#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭
[১৫]
গতবছর বড় দুলাভাইকে একটা স্মার্টফোনের কথা বলেছিলো খোরশেদ। তখন দুলাভাই বললেন,
-“তোমার এহন সময় কই টাচ মোবাইল চালানোর?”
এরপর আর খোরশেদ দ্বিতীয়বার মুখ খোলেনি। এবার হঠাৎ কি মনে করে দুলাভাই একটা নোকিয়া স্মার্টফোন নিয়ে আসলো খোরশেদ কে দিতে। অবশ্য খোরশেদের হাতে এখন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোন আছে। তবুও মা বলে দিলেন ফোনটা যাতে খোরশেদ ফিরিয়ে না দেয়। এতে দুলাভাই এর অপমান হবে। বড় আপার ও সংসারে অশান্তি হবে। তাই খোরশেদ ফোনটা হাতে নিয়ে হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো,
-“এই মোবাইলের দাম কত নিলো, দুলাভাই?”
বড় দুলাভাই বাঁকা সুরেই জবাব দিলেন,
-“ক্যান, তুমি টেহা দিবা নাকি?”
চুপ থেকে তারপরই আবার বললেন,
-“উনিশ হাজার।”
কিছুই বললোনা খোরশেদ। মাঝেমাঝে আপন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও এসব মানুষের মুখের উপর শক্ত জবাব দেওয়া যায়না। ফোনটা দেখলে কেউই বলবেনা এটা উনিশ হাজার টাকার ফোন। একটা নোকিয়া ১ ফোনের দাম গুগলে সার্চ দিলেই বলা যাবে কত টাকা?
সেই ফোনটি খোরশেদ নিজে ব্যবহার করলোনা। ঘরে উপমা আর রূপকথা আছে। তাদেরকে দিলো। তারা, গান, মুভি দেখে। একটা সিম দিয়ে ইমো চালু করে দিয়েছে খোরশেদ। সেই ফোনই রূপকথার প্রেমের সাক্ষী। রাতে চুপিচুপি মামুনের সাথে কতশত প্রেমালাপ, সুখ-দুঃখের কথা জুড়ে দেয়। চুটিয়ে প্রেম চলছে দুজনের। নিয়ম করে বকুল তলায় দেখা করা। মামুনের বেকার জীবনের গল্প করা সব মিলিয়েই বেশ চলছে। উপমা জানে ব্যাপারটা। সারাদিন বোনের সাথেই থাকে। এরকম একটা ব্যাপার টের পাওয়া কোনো ব্যাপার না। তাই রূপকথা ও আর উপমার কাছে লুকোয়নি কিছু।
[১৬]
খোরশেদের পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে। এখন ঠিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারে। তবে আলেয়া বেগম এখনই ছেলেকে কাজে যেতে দিচ্ছেন না। খোরশেদের সুস্থ হওয়াতে মামুনের আসা যাওয়া একেবারেই কমে গিয়েছে তাদের বাড়ীতে।
সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে মামুনের মিসড কল আসলো। এর মানে সে বকুল তলায় আছে। রূপকথা সুযোগ খুঁজলো বের হওয়ার। আগে অকপটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেও এখন দ্বিধা কাজ করে, ভ’য় হয়। মনে হয় কেউ জেনে যাবে তাদের প্রেমের ব্যাপার। উপমাকে বলেই ছুটলো বকুল তলায়।
মামুন ঝরে যাওয়া শুকনো বকুল ফুলের একটি মালা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। পকেটে করে একমুঠো বকুল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ভাবির কাছ থেকে সুঁই-সুতো জোগাড় করে ছোট্ট মালা গেঁথে নিয়েছিলো। ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু যত্ন করা ভালোবাসাটা শুকায়নি। রূপকথা মাথায় ওড়না টেনে চারপাশ জহুরি নজরে দেখে সামনে তাকাতেই ভ’য় পেলো। তার একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মামুন। সে যখন এদিক ওদিক দেখছিলো তখনই মামুনের দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপে। সে হুট করেই রূপকথার কাছে এসে দাঁড়ায় ভ’য় দেখাবে বলে। রূপকথা ভ’য় পেয়ে বুকে থুতু দিলো। মামুন খিলখিল করে হাসলো।
রূপকথা গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বলল,
-“ভ’য়ের চো’টে যদি মই’রা যাইতাম?”
