রূপকথা পর্ব-০২

0
852

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০২

[৩]
শুক্রবার দিন থাকায় আজ আর স্কুল যাওয়ার প্যারা ছিলোনা। এবছর দশম শ্রেণিতে উঠেছে রূপকথা। পড়ালেখা করলেও কথাবার্তায় আঞ্চলিকতার ছাপ বিদ্যমান। আমরা যতই শুদ্ধ বাংলা জানিনা কেনো? আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি। বয়স সতের বছর। গ্রাম অঞ্চলে মেয়েদের একটু বেশি বয়স করেই ভর্তি করানো হয়। তবে বিয়েটা অবশ্যই পিরিয়ড হওয়ার পরপরই দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এখনো সবার মাঝে আধুনিকতা আসেনি। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে এখনো অনেক পরিবার অসচেতন।

মায়ের হাতে বেগুন এনে দিয়ে হাতে হাতে কয়েকটা কাজ করে দিলো রূপকথা। দুপুরের রান্না শেষ হলো। বাড়ির জামাইদের খাবার দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সবাই খেতে বসে গেছে অথচ একটা মাত্র শা’লা খোরশেদ এর জন্য অপেক্ষা করলোনা। দুলাভাইরা বাড়িতে আছে। তাই খোরশেদ আজ আধা বেলা কাজ করেই বাড়ি ফিরলো। গোসল করে আসলেই চারজন মিলে খেতে পারতো। অথচ খোরশেদের গোসল পর্যন্ত বাড়ির জামাইরা অপেক্ষা করতে পারলোনা। আজানের পর পর গোসল করে আসলেই নাকি তাদের খাবার দিতে হয়। নয়তো শরীরে কাঁপন ধরে। ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। খোরশেদ গোসল করে এসে দেখলো দুলাভাই দের খাওয়া শেষ। খানিক কষ্ট পেলো খোরশেদ। তবে প্রকাশ করলোনা। বোনেরা এখনো খায়নি। খোরশেদ বারান্দায় গিয়ে বোনেদের সাথে পাটিতে বসে পড়লো। সব ভাইবোন একসাথে খাচ্ছে। ভালো তরকারি জামাইদের রাতের খাবারের জন্য আলাদা করে রেখে সবজি দিয়েই সবাই খাচ্ছে। আলেয়া বেগম ঢাকনা তুলে এক টুকরো মাছ ছেলের পাতে তুলে দিলেন। খোরশেদ একবার বোনেদের প্লেটে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবাই সবজি দিয়েই খাচ্ছে। স্মিত হেসে সে বলল,
-‘এহন মাছ খাইতে মন চায়না মা। সবজি দেও। সবজি দিয়াই খামু।”

আলেয়া বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলেন। তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন তার ছেলে কেনো মাছ খাচ্ছে না। তাই জোর করেই খোরশেদের পাতে মাছ টুকরো তুলে দিলেন। ভালো করে ভাত মেখে লোকমা তৈরি করলো খোরশেদ। প্রথম লোকমা মায়ের সামনে ধরলো। আলেয়া বেগমের চোখে পানি। খোরশেদ ইশারায় বলল হা করতে। আলেয়া বেগম হা করলেন। একে একে বড় বুবু থেকে শুরু করে ছোট বোন উপমাকে পর্যন্ত খাইয়ে দিলো খোরশেদ। প্রতিটা ভাই বোনের চোখে পানি। খোরশেদ মেকি শাসনের সুরে সবাইকে বলল,
-“একদম কেউ কানবা না। আব্বা বাঁইচা থাকলে কি করতো? কও। কবে আবার সবগুলা ভাই বোইন একলগে হমু তার ঠিক আছে?”

