#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_20
আকাশের বুকে সূর্যের বিস্তর ঘটেছে বেশ খানিকটা সময় হলো। সকালের কুয়াশা কেটে গিয়ে ফুরফুরে হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। ঘড়ির কাঁটা ঠিক দশটায় আটকে আছে। এখনো কুম্ভকর্ণের মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে আরজান। পাশেই হাত-পা ছড়িয়ে অসহায়ের ন্যায় বসে আছে কেউ। এমন একটা ভাবভঙ্গি যেন তার মতো অসহায় বোধহয় আর কেউ নেই। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে মাথা উঠিয়ে একবার আরজানের দিকে তাকিয়ে আবার নজর সরিয়ে নেয়। নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভয় পাচ্ছে সে, পাছে যদি একটু শব্দ হয় আর আরজান উঠে যায়।
একভাবে বসে থেকে থেকে পা লেগে গেছে, ইতিমধ্যে পশ্চাতদেশেও ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। আরজানের দিকে সতর্কতার দৃষ্টিতে চেয়ে একটু নড়েচড়ে বসতে চায় সে। অমনি বেখেয়ালিতে তার হাতের কাছে থাকা পানির বোতলটা ঢপ করে পড়ে যায় মাটিতে। অমনি আরজান ঘুমের মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে, “বউ”
চকিতে তাকায় লোকটা। শব্দটা খুবই ক্ষীণ কিন্তু এমন একটা ভুল হলো কী করে তার দ্বারা! সে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে আরজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ হাত বুলানোর পড়ে ধীরে ধীরে আবার নাক ডাকতে শুরু করে আরজান। হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় লোকটা। নিজের বউকেও সে কখনো এতো আদর করে ঘুম পাড়ায়নি!
তার ভাবনায় জল ঢেলে কোত্থেকে একটা মাছি এসে আরজানের মুখের ওপর ঘোরাঘুরি করতে থাকে। এ দৃশ্য চোখে পড়তেই লোকটার বুক যেন ছ্যাত করে ওঠে। দ্রুত হাত দিয়ে মাছিটা তাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু মাছিও যেন জেদ ধরে বসেছে, আজ সে কিছুতেই যাবে না। এ যেন ঠিক মরার উপর খাঁড়ার ঘা এর মতোই। অনেক কষ্টে মাছিটাকে তাড়াতে পেরে যুদ্ধে জয়ী বিধ্বস্ত সৈনিকের ন্যায় এলিয়ে পড়ে সে।
সারাটা রাত সে ঘুমাতে পারেনি। সকাল হতেই ঘুম তার শিয়রে এসে কড়া নাড়ছে। এ যেন গভীর রজনীতে প্রিয়তমার আহ্বানের ন্যায় টানছে তাকে। কিন্তু এমনই এক কুয়োয় ফেঁসে গেছে সে, যে ঘুম তো দূরের কথা নিঃশ্বাস নিতেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে বস্ত্রহীন কোনো পথিকের ন্যায় দৌড়ে গিয়ে কোনো ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়তে! এমন সময় ধুপধাপ শব্দ হয় দরজার বাইরে। বেশ বিরক্ত হয় লোকটা। মনেমনে বিশ্রি একটা গালি দিয়ে বলে, “কোন হা’লারপুত আবার হুদাই শব্দ করতে করতে আসছে?”
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই শার্ট-প্যান্ট পড়া একজন সুপুরুষ প্রবেশ করে দরজা দিয়ে। পুরুষটির বয়স বেশি নয় তবে চোখ-মুখের গাম্ভীর্যতা বড্ড বেশি। তাকে হতদরিদ্রের ন্যায় পড়ে থাকতে দেখে অবাক স্বরে শুধায়, “কী ব্যাপার ফিরোজ?”
করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লোকটা। অসহায় কন্ঠে বলে, “আর ফিরোজ, ফিরোজ শেষ স্যার, এখন শুধু হাড্ডি-মাংসটুকু বেঁচে আছে।”
খানিক বিচলিত হয় সম্মুখের পুরুষটি। দ্রুত এগিয়ে এসে বলে, “কী হয়েছে ফিরোজ? তোমাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে? কাল তো ভালোই দেখলাম মনে হলো। একরাতে অসুখ বাঁধালে কী করে?”
“অমন কথা বলবেন না স্যার। আলহামদুলিল্লাহ বলেন যে এতো অত্যাচার সহ্য করেও আমি এখনো বেঁচে আছি।”
ফিরোজের কথায় অত্যাধিক বিরক্ত হয়ে পড়ে সামনে পুরুষটা। কিঞ্চিত উচ্চস্বরে শুধায়, “কী হয়েছে বলবে তো নাকি? তোমার এ হাল কেন?”
“আস্তে কথা বলুন স্যার, উঠে পড়বে। গরিবের সর্বনাশ আর করিয়েন না। আমার পশ্চাতদেশ পর্যন্ত ব্যাথায় টনটন করছে। আমি আর একে সামলাতে পারবো না।” করুন স্বরে উত্তর দেয় ফিরোজ।
“কেন? মারপিট করেছে নাকি? হাত-পা তো শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা, এতো সহজে খোলার তো কথা নয়। ঠিক আছে, তুমি থাকো, আমি তোমার জন্য খাবার আর ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
বাক্য সম্পূর্ণ করে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ছুটে আসে ফিরোজ। হাতজোর করে বলে, “আপনার হাতে ধরি, পায়ে ধরি, আমারে ছাইড়া দেন স্যার। আপনি এখানে দু’দন্ড দাঁড়ালেই বুঝতে পারবেন এই ছেলে কত খতরনাক।”
“এর ব্যবস্থা নেওয়ার এখনো সময় আসেনি। একে কী করা হবে সেটা আগে কথাবার্তা বলে তারপর ঠিক করতে হবে। এর পেছনে আবার জনদরদী চেয়ারম্যান আছে না। ঐ ব্যাটা চেয়ারম্যান সবসময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমার কাজে। কবে যেন ওকেই মেরে পুঁতে দেবো মাঠের মাঝে।” রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে পুরুষটা।
স্যারের রাগ দেখে আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না ফিরোজের। এখন কথা বলা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। বললে দেখা যাবে তাকেই মেরে এখানে পুঁতে রেখে যাবে! তার চুপসানো মুখের দিকে চেয়ে পুরুষটা পুনরায় রাগান্বিত স্বরে বলে, “কথা অমান্য করা আমি পছন্দ করি না ফিরোজ। কালকের আগে এ ঘর থেকে যদি বেরোতেই হয় তবে তোমার লাশই বেরুবে। আমার কথার নড়চড় হলে কী হবে তা বুঝতেই পারছো?”
কথা সম্পূর্ণ করে পুরুষটা আবার চলে যায় দড়জা ভিড়িয়ে দিয়ে। চাতক পাখির ন্যায় দরজার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া ফিরোজের আর কিছুই করার নেই। এখন না-তো সে এখান থেকে যেতে পারবে আর না-তো এখানে শান্তিতে দু’দন্ড থাকতে পারবে। ‘পানিতে কুমির ডাঙায় বাঘ’ কথাটা পারফেক্টলি ফলে যাচ্ছে তার সাথে। সে আরজানের দিকে চেয়ে করুন কন্ঠে বলে ওঠে, “এখন আমার একটাই দোয়া, তোর ঘুম আরো সুদীর্ঘ হোক।”
তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে ওঠে আরজান, “কোন শা’লারে কথা বলে?”
চমকে ওঠে ফিরোজ। সে দ্রুত উঠে কিছু বলার পূর্বেই আরজান নিজের হাতের দড়ি ফটাফট দাঁত দিয়ে খুলে তড়িৎ গতিতে উঠে বসে পড়ে। চোখের ওপর থেকে বেঁধে রাখা কাপড়টা সরাতে সরাতে বিরক্ত স্বরে বলে, “দিলি তো ঘুমটা ভাঙিয়ে।”
দু’হাতে পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে পুনরায় বলে, “হাতদুটো পেছনে নিয়ে বাঁধতে হয়, মূর্খের দল। কোনো কর্মের নস তোরা, হুদাই পেলে-পুষে রেখেছে। তোদের দলের অধিপতি কোন গাছবল’দ বলতো?”