মামুনের বুক ধড়ফড় করে উঠলো। কড়া চোখে তাকিয়ে সাবধান করলো,
-“খব’রদার! আর এইসব অলক্ষুণে কথা কইবানা। আমি ম’রা’র পর তোমার যা খুশি কইও।”
রূপকথার চোখে পানি এসে ভীড় করলো। সবার কাছ থেকে অবহেলা পেয়ে একটা ভালোবাসার মানুষ পেলে কে হারাতে চায়? হারাতে সবাই ভ’য় পায়। ওড়নার একাংশ দিয়ে চোখ মুছে নিলো সে।
মামুন মুচকি হেসে রূপকথাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিলো। গলার জন্য গাঁথা মালাটি চুলের খোঁপায় প্যাঁচিয়ে দিলো।
রূপকথা চুলে হাত দিয়ে অনুভব করলো। বিষন্ন মনটা হুট করেই ভালো হয়ে গেলো। চমৎকার ভালোলাগার অনুভূতি হলো।
মামুন বলল,
-“কয়েকদিন দেহা হইবোনা। ফোনেই কথা কমু। আব্বা আম্মা সহ সবাই মিলে বেড়াইতে যামু মামুর বাড়িত।”
রূপকথার হাসিখুশি মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো। কতদিন দেখা হবেনা তাদের? কিন্তু হাসিমুখেই বিদায় জানালো মামুনকে। কাল সকালেই মামুনরা বেড়াতে যাবে। আযান পড়ার আগেই রূপকথা বাড়িতে ফিরলো। এমন দুমুখো সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে দেখে আলেয়া বেগম কথা শোনাতে ছাড়লেননা। বকা’বকি করলেন কিছুক্ষণ। রূপকথা চুপ করেই ছিলো। মা নিজ থেকেই আবার থেমে গেলেন।
[১৬]
আশরাফুলের জ্বালাতন যেনো বেড়েই চলেছে। এখন আর উপমার ভ’য় হয়না, বেশ রা’গ হয়। এত বেহা’য়া মানুষ হয়? তাকে চ’ড়, থা’প্পড়, কোনো কথা বলেও দমিয়ে রাখা যায়না। কিছু বললেই সে হাসে। পিছু পিছু আসে।
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে খোরশেদের মুখোমুখি হলো উপমা, রূপকথা। পেছনেই ছিলো আশরাফুল। বোনদের বি’রক্ত করছে দেখে ক্ষে’পে গেলো খোরশেদ। আশরাফুলকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলো। আশরাফুল কি দমে থাকার পাত্র? সে ও কয়েক ঘা দিলো। দুজনের মধ্যে এক পর্যায়ে হাতা’হাতি শুরু হলো। উপমা ভ’য়ে কেঁদে ফেললো। রূপকথা দুজনকেই দুদিকে সরানোর চেষ্টায় ব্যর্থ।
চু’রির আসামি ধরতে পুলিশ যাচ্ছিলো সিএনজি দিয়ে। রাস্তায় দুজন ছেলের মধ্যে মা’রা’মা’রি দেখে তারা নেমে পড়লো। উপমা কেঁদেকে’টে বলল ছেলেটা তাদের বিরক্ত করছে। এখন প্রতিবাদ করায় তার ভাইকে ও মা’রছে। পুলিশ ধরে নিলো আশরাফুলকে। হাতের লাঠি দিয়ে একটা আ’ঘাত করে বলল,
-“রাস্তাঘাটে ইভটিজিং করবি মেয়েদের? চল থানায় চল। পেছনে কয়েক ঘা পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আশরাফুল একই ভাবে হেসে বলল,
-“কিচ্ছু ঠিক হইবোনা। ভালোবাসা আরও বাইড়া যাইবো।”
আশরাফুলকে আরেক ঘা দিয়ে পুলিশ বলল,
-“ভালোবাসা আর ভালোবাসা থাকবেনা। মা’ইরের চো’টে ভালোবাসা পালাবে।”
আশরাফুল এখনো হাসছে। উপমার দিকে তাকিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে উপমার উদ্দেশ্যে বলল,
-“ভালো থাইকো বউ। কালকের মধ্যেই বিরক্ত করবার জন্য তোমার জামাই জেল ভাইঙ্গা আইয়া পড়বো। মন খারাপ কইরোনা।”
খোরশেদ দুবোনকেই ধমকে উঠে বলল,
-“এই পোলা যে তোগোরে বিরক্ত করে, কইলিনা ক্যান? কোনো বি’পদ হইলে কি হইতো?”