অল্পতেও সুখী হওয়া যায়। সুখী হতে বেশি কিছু লাগেনা। একটা ছেলে খোরশেদই কি সুন্দর মা থেকে সব বোনের মুখে হাসি ফোটালো। আবার খোরশেদই পারতো মা সহ সকল বোনকে কাঁদাতে। পুরুষের একটু ভালোবাসার উষ্ণতায় নারী মোমের মতো গলে যায়। আবার পুরুষের খারাপ ব্যবহারের উষ্ণতায় সেই নারীই গলে গিয়ে পুনরায় শক্ত হয়ে যায়।

[৪]
ভোরের সুমধুর আজানের ধ্বনিতে বিছানা ছেড়ে উঠলো আলেয়া বেগম। একে একে মেয়েদের ঘরের দরজায় দাড়িয়ে ডেকে নিলেন। তিন মেয়ে চারচালা ঘরের তিনটা রুমে ঘুমিয়েছে। আরেকটা রুমে খোরশেদ। আলেয়া বেগম ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার ছোট্ট রুমে ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়েছেন। সবাই উঠে টয়লেট আর কলপাড়ে সিরিয়াল ধরেছে। উপমা টয়লেটে ঢুকেছে অনেকক্ষণ হলো। রূপকথা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কিছুকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরও কেউ বের হলোনা। এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। পেট বারে বারে পাঁক দিচ্ছে। টিনের দরজায় কয়েকটা আঘাত করেই রূপকথা বলল,
-“টয়লেটে কে ঢুকসো? বাইর হও না ক্যান। আমার টয়লেট এখানেই পইড়া যাইতাছে।”

উপমা কথা বললনা। একেবারে সেরে ধীরে সুস্থে সে বের হলো। উপমাকে বের হতে দেখে রূপকথা কটমট করে বলল,
-“এতক্ষণ যে আমি ডাকতে ডাকতে ম’ই’রা যাইতেছিলাম আওয়াজ দিলি না ক্যান?”

উপমা আমতা আমতা করে বলল,
-“টয়লেটে থাইকা কথা কইলে নাকি হায়াত কইমা যায়। তাইতো আমি কথা কইনাই বুবু।”

রূপকথা উপমার কথায় বিষ্ময় প্রকাশ করলোনা। টয়লেটে যাওয়া জরুরি। নয়তো দেখা যাবে অন্য বুবু এসে ঢুকে যাবে টয়লেটে। আর এদিকে তার কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।

সকালে নাস্তা করে বুবুরা দুলাভাই দের সাথে শশুর বাড়ী চলে গেলো। খোরশেদ কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। উপমা কিছুক্ষণ টইটই করে ঘুরে আসলো। রূপকথা সকালের এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে মাকে কাজ এগিয়ে দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসলো। আকাশি আর সাদা রঙের সরকারি স্কুলের ড্রেস গায়ে জড়িয়ে দুবোন বের হলো স্কুলের উদ্দেশ্যে। উপমা ক্লাস এইট এ পড়ে। একই স্কুলে দু’বোনের পড়াশোনা।

মামুন। ছেলেটা বেকার। সারাদিন পাড়ায়, রাস্তায়, এ গলি ও গলি, দোকানে তাকে দেখা যায়। ফাইভ পাস ছেলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বই দেওয়ার পর ভাঙারির কাছে বই বিক্রি করে বাদাম বুট খেয়ে পড়ালেখা সেখানেই গিলে খেয়েছে। ছোটখাটো বিভিন্ন কাজ আছে যেগুলো সে করবেনা। তার আশা সে বিদেশ যাবে। তারপর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠাবে দেশে। তাই যতদিন না বিদেশ যেতে পারছে ততদিন সে কোনো কাজ করবেনা। বাবাকে অবশ্য বলেছিলো ধারদেনা, লোন নিয়ে তাকে বিদেশ পাঠাতে। বাবা কিছুতেই রাজি নয়। যে ছেলে দেশে কাজকর্ম করতে আলসেমি করে সে বিদেশে গিয়ে কষ্টের কাজ করবে? যদি কাজ না করলো? আবার দেশে ফেরত আসলো তাহলো এতগুলো দেনা কে শোধ করবে?

স্কুল ড্রেসে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দুজন কিশোরীকে কাঁচা রাস্তা ধরে আসতে দেখা গেলো। দূর থেকেই মামুন চিনে গেলো কিশোরী দুটির একজন কোকিল পাখি আরেকজন উপমা। শুক্রবার ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই তারা এই পথ দিয়ে স্কুলে যায়। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছিলো রূপকথা। মামুনের সুরেলা কন্ঠে পা জোড়া থেমে যায়।

-“কুহ্! কুহ্! কুহ্!”

