#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮
[১৮]
রোদ, বৃষ্টির মিষ্টি সকালটা আজ আর মন কাড়ছে না রূপকথার। এক দিকে বিরহ যন্ত্রণা, অপরদিকে মা জানালেন তাকে আজ দেখতে আসবে। ফলাফল তার জানাই আছে। প্রতিবারই ফলাফল একই হয়। আলেয়া বেগম সকাল থেকে আর কাজ করতে দেননি রূপকথাকে। এক বাটি হলুদ দিয়ে বললেন,
-“মুখে হলুদ মাইখা নে। চেহারা চকচকে হইবো।”
অনিচ্ছা স্বত্বে ও মায়ের চাপে পড়ে রূপ বাড়ানোর কাজে লেগে পড়ে। আর কেউ না জানুক, উপমা ঠিকই জানে তার বুবুর ক্ষ’ত গুলো। তার নিজেরই বুক ফেটে কান্না আসছে। খোরশেদ মেহমানদের জন্য বাজার থেকে ফল নিয়ে আসলো। খুশি খুশি পাত্রপক্ষের সামনে রূপকথাকে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রতিবার পাত্রপক্ষ উপমাকে পছন্দ করে যায়। তাই এবার উপমাকে লুকিয়ে রেখেছেন আলেয়া বেগম। তাতে ও লাভ হলোনা। এবার ও ফলাফল একটাই আসলো। রূপকথাকে পছন্দ করলোনা পাত্রপক্ষ। বিকেলে ঘটকের কাছ থেকে খবর পেয়েছে পাত্রপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে। ঘটক এটাও জানালেন,
-“বড় মাইয়ার লাইগা ছোডডারে ক্যান ধইরা রখবেন? কতকাল ধইরা রাখবেন? এর চাইতে মাইয়া ছোডডারেই বিয়া দিয়া দেন। আমার কাছে আরও ভালা পাত্র আছে।”
আলেয়া বেগম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তিক্ততার রো’গ বাসা বেঁধেছে। না জানি কোনদিন ম’রে যান। রূপকথার উপর ক্ষো’ভ হলো উনার। অহেতুক রা’গে কথায় কথায় খোঁচা মে’রে চলেছেন মেয়েকে। নিজেও শান্তি পাচ্ছেন না, আবার মেয়েকেও শান্তি দিচ্ছেন না।
-“আমার পোলার বারবার টেহা খরচ করাইয়া শান্তি হয়নাই। কোনোদিকে চইলা যাইতে পারস না? নাইলে ম’র’তে পারস না?”
রূপকথা পানি পান জরতে এসে আর পানি পান করলোনা। কলপাড়ে গিয়ে কিছু খুঁজলো। ফের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। মায়ের ব’কাগুলো এখনো বন্ধ হয়নি। হাতের মুঠো থেকে হাঁড়িপাতিল মাজা তারজালি দিয়ে চামড়ায় ঘষা দিলো। এই চামড়ার উপর তার অনিহা জন্মে গেছে, অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত দুঃখ, ক্ষো’ভে উত্তেজিত হয়ে তারজালি দিয়ে নিজের চামড়া ঝষে চলেছে। চামড়া ছিঁলে ছোপ ছোপ র’ক্ত দেখা যাচ্ছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে চিৎকার করে কাঁদলো রূপকথা। কালো রং কেনো তার জন্য অভি’শাপ হয়ে এলো? বাইরে তুমুল ঝড়। রূপকথার কান্নার শব্দ আর কারো কানে পৌঁছালোনা।
রাতে উপমা মায়ের সাথে ঘুমালো। রূপকথা আর দরজা খুললোনা। রাতে খেতেও বের হলোনা। মা উপমাকে দিয়ে ডাকিয়েছেন। নিজে রাগ দেখিয়ে ডাকলেননা। খোরশেদ অনেকবার ডেকেছে। রূপকথার একটাই উত্তর,
-“খামু না আমি। তোমরা খাও।”
