#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব
[১]
প্রেমিকের প্রত্যাখান শেষে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ী পৌঁছাতেই পাত্র পক্ষ দেখতে এলো রূপকথাকে। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত। ভাগ্য বিড়ম্বনা বলেও একটা কথা আছে। পাত্রপক্ষ ও তাকে পছন্দ করলোনা। রূপকথাকে পছন্দ না করার কারণ একটাই,কিশোরী কৃষ্ণকায়া অধিকারী। আজকাল মানুষতো সাদা চামড়া খোঁজে। সে দিক থেকে রূপকথা নিতান্তই সাদামাটা।
[২]
হানিফ হাসানের চতুর্থ কন্যা রূপকথা। বড় তিন কন্যার রূপের প্রশংসায় যখন পাড়াপড়শি পঞ্চমুখ তখনও হানিফ হাসানের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বড় কন্যা শাহিনূরের চেয়ে মেজো কন্যা মায়া বেশি রূপবতী। তার চেয়ে সেজো কন্যা মমতা আরও বেশি রূপবতী। এবারের সন্তান টা যদি কন্যা হয় তবে সে নিশ্চয়ই আরও রূপবতী হবে। একেবারে রূপকথার রাজকন্যা। তাই হানিফ হাসান আগে থেকেই নাম ঠিক করে রাখলেন এবার যদি আল্লাহ তাকে কন্যা সন্তান দেন তবে তার নাম রাখবে রূপকথা।
আল্লাহ হানিফ হাসানকে চাওয়া অনুযায়ী এবার ও কন্যা সন্তান দিলেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে কোমল চুমুতে ভরিয়ে তুলে নাম দিলেন রূপকথা। রূপকথা রূপবতী হয়েছে ঠিকই, তবে সেটা অন্তরের দিক দিয়ে। গায়েগতরে ফর্সা হলেই তাকে রূপবতী বলেনা।
একটা বাচ্চা যখন পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয় তখন সে সাদা চামড়া নিয়েই আসে। গায়ের রংটা সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়। সময়ই বলে দেয় বাচ্চাটার রং কেমন হবে? ঠিক তেমনই দিন কয়েক পেরুতেই রূপকথার চামড়ার রং ফোটে উঠলো। হানিফ হাসানের আদর একটু ও কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। যত দিন পেরুলো ততই লোকমুখে সমালোচনার মধ্যমণি হয়ে উঠলো হানিফ হাসানের মেয়ে রূপকথা।
ইশ হানিফের তিনটা মেয়ের রং যেনো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু শেষ মেয়েটার রং এমন কেনো? দেখলে মনে হয় কেঁচো হেঁটে যাচ্ছে। তিনটা ময়ূরের মাঝে একটা কাক।
রূপকথার পর কোল আলো করে আরও একটি কন্যা সন্তান এলো। স্কুল যাওয়ার পথে, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায়তেই রূপকথাকে কথা শুনতে হয়। তবে সে প্রত্যুত্তর করেনা। এসব মানুষতো তাকে খাওয়ায় না। এসব নিন্দাসূচক বানী শুনলে কানে তুলো দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলে যায়। বাবার সামনে কেউ তার গায়ের রং নিয়ে কথা বলতে পারেনা। হানিফ হাসান সেই মানুষ গুলোকে চারটে কথা শুনিয়ে দেওয়ার বদলে মেয়ের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এমন সব উক্তি করে যে মানুষ তার সামনে কিছু বলার সাহস করেনা। বাবা তাকে অল্পদিন সময় দিয়েই শেষ ঠিকানায় পাড়ি জমালো। দুঃখের দিন বাড়লো বলে।
মানুষগুলোর নিন্দাতে তার কিছুই আসে যায়না। সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগে যখন তার মা বোন ও তার রংকে তুচ্ছ করে। সবাই সৌন্দর্য্যের পূজারী। একদিন তো মেজো বুবু বলেই দিলো,
-“বাজারে ফর্সা হওনের কত কিরিম আইছে। ভাইয়ারে কইয়া কিরিম আইনা একটু মাখ। আমাগোরে তো ব্যাডারে চিলের মতো উড়াল দিয়া লইয়া গেছে। তোরে ও তো কারো কাছে গছাইয়া দিতে হইবো।”
বোনের কথা শুনে গলা কেঁপে উঠলো রূপকথার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষাদ ঢুকলো। ভেতরটা মুচড়ে আসলো যখন সাথে মা ও সুর মেলালো। মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-“আল্লাহই ভালা জানে এ জীবনে কি এমন বড় পাপ করলাম। যার কারণে আল্লাহ আমার মাইয়াডারে কালা বানাইছে। যদি তুই আরেকটু সুন্দর হইতি আমার আর দুঃখ থাকতোনা। একটু কি কিরিম টিরিম আছে হেইগুলা মাখিস। এহন তো সচরাচর মাইয়ারা এসব কিরিম মুখে, হাতে, বইরে মাখেই।”
মাথা নিচু করে রাখলো রূপকথা। মায়ের চোখের দিকে তাকালেই তার এখন কান্না পাবে। ভীষণ কান্না। প্রিয় মানুষের দেওয়া যন্ত্রনাগুলো বড্ড পোড়ায়। সে তো মায়েরই গর্ভের সন্তান। চামড়া কালো এটা কি তার দোষ? কি হবে ক্রিম মেখে চামড়া সাদা করে? যদি অন্তরটাই কালো হয়? সবাই তাকে নিন্দা করে। অন্তত মায়ের কাছে সে এমন কথা আশা করতে পারেনি। সবাই বলে সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হচ্ছে মায়ের বুক। সেখানে মায়ের কথার আ’ঘা’তেই যদি সন্তানের বুক ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয় তবে সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় খুঁজবে? কিছুটা সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপকথা। মা বোনের কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
-” এসব ঝামেলা আমারে দিয়া হইতো না। আমি যে আইলসা কে যাইবো প্রতি রাইতের বেলা এত কষ্ট করতে?”
