স্বরে চেঁচিয়ে বলতে থাকেন,
–আমি মেনে নিয়েছিলাম কারণ আমার ধারণা তোর পছন্দের মেয়েটা অবশ্যই খুব সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু তুই একটা কালো মেয়েকে পছন্দ করেছিস আবার বিয়ে করে নিয়ে চলে এসেছিস। তুই জানিস না এই একটা ভুলের জন্য তোর ওপর কি আযাব নেমে আসবে। তুই বুঝতে পারছিস না।
তাসফিয়া এগিয়ে এসে ছেলের মুখে, মাথায়, গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে পাগলের মতো বলতে থাকেন,
–সোনা বাবা আমার কথা শোন। মেয়েটাকে রেখে আয়। তোর জীবন বিভীষিকাময় হয়ে যাবে। তোর সুখ শান্তি সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। এই মেয়েটার জন্য…
এবার অরুনিকার দিকে তাকিয়ে পুনরায় ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠেন,
–এই মেয়ে, এই মেয়ে.. চলে যাও তুমি। চলে যাও এখান থেকে। তোমার জন্য আমার ছেলেটার জীবনটা তছনছ হয়ে যাবে। চলে যাও.. চলে যাও..
এবার আফতাব সাহেব এসে তাসফিয়াকে নিজের দিকে ঘোরান। দুহাতে মুখটা আগলে নিয়ে কোমলস্বরে বলেন,
–তাসু, এমন পাগলামো করছো কেন? কিচ্ছু হবেনা। তুমি ভয় পেওনা। আমাদের ছেলেটার প্রতি বিশ্বাস রাখো।
তাসফিয়া আফতাব সাহেবের কলার টেনে ধরেন। রাগে, ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলতে থাকেন,
–তুমি? তুমি কি করে এতো বড় সর্বনাশটা করলে আমাদের ছেলের? কি করে পারলে? তুমি কি নিজের অতীত ভুলে গেছো? তেমার কি মনে নেই নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাগুলো? ছেলেকেও সেই আগুনে কেন ফেলে দিলে? কেন? কেন? কেন?
চিৎকার করতে করতে কাঁদতে থাকেন তাসফিয়া। আফতাব সাহেবের কলার টেনে ঝাঁকাতে থাকেন আর পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকেন, “আমি হতে দিবোনা। আমার ছেলের সর্বনাশ আমি হতো দিবোনা। কিছুতেই না কিছুতেই…”
বলতে বলতেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েন তাসফিয়া। আফতাব সাহেব বুকে আগলে নেন তাসফিয়াকে। আহরার দ্রুত ছুটে এসে মাকে ধরে নেয় শক্ত করে। আহরার উদ্বিগ্ন স্বরে বলতে থাকে,
–মাকে ঘরে নিয়ে চলো বাবা। প্রচন্ড শক পেয়েছে।
আফতাব সাহেব তাসফিয়াকে পাঁজাকোলে নিয়ে নেন, আহরারও একপাশে ধরে রেখে নিয়ে যেতে থাকে মাকে মা-বাবার ঘরের দিকে। যাওয়ার আগে আহিয়াকে বলে দিলো, অরুনিকাকে যেন তার ঘরে নিয়ে যায়। আফতাব সাহেব আয়াজকে ডাক্তার ডাকার কথা বলেন। আয়াজ সাথে সাথে ফোন লাগায়। আহিয়া এগিয়ে এসে অরুনিকার কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেয়,
–চিন্তা কোরো না ভাবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো ঘরে চলো।
আহিয়া অরুনিকাকে আহরারের ঘরে রেখে এলো।
এদিকে পুরো ঘটনাটা ভালোভাবেই দেখলো ফারহা। ওপরে রেলিং এর কাছে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো সে। নিচে নামেনি। কোনো শব্দও করেনি। শান্ত ভাবেই দেখেছে সবটা। সকলে চলে যাওয়ার পর সে ধীরপায়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
ডাক্তার এসে তাসফিয়াকে দেখে গিয়েছেন। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ পড়ায় সইতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। পুরো রাতটা বিশ্রাম প্রয়োজন। তাসফিয়ার মাথার কাছে বসে আছেন আফতাব সাহেব। আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিছুটা দূরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আহরার। গভীর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুসময় পর থমথমে গলায় বলে ওঠে,
–তোমাদের অতীতটা কি সত্যিই খুব খারাপ ছিলো বাবা?