রূপকথা, উপমা দুজনই মাথানিচু করে দিলো। বাড়িতে জানালে ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে যেতো। তাই দুবোনের একবোন ও জানায় নি কিছু। কিন্তু এটা ভাবলোনা তারা দুজন মেয়ে। বড় কোনো বি’পদ হতে পারতো।
[১৭]
মামুন যাওয়ার দুদিন পর্যন্ত তাদের দুজনের লুকিয়ে চু’রিয়ে ফোনে প্রেমালাপ হলেও তৃতীয় দিন থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মামুনের ফোন বারবার বন্ধ বলছে। রূপকথা নিজের মনকে বুঝালো হয়তো বিদ্যুৎ নেই বলে ফোনে চার্জ দিতে পারেনি। কিন্তু সময়টা যখন গড়াতে গড়াতে সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো তখন আর নিজ মনকে বুঝ দিতে না পেরে কেঁদে গাল ভাসালো রূপকথা। বিরহ যন্ত্রনায় ভেতরটা আর্তনাদ করে উঠলো।
তার ঠিক দুদিন পরই মামুন গ্রামে ফিরলো। রূপকথা খবর পেয়েছে সে নাকি মামাতো বোন বিয়ে করে ঘরে উঠেছে। গ্রামের খবর ঘর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনা। বাতাসের বেগে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখে মুখে একই বুলি ‘মামুন মামাতো বোইন বিয়া করসে’।
কথাটি শুনেই প্রথম ধাক্কা খেলো রূপকথা। একে একে সব স্পষ্ট হচ্ছে। এজন্যই তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তাচ্ছিল্য হাসলো রূপকথা। তার সাথে তো সবাই ছলনা করে। তারই ভুল ছিলো। সুন্দরী মেয়ে রেখে কেউ কেনো তার মতো কুৎ’সিত মেয়েকে বিয়ে করবে? চোখ ফেটে জল গড়ালো। হাউমাউ করে কাঁদলোনা। তার নিয়তি বরাবরই নিষ্ঠু’রতা করে। আজ কল করে মামুনের নাম্বার খোলা পেলো, কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। শেষে রূপকথা বাংলায় গোটাগোটা অক্ষরে বার্তা পাঠালো,
-“শ্যাষ বারের মতো আমার লগে দেহা করেন। এরপর ইহজীবনে আর আমার মুখ দেখতে হইবোনা আমনের।”
কাজ হলো মনে হয়। সন্ধ্যার পর হারিকেন হাতে বকুল তলায় পৌঁছে গেলো রূপকথা। মামুন আগে থেকেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ মুখ মলিন, ফ্যাকাশে দেখা যাচ্ছে। রূপকথাকে দেখে দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করছে। রূপকথা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একভাবে বলে ফেললো,
-“খুব সুন্দরী আমনের বউ, তাইনা?”
ঢোক গিললো মামুন। নিজেকে প্রস্তুত করে জবাব দিলো,
-“বিশ্বাস করো কোকিল পাখি, আমি কিছুই জানতাম না। আব্বা আম্মা মামার বাড়ি নিয়া মামাতো বোইনের লগে বিয়া দিবো আমি জানতাম না। তোমার কথা কইয়া ও লাভ হয়নাই। আব্বা আম্মা তোমারে বিয়া করাইবোনা। তাছাড়া মামা আমার বিদেশ যাওনের সব ব্যবস্থা কইরা দিবো। তাই আব্বা বেশি জোর দিয়াই বিয়া করাইলো।”
মামুন থামতেই মলিন হাসলো রূপকথা। কারো যদি ইচ্ছে পূরণ হয় সাথে সুন্দরী বউ তাহলে সে কেনো বিয়েতে না করবে? একদম ঠিক করেছে মামুন। তার মতো কালা, পোড়াকপালিকে বিয়ে করে তাকে সারাজীবন পস্তাতে হতো। কোনোমতে কাঁপা কাঁপা স্বরে রূপকথা শুধালো,
-“তারে যত্ন কইরা ভালোবাইসেন।”
আর দাঁড়ালোনা। বাঁধ ভাঙা কান্নারা উপচে পড়ছে। হারিকেন হাতে ছুটে চললো রূপকথা। ‘সত্যিই সুখ মরিচীকা’। মামুন চোখের পানি লুকিয়ে বিড়বিড় করে শুধালো,
-“আমি ও যে তোমারে ভালোবাসছিলাম কোকিল পাখি। কিন্তু জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাইয়া সেটা কামে লাগাইয়া ফালাইছি। তোমার লগে অন্যায় কইরা ফালাইছি।”
রবীন্দ্র সংগীতের সুরগুলোই যেনো স্পষ্ট ভাবে রূপকথার অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোর ভাবানুবাদ।
“যদি আরও কারে ভালোবাসো,
যদি আরও ফিরে নাহি আসো।
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেনো পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো
আমার ও পরাণ ও যাহা চায়।”
রূপকথার প্রতিটি নিশ্চুপ চিৎকারের সাক্ষী ছিলো তার বিছানা,বালিশ। কতবার যে আর্তনাদে, যন্ত্রণায় বিছানা খামছে ধরেছিলো। তার ছটফট দেখে উপমা ভ’য় পেয়ে মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলোনা। রূপকথা উপমাকে ঝাপটে ধরে হিসহিস কন্ঠ বলল,
-” উপমারে আমি মনে হয় ম’ই’রা যামু।”
উপমা কেঁদে ফেললো। বুবুর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। এখনই আর মাকে জানালোনা উপমা। এদিকে বুবুর ছটফট দেখে ও সহ্য করতে পারছেনা। রূপকথা গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করেই চলেছে। চোখ দিয়ে গলগলিয়ে পানি ঝরছে।
#চলবে……