খোরশেদ কয়েকবার ডেকেও যখন লাভ হলোনা তখন আর বাড়াবাড়ি করলোনা। রাতের খাবার খেয়ে সকলেই ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত্রি এগারোটা কি বারোটা হবে। খোরশেদের পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। বাইরে প্রচুর ঝড় উঠেছে। এই ঝড়ের মধ্যে টয়লেটে যেতেও ইচ্ছে করছেনা। প্রকৃতির ডাকে তো আর সাড়া না দিয়ে পারা যায়না। তাই টর্চ নিয়ে লম্বা ডাটের ছাতা মাথায় ঘর থেকে বের হলো। দ্রুত কাজ সেরে বেরিয়ে আসলো। হাত পা ধোয়ার জন্য কলপাড়ে যাওয়ার সময় আশেপাশে টর্চ মেরে তাকালো। হঠাৎই তার চোখদুটো স্থির হয়ে গেলো।
আমগাছের ডালে কি যেনো দাপাদাপি করতে দেখা যাচ্ছে। খোরশেদ প্রথমে ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সেখানে কি আছে? যখনই মস্তিষ্কে স্পষ্ট হলো মানুষের পায়ের মতোই দেখা যাচ্ছে তখন আর দেরি করলোনা। মাথায় একটাই নাম গেঁথে গিয়েছে। দৌঁড়ে আমগাছের তলায় গেলো। ছাতা ফেলে দিয়ে দাপাদাপি করা পা জোড়া জড়িয়ে ধরলো। আমগাছের মোটা ডালে গলায় দড়ি বেঁধে মৃ’ত্যুর প্রহর গুনছিলো রূপকথা।
খোরশেদের শ্বাস আটকে আসছে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছেনা। মাকে কিভাবে ডাকবে? ডাকলেও এই ঝড়ের মধ্যে কারো কানেই কথা পৌঁছাবেনা। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেলো খোরশেদ। হাউমাউ করে কেঁদে রূপকথাকে বলল,
-“রূপ, এই রূপ। তুই ক্যান এমন করতে গেলি? দোহাই লাগে তোর, আমারে সাহায্য কর তোরে নামাইতে। তোর কিছু হইলে আমরা ম’ইরা যামু রূপ। তুই সাহায্য না করলে আমি তরে নামাইতে পারুমনা। দয়া কইরা এমন শাস্তি আমগোরে দিস না।”
খোরশেদ ওভাবেই পা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আশেপাশে কিছু চোখে পড়ছেনা, যার উপর ভর করে রূপকথাকে নামাবে। যতক্ষণ না রূপকথা সাহায্য করছে ততক্ষণ সে কিছুই করতে পারবেনা।
রূপকথা রুদ্ধশ্বাস করা কন্ঠে বলল,
-“আমারে বাঁইচা থাকতে দেও। আমি মই’রা গিয়া একেবারে বাঁইচা থাকতে চাই।”
খোরশেদ ভ’য় দেখানোর চেষ্টা করলো রূপকথাকে।
-“তুই যদি আমারে সাহায্য না করস তয় আমিও তর সাথে এই ডালেই ঝুইলা পড়ুম।”
তড়াক করে উঠলো রূপকথা। অস্থির হয়ে গেলো। ভাইয়া কেনো ম’রবে? তাহলে মা আর উপমার কি হবে? হাজারও ভাবনা চিন্তার পর খোরশেদের কথায় রাজি হলো সে। রূপকথাকে নামানোর পর সে মাটিতে বসে চিৎকার করে কেঁদে বলল,
-“আমার আর বাঁইচা থাকতে মন চায়না ভাইয়া। মাইনষে আমারে খোঁ’টা দেয়। তা সহ্য করন যায়। কিন্তু মায়ে যখন আমার জন্ম নিয়া আফসোস করে তখন আর আমি সইতে পারিনা। ক্যান আমি কালা হইলাম?”
খোরশেদ সিদ্ধান্ত নিলো মায়ের সাথে একটা বিহিত করেই ছাড়বে। তার আগে রূপকথাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে নিতে বলে খোরশেদ মায়ের ঘরে গেলো। ঘুমন্ত আলেয়া বেগমকে জাগিয়ে ফেললো। পাশে ঘুমিয়ে থাকা উপমা ও জেগে গেলো। খোরশেদের চোখে পানি দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আলেয়া বেগম। উপমাকে খোরশেদ রূপকথার ঘরে পাঠিয়ে দিলো। মাকে রূপকথার ঘটনা খুলে বলতেই পুরো বাড়ি মাতিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন তিনি।
-“দশ মাস দশদিন যে মাইয়ারে পেটে নিয়া কষ্ট করলাম, এতবড় করলাম। হেয় আমার কথা না ভাইবা ম’রতে গেছে? ক্যামনে পারলো? একবার ও আমার কথা মনে হয়নাই?”