আফতাব সাহেব চোখ তুলে তাকান ছেলের দিকে। তাদের জীবনের গল্পটা ছেলেমেয়েদের অজানা। তাসফিয়া নিজেই বরাবর সতর্ক থেকেছে এই ব্যপারে। অথচ আজ ঝোঁকের বশে নিজেই সবকিছু সামনে নিয়ে চলে এলো। উঠে দাঁড়ান আফতাব সাহেব। তাসফিয়ার গায়ের চাদরটা দিয়ে আরেকটু ভালোভাবে ঢেকে দেন। আরো একবার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন। এরপর ছেলের কাছে এসে দাঁড়ান। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ম্রিয়মাণ স্বরে বলতে থাকেন,
–গল্পটা খুব একটা সুখকর ছিলোনা। জানিস, তোদের মা আমার দৃষ্টিতে নিঁখুত একটা মানুষ। কিন্তু সকলের কাছে সে ছিলো ত্রুটিপূর্ণ। কেন বল তো? ওর গায়ের রং। এই রংএর ছেলেরা যদিও বা দুনিয়ায় মোটামুটি টিকেও যায় তবে অসীম ধৈর্যের অধিকারী না হলে মেয়েদের টিকে থাকা কঠিন। শ্যামবর্ণ মেয়েদের অভিশাপ মনে করার এই জঘন্য সমাজে তোর মা পিষ্ট হয়ে এসেছে বরাবর। আর এই মেয়েটাকে সঙ্গ দেওয়ায়, তার পাশে থাকায়, তাকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ায় আমিও দোষী হয়ে গিয়েছিলাম। সেসব বিচ্ছিরি অতীত এখনো মনে করলে তোদের মা ভয় পেয়ে ওঠে।
থেমে গেলেন আফতাব সাহেব। আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহরারের দিকে তাকান। আহরার এখনো তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আফতাব সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
–চিন্তা করিস না। তোর মাকে তো তুই চিনিস। শান্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই বরং এখন ঘরে যা। বউমা একা আছে। যা কিছু হলো মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক ভয় পেয়ে আছে। তুই ওর কাছে যা। আমি আছি এখানে।
–ঠিকাছে বাবা, কোনো দরকার পড়লে ডেকো।
–হুম।
আহরার চলে যায়। তবে দরজার কাছে গিয়ে বাবার দিকে একপলক তাকিয়ে মনে মনে বলে,
“গল্পটা যে খুব একটা সহজ নয় তা আমি বুঝেছি বাবা। আর আমার যে পুরোটাই জানা জরুরি। সময়মতো সবটা বের করে নিব আমি। এরপর আমি তা-ই করবো যা আমার বিবেক আমায় করতে বলবে।”
______
বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে অরুনিকা। মাথায় ঘুরতে থাকা দুঃশ্চিন্তার পাহাড়। কি হয়ে গেলো? কেন হলো? এবার কি হবে? ভাবতে ভাবতে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে তার। সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে।
খট করে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসে সে। সতর্ক দৃষ্টিতে খেয়াল করতেই বুঝতে পারে, আহরার এসেছে। একরাশ জড়তা আর সংকোচে আরো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। আহরার ভেতরে ঢুকে অরুনিকাকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে বেশ শান্ত স্বরে বলে ওঠে,
–কি ব্যাপার! এখনো এভাবে বসে আছো কেন? যাও চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়িটা খুলে রাখতে রাখতে আবারো বলে ওঠে,
–ওহহো! তোমার তো খাওয়াও হয়নি। নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
–আমার একটা কথা বলার ছিলো।