একের পর এক ঝটকায় অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয় ফিরোজ। হুঁশ ফিরতেই দৌড়ে আরজানকে আটকাতে যায়। তবে তার পূর্বেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে আরজান। ফিরোজ কিছু বূঝে ওঠার আগেই চেঁচিয়ে ওঠে সে, “পেয়েছে, পেয়েছে।”
“কী পেয়েছে?” হতবুদ্ধির ন্যায় শুধায় ফিরোজ।
তেতে ওঠে আরজান, “আবু’লের মতো কথা বলিস না। সারারাত পর ঘুম থেকে উঠলে কী পায়? হিসু পেয়েছে, বাথরুম কোথায় তাড়াতাড়ি বল।”
চমকে ওঠে ফিরোজ। আবার সেই বিখ্যাত হিসু! এবার সত্যিই আবুলের মতো চেয়ে থাকে ফিরোজ। তার অবস্থা বড়ই কাহিল। ধমকে ওঠে আরজান, “বলবি? নাকি এখানেই তোর সামনে মেরে দেবো?”
আফসোস করে ফিরোজ। না, এর কথা বলা যায় না, লাজলজ্জা তো কিচ্ছু নেই। দরজার বাইরের দিকে ইশারা করতেই ছুটে যায় আরজান। ইতিমধ্যে ঘাম ছুটে গেছে ফিরোজের। আর কী কী শুনতে হবে আল্লাহ মালুম! বাইরে তো দেখিয়ে দিলো এখন পালিয়ে গেলে স্যার তো তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। ভাবনা ছেড়ে সে দৌড়ে বাইরে আসতে নিতেই চিল্লিয়ে ওঠে আরজান, “আরেহ আরেহ, ব্রেক মার, এভাবে ষাঁড়ের মতো ছুটছিস কোথায়?”
আরজানকে পুনরায় ঘরে ফিরে আসতে দেখে হাঁ করে তাকায় ফিরোজ। কোনো বন্দি কি বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েও আবার সেচ্ছাই সেখানে ফিরে আসে? এর অছিলায় আর কতো আশ্চর্য হতে হবে তাকে কে জানে! আরজান আরাম করে ফিরোজের জন্য পেতে রাখা টুলটাতে বসে নিজের চুল করতে থাকে। হটাৎ মাথার পেছনে হাত লেগে ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে চোখ গরম করে তাকায় ফিরোজের দিকে। সন্দিহান হয়ে বলে, “কাল আমাকে তুই আঘাত করেছিলি?”
দ্রুতবেগে ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায় ফিরোজ। পানির বোতল হাতে তুলে নেয় আরজান। ঢকঢক করে একটু পানি খেয়ে পুনরায় শুধায়, “তোর স্যার এতো নির্দয়, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন কেন বলতো? পুরো একটা রাত আমাকে বউয়ের কাছ থেকে দূরে রেখেছ। এখন যদি আমার বউ রাগ করে আমাকে আদর না দেয়। আর আমি যদি বউয়ের আদরের অভাবে মরে যাই, এর দায় কে নেবে? তোর স্যার? ও শা’লা চির কুমার থাকবে মিলিয়ে নিস।”
নিমেষেই চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায় ফিরোজের। একরাত বউয়ের থেকে দূরে থাকাতে কেউ আদরের শূন্যতায় মারা যায়! এর বউয়ের চেহারাটা দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ফিরোজের। বেচারির কষ্টটা সে এখান থেকেই উপলব্ধি করতে পারছে। সে মিনমিনে স্বরে বলে, “যাই বলিস, তোর বউ অনেকদিন পর কাল রাতে শান্তির ঘুম দিয়েছে।”
মুহুর্তেই ফুঁসে ওঠে আরজান। হাতে থাকা পানির বোতলটা ফিরোজের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “এই শা’লা, তুই কেমনে জানলি আমার বউ কাল রাতে ঘুমিয়েছে? জবান টেনে ছিড়ে দেবো হারা’মখোর, বউয়ের ব্যাপারে একটা বাক্য উচ্চারণ করলে।”
চুপসে যায় ফিরোজ। এ তো মারাত্মক রকমের বউ পাগলা! এটাকে কি স্যার ভুল করে তুলে আনলো? একে তো কোনো দিক দিয়ে অমন রাগি, ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে না উল্টো বউয়ের প্রেমে অন্ধ প্রেমিকের ন্যায় আচরন তার। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে কিন্তু স্যারের হুকুম তো তাকে মানতেই হবে। এমন সময় পুনরায় ডেকে ওঠে আরজান, “ফিরোজ”
“তুই আমার নাম জানলি কীভাবে?”
“শুনলাম তো একটু আগেই।”
“তারমানে স্যার যখন এসেছিল তখন তুই জেগে ছিলি? চোখ বড়বড় করে শুধায় ফিরোজ।
উত্তর দেয় না আরজান। আনমনে কিছু ভেবে চলেছে সে। মা কি খুব চিন্তা করছে? ওষুধ খাচ্ছে তো? নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? রূপ, রূপ কী করছে? সে ভালো আছে তো? সে পানিতে নামলে লামিয়া দেখে ফেললে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই ভুলটা করো না রূপ, আর একটু অপেক্ষা করো। আমার জন্য কি চিন্তিত তুমি? পরক্ষণেই নিজ মনেই হেসে ওঠে সে, নাহ রূপ কেন শুধু শুধু তার জন্য চিন্তা করবে? জলরূপসী কি কখনো সাধারণ একটা মানুষের জন্য চিন্তা করে? উঁহু, কখনোই না।
ভাবনার মাঝে ফিরোজ পুনরায় শুধায়, “তাহলে স্যারকে পেয়েও কিছু বললি না কেন তখন?”
আচমকা পরিবর্তন হতে থাকে আরজানের মুখভঙ্গি। বাঁকা হেসে এগিয়ে আসে ফিরোজের দিকে। ফিরোজের একদম নিকটে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “আমার লাগবে পালের গুরু, এসব চুনোপুঁটি দিয়ে কোনো কাজ নেই। তোদের ভাষা শুনে বোঝা যায় তোরা শহরের মানুষ কিন্তু মেইন কালপ্রিট গ্রামের কেউ, সে ব্যাপারে একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত আমি।”
ফিরোজকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে পুনরায় বলে ওঠে, “বাপেরও বাপ থাকে ফিরোজ। আর কবে বুঝবি তোরা? তুই এক কাজ কর, আমার দলে চলে আস। আমার শ্বশুর অনেক বড়লোক, শ্বশুরের থেকে পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে তোকে দিয়ে দেবোনে।”
_______________________
মাথায় হাত চেপে চিন্তিত ভঙ্গিতে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে রূপকথা। সদর দরজার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেছে। এবার বোধহয় সকাল গড়িয়ে দুপুর হবে, তবুও ম্যাজিশিয়ান আসবে না। গাছ থেকে একটা পাতা পড়লেও যেন তার মনে আশার সঞ্চার হচ্ছে, এই বুঝি ম্যাজিশিয়ান এলো।
একরাতের ব্যবধানেই তার ঘুম হা’রাম হয়ে গেছে। রূপকথার হৃদয় যেন তারই বিরুদ্ধে তাচ্ছিল্য হাসছে। ব্যাঙ্গ করে বলছে, “মাত্র একটা দিনের অনুপস্থিতি তুই সহ্য করতে পারছিস না? আর সারাজীবনের জন্য বিচ্ছেদের জাল বুনছিস?”
ধমকে ওঠে রূপকথার অবচেতন মন, “খবরদার বাজে কথা বলিস না। জলপরিরা কখনো মানুষের সাথে সংসার করতে পারে না। তাদের আসল ঠিকানা হলো পানি।”
কেউ যেন দূর থেকে বলে ওঠে, “শীঘ্রই তোর হৃদয়ে ভাঙ্গন ধরবে রে জলরূপসী, নুইয়ে পড়বে ম্যাজিশিয়ানের শূন্যতায়।”
দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যায় রূপকথা। শক্ত হতে হবে তাকে, আড়ালে লুকিয়ে নিতে হবে নিজের অব্যক্ত সব অনুভূতিগুলোকে। সে কোনোভাবেই নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে পারে না। নিজের আফসোসের খাতাটা নাহয় আরেকটু বড় হোক। তবুও অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি তো ভালো থাকবে। তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে আকরাম মিঞা। রূপকথার দিকে এগিয়ে এসে ব্যস্ত হয়ে চিন্তিত স্বরে শুধায়, “বাজান ফিইরা আইছে?”
ডানে-বামে মাথা নাড়ায় রূপকথা। আর কোনো কথা বলে না আকরাম মিঞা। যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই বড়বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। তার এহেন ব্যবহারে খানিক অবাক হয় রূপকথা। আবার কোনো সমস্যা হলো নাকি? সে উঠে দাঁড়াতেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পলাশ। তার দিকে চেয়ে ডেকে ওঠে, “বোন”
হতবাক ভঙ্গিতে ফিরে তাকায় রূপকথা। আরো একটা আফসোস কি ঘুচতে চলেছে তবে!