উপমা থেমে গিয়ে মামুনের দিকে তাকায়।
মামুন চমৎকার এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

-“কই যাও উপমা আপু।”

উপমা ত্যাড়া ভাবে উত্তর দেয়।
-“বিয়ার দাওয়াতে যাইতাছি। আমনে যাইবেন?”

মামুন চোখ সরু করে বলল,
-“মিথ্যা কও ক্যান উপমা আপু। তুমিতো ইস্কুলে যাও।”

উপমা মুখ ভেটকি দিয়ে বলল,
-“তাইলে আবার জিগান ক্যান?”

রূপকথা মাথানিচু করে উপমার হাত চেপে ধরলো। মামুন থতমত খেয়ে গেলো। সে বুজতে পেরেছে ভাব জমাতে গিয়ে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাই আর কথা বাড়ালোনা। শার্টের পকেট থেকে টেস্টি হজমী বের করে দুটো উপমার হাতে দিলো, দুটো রূপকথার হাতে।
উপমা টেস্টি হজমী দুটো নিয়েই পা বাড়ালো। রূপকথা পা বাড়ানোর আগেই গোপনে রূপকথার হাতের ভাঁজে আরও পাঁচটা টেস্টি হজমী দিয়ে মিটিমিটি হাসলো মামুন। রূপকথা কোনোদিকে না তাকিয়েই ব্যাগে টেস্টি হজমী ঢুকিয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। পা চালিয়ে উপমার বরাবর হলো। পেছনে একবার ঘুরে দেখলো মামুন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে পড়ে যাওয়ায় আরেকটু লজ্জায় মিইয়ে গেলো রূপকথা।

স্কুলে পৌঁছে সামনের বেঞ্চে জায়গা থাকা সত্ত্বেও রূপকথার জায়গা হলোনা। অন্যান্য মেয়েরা রূপকথাকে দেখে বই রেখে নিজের বান্ধবীদের জন্য জায়গা রেখে দিলো। কিছুক্ষণ তর্ক করার পরও যখন তিনজনের সাথে পেরে উঠলোনা তখন রূপকথা পেছনে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পরই তার সই এলো। তাহমিনা। মেয়েটির মনে কোনো অহংকার নেই। বাবা কত বড়লোক, মেয়েটা কত সুন্দরী। অথচ সে এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রূপকথার সাথে ভাব জমিয়েছে। এখনো দুজনের গলায় গলায় ভাব। তাহমিনা ব্যাগ এনে রূপকথার সাথেই বসলো। ব্যাগ থেকে একমুঠো চকলেট বের করে রূপকথাকে দিলো।

-“এই ল। এগুলা আব্বায় বিদেশ থেইকা আনছে। ভিতরে নাইকল দেয়া। খাইতে অনেক স্বাদ।”

রূপকথা খুশিমনে চকলেটগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। এখন খাবেনা। বাড়িতে গিয়ে উপমাকে নিয়ে খাবে। এসব বিদেশি চকলেট তারা সচরাচর চোখে দেখেনা। এইতো তাহমিনা দিলো আর রূপকথা পেলো। সে যদি এখন খেয়ে নেয় তার ছোট বোনটাতো আর পাবেনা। তাই রেখেই দিলো। দুপুরে টিফিন টাইমে রূপকথা রুটি আর তরকারি বের করলো। তাহমিনা সব সময় টাকা নিয়ে আসে। তাহমিনাকে ধরে বসিয়ে দিলো রূপকথা। দুজনে মিলে রুটি ভাগাভাগি করে খেলো। অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেটকি দিচ্ছে। হয়তো তাহমিনার কাছে তাদের প্রশ্ন,’এই জঘ’ন্য দেখতে মেয়েটার সাথে কিভাবে খাবার ভাগ করে খাচ্ছে?’