উঠে বাড়ির বাইরে পা বাড়ালো রূপকথা। পেছন থেকে মায়ের স্পষ্ট বানী তার কান এড়ালোনা।
-“এমনেই আমারে একদিন শেষ করবি। বুঝবি যেদিন তোর শোকে আমি ম’রুম।”
আর বাড়ীর বাইরে যাওয়া হলোনা রূপকথার। চুপচাপ বারান্দার ছোট্ট ঘরটিতে গিয়ে চৌকির উপর উঠে বসলো। গ্রিল হীন কাঠের খোলা বারান্দার ফাঁক গলিয়ে আকাশে চোখ রাখলো। কষ্টগুলোকে উজাড় করে দিয়ে নিরবে কেঁদে উঠলো রূপকথা। হুট করে ছোট্ট ঘরটিতে বড় বুবু শাহিনূরের আগমন। রূপকথাকে কাঁদতে দেখেই বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কিরে রূপ কান্দস ক্যান? কি হইছে তোর?”
চোখের পানি আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করলোনা রূপকথা। তবে ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্ম ভাবে আড়াল করলো। হেঁচকি তুলে বলল,
-“আব্বার কথা খুব মনে পড়ছে বুবু।”
এবার শব্দ করেই কাঁদলো রূপকথা। একহাতে বোনকে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে স্থির হয়ে রইলো শাহিনূর। চোখ জোড়া পানিতে টইটম্বুর। আব্বারে যে তার ও মনে পড়ে। কতই না আদর করতো। ভাত খাওয়ার সময় পাঁচটা মেয়ে একটা ছেলে কাউকে রেখে তিনি খেতে বসতেননা। শাহিনূরের পরই খোরশেদ এর জন্ম হয়। ছেলে হলেও সে ও বাকি বোনেদের মতো রূপ লাবন্য নিয়েই জন্ম নিয়েছে। খেতে বসে বড় থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট মেয়ে পর্যন্ত সবার মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দিয়ে তবেই হানিফ হাসান মুখে খাবার তুলতেন। টানাপোড়োনের মাঝেও ছিলো তার সুখের সংসার। একজনের রোজগারের ছয় সন্তান সহ তাদের আটজনের পরিবার সুন্দরভাবে কে’টে যেতো। কতই না সুখের ছিলো দিনগুলো। তবে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলোনা। বছর পাঁচেক আগে গত হলেন হানিফ হাসান। ছোট মেয়ে উপমার বয়স যখন নয় বছর তখনই হঠাৎ করেই মা’রা গেলেন। পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরলো খোরশেদ। গ্রামেগঞ্জে যখন যে কাজ পায় তখন সে কাজ করেই সংসার চালায়। বড় তিনটা বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন বাকি আছে ছোট দুইটা বোন। রূপকথা আর উপমা। রূপকথার বিয়ে হয়ে গেলেই উপমাকে নিয়ে আর চিন্তা নেই। এখন থেকেই চারদিক থেকে উপমার জন্য পাত্রপক্ষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রূপকথার আগেই তাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু একটা বোন রেখে আরেকটা বোনকে বিয়ে দিয়ে তার অপমান কিভাবে করবে খোরশেদ? রূপকথাকে সে ও বাবার মতোই ভালোবাসে। যতটা বাবা রূপকথাকে ভালোবাসতো? ঠিক ততটা না বাসতে পারলেও কম কিন্তু বাসেনা।
বাইরে চুলা ঘর থেকে মা শাহিনূরকে ডাক দিলেন।
তিনটা মেয়ের জামাই ই শশুর বাড়ীতে আছে। তাদের কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেটারই তদারকি করছে আলেয়া বেগম। জামাইরা বলে কিছু করা লাগবেনা আম্মা। আপনারা যা দিয়া খাবেন আমরা ও তা দিয়াই খাবো। কিন্তু সামনে ভালো খাবার না হলেও জাত যায়, মান যায়। একটা ছেলের রোজগারেই কোনোমতে সংসার টিকে আছে। ছেলেটা তার মানুষ হয়েছে বটে। করিম মিয়ার তিনটা ছেলে। অথচ একটা ও মানুষ হয়নি। বাবা মাকে ভাগে খাওয়াতে গিয়েও তাদের কত বাহানাবাজী। সে দিক থেকে আলেয়া বেগম আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করেন। যদি ছেলেটা অমানুষ হতো তাহলে মেয়েদের নিয়ে তিনি কার দুয়ারে যেতেন? এজন্যই বলে আল্লাহ তার বান্দাকে একেবারে মা’রেন না। কাউকে না কাউকে বান্দার রিজিকের উচিলা করে ঠিকই পাঠিয়ে দেন।
মায়ের ডাকে শাহিনূর চুলা ঘরে গেলো। চোখ মুছে বুবুর পিছু পিছু রূপকথাও বের হলো। রূপকথাকে দেখে আলেয়া বেগম বলে উঠলেন,
-“ক্ষেতে গিয়া কয়ডা বেগুন নিয়া আয়। তরকারির লগে ভর্তা ও বানান যাইবো।”
মাথায় ওড়ানা দিয়ে নিজেদের ক্ষেতে ছুটলো রূপকথা। বাড়ির থেকে কিছু দূর সামনে তাদের একটা জমি আছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করে রূপকথার মা। উপমাকে সহজে ঘরে পাওয়া যায়না। পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা তার অভ্যেস। তাই অগত্যা রূপকথাকেই যেতে হলো।
ক্ষেতে প্রবেশ করে বোঁটা থেকে বেগুন ছিঁড়ে ওড়নায় পুড়ে নিচ্ছে রূপকথা। নেওয়া শেষ হতেই ওড়না মুঠো করে নিরবে মাথানিচু করে হেঁটে বাড়ির দিকেই আসছিলো।
-“ওড়নায় কি নিয়া যাও কোকিল পাখি?”
পা জোড়া থেমে গেলো রূপকথার। মামুন ভাইরে দেখলেই তার কলিজায় কামড় মারে। যেনো কতবছর ধরে তাদের মধ্যে ভাব। কত অবলীলায় মানুষটি তার সাথে কথা বলে। কেমন যেনো নেশা ধরানো গলা মানুষটার। যখন হাসে তখন মন চায় শুধু চেয়ে থাকতে।
রূপকথা পেছন না ঘুরেই চাপা গলায় বলল,
-“মা বেগুন নিতে পাঠাইছে।”
মামুন ঘুরে সামনে এসে দাঁড়ালো। রূপকথার ওড়না থেকে দুটো বেগুন নিয়ে বলল,
-“বেকার মানুষ তোমার কাছ থেইকা দুইটা বেগুন নিলাম। দাবি রাখবা না কিন্তু। যাও কোকিল পাখি।”
রূপকথা বুঝলোনা এই কাঁচা রান্নাছাড়া বেগুন দিয়ে কি করবে মানুষটা? রূপকথার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো।
-“মামুন ভাই, আপনি আমারে ক্যান কোকিল পাখি ডাকেন?”
ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখলোনা। তাই ইতিউতি করে প্রশ্নটি করেই ফেললো।
মামুন হেসে উঠে বলল,
-“তোমার মিষ্টি কন্ঠ শুনলেই আমার মনে হয় আশপাশ দিয়া পাখি ঘুরঘুর করতাছে। এমন সুরেলা কন্ঠ কোকিল পাখি ছাড়া আর কার হইতে পারে? তাই তোমার লগে মিলাইয়া নাম দিলাম কোকিল পাখি।”
ধরা গলায় রূপকথা বলল,
-“সবার মতো আপনে ও তো কাক ডাকতে পারেন।”
মামুন স্মিত হেসে বলল,
-“যারা তোমারে কাক কয়। আসল কাক তো তারাই। যারা কা কা ছাড়া কিছুই পারেনা। সে সকল কাক রা কি বুঝবে কোকিল পাখির কোকিলা কন্ঠস্বর।”
#চলবে……