______________________
মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে আরজান ও ফিরোজ। কিছুক্ষণ আগেই সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা। ঘরের বাইরে এসে আরজান উপলব্ধি করতে পারে ওটা আসলে মাঠের মাঝে তৈরি করা ঘর। যা সাধারণত ফসল পাহাড়া দিতে বানানো হয়ে থাকে। কৃষকরা ওখানে থেকে রাত জেগে ফসল পাহাড়া দেয়। তখন হিসু করার জন্য বেরিয়ে চারদিকে ফসল দেখে হিসু না করেই ফিরে গিয়েছিল সে। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করে দেখে ইতিমধ্যে তার খেল খতম। এটা আর ব্যবহারযোগ্য নেই। এমন সময় বেজে ওঠে ফিরোজের মোবাইল। রিসিভ করে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায় সে। কে কল করেছে কে জানে? তবে দু’বার হ্যাঁ,হুম করেই কল কেটে ফিরে আসে ফিরোজ।
আরজান ভ্রু কুচকে শুধায়, “কি রে? তোর স্যার কল দিয়েছিল?”
“না, বাসা থেকে বউ কল দিয়েছিল। বলছিলো কবে ফিরবো?”
অমনি বুক চেপে আহ করে চিল্লিয়ে ওঠে আরজান।
ফিরোজ হন্তদন্ত হয়ে শুধায়, “কী হলো? কী হলো?”
“বউয়ের কথা মনে করিয়ে দিলি, বুকে ব্যথা লাগলো।”
অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফিরোজ। একটা মানুষ এতো বউ পাগল হয় কী করে! এর জীবনে কি বউ ছাড়া আর কিছু নেই?
ইতিমধ্যে সাদাবিলের পাড়ে পৌঁছে গেছে তারা। বিলের দিকে একবার তাকায় আরজান। এই বিলের মাঝেই খলবলিয়ে বেড়াতো রূপ। এখনেই তো রূপকে পেয়েছিল সে। বিলের মাঝে নিজের সোনালি চুলগুলো ভাসিয়ে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে চেয়ে থাকতো। উল্টা-পাল্টা কথা বলে তার মাথা ধরিয়ে দিত। বারবার ম্যাজিশিয়ান, ম্যাজিশিয়ান করে মেজাজ গরম করতো। স্মৃতিচারণ করে অজান্তেই মুচকি হাসে আরজান। তার সুখময় ভাবনার মাঝেই ধারালো কিছু এসে গেঁথে যায় তার শরীরে। কোনো রকম সময় না দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় তার দেহ।
সে হতবাক নয়নে ফিরে তাকায় ফিরোজের দিকে। ফিরোজের হাতের চকচকে ছুড়িটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তার রক্ত। চোখ-মুখ শুকিয়ে এসেছে ফিরোজের। সে মায়া মিশ্রিত কন্ঠে বলে, “আমাকে মাফ করে দিস, তোকে আলাদা করে দিচ্ছি তোর বউয়ের থেকে। তুই ঠিকই ধরেছিলি, স্যারই কল দিয়েছিল। সে তোকে মারার হুকুম দিয়েছে। আমার হাত-পা বাঁধা অদৃশ্য শেকলে। আমি তোকে না মারলে ওরা আমার মা-বাবা, বউ-বাচ্চা সবাইকে মেরে ফেলবে।”
বাক্য সম্পূর্ণ করে আচমকা আরজানকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় সাদাবিলে। অতঃপর দ্রুত পায়ে ত্যাগ করে সেই স্থান। এখানে থাকলে হয়তো বাঁচাতে ইচ্ছে করবে ছেলেটাকে। আর তার এই ইচ্ছা কাল হয়ে দাঁড়াবে তার পরিবারের জন্য। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। কঠিন হৃদয়ে মায়ার সঞ্চার করেছে যে জন, তাকেই ফেলে যেতে হচ্ছে মৃত্যুর দুয়ারে। আবারো পেছনে ফিরে তাকায় সে, “তোর বউয়ের শরীরে বিধবার তকমা লেপে দিলাম, তুই কি এ কথা সহ্য করতে পারবি কখনো? নাকি অভিশাপ দিবি ওপারে গিয়ে।”
ধীরে ধীরে পানির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে আরজান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তার বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই সাঁতরে উপরে ওঠার। তার জীবনের অধ্যায় বোধহয় এখানেই সমাপ্ত তবে আফসোস রয়ে গেলো অগণিত। সম্পূর্ণে একা হয়ে গেলো তার অভাগী মা। স্বামীর মৃত্যুর শোক সামলে উঠতে না উঠতে পুত্রের মৃত্যু কি মেনে নিতে পারবে সে? আর রূপ, সে কীভাবে বাঁচবে একা এই মানুষদের মাঝে? তার জলরূপসী কি অচিরেই হারিয়ে ফেলবে নিজের উচ্ছ্বাসিত রূপ! আর বোধহয় দেখা হবেনা তার পানির মাঝে খলবলিয়ে সাঁতরে চলা! দেখা হবে না তার সোনালি চুলের অবাধ্য বিচরণ। তোমায় সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হলো না আর। তুমি কি খুব রাগ করবে তোমার ম্যাজিশিয়ানের উপর?
পানির অতল গহ্বরে পিঠ ঠেকতেই চোখদুটো বন্ধ করে নেই সে। অসাড় দেহটা সেটিয়ে যায় কাদাপানিতে।
চলবে,,,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_21
কাঠ ফাটা দুপুরে সাদাবিলের পানিগুলো রক্তের রঙে এঁকেছে বিষাদের গল্প। পাড়ে লাগানো খেজুরের গাছগুলো যেন ঝুঁকে পড়ছে অভিমানে। গাছে বসে থাকা পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দ তুলে জানান দিচ্ছে কারোর উপস্থিতি। আচমকা খলবলিয়ে ওঠে সমস্ত পানি। পানির বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক জলরূপসী। সে নিজের সাথে জাপটে ধরে রেখেছে এক বলিষ্ঠদেহি পুরুষকে। তার সোনালি চুলগুলো বড় বিরক্ত করছে পুরুষটির চোখে-মুখে পড়ে। সে দ্রুত পাড়ে এনে শুইয়ে দেয় পুরুষটিকে। তার ফ্যাকাশে মুখটা ঝাঁকিয়ে কয়েকবার ডাকে, “ম্যাজিশিয়ান, ম্যাজিশিয়ান ওঠো। কিছু হয়নি তোমার। ওঠো ম্যাজিশিয়ান, যেই পানি আমার শক্তি সেই পানি তোমাকে বিলীন করতে পারে না ম্যাজিশিয়ান। তোমার ক্ষতি করার সাধ্যি কোথায় তার?”
চোখ থেকে বেরিয়ে আসা অশ্রুকণা মুছে নেয় সে। পুরুষটার মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে পুনরায় বলে, “উঠছো না কেন ম্যাজিশিয়ান? চোখ মেলে দেখো না আমার দিকে? তাকাও না একটাবার? তুমি জানো লামিয়া আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে তোমার অনুপস্থিতিতে। আমিও সপাটে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছি। ভালো করেছি না? বলো?”
এবারো চোখ মেলে দেখে না পুরুষটা। কথা বলে না তার জলরূপসীর সাথে। অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে নারীটি। দু’হাতে পুরুষটির মুখ আগলে ধরে বলে ওঠে, “কেন কথা বলছো না আমার সাথে? কেন দেখছো না আমার দিকে? কেন এতো নিষ্ঠুর আচরণ করছো তুমি? বলছো না কেন, বলো?”
পুরুষটির এমন কঠিন নীরবতায় যেন উন্মাদ হয়ে ওঠে নারীটি। তার মাথা কোল থেকে নামিয়ে হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পানির মাঝে। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই হাতে কিছু নিয়ে উঠে আসে সে। দৌড়ে যায় পুরুষটির কাছে। হাতে থাকা জড়িবুটি ভালোমতো দু’হাতে চেপে চেপে থেঁতলে নিয়ে তা আলতো করে লাগিয়ে দেয় পুরুষটির ক্ষতস্থানে। জড়িবুটির রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তার ক্ষতস্থানে। নারীটি পুনরায় কোলে তুলে নেয় তার মাথা। উন্মাদের ন্যায় পুরুষটার সারা মুখ জুরে চুমু একে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ওঠে, “তোমায় উঠতে হবে ম্যাজিশিয়ান, তোমায় উঠতে হবে।”
এভাবে খানিক সময় কেটে যাওয়ার পর হটাৎ তার কষ্টের অবসান ঘটিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় পুরুষটা। তার দিকে চেয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে, “রূপ”
চকিতে তাকায় রূপকথা। ব্যস্ত স্বরে শুধায়, “তুমি ঠিক আছো তো?”
উত্তর দেয় না আরজান উল্টো নিজের ক্ষত চেপে ধরে মৃদুস্বরে ধমকে উঠে বলে, “কাঁদছো কেন শুধু শুধু? একদম কাঁদবে না বলে দিলাম।”
হকচকিয়ে উঠে থেমে যায় রূপকথা। ধীরে সুস্থে রূপকথার হাত চেপে উঠে বসে আরজান। নিজের ক্ষতস্থান পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে, “মুখের ওপর এতো অত্যাচার চালালে কেউ না উঠে পারে?”
অবাক হওয়ার সীমা থাকে না রূপকথার। কান্না যেন মুহুর্তেই থেমে গেছে এসব শুনে! অবাক স্বরে শুধায়, “আমি অত্যাচার করেছি?”
“তা নয় তো কী? একটা অবচেতন ছেলের সরলতার সুযোগ নিয়ে তার সারা মুখে চুমু দেওয়া কি অত্যাচার নয়?” এখনো ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না সে। কথাগুলো কেটে কেটে যাচ্ছে, খুব বেশি অস্পষ্ট হচ্ছে। তবুও কেমন উল্টো-পাল্টা কথা বলে যাচ্ছে অবিরত!
তার কথাখানা শ্রবণগোচর হতেই তৎক্ষণাৎ লজ্জায় নুইয়ে পড়ে রূপকথা। তারমানে লোকটা সব উপলব্ধি করেছে আর এখন তাকে পচাবে এসব বলে! আড়চোখে একবার তাকায় তার ক্ষতের দিকে। সেটা খুব বেশি গভীর না হলেও বেশ তাজা, এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার ভাবনার মাঝেই আরজান পুনরায় বলে ওঠে, “আমার মতো নিষ্পাপ একটা ছেলের ইজ্জত হরণ করলে তুমি? এই মুখ আমি কাকে দেখাবো?”
উত্তর দেয় না রূপ। লোকটার মুখে কিছুই আটকায় না। এখন কথা বললেই শুধু ঠোঁটকাটা কথাবার্তা বলে কান পচিয়ে দেবে। তাকে চুপ থাকতে দেখে আরজান বলে ওঠে, “এখন চুপ করে থেকে আর লাভ কী? আমার ইজ্জতের নিলাম তো তুমি করেই ফেলেছো।”
মুখ ঘুরিয়ে নেয় রূপকথা। তার মোটেও এসব লজ্জাজনক কথা শোনার ইচ্ছে নেই। নেহাতই ওটা ঝোঁকের বসে করে ফেলেছে তা বলে এভাবে বলবে? আরজান পুনরায় বলে, “তুমি জানো এখানে কোনো সাংবাদিক থাকলে আজকের ব্রেকিং নিউজ কী হতো?
কাগজের ফ্রন্ট পেজে বড়বড় অক্ষরে ছেপে দিত
‘বউয়ের চুমুতে অজ্ঞান অসহায় যুবক’।”
চোখ-মুখ কুচকে নেয় রূপকথা। লোকটার দিকে তাকানোও রিস্ক এখন। কিছুতেই তাকাবে না সে।
ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান। কত বড় সাহস এই মেয়ের! নিজের স্বামীকে উপেক্ষা করছে! দ্রুত নজর ঘুরিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে নেয় সে। না, আশেপাশে তো কোনো পুরুষ নজরে আসছে না। তাহলে তার বউ ওদিকে চেয়ে কী দেখছে? আচমকা চোখদুটো বড়বড় করে বিস্মিত কন্ঠে বলে, “ভূত আছে ওদিকে? যাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না শুধু তোমায় দেখা দিচ্ছে? নিশ্চয়ই পুরুষ ভূত। সে কি আমার চেয়ে বেশি সুদর্শন?”
নিমেষেই চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায় রূপকথার। বিরক্ত স্বরে বলে, “মাথা কি খারাপ হলো তোমার? ওরা কি মাথায় আঘাত করেছিল নাকি সত্যি করে বলোতো?”
চুপসে যায় আরজান। উঁহু, কিছুতেই বলা যাবে না মাথায় আঘাতের কথা। তাহলে দেখা যাবে তাকে পাগল প্রমাণ করে তার বউ ভেগে গেছে ঐ সুদর্শন ভূতের সাথে! কথাটা ভাবতেই সে কটমট করে তাকায়। রূপকথার দৃষ্টি অনুসরণ করে শূন্যে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “শা’লা ভূত, মরেও শান্তি দিচ্ছিস না? আমার বউয়ের দিকে তাকালে চোখ গেলে তান্ত্রিকের বোতলে ভরে দেবো। লু’চ্চা ভূত কোথাকার, মানুষের সুন্দরী বউ দেখলেই নগদে নজর দিতে চলে আসিস।”
অতঃপর রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “চলো তো রূপ। এখানে থাকার কোনো দরকার নেই। কালেমা পড়তে পড়তে চলো যেন ভূত ব্যাটা ধারে কাছে আসতে না পারে।”
রূপকথা আবুলের মতো চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছূ বলার মতো খুঁজে পায় না। তাকে টেনেটুনে দাঁড় করায় আরজান। ধমকে উঠে বলে, “একদম অন্যদিকে তাকাবে না। আমি কি দেখতে খারাপ? খারাপ হলেও কিছু করার নেই, আমার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে।”
রূপকথা কিছু বলার পূর্বেই পুনরায় ধমকে ওঠে সে, “একি! তুমি তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না। ভূত ব্যাটা আমার সংসার ভেঙে দিলো! তাকাও বলছি আমার দিকে।”
রূপকথার মুখ ধরে টেনেটুনে নিজের দিকে করে আরজান। গম্ভীর স্বরে বলে, “হুম, এবার ঠিক আছে।”
চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে রূপকথার চোখে-মুখে। চুমু দিয়ে কি খুব বেশি ভুল করলো সে? লোকটা কি চুমুর কারনেই উল্টা-পাল্টা বলতে শুরু করেছে? নাকি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে? কিছুক্ষন পূর্বে সে আর পলাশ ম্যাজিশিয়ানের খোঁজে মাঠে আসে। চারপাশে খুঁজে কোথাও না পেয়ে সাদাবিলের কাছাকাছি আসতেই সম্মুখীন হয় এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের। অপরিচিত এক ছেলে রক্তমাখা ছুড়ি হাতে হনহন করে নেমে আসছে সাদাবিল থেকে। সন্দেহ হওয়ায় পলাশ ধরে খানিক উত্তম-মধ্যম দিতেই সে হরহরিয়ে উগলে দেয় সবকিছু। অতঃপর রূপকথা ছোটে বিলের দিকে আর পলাশ ছেলেটাকে নিয়ে যায় মাঠের বাইরে। ইতিমধ্যে তাকে টানতে টানতে মাঠে নেমে পড়েছে আরজান। রূপকথা নিজের মতো করে ভাবছে আর হাঁটছে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে আরজান। এভাবে হুট করে দাঁড়িয়ে পড়াতে কৌতূহলী হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে রূপকথা। তাকে আরো একবার চমকে দিয়ে আরজান বলে ওঠে, “দূরে দূরে হাঁটছো কেন?”
রূপকথা মাথা তুলে তাকাতেই ধমকে ওঠে সে, “সরে এসো আমার কাছে।”
বিনাবাক্যে তার একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় রূপকথা। এতোটা কাছাকাছি যে একপা নড়তে গেলেও স্পর্শ লাগবে পাশের মানুষটার। এবার যেন স্বস্তি পায় আরজান। সামনে তাকিয়ে চুপচাপ হাঁটতে শুরু করে। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে তার সাথে হেঁটে চলে রূপকথা। বিস্মিত হওয়ার কোনো কারন পায় না সে। লোকটা মাঝে মাঝেই এমন আজগুবি আচরণ করে! কিছুটা পথ হাঁটার পর ব্যথায় চোখ-মুখ কুচকে নেয় আরজান। ক্ষতস্থানের ব্যথা তো আছেই তার উপর মাথা পর্যন্ত ধরে আসছে। কতক্ষণ এভাবে জোর করে শক্তি দেখিয়ে চলতে পারবে তা তার জানা নেই। ব্যথায় দু’হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরতেই ভরকে যায় রূপকথা। সে কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই ঢলে পড়ে যেতে নেয় আরজান। তৎক্ষণাৎ তাকে নিজের সাথে আকড়ে নেয় রূপকথা। রাগান্বিত স্বরে বলে, “সবসময় বেশি বোঝো তুমি। তোমার এ ক্ষত এতো সহজে সারবে না। শুধু শুধু জোর খাটিয়ে চলার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে বসে থাকো, আমি ভাইকে ডেকে নিয়ে আসছি।”
“ভাই কে? পলাশ?” ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান।
“হুম”
“ও শা’লা তো আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। দেখা যাবে আমাকে মেরে এখানে পুঁতে রেখে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলবে ‘খতম’।”
কিঞ্চিত বিরক্ত হয় রূপকথা। লোকটার সবসময় উল্টা-পাল্টা চিন্তাভাবনা। কখনো একটু ভালো কিছু ভাবতে পারে না। সে বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে, “মারবে কেন? তাছাড়া আমাকে এ পর্যন্ত ভাই-ই নিয়ে এসেছে। সেই বলেছে ডাকাতদল মাঠের মধ্যে কোথাও নিজেদের ঘাঁটি গেড়েছে। একটা দরকারে সে এখানে থকতে পারেনি তবে মাঠের প্রান্তেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুধু এই যাবো আর এই আসবো।”
“না না, তুমি কোথাও যাবে না। আমাকে একটু ধরে রাখো, আমি নিজেই যেতে পারবো। ও শা’লার উপর আমার এক বিন্দু বিশ্বাস নেই। হটাৎ বোনের উপর দরদ উতলে পড়ছে একেবারে।”
“তুমি এতো সন্দেহ করো কেন বলোতো?” বিরক্ত স্বরে শুধায় রূপকথা।
“সন্দেহ করবো না তো কী করবো? ও শা’লা ভালো নাকি? কখন আবার মন বদলে যায় তার ঠিক আছে?”
“কিছুই হবে না। তুমি থাকো, আমি ডেকে নিয়ে আসি।”
চিৎকার করে ওঠে আরজান, “খবরদার বলছি রূপ, তুমি কোথাও যাবে না। আমি দুর্বল বলে যা ইচ্ছা তা করো না। আমাকে ধরো, আমি একাই যেতে পারবো। তোমার গুণধর ভাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।”
কথা বলতে বলতে ব্যথায় চোখ-মুখ কুচকে নেয় সে। হতাশার শ্বাস ফেলে রূপকথা। অগত্যা তাকেই ধরে নিয়ে যেতে হয়। একজন বলিষ্ঠদেহি পুরুষকে ধরে নিয়ে চলা চারটেখানি কথা নয়। রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে তাকে। কোনোমতে তারা মাঠ পেরিয়ে রাস্তা পর্যন্ত উঠতেই দেখা হয় পলাশের সাথে। পলাশের চারপাশে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে তার সাঙ্গোপাঙ্গ। ভ্রু কুচকায় আরজান। সবক’টা একসাথে মিলে করছে টা কী?
আরেকটু এগোতেই তার চক্ষু যেন চড়কগাছ। মাটিতে পড়ে আছে আহত ফিরোজ। শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে গেছে, লালচে হয়ে আছে। যে কেউ দেখে বলে দিতে পারবে, উত্তম-মধ্যম ভালোই চলেছে তার উপর। আরজান অবাক কন্ঠে বলে ওঠে, “একি ফিরোজ! তোর তো মানচিত্রই বদলে গেছে!”
একরাশ বিস্ময় নিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে ফিরোজ। আরজান এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তার কিছুই হয়নি, সামান্য অসুস্থ। মারার সময় তার হাত কাঁপার কারনে সে ঠিকমতো অস্ত্র চালাতে পারেনি। তাই পানিতে ফেলেছিল যেন ক্ষতের কারনে না মরলেও ডুবে মারা যায়। কিন্তু এ তো সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! যেন তেমন গুরুতর কিছুই হয়নি!
তার এভাবে চেয়ে থাকা দেখে বাঁকা হাসে আরজান। কিছুটা আল্লাদি স্বরে বলে, “ব্যাটা তুই শুনোস নাই? প্রেমের মরা জলে ডোবে না।”
আরজান যে আবার এভাবে করে তার সাথে কথা বলবে তা কল্পনাও করেনি ফিরোজ। ফট করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যথায় আহ করে শব্দ তুলে পুনরায় বসে পড়ে। হাজার ব্যথার মাঝেও যেন তৃপ্তি পায় আরজান। বেশ হয়েছে, শা’লা, বোঝ এখন কেমন লাগে। পলাশের দিকে চেয়ে চুমুর ভঙ্গিমা করে বলে, “আহা শা’লাবাবু, তুমি আসলেই গোল্ডেন প্রপার্টি।”
বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে পলাশ। সবসময় এইডার খালি ছিল্লি করা কতাবার্তা। মইরা যাইব তাও মানুষরে জ্বালানো বন্ধ করব না। এমন সময় ফিরোজ বলে ওঠে, “তুই এতো দ্রুত ভালো হইলি কীভাবে? ক্ষত গভীর ছিল না মানলাম কিন্তু এতোটাও কম ছিল না।”
“সবই বউয়ের চুমুর জাদু। বউয়ের ছোঁয়ায় সমস্ত ক্ষত ভালো হয়ে যায় আর এ তো সামান্য ক্ষত। বউ একবার আদর করে ছুঁয়ে দিলে আমি আকাশে উড়তেও পারি। উড়ে দেখাবো তোকে?” গর্বের সাথে বলে আরজান।
ফিরোজ এবার অসহায় চোখে রূপকথা দিকে তাকায়। সে আপাতত বিস্ময় নিয়ে আরজানের মুখের পানে চেয়ে আছে। কিন্তু এসবে পাত্তা দেওয়ার সময় কোথায় আরজানের! সে তো ফিরোজের দিকে কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হটাৎ ফুঁসে উঠে বলে, “আবার আমার বউয়ের দিকে তাকিয়েছিস?”
যত দ্রুত সম্ভব দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ফিরোজ। এর কথা বলা যায় না। বউয়ের দিকে তাকানোর অপরাধে তাকে এই অবস্থায় আবার উত্তম-মধ্যমও দিতে পারে। তবুও যেন শান্তি পায় না আরজান। একবার রূপের দিকে তাকাচ্ছে তো আবার ফিরোজের দিকে তাকাচ্ছ। কী এক মহা জ্বালায় পড়া গেল। সবাই কেন তার বউয়ের দিকেই তাকাবে?
তখনই সেখানে উপস্থিত হয় তার পরাণের শ্বশুরমশাই অর্থাৎ চেয়ারম্যান আকরাম মিঞা। তাদের সবাইকে এভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গোলবৈঠক করতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। আরজানকে দেখেই শুধায়, “বাজান, আইছো তুমি?”
চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে ফিরে তাকায় আরজান। আচমকা বলে ওঠে, “আপনার মেহেরবানিতে তো আরেকটু হলে উপরেই চলে যেতাম। টপকে দিতে চেয়েছিল শা’লারা। নেহাত বউয়ের মোহব্বতে এখনো বেঁচে আছি।”
লজ্জায় আরজানের পেছনে মুখ লুকিয়ে নেয় রূপকথা। এমন দিনও দেখতে হচ্ছে তাকে। ছি ছি! লোকটার মুখ আর ভালো হলো না। আকরাম মিঞা এবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আরজানের আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে নেয়। ক্ষতস্থান নজরে আসতেই ঘাবড়ে যায় সে। ব্যস্ত স্বরে শুধায়, “কী হইছে বাজান? তোমারে তো এখনি ডাক্তারের দরবারে যাওয়ার কাম। এইহানে দাঁড়ায় আছো ক্যাঁ?”
“উঁহু, তা হচ্ছে না। আমি কোথাও যাবো না এখন।”
কথাটা বলে ফিরোজকে দেখিয়ে বলে, “শা’লাবাবু এই মরাটাকে হাসপাতালে ফেলে আসো তো আর রূপ আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো।”
এবার আর সহ্য করতে পারে না রূপকথা। রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে। নিজে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না আর মরা বলছে আরেকজনকে। সে কিছুতেই মেনে নেবে না ম্যাজিশিয়ানের এই কথাখানা। প্রয়োজনে ধরে বেঁধে হাসপাতালে নেবে তবুও বাড়িতে নয়।
আরজান বাড়ির দিকে এগোতেই শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে রূপকথা। গম্ভীর স্বরে বলে, “চুপচাপ এখানে দাঁড়াও। হাসপাতালে যেতে হবে তোমাকে।”
চোখদুটো বড়বড় করে তাকায় আরজান। বউ তার উপর হুকুম চালাচ্ছে! মা দেখলে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেত। সে কিছু বলার পূর্বেই ইতিমধ্যে আকরাম মিঞা ভ্যান ডেকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আরজান কিছু বলতে নিতেই মুখ চেপে ধরে রূপকথা। রাগান্বিত স্বরে বলে, “এখন যদি বলো যাবো না তাহলে আমি চলে যাবো ঐ ছেলেটার সাথে। নাম কী যেন? ফিরোজ, হ্যাঁ ফিরোজ। ওর সাথে চলে যাই আমি তুমি বরং বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
ঢোক গেলে ফিরোজ। এই মেয়ে তো শুধু শুধু তাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বিনা দোষে। ইতিমধ্যে আরজান কটমটে দৃষ্টিতে ফিরোজের দিকে চেয়ে আছে। হটাৎ পলাশের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “এটাকে নিয়ে যাও তো শা’লাবাবু। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পানি পড়া, তেল পড়া যা আছে সব দাও। শা’লা আমার ঘর ভাঙতে লেগেছে, ইচ্ছেতো করছে এটাকে এখনি,,,,,,,,,,।”
কথা অসম্পূর্ণ রেখে রূপকথার দিকে চেয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে, “আমি কখন বলেছি যে যাবো না। ধরো, আমাকে ধরে ভ্যান পর্যন্ত নিয়ে চলো। খুব ব্যথা করছে, দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া উচিত।”
চলবে,,,,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_22
ছেলের খবর পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন সোফিয়া শিকদার। সাথে আসেনি লামিয়া। তার এখন সময় কোথায় এখানে আসার? সে তো গভীর পরিকল্পনার জাল বুনতে মগ্ন। ছেলেকে দেখতে এসে ছেলের আচার-আচরনে অতিশয় হতবাক এবং বিরক্ত সোফিয়া শিকদার। এসে থেকে দেখে যাচ্ছে তার ছেলে কেমন বউয়ের আঁচল ধরে বসে আছে। মেয়েটার আশেপাশে কোনো ডক্টরকে পর্যন্ত আসতে দিচ্ছে না আর না তো মেয়েটাকে কাছ ছাড়া করছে। এক কথায় তাকে উপাধি দেওয়া যায় ‘বউ পাগলা’। ছেলের আচরনে বিস্ময়ের যেন সীমা থাকে না সোফিয়া শিকদারের। তার ছেলে তো কখনোই এমন ছিল না। হ্যাঁ, বাবার মৃত্যুর আগে সে এরকমই সবাইকে জ্বালিয়ে মারতো, উল্টা-পাল্টা কথা বলে সবাইকে হাসাতো। তবে সেই আরজান তো বদলে গিয়েছিল বাবার মৃত্যুতে। গড়ে উঠেছিল গম্ভীর আর কঠোর হৃদয়ের একজন মানুষ। এই মেয়েটা কেমন এক পলকেই বদলে দিয়েছে তার আরজানকে! গম্ভীর আরজানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে তৈরি করেছে সেই আগের আরজানকে। যে ছিল হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত।
সে বুঝে উঠতে পারছেন না ছেলের এহেন পরিবর্তনে তার খুশি হওয়া উঠিত নাকি রাগ করা উচিত। মাঝে মাঝে তার ভালো লাগছে ছেলের পরিবর্তনে আবার রাগ লাগছে তার এমন বউ পাগলা আচরনে। অন্যদিকে মেয়েটা তার ছেলেকে বাঁচিয়ে এনেছে শুনে তার প্রতি রাগগুলো কেমন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গিয়েছে কিন্তু তার বোনের মেয়ে? তাকে কী উত্তর দেবে আর বোনের সামনেই বা কোন মুখে যাবে? এই মেয়েকেও কিছু বলার উপায় নেই। ছেলে যে তার বড় বেশি সুখে আছে এই মেয়ের সঙ্গে। সেই সুখ কেড়ে নেওয়ার পাপ সে মা হয়ে কী করে করবে? বর্তমানে সে মহা সংশয়ে ভুগছেন।
আবার লামিয়া সেই যে পলাশ আর রূপকথার পেছনে ছুটলো আর ফিরে এলো খানিক আগে। এসে থেকেই কেমন গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার মুখ দিয়ে টু শব্দটা পর্যন্ত বলাতে পারেনি সে। আর না তো পেরেছে নিজের সাথে আনতে। অগত্যা তাকে একাই আসতে হয়েছে। আর এসে থেকেই ছেলের এসব আজব কান্ড দেখতে হচ্ছে। নিজের অসুস্থতার পরোয়া না করে মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে আছে তো আছেই। আশেপাশের সকলে ড্যাবড্যাব করে তাদের দিকে চেয়ে আছে এসব কর্মকাণ্ডের কারনে। সে এটুকু বুঝে গেছে যে তার ছেলে বদলে গেছে, পুরোপুরি বদলে গেছে।
তার ভাবনার মাঝেই আরজান বলে ওঠে, “তুমি এতো চিন্তা করো কেন বলোতো মা? একদিনেই দেখো কেমন শুকিয়ে গেছো তুমি? ওষুধ টষুধ খেয়েছো তো ঠিক মতো? নাকি সেটাও বাদ দিয়ে দিয়েছো?”
শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে সোফিয়া শিকদার। সে কি একা চিন্তা করেছে? ছেলের বউটা যে কাল থেকে চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে সে খবর সে ঠিকই পেয়েছে। মেয়েটা খেয়েছে কি-না কে জানে? আরজানের পাশে বসে থাকা রূপকথার দিকে তাকাতেই আরজান বলে ওঠে, “আবার ওর দিকে ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? তুমি কি এখনো স্টার জলসার দজ্জাল শাশুড়ির রোল প্লে করছো?”
বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে চায় রূপকথা। লোকটার সবসময় শুধু বাজে কথা। তবে তার পূর্বেই তাকে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে দেয় আরজান। চোখ গরম করে তাকায় রূপকথার দিকে। সেসব পাত্তা দেয় নাকি রূপকথা? সে নিজের মতো উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে, “আপনার শরীর ভালো নেই মা। আপনি বরং বাড়িতে গিয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম করুন। আমরা আছি তো, ঠিকই সামলে নেবো সবকিছু। তাছাড়া মোবাইল তো আছেই, যখন ইচ্ছা তখন নাহয় কথা বলে নিয়েন।”
“আমি নাহয় বাড়িতে গিয়ে খেয়ে নেবো কিন্তু তুমিও তো কাল থেকে খাওনি কিছু। তুমি খাবে না?” শুধায় সোফিয়া শিকদার।
শাশুড়ির এমন স্বাভাবিক ব্যাবহারে কিছুটা অবাক হতে হয় রূপকথাকে। তবুও নিজেকে সংবরণ করে বলে ওঠে, “ভাইকে দিয়ে পরে খাবার আনিয়ে নেবো। আমি কি ভাইকে বলবো আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে?”
“না না, থাকো তোমরা। আমি একাই ঢের যেতে পারবো। হাসপাতালের সামনে থেকে ভ্যান নিলেই সোজা বাড়ি।” কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় সোফিয়া শিকদার।
ছেলের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যায় সোফিয়া শিকদার। অমনি আরজান ভ্রু কুচকে বলে ওঠে, “বউ-শাশুড়ির প্রেম তো দেখছি জমে উঠেছে।”
চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায় রূপকথা। এই লোকটাকে নিয়ে সে কী করবে? কী করলে তার মুখ বন্ধ হবে? সে হনহন করে বাইরে চলে যায়। বাইরের কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে আকরাম মিঞা, পলাশ ও ফিরোজ। আরজানের কথামতো তাকেও ডক্টর দিয়ে দেখানো হয়েছে। তবে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি, আরজান বলে রেখেছে তাকে ধরে বেঁধে বাড়ি নিয়ে যেতে। তাইতো সকলের সাথে অসহায়ের ন্যায় বসে আছে ফিরোজ। রূপকথাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় পলাশ। ব্যস্ত হয়ে শুধায়, “কী হইছে বোন?”
ডানে-বামে মাথা নাড়ায় রূপকথা। হুট করে ফিরোজের মোবাইলটা ছিনিয়ে নেয় সে। ফিরোজ হকচকিয়ে ওঠে আচমকা এমন হওয়াতে। মস্তিষ্ক সচল হতেই কেড়ে নিতে যায় নিজের মোবাইল। অমনি তাকে ধরে নেয় পলাশ। শক্ত হাতে জাপটে ধরে থাকে। ফিরোজ ইতিমধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। তবে পলাশের সাথে পেরে উঠছে না সে। তার শরীর এখনো দূর্বল। সেদিকে আর নজর না দিয়ে পুনরায় কেবিনে ঢুকে যায় রূপকথা। আরজানের কাছে গিয়ে ধরিয়ে দেয় মোবাইলটা। সেটা হাতে পেতেই আচমকা বাঁকা হাসে আরজান। মোবাইলটা নিয়ে ফটাফট কিছু করে আবার ফিরিয়ে দেয়। ইশারায় বুঝিয়ে দেয় ফেরত দিয়ে আসতে, তার কাজ শেষ। মোবাইল নেওয়ার কথাটা সেই বলেছিল তবে ভাবেনি এতো দ্রুতই করতে পারবে রূপকথা।
অপরদিকে ফিরোজ নিজের মোবাইল পেতেই পলাশের হাত ফসকে ছুটে বেরিয়ে যায় হাসপাতাল ছেড়ে। সাথে সাথে দৌড়ে তার পেছনে গেলেও আর হদিস পাওয়া যায় না। শেষে রেগেমেগে ফিরে আসে পলাশ। রাগান্বিত স্বরে বলে, “পলাইছে ছ্যামড়া।”
রূপকথা কেবিনে এসে একবার নজর দেয় আরজানের উপর। সে আপাতত আনমনে কিছু ভেবে চলেছে গম্ভীর হয়ে তাই আর ডাকে না রূপকথা। কিছুক্ষণ বাদে পলাশ খাবার এনে দিলে চুপচাপ দু’জনে খেয়ে নেয়। তবে রূপকথার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। কাল থেকে না ঘুমিয়ে এখনো পর্যন্ত। না চাইতেও ঘুম লেগে আসছে। চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসবে যেন জোর করেই। চিন্তিত মুখে শুয়ে আছে আরজান। ডাকাতদলের মাঝে শহরের লোকজন কীভাবে? গ্রামের কে কে জড়িত? আকরাম মিঞা যে সামান্য এক শিকার মাত্র তা সে জানে। আকরাম মিঞা কখনোই এমন একটা দল চালানোর মতো সাহস দেখাতে পারবে না। তার হৃদয় এতো কঠিন নয়। আসল খিলাড়ি অন্য কেউ। যে গ্রামের মানুষের সাথে মিশে গিয়ে চুপচাপ কলকাঠি নেড়ে চলেছে। আর ফিরোজ তো একটা গুটি, যাকে ইচ্ছা মতো নাচায় তারা। তবে ফিরোজের সামনে কেউ বেশি কথা বললে সে ঘাবড়ে গিয়ে সব গুলিয়ে গন্ডগোল করে ফেলে। তাইতো দু’দিন এতো বকবক করতে হলো। এখন আর ফিরোজকে দিয়ে তার কোনো কাজ নেই। তার প্রয়োজন শেষ আপাতত। তবে খুব দ্রুত আমাদের মুলাকাত হবে আবার। সেদিন হয়তো রক্তমাখা অস্ত্রটা থাকে আমার হাতে। ফানুসের ন্যায় উড়ে যাবে ডাকাতদলের এই অসামাজিক কারবার। ধংস হবে কারোর দশ বছর ধরে চালিয়ে আসা এই চক্র।
হাজারটা চিন্তায় যখন মশগুল সে তখনই তার নজর কাড়ে তার শিয়রে থাকা এক ঘুমন্ত জলরূপসী। টুলে বসেই ঘুমিয়ে গেছে রূপকথা। মাথাটা ঢলে পড়েছে আরজানের হাতের কাছে। আগে কখনো তাকে এভাবে ঘুমাতে দেখেনি আরজান। সোনালি চুলগুলো খূব বিরক্ত করছে তার চোখে-মুখে পড়ে। ঘুমের মাঝেই চোখ-মুখ কুচকে নিচ্ছে সে। তা দেখে মুচকি হেসে উঠে বসে আরজান। চুলগুলো দু’হাতে গুছিয়ে নিয়ে বেঁধে দিতে চায় তবে এ ব্যাপারে তার পারদর্শিতা না থাকায় সে সফল হতে পারে না। অবশেষে হাল ছাড়তে হয় তাকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। ক্ষতস্থানের উপর করা ব্যান্ডেজের দিকে একবার দৃষ্টি দেয়। না, খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না এটা নিয়ে।
হুট করে রূপকথাকে কোলে তুলে নেয় সে। ঝাঁকুনিতে খানিক নড়ে ওঠে রূপকথা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয় আরজান, চুল পরিমাণ নড়াচড়া করে না। ক্ষণিক পরেই রূপকথার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে সে। স্বস্তি পায় আরজান, আলগোছে তাকে শুইয়ে দেয় নিজের জায়গাতে। চুলগুলো গুছিয়ে মাথার পেছনে দিয়ে নিজে বসে পড়ে টুলের ওপর। ঘুমন্ত রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “তুমি কি জানো মেয়ে তুমি আমায় কতোটা বদলে দিয়েছো? আমি জড়বস্তুর উপর জাদু চালায় তবে তুমি মানুষের উপর জাদু চালাও, সেটাও নিপুণ হাতে।”
অতঃপর কিছুক্ষণ চলে যায় নিখুঁত নীরবতায়। বেশি কথা বললে কি জেগে যাবে তার জলরূপসী? রাগ করবে কি তার হৃদয়ের কথাগুলো শুনতে পেলে?
সতর্কতার সাথে রূপকথার হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে নেয় সে। হাতের ওপর পিঠে আলতো চুম্বন করে বলে, “জানো তো রূপ, প্রত্যেক প্রেমিক হৃদয়ে একজন নিজস্ব রানির অস্তিত্ব থাকে। তুমি আমার সেই রানি জলরূপসী।”
থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রূপকথার ঘুমন্ত মুখটার দিকে। সংসার করবে না বলে কতো ছুতো, কতো তালবাহানা করেছে সে অথচ আজ? তার হাতের জাদুর চেয়ে মেয়েটার জাদুই বোধহয় বেশি কার্যকর। কিছুদিনের মধ্যেই কী বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে তার উপর! অবিশ্বাস্যভাবে বদলে দিয়েছে তার অনুভূতিগুলোকে। হৃদয়ে জমা হাজার হাজার কথা যেন একত্রে উগলে আসতে চাইছে আজ। অব্যক্ত কথাগুলো চাইছে বাইরে বেরিয়ে আসতে। হৃদয়ের নামহীন চাওয়াগুলোও নিজস্ব কোনো পরিচয় পেতে চাইছে। মানুষের সমস্ত চাওয়া কি আর পূরণ হয়? অপূর্ণ থেকে যায় হাজারো চাওয়া। তার এই চাওয়াটাও সেগুলোর মধ্যেই। তাইতো বিধি বাঁধ সেধেছে তাদের মিলন মেলায়, মাঝখানে গড়ে দিয়েছে অস্তিত্বের বিশাল পাহাড়। যা কখনোই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। দুজনের আলাদা অস্তিত্ব আজীবন থেকে যাবে দেয়াল হয়ে।
বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে।ক্লান্ত পথিকের নাযায় রূপকথার হাতের ওপর আলতো করে এলিয়ে দেয় নিজের মাথাটা। ধীর স্বরে পুনরায় বলে ওঠে, “আমার হৃদয়ে লাগানো লোহার বেড়ি কেন ভাঙলে বলোতো তুমি?”
আরো কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার, অনেক কথা। জমিয়ে রাখা সমস্ত কথা উগলে দিতে ইচ্ছে করছে। এই কথাগুলো হয়তো রূপকথা জেগে উঠলে আর বলা হবে না। সে শুনতে পাবে না কখনোই। উপলব্ধি করতে পারবে না তার অনুভূতিগুলো। কথাগুলো কি খুব বেশি কঠিন? নাকি তাদের অস্তিত্বই বেশি নিষ্ঠুর?
সময় পেরিয়ে গেছে নিজের নিয়ম অনুযায়ী। চারদিকে আঁধার নেমেছে, চাঁদ উঠেছে নিজস্ব দিগন্তে। পশুপাখিরা ফিরেছে নিজের নীড়ে। নিকষ কালো এই আঁধার যেন কমিয়ে আনে সকল প্রেমিক যুগলের মধ্যকার দূরত্ব। বাড়িয়ে দেয় একত্রিত হবার মধুর আহ্বান।
হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে সোফিয়া শিকদার। ছেলেকে একপলক দেখার জন্য আবার ছুটে এসেছে সে। এবার সাথে এসেছে লামিয়া। তার নাকি আরজানকে দেখার বড্ড মন হয়েছে। নিষেধ করেনি সোফিয়া শিকদার। অসুস্থ মানুষকে দেখার মন সবারই হয়। ভ্যান থেকে নেমে সে ভাড়া মেটাতে গেলে একাই ভেতরে চলে যায় লামিয়া। তার এতো ধৈর্য নেই যে এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবে। ভেতরে এসে শুনে নেয় আরজানের কেবিন নম্বর। খুঁজে খুঁজে পেয়ে যায় নির্দিষ্ট কেবিনটি। হুট করে কেবিনে ঢুকেই তার মাথা গরম হয়ে যায়।
রূপকথা আরামে ঘুমিয়ে আছে রোগির স্থানে। টুল নিয়ে তার শিয়রে বসে বসে ঘুমোচ্ছে আরজান। শুধু তাই-ই নয় বরং মাথাটা ঠেকিয়ে দিয়েছে রূপকথার কপালের সাথে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছে রূপকথার হাতটা। মাথায় আগুন ধরানোর জন্য বোধহয় এই দৃশ্যটাই যথেষ্ট ছিল। সে দৌড়ে এসে আরজানের হাত থেকে টেনেটুনে ছাড়িয়ে নেয় রূপকথার হাতটা। এক ঝটকায় রূপকথাকে টেনে ফেলে দেয় নিচে। ঘুমের মাঝে আকস্মাৎ ঝটকায় হকচকিয়ে ওঠে আরজান। রূপকথা নিচে বসেই অবাক চোখে চেয়ে আছে লামিয়ার দিকে। এই মেয়ে কি কোনোদিন শোধরাবে না?
আচমকা আরজানের দিকে তেড়ে আসে লামিয়া। চিৎকার করে বলে, “এই মেয়ের সাথে সময় কাটাতে এসেছিস তুই এখানে? অসুস্থ তুই হ্যাঁ? ঐ মেয়ে আরামে নবাবজাদির মতো শুয়ে আছে আর তুই পাহাড়া দিচ্ছিস বসে বসে? এসব করতে এসেছিস হসপিটালে?
রোম্যান্স করতে এসেছিস?”
অতিশয় বিরক্ত বোধ করে আরজান। রাগান্বিত স্বরে বলে, “এ কেমন প্রশ্ন? আমার বউয়ের সাথে আমি রণে-বনে, জলে-জঙ্গলে যেখানে ইচ্ছা সময় কাটাই তাতে তোর সমস্যা কোথায়? আর আমার বউ, আমি তাকে নবাবজাদির মতো শুইয়ে রাখি বা তাকে পাহাড়া দেই বসে বসে তাতে অন্যদের কী? রইলো রোম্যান্সের কথা, সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আমার বউয়ের সাথে বাথরুমেও রোম্যান্স করতে পারি, নান অফ ইউর বিজনেস।”
আরজানের এ বাক্য যেন আগুনে ঘি ঢালার মতোই কাজ করে। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই আরজানের একদম কাছে সরে আসে লামিয়া। শরীরের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আরজানের দু’গালে হাত রেখে আক্রোশের সাথে বলে ওঠে, “কেন? কোন দিক অসুন্দর আমি? বল, ঐ মেয়ের থেকে কোন দিক দিয়ে কম আমি? কিসে ত্রুটি রয়েছে আমার? বরং ঐ মেয়ের চেয়ে হাজারগুন সুন্দর আমার শরীরের বর্ণ।”
এসব দেখে নিঃশব্দে সেই স্থান ত্যাগ করে রূপকথা।
ভালো লাগছে না তার। ভেতর থেকে কেউ যেন রুষ্ট স্বরে প্রতিবাদ বলে উঠছে, “তোর সম্পদে হাত দিয়েছে সে। এখনো নিশ্চুপ থাকবি তুই?”
রূপকথাকে চলে যেতে দেখে লামিয়ার প্রতি ক্ষোভ যেন বেড়ে যায় আরজানের। তবুও নিজেকে সংবরণ করে ধীরে সুস্থে সরিয়ে দেয় লামিয়াকে। ভীষণ শান্ত এবং গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, “মানুষ মাত্রই সুন্দর। স্রষ্টার সৃষ্টির নিন্দা করার দুঃসাহস আমার নেই।”
লামিয়া কিছু বলার পূর্বেই চোখ রাঙিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় সে। পুনরায় বলে ওঠে, “তবে এই সৃষ্টির মাঝে আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে সুন্দর আমার রূপ। তার সৌন্দর্য আমি বর্ণ দিয়ে বিবেচনা করতে পারি না, সে মায়ার আঁধার। অবশ্য শরীরের বর্ণ আমার কাছে কোনোদিনই গুরুত্ব রাখেনি।”
লামিয়া পুনরায় তেড়ে যেতে নেয় আরজানের দিকে। তার আগেই সোফিয়া শিকদার এসে ধরে ফেলে তাকে। এতোক্ষন অবাক চোখে সে দেখে যাচ্ছিল সবকিছু। বোনের মেয়ের এহেন নিরর্থক আচরনে বড্ড হতাশ সে। লামিয়ার এমন আচরন কাম্য ছিল না তার নিকট। লামিয়াকে এখানে নিয়ে আসা মোটেই উঠিত হয়নি তার। মেয়েটা যে এমন করে বসবে তা কে জানতো?
লামিয়ার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? এগুলো কোন ধরনের আচরন?”
অভিযোগ করে ওঠে লামিয়া, “তুমি জানো না খালামণি, ঐ মেয়েটা আর আরজান,,,,,,,,,,,”
সে কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ধমকে ওঠে সোফিয়া শিকদার, “অনেক শুনেছি তোর অন্যায্য কথা, আর নয়। ওরা স্বামী-স্ত্রী যা ইচ্ছা করুক, তুই তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কেন কথা বলবি তার ভেতর? তোর থেকে অন্তত এমন ব্যাবহার আশা করিনি আমি।”
“কিন্তু খালামণি ওরা,,,,,,,,,,,,,।”
অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার কথাখানা। সোফিয়া শিকদার পুনরায় বলে ওঠে, “আর কোনো কথা নয়। তুই এখন আমার সাথে বাড়ি যাবি। তোরও উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে। ওদের পেছনে পড়ে তা শুধু শুধু নষ্ট করিস না।”
সে আরজানের দিকে চেয়ে বলে, “আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। তোরা সাবধানে থাকিস আর নিয়ম করে ওষুধ নিস।”
মায়ের কথর প্রত্যুত্তরে আরজান কিছু বলার সময়ও পায় না। তার পূর্বেই লামিয়াকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় সোফিয়া শিকদার। অনেক বেশিই হতবাক হতে হয় আরজানকে। তার মা আজ এ কি রূপ ধারণ করেছে!
সবাই চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ধীরে সুস্থে প্রবেশ করে রূপকথা। ওষুধগুলো বের করতে করতে বলে, “অনেক হয়েছে, এখন চুপচাপ ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ো। বিশ্রাম প্রয়োজন তোমার।”
ছোখ ছোট ছোট করে তাকায় আরজান। আচমকা বলে বসে, “বিশ্বাস করো রূপ, এসব বিরোধী দলের চক্রান্ত। আমি এখনো ফুলের মতো নিষ্পাপ। আমি কিছুই করিনি, শা’লাবাবুর কসম।”
হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না রূপকথা। তার সামনে আসলেই লোকটার যত উল্টা-পাল্টা কথা। সে কথা ঘুরিয়ে বলে ওঠে, “তুমিই বা কেমন বলোতো ম্যাজিশিয়ান? আমাকে কেন উপরে শুইয়েছো? আর নিজে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বসে বসে কাটালে। এতে তো যে কেউ রেগে যাবার কথা।”
“আমার বউকে আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রাখবো। অন্যদের কথা কেন শুনবো? তাছাড়া তুমি যে এতো লেকচার দিচ্ছো, তুমি কি চাইছিলে আমি নিচে না বসে তোমার সাথেই শুয়ে পড়ি?”
চোখ বড়বড় করে তাকায় রূপকথা। কোন কথা ঘুরিয়ে কোন দিকে নিয়ে গেছে লোকটা! সে হতবাক নয়নে চেয়ে বলে, “আমি মোটেই সে কথা বলিনি।”
হুট করে তার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় আরজান। শান্ত স্বরে শুধায়, “ও আমাকে জাপটে ধরলো। তোমার রাগ হয়নি?”
“রাগ হবে কেন? তাছাড়া ওটা জাপটে ধরা নয়, শুধু ছুঁয়েছে একটু। বাদ দাও তো, তুমি শুয়ে পড়ো আমি পানি নিয়ে আসছি ওষুধ খেতে হবে তোমার।”
বাক্য সম্পূর্ণ করেই পানি আনার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় রূপকথা। বড্ড বেশিই হতাশ হয় আরজান। দড়জার দিকে চেয়ে আনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে, “অথচ আমি চেয়েছিলাম তুমি রাগ করো।”
চলবে,,,,,,,,