খোরশেদ রাগত সুরে বলল,
-“তুমি ক্যামনে পারলা এতকষ্টের সন্তানরে কষ্ট দিয়া কথা কইতে? তুমি জানো? রূপ তোমার কথা নিতে না পাইরাই জীবন ব’লি দিতে গেছে।”
তখনই আলেয়া বেগমের মনে পড়ে গেলো বিকেলে তিনি রূপকথাকে ম’রতে বলেছেন। এটাতো রাগের বশে বলেছেন। তাই বলে সত্যি সত্যি এমন করবে মেয়েটা? মায়েরা তো মেয়েদের কতকথাই বলে বলে ধারণা করলেন আলেয়া বেগম।
আর দেরি করলেননা। দৌঁড়ে রূপকথার ঘরে গেলো। জামা পাল্টে ভেজা চুল নিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো রূপকথা। আলেয়া বেগম গিয়ে মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন। রূপকথার শরীর একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। তিনি অনুভব করলেন রূপকথা ঢলে পড়ছে।
“রূপরে” বলে চিৎকার দিয়ে কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে ঝাপটে ধরে শুইয়ে দিলেন মেয়েকে। উপমা কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বুবুর মাথার পাশে গামছা নিয়ে বসেছে চুল মুছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
পরেরদিন সকালের পরিবেশ একেবারে শান্ত, স্নিগ্ধ। কেউ আর রূপকথাকে কিছু জিজ্ঞেস করে ক্ষ’ত বাড়িয়ে দেয়নি। আলেয়া বেগম যথাসম্ভব মেয়ের সাথে নরম আচরণ করছেন।
[১৮]
এদিকে খোরশেদ ঘটক লাগিয়ে দিয়েছে রূপকথার জন্য পাত্র খুঁজতে। ঘটক প্রচুর টাকা চায়। তবুও তার শর্তে রাজি হলো খোরশেদ। বোনের কষ্ট আর নিতে পারছেনা সে। হয়তো বিয়ে হয়ে গেলে লোকে আর তাকে নিয়ে কানাকানি করবেনা। তবে ভ’য় ও হচ্ছে খোরশেদের। তার বোনকে শশুর বাড়ীতে অত্যা’চারিত হতে হবে নাতো?
ঘটক যতগুলো পাত্রের সন্ধান দিয়েছে তাদের প্রায় অনেকেই যৌ’তুক চাচ্ছে আকাশসম, বাকিদের বয়স হয়েছে, ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়েছে এমন বুড়ো লোক। রূপকথাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে পরিবার। এটা দেখে মা ভাইকে কাছে ডাকলো রূপকথা। দুজনই পাশে বসলো। রূপকথা শান্ত, গভীর চোখে তাকিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-“আমার কিছু কথা রাখবা?”
আলেয়া বেগম কৌতুহল দেখিয়ে বললেন,
-“কি কথা?”
রূপকথা মা আর ভাইয়ের চেহারায় তাকিয়ে ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-” আমি এহনই বিয়ার চিন্তা করতাছিনা। আমি পড়তে চাই। আমার জন্যই তো উপমার বিয়া বন্ধ হইয়া রইছে তাইনা? তারে বিয়া দিতে চাইলে দেও। আমি কিছু মনে করুমনা। তয় আমারে এহনই বিয়া দিতে চাইওনা। আমি প্রস্তুত না। দোহাই লাগে আমার পড়া বন্ধ কইরোনা।”
কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা চললো। আলেয়া বেগম হতভম্ব হয়ে রইলেন। তিনি কিছু বলতে নিলেই খপ করে তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো খোরশেদ। লম্বা শ্বাস ছেড়ে রূপকথার উদ্দেশ্যে বলল,
-“তুই যেইটা ভালা বুঝবি হেইটাই কর। আমি তর পাশে আছি। তবুও তুই দ্বিতীয়বার নিজের ক্ষ’তি করতে যাইসনা। আমরা কেউ ভালা থাকতে পারুমনা তরে ছাড়া।”
রূপকথা খোরশেদের হাত শক্ত করে ধরে অভয় দিয়ে বলল,
-“কথা দিলাম নিজের কোনো ক্ষ’তি করবোনা।”
খোরশেদ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।
ভাইয়ের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে রূপকথা মায়ের দিকে তাকালো। আলেয়া বেগম ও আর বাড়াবাড়ি করলেননা। প্রথমবার মেয়ের কথায় প্রাধান্য দিলেন। রূপকথা ঠিক করেছে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করবে। টেষ্ট পরীক্ষা নখদর্পনে। এতদিন প্রেমলীলায় আর পড়াশোনা ঠিক করে হয়ে ওঠেনি। সে আর পিছু ফিরে চাইবেনা। সফলতার পেছনে ছুটবে সে। একসময় বুড়ো লোকগুলো নয়, একজন সফল মানুষই তার পেছনে ছুটবে। নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, এখন যারা তাকে কালো বলে হেলা করছে তারাই একদিন তাকে সম্মান করবে। মনের সংকল্পকে দৃঢ় করলো রূপকথা। এখন থেকে সময় নষ্ট করবেনা। মায়ের কাছ থেকে উঠে পড়লো রূপকথা। একবার বকুল তলায় যাওয়া দরকার। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো বকুল সই এর সাথে দেখা হয়না, ভাব বিনিময় হয়না। তার মন খারাপের একমাত্র সঙ্গী ওই মুক বকুল সই।
#চলবে……..