দরজার কাছে যেতেই অরুনিকার মিনমিনে স্বরের আওয়াজ ভেসে আসে আহরারের কানে। দাঁড়িয়ে পড়ে সে। পিছু ফিরে সরাসরি অরুনিকার দিকে তাকাতেই অরুনিকা চোখ নামিয়ে নেয়। মাথা নিচু করে পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝে খুটতে থাকে। আহরার এগিয়ে আসে। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠে,
–হুম! বলো।
ভীতস্বরে কিছুটা থেমে থেমে জবাব দেয় অরুনিকা,
–আসলে.. আমি.. আমি.. বলতে চাইছি, আপনি আপনার মায়ের কথা রাখুন। আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসুন।
কথাটুকু শেষ করেই চোখ বন্ধ করে নেয় অরুনিকা। তার মনে হতে থাকে আহরার হয়তো এখুনি রেগে যাবে। রেগে গিয়ে রামধমক দিয়ে বসবে। কিন্তু না। এমন কিছুই হয়না। ওদিক থেকে কোনো জবাবই আসে না। ধীরে ধীরে চোখ খুলে সামনে তাকায় অরুনিকা। আহরার শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। অরুনিকা তাকাতেই আহরার কিছুটা নিচু হয়ে শীতল কণ্ঠে জবাব দেয়,
–তোমাকে আমি নিয়ে এসেছি এখানে। আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে। যতদিন না আমি চাইবো এখান থেকে এক পা ও নড়তে পারবে না তুমি। না তুমি নিজে সরতে পারবে আর না কেউ তোমাকে সরাতে পারবে। যদি না আমি চাই। আর তুমি তো জানোই.. আমি এটা কখনোই চাইবোনা।
কথ শেষ করেই হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় আহরার। অরুনিকা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আহরারের ওমন শীতল কন্ঠস্বরে বলা কথাগুলো তার ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছে। আর কিছু না ভেবে সে চলে যায়, আহরারের আদেশ অনুযায়ী ফ্রেশ হতে।
বিয়ের শাড়িটা পাল্টে একটা সুতি শাড়ি পরে নিলো অরুনিকা। আহরার এখনো আসেনি। তাই সে ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো। সাজানো গোছানো ঘরটা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে লাগোয়া বারান্দায় চোখ যায় তার। সেখানে যেতেই মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেলো। ফুলগাছগুলো দেখে তার মনের সকল বিষন্নতা এক নিমিষেই দূরীভূত হয়ে গেলো। আনমনেই সেখানে ঝুলিয়ে রাখা দোলনাটাই বসে পড়ে সে। দোলনায় ঝুলতে ঝুলতে গাছগুলোকে দেখতে থাকে।
–অরু, তুমি এখানে?
আহরারের কন্ঠস্বর পেয়ে ধড়পড় করে উঠে দাঁড়ায় অরুনিকা। দাঁড়াতে গিয়ে নিজেই উল্টে পড়ে যাচ্ছিলো। কোনোরকমে গ্রিল ধরে বাঁচায় নিজেকে। আহরার তার হাতের খাবারের প্লেটটা ছোটো টি-টেবিলটার ওপর রাখে। তারপর অরুনিকার কাছে এসে আলতো করে দু বাহু ধরে তাকে বসিয়ে দেয় দোলনাটায়। মূর্তির মতো বসে থাকে অরুনিকা। একটা ছোটো টুল এনে অরুনিকার সামনে রেখে তাতে নিজে বসে পড়ে আহরার। খাবারের প্লেটটা নিয়ে তাতে রাখা ভাত মাখাতে মাখাতে বলে,
–এতো সংকোচ কেন অরুনিকা? আমি কিন্তু এখন তোমার স্বামী। তবে স্বামী ভেবে আমাকে ভয় করে চলার কোনো মানে নেই। তুমি সবসময় আমাকে বন্ধু ভাববে।
বলতে বলতে অরুনিকার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে সে। অরুনিকা ক্ষীণ স্বরে বলে ওঠে,
–আমি নিজে খেতে পারবো তো..
–স্ত্রীকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে পারা একজন স্বামীর জন্য সৌভাগ্য। তুমি কি আমার কাছ থেকে এই সৌভাগ্য কেড়ে নিতে চাও?
অরুনিকা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে না বলে। তারপর মুখটা হা করে নেয়। আহরার মৃদু হেসে অরুনিকার মুখে লোকমা তুলে দেয়। অরুনিকাকে খাওয়াতে খাওয়াতেই আহরার বলতে থাকে,
–আমি তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ হতে চাই অরু। যাকে দেখলে জড়োসড়ো হয়ে নয় বরং হাত পা মেলে রিল্যাক্সে বসতে পারবে, যার সাথে কথা বলতে গেলে ভাবনা চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মনের ভিতরে জমে থাকা ভালো-মন্দ সব কথাই যাকে বলতে পারবে। যাকে দেখলে ভয় নয় স্বস্তি পাবে, সংকোচে গুটিয়ে না গিয়ে মনখোলা হাসি হাসতে পারবে। যার সাথে থাকলে নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হবে। যার সান্নিধ্য তোমাকে শান্তি দিবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার প্রতি তুমি অগাধ বিশ্বাস রাখতে পারবে। আমি তোমার তেমনই একজন মানুষ হতে চাই অরু। আশা করি তুমি আমাকে সেই সুযোগটা দিবে।
মুগ্ধ হয়ে আহরারের সমস্ত কথা শুনছে অরু। এতোদিন সে জেনে এসেছে স্বামী মানে হুকুমজারি আর নিজের ফাইফরমাশ খাটিয়ে নেওয়া। স্বামী কখনো বন্ধু হতে চায়? বিষয়টা তার কাছে অবাস্তব কল্পনার মতো। কিন্তু নিজের স্বামীকে এমন মানুষ হিসেবে দেখছে। সে যে কিভাবে, কতোটা খুশি হবে তা-ই বুঝে উঠতে পারছেনা।
আহরার পুনরায় বলে ওঠে,
–আর হ্যা, এই ঘরটা আজ থেকে তোমারও। যতোটা অধিকার এই ঘরে আমার আছে ঠিক ততটাই অধিকার এখন তোমারও। এই বেলকনি, এখানকার সব টব, গাছ এমনকি এই দোলনাটাও, সব তোমার। বুঝতে পেরেছো?
অতি আবেগে অরুনিকা জোরে জোরে মাথা নাড়াতে থাকে। তা দেখে আহরার হো হো করে হেসে ওঠে। আহরারের হাসি দেখে অরুনিকাও হাসে। মুচকি হাসি।
তাদের এই সুন্দর মুহুর্ত দৃষ্টিগোচর হয় পেছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহার। আহরারের বলা কথাগুলোও সে শুনে নিয়েছে। নিশ্চুপে ঘরে প্রবেশ করেছিলো সে। কেন? কি কারণে? তা সে জানেনা। শুধু জানে এই ঘরটা তার হতে হতে অন্য কারো হয়ে গেলো। ভাবতে ভাবতেই আনমনে এই ঘরে প্রবেশ করে ফেলে সে। আর ভেতরে এসে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। টলমল পায়ে পেছাতে থাকে সে। যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে গেলো।
খাওয়া দাওয়া সেরে নিজেও ফ্রেশ হয়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে নেয় আহরার। বিছানার কাছে এসে দেখতে পায় অরুনিকা শুয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই আবার গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। স্মিত হেসে আহরার বিরবির করে বলে, “নাহ! এই মেয়ের জড়তা কাটানো অনেক কসরতের ব্যাপার মনে হচ্ছে।”
অরুনিকার গায়ে ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে দিয়ে পাশে থাকা ল্যাম্পটা অফ করে দেয় আহরার। ঘরের আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে। কিন্তু দু মিনিটের মাথায় হঠাৎ দরজায় ধুমধুম আওয়াজ পড়ায় হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে সে। অরুনিকাও লাফিয়ে উঠে পড়েছে। ভয়ে যেন প্রাণটা তার বেরিয়ে আসার জোগাড় হয়েছে। আহরার ছুটে এসে দরজা খুলতেই দেখতে পায় আহিয়া কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–ভাইয়া.. সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাইয়া…
চলবে…