ঘরে বিদ্যুৎ নেই। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বাজ পড়ছে। বৃষ্টি আসার পূর্ব মুহূর্ত। হু হু করে বাতাস বইছে। আগের দিনের হারিকেন টা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন আলেয়া বেগম। ধানের তুঁষ দিয়ে মেজে ঘষে পরিষ্কার করেছেন। বিদ্যুৎ না থাকলে সম্বল হিসেবে কাজ করে। সেই হারিকেনের আলোতে পড়তে বসেছে রূপকথা আর উপমা। উপমা পড়তে বসেছে বললে ভুল হবে। সে বসে বসে দৃশ্য আঁকছে। চমৎকার দৃশ্য সে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারে। বৃষ্টি হওয়ার ভ’য়ে বাইরের শুকনো লাকড়ি সব আঁটি করে রাখছেন আলেয়া বেগম। মাটির পিঁড়া ঢেকে রাখতে হবে। নয়তো বৃষ্টির পানিতে মাটি সব ধুয়ে যাবে। হাঁক ছেড়ে রূপকথাকে ডাকলেন,

-“রূপ। এত কিসের পড়ালেহা? আমার লগে আইয়া কাম কর।”

রূপকথা বিরক্তির সুরে বলল,
-“ওপপ! মা, উপমারে ডাক দেও। সামনে আমার পরীক্ষা আছে। আমি কাম করতে পারুমনা।”

খেঁকিয়ে উঠলেন আলেয়া বেগম। বাইরে থেকেই চেঁচিয়ে বললেন,
-” কিসের পড়ালেহা? পড়ালেহা কইরা মাস্টরি করবি? কাম কর। রূপ দিয়া তো জামাইর বাড়িত খাইতে পারবিনা। কাম কইরা খাওন লাগবো। পড়ালেহা ভাত খাওয়াইতো না। কি ফরম পূরণ নাকি কি কয়। হে সময় যে কত হাজার টেহা লাগবো। কেডায় দিবো? এহন থেইকাই পড়ালেহার মায়া ছাইড়া দে।”

মায়ের কথায় টলমলে চোখের পানি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো রূপকথা। বুবুরে কাঁদতে দেখে উপমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর পা টিপে টিপে বাইরে গেলো। খোরশেদ বাড়িতেই ঢুকছিলো। মায়ের কথা শুনে বলল,
-“মা তুমি এমন কথা কও ক্যান? আমি আছিনা? আল্লাহ টেহার এক ব্যবস্থা করবোই। তুমি ওগো পড়ালেহা বন্ধ করার কথা কইবানা।”

আলেয়া বেগম ছেলের কথায় ব্যাগড়া দিলেন।
-“তুই চুপ থাক। নুন আনতে পানতা পুরায়। হেয় আবার দুই দুইডা দা’মড়ি ছেরিরে পড়াইবো।”

উপমা পা টিপে টিপে লাকড়ির আঁটি ধরতে গেলেই একটা লাকড়ি নিয়ে উপমার পিঠে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন আালেয়া বেগম।
উপমা ও মা, ও আব্বা বলে যখন চিৎকার দিলো তখন খোরশেদ এসে ধরলো। রূপকথা ও দৌঁড়ে আসলো।

আলেয়া বেগম বলে দিলেন,
-“খবরদার কারো আমার কামে হাত দেওন লাগতোনা। আমার কাম আমিই করুম। আমি ম’রলেই আমার দুঃখ বুঝবি সবগুলা। আমি পালতেছি সব নবাবের বেটি। আগে তিনটা পালছি। এহন আরও দুইটা পালতেছি।”

রূপকথা ভ’য়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। খোরশেদ ইশারায় বোঝালো কাজে হাত লাগাতে। নয়তো এই জেদ কাল পর্যন্ত ধরে রেখেই দুইবোনকে মা’রবে। ভাইয়ের ইশারায় রূপকথা প্লাস্টিক এনে ঘরের পিঁড়া ঢেকে নিলো। আঁটি সব ঘরে তুলতেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো।
স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো রূপকথা। খোরশেদ মায়ের আড়ালে এসে রূপকথার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-“তুই পড়ালেহায় মন দিয়া যা। টেহার ব্যবস্থা আমি করুম।”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে