রূপকথার ম্যাজিশিয়ান পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
1652

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_17

শীতের ভোরগুলো রোজ নিয়ম করে এসে অনন্য সৌন্দর্যের নিদর্শন প্রদর্শিত করে যায়। এই অপার সৌন্দর্যের তুলনা বোধহয় প্রকৃতি নিজেই। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরগুলো যেন জমিনে নেমে আসা একটুকরো মেঘের ন্যায় স্বচ্ছ। নিয়মের ব্যাঘাত ঘটিয়ে হটাৎ এই অসময়ে ঘুম ছুটে যায় আরজানের। এতো ভোরে ওঠার অভ্যাস তার নেই। চোখ-মুখ কুচকে কিছুটা মাথা উঠিয়ে মোবাইল হাতে তুলে সময় দেখে নেয় সে। অতঃপর বিরক্ত হয়ে পুনরায় বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। এটা কোনো সময় হলো ঘুম ভাঙার!

হারিয়ে যাওয়া ঘুম পুনরায় জমে ওঠার আগেই ধরফর করে উঠে বসে আরজান। দু’হাতের সাহায্যে চোখ ডলে ডলে ঘুম তাড়ানোর মিছে চেষ্টা করতে থাকে। এই ভোর রাতে কেউ ঘুম থেকে ওঠে নাকি? অবশ্য সবকিছু আর নিয়মমাফিক চললো কই? রূপ এসে পর্যন্ত সবই তো বদলে গেছে নিয়মকানুন। তার জীবনের সবকিছু থেকে আজীবন ধরে চলে আসা রীতিনীতি কবেই উঠে গেছে। রূপকথাকে পুকুর থেকে নিয়ে আসতে হবে সে কথা ঘুমের মাঝে প্রায় ঘেঁটেই ফেলেছিল সে। ভাগ্যিস পুনরায় ঘুমিয়ে যায়নি! নাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত!

দ্রুত উঠে কোনোমতে ঢুলতে ঢুলতে টেবিল পর্যন্ত গিয়ে পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে চোখে-মুখে পানি মারতে থাকে। সকাল সাতটা/আটটার আগে ঘুম থেকে উঠতো না সেই মানুষের ভোর রাতে উঠে ঘুম তাড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাতে হচ্ছে। কী দিন আসলো তার! ঘুমও যেন পণ করে বসেছে আজ তাকে ছাড়বে না। চোখদুটো খোলা রাখতে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। সেও নাছোড়বান্দা, ঘুম তাড়াতে জান-পরাণই তৎপর হয়ে উঠেছে। অনেক প্রচেষ্টার পর ঘুম একটু কমে আসাতে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট গলিয়ে নেয় শরীরে।

চাদরটা শরীরে পেঁচিয়ে নিয়ে খুব ধীরে ধীরে দরজা খুলে দেয় যেন কোনো শব্দ না হতে পারে। বাইরেটা এখনো কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন তাই পুনরায় ঘরের ভেতর গিয়ে টর্চটা এনে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে লাইট জ্বললেও পুকুরপাড়ে সে আলো খুবই কম পৌঁছায়। তাছাড়া এসময় চারদিকে কুয়াশার ছড়াছড়ি, সেই স্বল্প আলো খুব একটা কাজে আসবে না। পাশের ঘরগুলোর দিকে একবার সতর্কতার সাথে তাকিয়ে দেখে নেয় সে। ঘরগুলোতে মানুষের কোনো সাড়াশব্দ নেই। থাকবে কীভাবে? এই ভোরে সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তবুও সে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখে নেয় চারপাশ। এমন অনুভূতি হচ্ছে যেন সে নিজের বাড়িতে নিজে চুরি করতে নেমেছে সে।

কিছুক্ষণ চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে বড়বড় পা ফেলে সে ছুটে চলে পুকুরের দিকে। পুকুরপাড়ে এসে টর্চটা জ্বালিয়ে আবারো ফিরে তাকায় পেছন দিকে। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে ধীর স্বরে ডাকতে থাকে, “রূপ, শুনতে পারছো?”

নীরব, স্থির পানিগুলো আচমকাই খলবলিয়ে ওঠে। মুহুর্তেই পানির বুক চিরে বেরিয়ে এক শ্যামপরি। সোনালি চুলগুলো নিজ নিয়মে খেলে বেড়চ্ছে পানির উপরিভাগে। কপাল থেকে পানি বেয়ে থুতনিতে এসে ঠেকছে, অতঃপর অভিমান করে তা পতিত হচ্ছে পুকুরের মাঝে। জলরূপসীর এই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য উপেক্ষা করা বড়ই কঠিন হয়ে উঠেছে। ততক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেয় আরজান। অন্যদিকে চেয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে, “উঠে এসো।”

ধীর পায়ে উঠে আসে রূপকথা। নিজের জলরূপসীর আবরন ছেড়ে পরিণত হয় সাধারণ এক রমনীতে। আরজান তাড়া দিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি চলো, কেউ উঠে পড়লে আমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।”

“মানসম্মান নিয়ে টানাটানির কী হয়েছে? কেউ দেখলে তো আমার সত্যতা সামনে আসার কথা।” আরজানের সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলে রূপকথা।

“সৈ-সকালে বউকে সাথে নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়ালে লোকে তো অন্যকিছু সন্দেহ করবে। তাই আমার মানসম্মান খুইয়ে বসার আগেই তাড়াতাড়ি ঘরে চলো।”

কথা বলতে বলতে পুকুরপাড় ছেড়ে বাড়ির আঙিনায় এসে পৌঁছালে টর্চ বন্ধ করে দেয় আরজান। সে আবারো বেফাঁস কোনো কথাবার্তা বলার পূর্বেই জোর কদমে হাঁটতে শুরু করে রূপকথা। শীতও লাগতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। ঘরে ঢুকে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় বসে লেপ টেনে নেয় নিজের শরীরে। দরজায় খিল এঁটে টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসে যায় আরজান। ভ্রু কুচকে তাকায় রূপকথা। জিজ্ঞাসু স্বরে শুধায়, “তুমিও এ ঘরে থাকবে নাকি?”

“তা নয়তো কী? স্বামী-স্ত্রী আলাদা ঘরে থাকলে মোহব্বত কমে যায়, শোনোনি তুমি?” গাঁ ছাড়া ভাবে জবাব দেয় আরজান।

“কিন্তু তুমি এ ঘরে থাকলে আমি ঘুমাবো কোথায়?”

“কেন? বিছানায় ঘুমাবে। এমনিও সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই।”

“আর তুমি কোথায় ঘুমাবে?” ভ্রু কুচকে শুধায় রূপকথা।

“ভেবেছিলাম চেয়ারে বসে বসেই ঘুমাবো কিন্তু তুমি যে পরিমাণ প্রশ্নের ঝোলা খুলে বসেছো তাতে মনে হচ্ছে বিছানায় আসতেই হবে আমাকে।”

সে দুষ্টামি করার উদ্দেশ্যে কথাখানা বলেও যেন ফেঁসে গিয়েছে। তাকে অবাক করে দিয়ে রূপকথা বলে ওঠে, “তাহলে এসো, নিষেধ করেছে কে তোমাকে?”

এমন একটা কথা যে রূপ বলবে তা ধারনাও করেনি আরজান। কথাটা শ্রবণগোচর হতেই চুপসে যায় তার মুখশ্রী। রূপকথার দিকে চেয়ে দেখে তার মুখভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। বিন্দুমাত্র মজা বা দুষ্টুমির লেশ নেই। মেয়েটা দিন দিন মারাত্মক হয়ে উঠছে! কবে যানি তার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়! না, এই মেয়ের কাছে সে একদম নিরাপদ নয়! তার ভাবনার মাঝেই রূপকথা পুনরায় বলে ওঠে, “কী হলো? এসো।”

চকিতে তাকায় আরজান। চোখ-মুখ কুচকে বলে, “আবেগে গুঁতোগুতি করছে নাকি রূপ?”

“বাজে কথা বলোনা তো ম্যাজিশিয়ান, তাড়াতাড়ি এসো।”

চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে আরজান। হতবাক স্বরে শুধায়, “সুযোগ পেলেই তুমি আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করো কেন বলোতো রূপ?”

তার কথাখানা মোটেই আমলে নেয় না রূপকথা বরং আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলে বসে, “আমি কী করেছি? বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী একসাথেই ঘুমাতে হয়, এটাই নিয়ম। মা আমাকে সবই শিখিয়ে দিয়েছে।”

এতোক্ষনে যেন আরজান হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। তারমানে এসব সানদার বুদ্ধিগুলো তার শাশুড়ির দেওয়া! শাশুড়ি তো চালু আছে বটে! একদিনেই কতো কী শিখিয়ে দিয়েছে! শা’লাবাবু তো গোল্লায় গেছেই এখন আবার তার বউটাকেও উল্টা-পাল্টা বুদ্ধি শেখাচ্ছে। সে কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “খবরদার বলছি, ঐ বাড়ির জ্ঞান এ বাড়িতে খাটাবে না। বেশি বুদ্ধি খাটালে ঐ বাড়িতেই রেখে আসবো।”

বিরক্ত হয় রূপকথা। সে বুঝি এখানে থাকার জন্য মরে যাচ্ছে একেবারে। রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “তাহলে রেখেই এসো। আমারো খুব মনে পড়ছে মায়ের কথা।”

বুকে হাত দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে আরজান। তার এখন খুব ইচ্ছা করছে ‘আমেনার মা’ বলে একটা চিৎকার দিতে। বিয়ের একদিন যেতে না যেতেই তার বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইছে! এই ছিল তার কপালে? যেখানে তার গুণধর শা’লাবাবুর মতো একটা গোল্ডেন প্রপার্টি আছে সেখানে কি-না বউ রেখে আসবে! কক্ষনো না। সে রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “শেয়ালের কাছে মুরগি পালতে দেওয়ার কোনো শখ নেই আমার। চুপচাপ উঠে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসো।”

তাদের কথপোকথনের মাঝেই কখন সকাল হয়ে গেছে তা বুঝতেও পারেনি রূপকথা। জানালা দিয়ে একবার বাইরেটা দেখে নিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে যায় সে। আরজান উঠে জ্যাকেট পড়ে নিয়ে নিজের চাদরটা ছুড়ে মারে তার দিকে। রূপকথা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ইশারায় সেটা পড়ে নিতে বলে। বিনাবাক্যে সেটা শরীরে জড়িয়ে ধীরে সুস্থে কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেয় রূপকথা। মুখ মুছতে মুছতে ঘরে এসেই দেখতে পায় আরজান আলমারির ভেতর খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। সে অবাক স্বরে শুধায়, “কী খুঁজছো?”

উত্তর দেওয়ারও যেন সময় নেই আরজানের। সে নিজের মতো করে আলমারির এ-কোনা থেকে ও-কোনা হাতরিয়েই চলেছে। ফিরে তাকানোরও কোনো প্রয়াস নেই তার। অনেক্ষন খোঁজাখুঁজির পরে নীল রঙা পোশাকটা বের করে রূপকথার হাতে দেয়। অতঃপর রূপকথার জন্য আনা সাদা সোয়েটারটা বের করে বিছানায় রাখতে রাখতে ব্যস্ত স্বরে বলে, “ফটাফট এই পোশাকটা পড়ে ফেলো, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।”

“কিন্তু এখন কেন?”

“যা বলেছি তা করো। বেশি প্রশ্ন করো না।” ধমকে ওঠে আরজান।

হটাৎ ধমকে ওঠাতে খানিক ভড়কে যায় রূপকথা। তবে সেটা আরজানকে বুঝতে না দিয়ে বিনাবাক্যে তার হাত থেকে পোশাকটা নিয়ে নেয়। আরজান দরজার বাইরে গেলে খিল এঁটে দ্রুত পোশাক বদলে নেয় সে। ওরনাটা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে দিলে হুরমুর করে ঢুকে পড়ে আরজান। তার দিকে চেয়ে একবার উপর-নিচ দেখে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলে ওঠে, “তোমাকে একদম জলরূপসীর মতো লাগছে রূপ। এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কবে যেন দু’চোখ ঝলসে যায় আমার।”

“তেলবাজি” ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে ওঠে রূপকথা।

চোখ-মুখ কুচকে নেয় আরজান। এতো সুন্দর মন্তব্যকে তেলবাজি বললো! আফসোসের স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে, “দুনিয়া থেকে সত্য কথার ভাত উঠে যাচ্ছে দিনদিন।”

“কিছু বললে?” ভ্রু উচিয়ে শুধায় রূপকথা।

মুহূর্তেই কথা ঘুরিয়ে নেয় আরজান, “অল্প-স্বল্প তেলবাজি না করলে মেয়ে মানুষ টেকানো যায় না। এটা প্রত্যেক স্বামীর মাঝে লুকায়িত সুপ্ত প্রতিভা।”

কথাটা বলে রূপকথা কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেবিলের উপর রাখা গ্লাসভর্তি পানি এনে রূপকথার চুলে ছিটিয়ে দিতে থাকে সে। রূপকথা হতবাক হয়ে বলে ওঠে, “আরে কী করছো? চুলগুলো ভেজাচ্ছো কেন শুধু শুধু?”

“তোমার এতোকিছু বুঝে কাজ নেই। সোয়েটারটা পড়ে নিয়ে রান্নাঘরে এসো।”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায় সে। তার কর্মকাণ্ডে অবাক হলেও খুব একটা পাত্তা দেয় না রূপকথা। লোকটার সবকিছুই বড় আজব! ভাবনা বাদ দিয়ে দ্রুত সোয়েটারটা পড়ে নেয় সে। সোয়েটার পড়ে ওরনা জড়িয়ে পেছনে ফিরতেই ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় ছুটে আসে আরজান। ঝড়ের বেগে পকেট থেকে একটা আংটি বের করে রূপকথার আঙ্গুলে পড়িয়ে দিয়ে আবার দ্বিগুণ গতিতে বেরিয়ে যায়। মানে যাকে বলে ধুম করে এসে দাম করে চলে যাওয়া। রূপকথা হাঁ করে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হনহন করে গিয়ে দরজায় খিল এঁটে দেয়। দরজার সাথে শরীর এলিয়ে আঙ্গুলের দিকে দৃষ্টিপাত করে। সোনালি আংটিটা তার শ্যামবর্ণের আঙ্গুলে অধিক ফুটে উঠেছে। আংটির মাঝে লাগানো ছোট্ট পাথরটা যেন তার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া ম্যাজিশিয়ানের নিয়ে আসা সবকিছুই সবসময় অধিক সৌন্দর্য বহন করে। এর কারন হয়তো লোকটার সঠিক নজর পছন্দ অথবা তার দৃষ্টিকোণ।

মুচকি হেসে অন্যহাত দিয়ে আংটিটা একটু ছুঁয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় সে। রান্নাঘরের সীমানায় আসতেই তার চক্ষু যেন চড়কগাছ। আরজান ভাত ধুয়ে মাটির চুলায় দিয়ে ইতিমধ্যে তরকারি কাটতে শুরু করে দিয়েছে। বড়বড় কয়েকটা লাকরি ধরিয়ে দেওয়ায় একাই জ্বাল জ্বলছে। পাশেই একটা বাটিতে সালাদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয় রূপকথা। এতটুকু সময়ের ভেতর কতোকিছু করে ফেলেছে ম্যাজিশিয়ান! দরজা থেকে সামান্য এগিয়ে দাঁড়ায় সে। আগুনের খুব বেশি কাছে যাওয়ার সাহস হলো না তার। কারো আসার শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকায় আরজান। তাকে দেখে বলে, “কী হলো? ওখানে দাঁড়িয়ে রইলে যে?”

“আমি আগুনের সংস্পর্শে আসতে পারবো না ম্যাজিশিয়ান।” ভীত স্বরে জবাব দেয় রূপকথা।

“আরে কিছু হবে না। তোমাকে কি আগুনের ভেতর ঢুকে যেতে বলছি? মোড়া পাতা আছে ওটাতে শুধু বসে দেখো সবকিছু। কোনোদিন তো কাজেও লাগতে পারে নাকি?”

চুলা থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে মোড়া টেনে বসে রূপকথা। আংটির দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলে, “শুধু শুধু খরচের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এমনিতেই আমার জন্য তোমায় অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। খরচটাও নেহাতই কম হচ্ছে না তার ভেতর আবার বাড়তি খরচ!”

তরকারি বসিয়ে দিয়ে গাঢ় দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে ফিরে তাকায় আরজান। মেহেদী রাঙা হাতটাকে আংটিটা যেন সৌন্দর্যের পূর্ণতা দিয়েছে। এটার জন্যই কাল আসতে দেরি হয়ছিল। জাদু শেষ করে বাজারে গিয়ে সে পছন্দ করে কিনে এনেছে। মেহেদী রাঙা হাতটা বড় খালি খালি লাগছিল এখন যেন নিখুঁত রূপ পেয়েছে। সে গলা ঝেড়ে বলে ওঠে, “নতুন বউকে উপহার দিতে হয়। সব কথা তোমার মা শিখিয়েছে আর এটা বলেনি?”

“কিন্তু আমরা তো,,,,”

কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই মৃদুস্বরে ধমকে ওঠে আরজান, “বারবার একই প্রলাপ বকবে না রূপ। আমরা দু’জন যে একসাথে সংসার করবো না সে কথা আমার মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে যায়নি যে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। তোমার অবগতির জন্য আবারো জানিয়ে দিচ্ছি, সংসার না করলেও আমরা দু’জন স্বামী-স্ত্রী। আর দশটা সাধারণ দম্পতির ন্যায় সংসার না করলেও বিয়েটা আমরা তাদের মতো সমস্ত নিয়ম মেনেই করেছি।”

একদমে কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আরজান। চোখদুটো বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে পুনরায় তাকায় রূপকথার দিকে। তবে তার চুপসানো মুখশ্রী যেন মোটেও পছন্দ হলো না আরজানের। মুহুর্তেই সে নিজের গম্ভীরতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। রূপকথার ভীত মুখভঙ্গি বদলাতেই বোধহয় বলে ওঠে, “তাছাড়া আমার টাকায় আমি আমার বউকে যা ইচ্ছা কিনে দেই তাতে তোমার কী?”

অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রূপকথা। এক নিমেষেই লোকটার কথা বলার ভঙ্গিমা কেমন বদলে গেছে! কমে এসেছে কন্ঠের দৃঢ়তা! সে হতবাক স্বরে কিছু বলার পূর্বেই আরজান চোখ বড়বড় করে শুধায়, “তুমি আমার বউকে হিংসা করছো রূপ?”

কথার আগা-মাথা কিছুই উপলব্ধি করতে না পেরে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে রূপকথা। ম্যাজিশিয়ানের বউ তো সে নিজেই, তাহলে হিংসা কীভাবে করলো?
সে কৌতূহলী হয়ে শুধায়, “তুমি কি অন্য কোনো বউয়ের কথা বলছো ম্যাজিশিয়ান?”

বাক্য সম্পূর্ণ করে এক মুহুর্ত থেমে দাম করে মোড়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে সে। ভ্রু কুচকে বলে, “তারমানে আরো বউ আছে তোমার? ক’টা বিয়ে করেছো সত্য করে বলোতো?”

হতাশার শ্বাস ছাড়ে আরজান। মুখভঙ্গি অসহায় করে বলে ওঠে, “কাকে দিলাম রানির পাট?”
_________________________

“দেখো গিয়ে তোমার ছেলে হাত পুড়িয়ে রান্না করছে আর ঐ মেয়েটা নবাবজাদির মতো বসে বসে গল্প করছে। রূপের তো বালাই নেই তার উপর অকর্মণ্য। কোন জাদুতে ফাঁসিয়েছে আরজানকে?”

বোনের মেয়ের কথা শুনে ফুঁসে ওঠে সোফিয়া শিকদার। এ কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আজ ঐ মেয়ের একদিন কী তার একদিন। তার ছেলে হাত পুড়িয়ে রান্না করবে আর সে বসে বসে খাবে? বাড়ির বউ কাজ না পারলে অমন বউয়ের দরকার কী?
হনহন করে সে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখে হতবাক হওয়ার সীমা থাকে না তার। সকাল করে এমন দৃশ্যও দেখতে হচ্ছে তাকে!
রাগান্বিত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে সে, “আরজান”

হটাৎ এমন চিৎকারে হকচকিয়ে যায় তারা দু’জন। মাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় আরজান। স্বাভাবিক স্বরেই শুধায়, “চা খাবে? বানিয়ে দেবো?”

ততক্ষণে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে লামিয়া। আরজানের এমন স্বাভাবিক আচরনে আরোও বিরক্ত হয় সে। চোখ-মুখ কুচকে তাকায় রূপকথার দিকে। পোশাক বদলেছে মেয়েটা আবার চুলগুলোও ভেজা। সবকিছু যেন নিখুঁতভাবে সাক্ষী দিয়ে যায় তাদের দাম্পত্য জীবন কতোটা সুখময়। এরই মধ্যে পুনরায় চেঁচিয়ে ওঠে সোফিয়া শিকদার, “বউ এখানে রানির হালে সেজেগুজে বসে আছে আর তুই রান্না হাত পুড়িয়ে রান্না করছিস? বুড়ো বয়সে এসে এই দিন দিন দেখতে হচ্ছে আমাকে!”

আরজান ভ্রু উঠিয়ে একবার নিজের হাতের দিকে তাকায় তো আবার রূপকথার দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ অত্যন্ত বিজ্ঞের ন্যায় পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে আচমকা বলে ওঠে, “আগেই বলেছিলাম সবসময় এতো টেলিভিশন দেখো না, দেখো না। শোনোনি আমার কথা, এখন দেখো কেমন চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে তোমার?”

গুরুতর মুহুর্তে ছেলের এমন কথাতে জান পরাণই অবাক হয় সোফিয়া শিকদার। অবাক স্বরে শুধায়, “মানে?”

মায়ের চোখের সামনে নিজের হাতদুটো মেলে ধরে আরজান। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, “ভালো করে দেখো, না তো আমার হাত পুড়েছে কোথাও আর না তো রূপের শরীরে কোনো আলগা সাজসজ্জা আছে। তবুও তোমার চোখে এসব পড়লো তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? মানে হচ্ছে চোখে সমস্যা শুরু হয়ে গেছে। আজই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবে তুমি।”

ছেলের কথার মারপ্যাঁচ বুঝতে কিছুটা সময় লেগে যায় সোফিয়া শিকদারের। আসল কাহিনী উপলব্ধি হতেই তেতে ওঠে সে। রাগান্বিত স্বরে বলে, “মস্করা করছিস আমার সাথে?”

“আমি মস্করা করছি না তবে তুমি অবশ্যই সিরিয়ালের শাশুড়িদের মতো আচরন করছো। আজ থেকে তোমার স্টার জলসা দেখা বন্ধ।” শাসনের সুরে কথাটা বলে আরজান।

মুখটা হাঁ করে তাকায় সোফিয়া শিকদার। এক মুহুর্তের জন্য সে ভুলে যায় এখানে সে কী করতে এসেছিল। লামিয়া ইশারা করতেই সে চোখ বড়বড় করে তাকায় আরজানের দিকে। তার গম্ভীর, ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা কি-না রসিকতা করছে! এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! এই আরজানকে ফিরিয়ে আনতে তার কত সাধনা অথচ এখন দিব্যি সে পূর্বের ন্যায় আচরন করছে। ঠিক যেমনটা করতো তার বাবা বেঁচে থাকা কালীন। তবুও যেন তার মন মানতে নারাজ যে তার ছেলে রান্না করছে আর বউ বসে বসে গল্প করছে। রূপকথার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে শুধায়, “এই মেয়ে, নাম কী তোমার?”

রূপকথা কিছু বলার পূর্বেই আরজান বলে ওঠে, “রূপ, ওর নাম রূপ।”

“শুধু নামেই রূপ, বাস্তবে তো রূপের ছিটেফোঁটাও নেই।” তাচ্ছিল্য স্বরে বলে ওঠে লামিয়া।

“কিছু মানুষের তো আবার নামেও রূপ নেই। তাদের জন্য হাজারটা ক্রিমের কৌটাই একমাত্র ভরসা।” লামিয়া কথা শেষ করতে না করতেই নগদে জবাব দিয়ে দেয় আরজান। এমন একখানা ভাব যেন বন্দুকে গুলি সে ভরেই রেখছিল, সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল শুধু।

রেগেমেগে হনহন করে বেরিয়ে যায় লামিয়া। মনে মনে পণ করে বসে এই মেয়ের একটা না একটা ব্যবস্থা সে করবেই। শুধুমাত্র ঐ মেয়ের জন্যই আরজান কটু কথা শোনালো তাকে। তার এতোদিনের স্বপ্ন ভঙ্গের কারন এই মেয়ে!

চলবে?????

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_18

রান্নাঘরের পরিবেশ অত্যাধিক থমথমে। সোফিয়া শিকদার আগ্রহের সাথে চেয়ে আছে রূপকথার দিকে। রূপকথা একবার তার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার ঘুরে ঘুরে আরজানের দিকে তাকাচ্ছে। ভাবখানা ঠিক এমন যে, এই মুহূর্তে কথা বললেই যেন তার মাথা কর্তন করা হবে। আরজান বিজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় গভীর দৃষ্টিতে রূপকথার দিকে চেয়ে আছে। হয়তো অপেক্ষা করছে তার মুখ থেকে কিছু শোনার কিন্তু রূপকথার এ মৌনতা যেন আজ আর ভাঙার নয়। লামিয়া তো আগেই রেগেমেগে ত্যাগ করেছে এই স্থান। সকলের এমন কঠিন নীরবতার কারন হলো সোফিয়া শিকদারের করা একটি সহজ প্রশ্ন। রূপকথার উদ্দেশ্যে করা তার প্রশ্নটাই যেন নীরব করে দিয়েছে পরিস্থিতি। সে পুনরায় শুধায়, “কী হলো? এই মেয়ে? রান্নাবান্না কি আদৌ পারো কিছু?”

পুনরায় তাকে এই মেয়ে বলাতে কিঞ্চিত বিরক্ত হয় রূপকথা।
কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে ওঠে, “আমার নাম রূপকথা তবে আপনি চাইলে আমাকে রূপ বলেও ডাকতে পারেন।”

চকিতে তাকায় সোফিয়া শিকদার। রূপকথার এই বাক্য উপেক্ষা করতেই হয়তো চেঁচিয়ে ওঠে সে, “যা জানতে চেয়েছি তা বলো। রান্নাবান্না পারো নাকি শুধু আমার ছেলের মাথায় বোঝা হয়ে থাকার ইচ্ছে?”

“আমি রান্নাবান্না পারি না তবে তা অত্যন্ত জরুরী হলে শিখে নেবো। আমাকে কিছুদিন সময় দিন আমি চেষ্টা করবো সবকিছু শিখে নেওয়ার।” ধীর স্বরে বলে রূপকথা।

জবাবে যেন ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারে না সোফিয়া শিকদার। সে পূর্বের তুলনায় অতিরিক্ত রূঢ় কন্ঠে বলে ওঠে, “কাজ-কর্ম না পারলে অমন বউ দিয়ে কী হবে? রান্নাবান্না না পারলে অমন বউয়ের কোনো দরকার নেই।”

“আমাকে তো বিয়ের আগে ম্যাজিশিয়ান জানায়নি যে বিয়ে করতে হলে কাজ-কর্ম, রান্নাবান্না জানা আবশ্যক। যদি জানাতো তাহলে হয়তো বিয়ের আগে আমি আরো একবার ভেবে দেখতাম।” বিনা দ্বিধায় বলে বসে রূপকথা। কন্ঠ তার অত্যন্ত সাবলীল।

টাসকি খেয়ে যায় আরজান। সে অপেক্ষা করছিল যে রূপকথা নিজে থেকে কিছু বলুক কিন্তু তা বলে এভাবে যে সরাসরি ঝেড়ে দেবে সে কথা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

আচমকা এমন ঠাসঠাস জবাবে চোখ বড়বড় করে তাকায় সোফিয়া শিকদার। এ কেমন ঝগড়াটে মেয়ে বিয়ে করেছে তার ছেলে! সে রাগান্বিত স্বরে বলে, “কথার তেজ তো দেখছি তোমার ভালোই আছে। শোনো মেয়ে, বাড়ির বউদের মুখে এতো তেজ মানায় না।”

রূপকথা ভাবুক স্বরে শুধায়, “আর বাকি সবার মুখেই তেজ মানায়?”

এতোক্ষনের ধরে রাখা ধৈর্যশক্তি যেন শূন্যের কোঠায় পৌঁছায় সোফিয়া শিকদারের। রাগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে বসে সর্বশক্তি দিয়ে দাম করে দরজা সরিয়ে যে গতিতে এসেছিল ঠিক তার দ্বিগুণ গতিতে বেরিয়ে যায় সে। এতোক্ষন চেপে রাখা হাসিটুকু সশব্দে উগরে দেয় আরজান। স্টার জলসার তৈরিকৃত শাশুড়ি আর ননদের এমন লজ্জাজনক পরাজয় তো মেনে নেয়া যায় না। ছি! এ যেন সমগ্র সিরিয়ালের অপমান! সে রূপকথার দিকে চেয়ে মুখে হাসি বজায় রেখে বলে, “তুমি নিজের শাশুড়িকে এভাবে হ্যনস্তা করলে রূপ?”

“আমি কী করেছি? উনি যা জানতে চেয়েছে আমিতো শুধু সেটুকুই বলেছি।” অবাক স্বরে বলে রূপকথা।

“সেটাই তো, শুধু শুধুই চলে গেলো ওরা দু’জন। আচ্ছা শোনো, আমি চা করে দিচ্ছি তুমি গিয়ে মাক আর লামিয়াকে দিয়ে এসো।” কথাটা বলে চুলায় গরম পানি বসিয়ে দেয় আরজান। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা পরিবেশন যোগ্য হয়ে ওঠে। চা ঢেলে কাপদুটো ট্রেতে রেখে সেটা রূপকথার হাতে ধরিয়ে দেয় সে। রূপকথা দরজা পেরোতেই পুনরায় ডেকে ওঠে আরজান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় রূপকথা। শুধায়, “কী হলো আবার?”

“আমার মা এখন থেকে তোমারও মা তাই তাকে সুন্দর করে মা বলে ডাকবে।”

“আর লামিয়া?” ভ্রু কুচকে শুধায় রূপকথা।

“বোন, মানে আপু ডাকবে।”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় রূপকথা। সোফিয়া শিকদারের দরজার সামনে এসে ডেকে ওঠে, “মা”

চকিতে তাকায় সোফিয়া শিকদার। রূপকথাকে দেখে জান পরাণই অবাক হয় সে। কী বলে ডাকলো মেয়েটা? মা বললো! তার ভাবনার মাঝেই এগিয়ে আসে রূপকথা। চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে একটা কাপ উচিয়ে তার সামনে ধরে। মুচকি হেসে বলে, “আপনার চা।”

এতোক্ষন কথা শুনিয়ে এখন আবার চা দিতে এসেছে! খাবে না সে এই চা। সে মুখ কালো করে বলে, “খাবো না আমি, নিয়ে যাও। সেই তো আমার ছেলেই চা বানিয়ে দিয়েছে আর তুমি শুধু ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে নিয়ে চলে এসেছো। যেদিন নিজে চা বানাতে পারবে সেদিন দিতে এসো।”

তার উত্তর খানিক অবাক করে রূপকথাকে। আজব কান্ড! চা খাওয়ার সাথে তার বানিয়ে দেওয়ার কী সম্পর্ক! সে ভ্রু উচিয়ে শুধায়, “আমি বানিয়ে দিলে খাবেন?”

“বানানোর তো মুরোদ নেই তোমার। শুধু শুধু জানতে চেয়ে কী প্রমান করতে চাইছো?”

“হ্যাঁ বা না তে উত্তর দিন মা। এতো লম্বা বাক্য বুঝতে সময় লাগে আমার।”

চটে ওঠে সোফিয়া শিকদার। মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলে, “তোমার তো তর্ক করা ছাড়া আর কোনো গুন নেই। চা যদি নিজে বানাতে পারো তাহলে এসো।”

কথা বাড়ায় না রূপকথা। তার বোঝা শেষ চা তাকে বানানোই লাগবে। তাই চায়ের ট্রে হাতে বেরিয়ে যায় সে। লামিয়ার ঘরের সামনে গিয়ে ডাকে, “আপু, চা খাবেন?”

মাত্রই সানস্ক্রিনের কৌটায় হাত দিয়েছিল লামিয়া। রূপকথাকে দেখে চোখ-মুখ কুচকে তাকায় তার দিকে। তার মুখভঙ্গি দেখেও মুচকি হাসে রূপকথা। চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “আপনার চা।”

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কাপটা হাতে নেয় লামিয়া। উদ্দেশ্য সেটা ছুড়ে ফেলা কিন্তু তার চিন্তাই জল ঢেলে আচমকা দরজায় এসে দাঁড়ায় আরজান। লামিয়া চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলার আগেই ছুটে এসে কেড়ে নেয় সেটা। টানাটানির মাঝে সমস্ত চা ঢেলে পড়ে ফ্লোরে। কয়েক ফোটা চা পায়ে এসে পড়ায় খানিক বিরক্ত হয় আরজান। লামিয়ার দিকে শক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে ওঠে, “আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে কুত্তার পেটে ঘি হজম হয় না।”

অপমানে লাল হয়ে আসে লামিয়ার মুখশ্রী। আকস্মাৎ চিৎকার করে বলে, “কী বললি?”

তার কথাটা যেন উপস্থিত দু’জনের করোরই কর্ণ গহ্বরে গিয়ে ঠিক পৌঁছায় না। আরজান রূপকথার উদ্দেশ্যে বলে, “চলো রূপ, তোমার আপু চা খাবে না, তার পেট খারাপ।”

চোখ বড়বড় করে তাকায় রূপকথা। লোকটা দিনে দুপুরে এমন একটা ডাহা আকারের জ্বলন্ত মিথ্যা কথা কী অবলীলায় বলে দিল! তার হতবাক মুখভঙ্গি যেন খুব একটা পছন্দ হলো না আরজানের। খালি কাপটা রূপকথার হাতে দিয়ে চা ভর্তি কাপ নিয়ে আলগোছে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। অতঃপর মজাদার ধ্বনি তুলে বলে, “আহা! কী স্বাদ!”

বিপরীতে রূপকথা কিছু বলার পূর্বেই তার হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে যায় আরজান। লামিয়া রাগে গজগজ করতে করতে এসে দরজায় শক্ত করে খিঁল এঁটে দেয়। দরজা বন্ধ করার সেই বিকট শব্দ শুনেও যেন শোনেনা আরজান। চুপচাপ রান্নাঘরে ফিরে আসে রূপকথাকে নিয়ে। এই মুহুর্তে তার প্রধান কাজ হলো রূপকথাকে চা বানানো শেখানো। প্রয়োজনে কোমর বেঁধে নামবে সে তবুও চা আজ বানাতেই হবে রূপকথাকে। আর যাই হোক না কেন বউয়ের সম্মান তো আর চায়ের কাপে গড়াগড়ি খেতে দেওয়া যায় না। তার ভাবনার মাঝেই রূপকথা বলে ওঠে, “আমাকে চা বানানো শিখিয়ে দাও তো ম্যাজিশিয়ান। মা বলেছে আমি বানালে তবেই সে খাবে।”

এবার যেন গর্বে বুক ফুলে ফেটে যাওয়ার অবস্থা আরজানের। হুট করে হাত বাড়িয়ে রূপকথার দুই গাল টেনে দিয়ে বলে, “আমার বউটা কত লক্ষি! মা শুধু শুধুই বিরোধী দলের পক্ষ নিচ্ছে, লস খাবে লস।”

“বিরোধী দল?” ভ্রু কুচকায় রূপকথা।

“হ্যাঁ, তোমার শাশুড়ি বিরোধী দলে নাম লিখেছে তবে তুমি চিন্তা করো না। তোমার জামাই আছে তোমার সাথে।”

রূপকথা এতোক্ষনে বুঝতে সক্ষম হয় যে লোকটা আবার উল্টা-পাল্টা বকতে শুরু করেছে। তাই কিঞ্চিত বিরক্ত স্বরে বলে, “আরে তাড়াতাড়ি শেখাও না?”

কথাটার বোধহয় ভালোই আছর পড়েছে আরজানের উপর। মুহুর্তেই সে খানিক গম্ভীর হয়ে উঠেছে। পাতিল চুলোয় বসিয়ে দিতে দিতে বলে, “পানির জগটা নিয়ে এসো।”

রূপকথা পানি এগিয়ে দিতেই সরে দাঁড়ায় সে। পাশে দাঁড়িয়ে একের পর এক ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছে আরজান। রূপকথা বহু চেষ্টার পর সক্ষম হয় লাকরিতে আগুন জ্বালাতে তবে তা চুলোয় দেওয়ার পূর্বেই নিভে যায়। রূপকথা হতাশ দৃষ্টিতে আরজানের দিকে তাকালেও সে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করে না তাতে উল্টো আবারো চেষ্টা করতে বলে। বারবার সে আগুন জ্বালাচ্ছে কিন্তু তা চুলো পর্যন্ত পৌঁছানোর পূর্বেই নিভে যাচ্ছে। বারকয়েক চেষ্টার পর সক্ষম হয় সে। তৎক্ষণাৎ মুখে হাসি ফুটিয়ে আরজানের দিকে তাকাতেই সে পুনরায় বলে ওঠে, “ওখানে বোয়ামের মধ্যে তেজপাতা, লবঙ্গ সবকিছু আছে ওটা নিয়ে এসো।”

রূপকথা দ্রুত উঠে দৌড়ে যেতে নিলেই ধমকে ওঠে আরজান, “আস্তে যাও, ওখানে কি তোমার জামাই বসে আছে যে এতো জোরে দৌড়াচ্ছো?”

বিরস মুখে তাকায় রূপকথা। সে বুঝতেই পারছে না এটা রাগ ছিল নাকি রসিকতা ছিল? ভাবনার মাঝে পুনরায় ধমকে ওঠে আরজান, “কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? দ্রুত নিয়ে এসো, পানি গরম হয়ে যাচ্ছে।”

দৌড়ে গিয়ে বোয়ামটা এনে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে রূপকথা। লোকটার কথাবার্তা কিছুই বোঝে না সে। কখনো বলে আস্তে যাও তো আবার বলে দ্রুত যাও।
আরজান হাতে গুনে ক’টা লবঙ্গ নিয়ে তার হাতে দেয়। রূপকথা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ইশারায় পাতিলে ফেলতে বলে আরজান। দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি গরম হয়ে টগবগিয়ে ওঠে। বাকি কাজটুকু বোঝাতে আর খুব একটা কষ্ট করতে হয় না আরজানের। তার উপদেশ অনুযায়ী রূপকথা খুব যত্ন সহকারে ধীরে সুস্থে কাপে ফুটন্ত পানি ঢেলে চা, চিনি মিশিয়ে স্বল্প পরিসরে নেড়ে নেয় চামচ দিয়ে। এতো সহজ একটা কাজও জীবনে প্রথমবার হওয়ায় সামান্য বেগ পোহাতে হলো তাকে তবে সে নিশ্চিত এরপর থেকে এটা খুব সহজেই করতে পারবে।

রান্নাঘরর সামনে থেকে সরে যায় সোফিয়া শিকদার। দ্রুত ঘরে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে সে। এতোক্ষন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের চা বানানোর যুদ্ধ দেখছিল। মেয়েটার আগুন জ্বালানোর প্রচেষ্টা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে এসব কাজে ভীষণ আনাড়ি। কয়েক মুহূর্তেই যেন ঘাম ছুটে গেছে তার। এ মেয়ে যে তার ছেলের তুলনায় অত্যাধিক ঘাড়ত্যাড়া তা বুঝতে আর বাকি নেই তার।

কিছুক্ষণ বাদে রূপকথা চা নিয়ে এলে বিনাবাক্যে তা পান করতে হয় তাকে। আর কিছু বলার যেন অবকাশ রাখেনি মেয়েটা। তার মাটির চুলোয় আগুন জ্বালানোর প্রচেষ্টা নীরব করে দিয়েছে সোফিয়া শিকদারকে। এর মধ্যেই সদর দড়জা থেকে বিকটভাবে শব্দ আসতে শুরু করে। কেউ হয়তো সর্বশক্তি দিয়ে অবিরত কড়াঘাত করছে দড়জায়। সচকিত হয়ে ওঠে বাড়িতে অবস্থান করা প্রত্যেকটা প্রাণী। দ্রুত সদর দড়জার দিকে এগিয়ে যায় আরজান। হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সোফিয়া শিকদার ও রূপকথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে লামিয়াও। সকলে আগ্রহের সাথে চেয়ে আসে দরজার দিকে। কিঞ্চিত বিরক্তও বটে তারা। কার এতো তাড়াহুড়ো বেঁধেছে যে এভাবে অন্যের দরজায় কড়াঘাত করছে?

আরজান দরজা খুলে দিতেই হুরমুর করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা। পোশাক পরিচ্ছদে চিহ্নিত করা যাচ্ছে একজন থানার দায়িত্বে থাকা অফিসার অন্যজন হয়তো তার সহকারী যাকে বলা হয়ে থাকে হাবিলদার। হাবিলদার লোকটার অবস্থা অবশ্য খুব একটা ভালো না। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ, শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়া, মুখটা ফুলে ফেঁপে লাল হয়ে আছে। যেন কেউ নিজের খায়েস মিটিয়ে ইচ্ছামতো ধুয়েছে তাকে। আচমকা চিল্লিয়ে ওঠে হাবিলদারটা। চোখদুটো লাল করে আরজানকে দেখিয়ে বলে, “স্যার এইডাই, এইডাই সেই ছ্যামড়া।”

চক্ষু যেন নিজ স্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসবে সোফিয়া শিকদারের। তারমানে হাবিলদারের চোখে-মুখে সৃষ্ট এই শিল্পের কারিগর তারই ছেলে। দৌড়ে বারান্দা ছেড়ে নেমে আসে সে। পেছন পেছন লামিয়াও আসতে ভোলে না। রূপকথা কিছু উপলব্ধি করতে না পেরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়।

পুলিশ অফিসার গম্ভীর স্বরে আরজানের উদ্দেশ্যে বলে, “তোমার সাহস দেখে আমি বিস্মিত! তুমি সাহস কী করে পাও থানায় গিয়ে পুলিশের শরীরে হাত তোলার?”

শক্ত হয়ে ওঠে আরজানের মুখভঙ্গি। কটমট করে তাকায় হাবিলদারের দিকে। সবাইকে অবাক করে দু’পা পিছিয়ে যায় হাবিলদার। অফিসার রাগান্বিত স্বরে বলে, “তুমি ভয় পাচ্ছো কেন জসিম? আমি আছি না তোমার সাথে?”

আরজানের দিকে চেয়ে বলে, “তুমি কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলছো? একেতো পুলিশের শরীরে হাত তুলেছো তাও থানায় ঢুকে আবার এখন চোখ রাঙাচ্ছো? তোমাকে জেলে ঢোকাতে একটুও সময় লাগবে না আমার তা কি জানো তুমি? আর একবার ঢুকলে নিম্নত সাজা ছ’মাসের জেল।”

পুলিশ অফিসারের দেওয়া নীরব হুমকি যেন আমলেই নেয় না আরজান। উল্টো শুধায়, “আচ্ছা? তা উপযুক্ত কোনো প্রমাণ আছে তো আপনার কাছে?”

ফুঁসে ওঠে পুলিশ অফিসার। রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোমার কি মনে হয় প্রমাণ জোগাড় করতে সময় লাগবে আমাদের?”

“তা তো অবশ্যই লাগবে। সময় না লাগলে এতোগুলো দিন ধরে ডাকাতদল তান্ডব করে বেড়াতে পারতো না গ্রাম জুরে। আপনারা কি পেরেছেন এতোগুলো দিনের ভেতর একজন ডাকাতকে চিহ্নিত করতে? আপনি কি বলতে চান দশ’টা বছর ধরে চলে আসা তান্ডবলীলা সম্বন্ধে কিছুই জানেন না আপনারা? পৌঁছায়নি আপনাদের পর্যন্ত এই গ্রামের মানুষের ভয়ের আহাজারি? নাকি আপনারা অপারগ ডাকাতদল শনাক্ত করতে?” থমথমে গলায় বলে আরজান।

পুলিশ অফিসারসহ চমকে যায় সোফিয়া শিকদার ও লামিয়াও। শুধু শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রূপকথা। ডাকাতদলের উপর ম্যাজিশিয়ান কী পরিমাণ ক্ষিপ্ত ম্যাজিশিয়ান তা সম্পর্কে খানিক ধারনা তার থাকলেও এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারন তার জানা নেই।

“খুব দেখি বড়বড় কথা বলছো ছেলে। তুমি পারবে তাদের শনাক্ত করতে? সেই তো আমাদেরকেই ধরতে হবে। তাছাড়া কোনো অভিযোগ আসলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করতাম। গ্রামের কেউ সাহস জুগিয়ে থানা পর্যন্ত না গেলে আমাদের দায় বেঁধেছে কি গ্রামে এসে অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার?”

বাঁকা হাসে আরজান। বাক্যটা যেন তার জন্য বড়ই পছন্দসই হয়েছে। দৌড়ে ঘরে চলে যায় সে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে খাতা-কলম নিয়ে ফিরে আসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ব্যস্ত হাতে কিছু লিখতে থাকে সে। অফিসার অবাক চোখে অবলোকন করছে তার কার্যকলাপ। লেখা শেষ করে নিজের নামসহ সই করে দেয় কাগজের নিম্নভাগে। অতঃপর পুলিশ অফিসারের দিকে কাগজটি বাড়িতে দিয়ে বলে, “নিন, আমার অভিযোগপত্র। আশা করি এবার তদন্ত শুরু করতে কোনো আপত্তি নেই?”

“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় ছেলে। যুবক বয়স তাই রক্ত গরম। তবে আবারো ভেবে দেখো, এই অভিযোগ দায়ের করার ফলে তোমার ক্ষতিও হতে পারে। ডাকাতদল তো আর ছেড়ে কথা বলবে না।”

“আপনি কি কোনোভাবে আমাকে দমে যেতে বলছেন? তাছাড়া অভিযোগপত্র দিয়েছি আমি আপনার কাছে। এটা ডাকাতদল পর্যন্ত পৌঁছাবে কী করে? আপনি তো আর তাদের গিয়ে বলবেন না তাই না?” ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান।

দ্রুত কাগজটা পকেটে পুরে হাঁটতে শুরু করে অফিসার। এই ছেলেকে বলে কোনো লাভ নেই তা সে ভালোই বুঝে গিয়েছে, উল্টো কথার জালে তাকেই ফাঁসিয়ে দেবে। তবুও একবার পেছনে ফিরে বলে, “পস্তাবে তুমি পস্তাবে।”

তার কথাখানা মোটেই আমলে নেয় না আরজান। তারা বেরিয়ে গেলে সদর দরজা বন্ধ করে দু’পা এগোনোরও সময় পায় না সে। তার পূর্বেই পুনরায় দরজায় কড়াঘাত পড়তে শুরু করেছে।

চলবে,,,,,,

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_19

রোজিনা বেগম এসে থেকে রূপকথাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। রূপকথাও যেন মাকে পেয়ে দিন-দুনিয়া সব ভুলে গেছে। অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের ছাড়াছাড়ির কোনো নামই নেই। এদিকে আরজান তো পড়েছে মহা বিপদে। তার বউ আর তাকেই পাত্তা দিচ্ছে না! কী মারাত্মকভাবে তাকে উপেক্ষা করে শাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে! তাকে কি দেখতে খারাপ লাগছে যে বউ তার কাছে আসছে না? দ্রুত মোবাইল বের করে স্ক্রিনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখটা দেখে নেয়। নাহ, সবতো ঠিকই আছে তাহলে বউ কেন পাত্তা দিচ্ছে না? একদিকে আকরাম মিঞা অন্যদিকে আরজান, দুজোনেই তাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করছে। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন মা-মেয়ের এই মিলন ভঙ্গ হবে। কিছুটা দূরেই পলাশ দাঁড়িয়ে আছে বিরস মুখে। মাঝে মাঝে নজর হটিয়ে একবার দেখে নিচ্ছে তাদের কার্যকলাপ। তাকে ধরে বেঁধে এনেছে রোজিনা বেগম। তার একটাই কথা, “তোর একটামাত্র বইন, তুই যাবি না তে কেডা যাইব?”

মাঝ উঠোনে টাসকি খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোফিয়া শিকদার। মাঝে মধ্যে গ্রামে আসার সুবাদে চেয়ারম্যানকে চিনতে তার অসুবিধা হয় না। তবে চেয়ারম্যানের স্ত্রী, পুত্রকে এই প্রথম দেখছে সে। কিন্তু রূপকথার সঙ্গে কী সম্পর্ক তাদের তা বুঝে উঠতে পারছেন না। আরজান ইতিমধ্যে তাদের জানিয়ে দিয়েছে রূপকথার পরিবারের কেউ নেই, সে একা। এমন একটা মেয়েকে না চাইতেও মেনে নিতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু এদের কাহিনী মাথায় ঢুকছে না তার!

পাশেই চোখ-মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে লামিয়া। এসব আলগা আদিখ্যেতা খুবই অসহ্য লাগছে তার। কিছুক্ষণ আগে কড়াঘাতের শব্দ শুনে দরজা খুলে দিলে হুরমুর করে প্রবেশ করে এনারা। সাথে আসা ছেলেটা দুই হাতে ফল-মিষ্টি নিয়ে নড়তে পারছিল না। কোনোমতে আরজানের সাহায্যে সেগুলো বারান্দায় রেখে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে যেন। এতোক্ষনে সে ছেলেটার নামটাও জেনে গিয়েছে। ছেলেটার নাম পলাশ, মহিলাটা বারকয়েক এ নামেই ডেকেছে। তবে সেও বোধহয় তারই মতো বিরক্ত এসবে। সেটা তার চোখমুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

এরই মধ্যে হটাৎ আরজান লামিয়াকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে পলাশে কাছে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, “শা’লাবাবু, প্রেম করবা?”

ছিটকে সরে যায় পলাশ। তার হাত ধরে টেনে পুনরায় নিজের কাছে সরিয়ে আনে আরজান। কিঞ্চিত বিরক্ত স্বরে বলে, “এতো পালায় পালায় করো কেন? তুমি আমার একটামাত্র শা’লা। তোমার ভালো-মন্দের খেয়াল রাখার একটা দায়িত্ব আছে না আমার?”

বিরক্ত হয় পলাশ। চোখগুলো ছোট ছোট করে বলে, “তাই বইলা পিরিত করাইবি তুই আমারে?”

আরজান কিছু বলার পূর্বেই আচমকা আকরাম মিঞা কোথা থেকে এসে ধমকে ওঠে পলাশকে, “দুলাভাইরে কেউ তুই-তোকারি করে ছ্যাড়া? আপনে কইতে পারস না?”

“ওরে অহন আপনে কইতে হইব?”

“হ, কইবি। আপনে কইরাই কইবি।” চোখ রাঙিয়ে বলে আকরাম মিঞা।

পলাশ রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকাতেই আরজান তার পিঠ চাপড়ে বলে, “কোনো ব্যাপার না শা’লাবাবু। আস্তে আস্তে হয়ে যাবে।”

তার আশ্বাস পেয়ে আকরাম মিঞা দ্রুত ছুটে যায় রোজিনা বেগমের দিকে। পলাশ মুখ গোমড়া করে বলে, “তোরে আপনে কইবার পারুম না আমি।”

“তাহলে কী পারবা? শুধু মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করতে?” ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান।

তেতে ওঠে পলাশ, “দেখ, অপমান করবি না কইতাছি। ভূতের মাইর খাইয়া সব ছাইড়া দিছি আমি।”

“সাবাশ, এই না হলে আমার শা’লা।”

পলাশ রেগেমেগে তাকাতেই ব্যস্ত পায়ে রূপকথার দিকে এগিয়ে যায় সে। কিন্তু একি! রূপকথা এখনো ছাড়েনি রোজিনা বেগমকে! এবার যেন অতিশয় বিরক্ত বোধ করে আরজান। জামাই এখানে ছটফটিয় মরছে আর বউ কি-না আরামে জড়াজড়ি করছে! এটা মোটেও ভালো কথা নয়। আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে আরজান বিস্মিত কন্ঠে বলে ওঠে, “রূপ, তুমি আমার শাশুড়িকে দম বন্ধ করে মেরে ফেলতে চাইছো?”

এক ঝটকায় সরে আসে রূপকথা। হতবাক স্বরে বলে, “ছি ছি! এসব কী বলছো ম্যাজিশিয়ান! মাথা ঠিক আছে তোমার?”

এতক্ষন পরে সস্তির শ্বাস ছাড়ে আরজান। দাঁত কেলিয়ে বলে, “যাক, অবশেষে খতম হলো মা-মেয়ের মিলন। শ্বশুরমশাই, চলুন ঘরে যাওয়া যাক।”

চকিতে তাকায় আকরাম মিঞা। এই পোলা তো পুরাই বদলাইয়া গেছে! সে কাশতে কাশতে বলে, “না বাজান, আমারে আবার মেম্বার ভাইয়ের লগে যাইতে হইব। তার পোলা আইব শহর থেইকা আইজ।”

বাক্য সম্পূর্ণ করেই হন্তদন্ত হয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় আকরাম মিঞা। হাঁ করে সেদিকে চেয়ে আছে আরজান। হুট করে এভাবে যাওয়ার কী হয়েছে? শ্বশুর কি ভয় পেয়ে গেলো?

সবাইকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রেখে ছুটে বেরিয়ে যায় সে। ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করে রাস্তা দিয়ে। কিছুদূর এগোনোর পর দূর থেকে দেখতে পায় আকরাম মিঞাকে। সে খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে হনহন করে হেঁটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর ভ্যান আসতেই তাতে চড়ে চলে যায় আকরাম মিঞা। পেছন পেছন দৌড়েও আর তাকে ধরতে পারে না আরজান। আকরাম মিঞা তার সন্দেহের তালিকায় এসেছে আরো আগেই। তবে নিশ্চিত ছিলো না সে। আজ আকরাম মিঞাকে অমন হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখেই পিছু নেয় সে কিন্তু লাভ তো কিছু হলো না। বিরক্ত হয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে পেছনে ফিরতে না ফিরতেই কেউ শক্ত কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করে তার মাথা বরাবর। মূহুর্তেই চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা হয়ে আসে আরজানের। তবুও সে নিজের মাথা চেপে ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে সামনের ব্যক্তিটিকে দেখার জন্য তবে ব্যর্থ হয়। তার পূর্বেই দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ফুরিয়ে আসে তার, ঢলে পড়ে মাটিতে। বিদঘুটে হাসি হাসে সামনের ব্যক্তিটি, অসাড় দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে নেমে যায় মাঠের মাঝে।

এদিকে রোজিনা বেগমের সাথে কথা বলার মাঝে বারবার সদর দরজার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে রূপকথা। বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আরজানের ফিরে আসার কোনো লক্ষণ না দেখে কাউকে কিছু না বলেই দৌড়ে বেরিয়ে যায় সে। সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় ততটা রাস্তা তীক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করে আরজানের টিকিটিও খুঁজে পায় না। বিষন্ন মনে ফিরে আসে বাড়িতে। অনেকটা সময় তো পেরিয়ে গেলো, এখনো কেন ফিরছে না ম্যাজিশিয়ান?

অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। তবুও খোঁজ নেই আরজানের। ইতিমধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে সোফিয়া শিকদার। আরজানের মোবাইলে বারংবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি বরং সকাল থেকেই ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে। ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে সোফিয়া শিকদার। তাকে সামলাচ্ছে রোজিনা বেগম। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা, বারবার কানে বাজছে পুলিশ অফিসারের দেওয়া সেই হুঁশিয়ারি। খটকা তো তখনই লেগেছিল, হয়তো শীঘ্রই কোনো বিপদ আসবে তবে তা যে এতো দ্রুত চলে আসবে সেকথা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। পাশেই পায়চারি করছে লামিয়া। মাঝে মাঝে পা থামিয়ে রূপকথার দিকে চেয়ে তাকে খানিক গালাগালি করে মনের স্বাদ মিটিয়ে নিচ্ছে। এসব কিছু নাকি তার জন্যই হয়েছে। লামিয়ার ভাষ্যমতে সবকিছুর জন্য দায়ী শুধুমাত্র রূপকথা। চুপচাপ প্রতিটা কটু বাক্য হজম করে নেয় রূপকথা। অন্য সময় হলে প্রতিটা বাক্যের পাল্টা জবাব সে দিয়ে দিত কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। তার মোটেই ইচ্ছা করছে না কারো কথার কোনো প্রত্যুত্তর করতে। কেমন যেন দম বন্ধকরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তার এখন ম্যাজিশিয়ানকে প্রয়োজন খুব করে। ম্যাজিশিয়ান ছাড়া এই ধরণীর বুকে টিকে থাকা তার জন্য বড়ই দুষ্কর! ম্যাজিশিয়ানের অনুপস্থিতিতে তার এই অনুভূতির কারন কি শুধুই তার স্বার্থ? এর কোনো উত্তর নেই তার কাছে।

তখনই লামিয়া পুনরায় বলে ওঠে, “এই অলক্ষুনে মেয়েটাই যত নস্টের মূল। আরজান কোথা থেকে এটাকে জুটিয়েছে কে জানে। যত্তসব, চালচুলোহীন মেয়ে, না আছে রূপ আর না আছে গুন। বিয়ে হতে না হতেই বিপদ ডেকে আনলো।”

শক্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায় রূপকথা। এমন একটা পরিস্থিতিতে লামিয়ার এসব আজেবাজে কথাবার্তায় খুবই বিরক্ত সে। এই মেয়েটা সুযোগ পেলেই অতিরিক্ত কথা বলে। এমনভাবে তেড়ে আসতে চায় যেন তার সাথে সাত জনমের শত্রুতা। আর কটু কথা বলাতে তো সে ভারি পারদর্শী। কিছু হতে না হতেই মুখ উচিয়ে চলে আসে বাজে বকতে।

তখনই লামিয়া পুনরায় উচ্চস্বরে বলে, “আমার তো এই মেয়েকেই সন্দেহ হচ্ছে। আরজানের ক্ষতি করতে পারলে তবেই তো তার সম্পত্তি হাতাতে পারবে।”

হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা। তার ধৈর্যশক্তি ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে এসব কথাবার্তায়। ইচ্ছে তো করছে এটাকে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। ম্যাজিশিয়ান ভালো করেছে এটাকে বিয়ে না করে। এই মেয়ে তো দু’দিনেই তার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। বোধহয় তার চুলগুলো টেনে টেনে ছিড়তে পারলে শান্তি পেতো এই মেয়ে। যার সাথে বিয়ে হবে সে বেচারার না জানি কী হবে!

লামিয়া পুনরায় কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মেরে দেয় রূপকথা। সবকিছুর একটা সীমা আছে। এমন পরিস্থিতিতে সে আর সহ্য করতে পারছে না এসব কটু কথা। আচমকা ধাক্কায় নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে আছড়ে পড়ে লামিয়া। গালে হাত দিয়ে হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকে রূপকথার দিকে। ব্যথায় গালটা যেন অসাড় হয়ে আসছে। একটা মেয়ের শরীরে এতো শক্তি!

রাগে যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে সে। উচ্চস্বরে চিৎকার করে কিছু বলতে নিতেই ধমকে ওঠে রূপকথা, “চুপ, একদম চুপ। কিছু বলছি না দেখে কি মাথায় উঠে বসেছো? মাথা থেকে টেনে নামাতে থাপ্পড়টা তোমার প্রয়োজন ছিলো। কখন কী বলতে হয় সেই জ্ঞানটুকুও কি নেই তোমার? তাছাড়া সম্পর্কে ম্যাজিশিয়ান তোমার বড় ভাই। সেদিক দিয়ে আমি তোমার বড় ভাবি হই আর তুমি কি-না যাচ্ছে তাই বলেই চলেছো? বড় ভাবির সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় সেই শিক্ষা কি কেউ দেয়নি তোমাকে? শিখিয়ে দেবো আমি?”

রাগে কিড়মিড় করতে করতে চেয়ে থাকে লামিয়া। সে চাইছে চিল্লিয়ে কিছু বলতে তবে তার মুখ তাতে সায় দিচ্ছে না। ব্যথায় টনটন করছে পুরো গাল। এমতাবস্থায় চেয়েও উত্তর দিতে ব্যর্থ সে। তাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে দেয় রূপকথা। কন্ঠের দৃঢ়তা বজায় রেখে বলে, “হাত ধরো।”

হাত না ধরে উল্টো নিজের হাত আরো গুটিয়ে নেয় লামিয়া। তার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মেয়ে তার গায়ে হাত তুলেছে! কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় নেই, গালভর্তি ব্যথা তাকে মানতে বাধ্য করছে। যেখানে তার পরিবারের কেউ কখনো তার সাথে উচ্চস্বরে কথা অব্দি বলেনি সেখানে এই মেয়ে কি-না তাকে থাপ্পড় মারলো!

হাত না ধরাতে বিরক্ত হয়ে জোর করে হ্যাঁচকা টানে তাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় রূপকথা। লামিয়া রাগে গজগজ করতে করতে তার দিকে চাইলেই সে উপেক্ষা করে সোফিয়া শিকদারের ঘরে চলে যায়। বিছানায় অচেতনের ন্যায় পড়ে আছে সোফিয়া শিকদার। পলাশকে দিয়ে ওষুধ আনিয়ে খাইয়ে দেওয়ায় সে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শিয়রে বসে মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে রোজিনা বেগম। চিন্তিত ভঙ্গিতে কারো নম্বরে কল দিতে দিতে ঘরময় পায়চারি করে চলেছে পলাশ। উটকো ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে বোধহয় বিরক্ত হচ্ছে সে। রূপকথা ঘরে প্রবেশ করে একবার শাশুড়ির দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকায়। কি থেকে কি হয়ে গেলো!

রোজিনা বেগমের উদ্দেশ্যে ধীর স্বরে শুধায়, “মায়ের কী অবস্থা এখন?”

“অহন তো ঘুমাইতাছে, বড়ি খাওয়াইয়া দিছি।”
কথাটা বলে পলাশে দিকে চেয়ে বলে, “কল ঢুকতাছে তর দুলাভাইয়ের নম্বরে?”

অবাক নয়নে তাকায় রূপকথা। পলাশ না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে, “ঢুকতাছে না তো আমি কী করমু? বন্ধ কইতাছে।”

পুনরায় হতাশ হয় রূপকথা। আনমনে বিছানার এক কোনায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে। বুকটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে! বারকয়েক ঢোঁক গিলে বিড়বিড়িয়ে বলে, “কোথায় তুমি ম্যাজিশিয়ান? কেন ফিরে আসছোনা আমার কাছে? তোমার এতোটুকু অনুপস্থিতিতে আমার হৃদয়ে যে দহন শুরু হয়েছে তা কী করে থামবে বলোতো? চিরজীবনের জন্য তোমায় ছেড়ে বহুদূরে একাকী কীভাবে কাটাবো আমি? জীবনের সব আফসোসের তালিকায় বোধহয় আরো একটা আফসোস যুক্ত হতে চলেছে। দিনকে দিন আমার অপ্রাপ্তির খাতাটা বড্ড বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি চলে গেলে চলতি পথে ভুল করে হলেও একবার কি আমায় মনে করবে তুমি? নাকি জীবনের উটকো কোনো অধ্যায়ে যোগ করে দেবে আমার নামটা?”
__________________________

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়েছে আরজান। মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে, চোখদুটোও ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে। কিন্তু কোথায় আছে সে? জায়গাটা এতো অন্ধকার কেন? পরক্ষণেই সেই ভুল ভেঙে যায় তার। জায়গাটা অন্ধকার নয় বরং তার চোখদুটো কোনো কিছু দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাত-পা নাড়াতে চেয়েও ব্যর্থ হয় সে। দড়ি জাতীয় কিছু দিয়ে তার হাত, পা বেঁধে রাখা হয়েছে শক্ত করে। মুখের খুব কাছ থেকে মাটির তীব্র ঘ্রান নাকে এসে লাগছে। শরীরেও কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে। তাহলে কি তাকে মাটিতে ফেলে রেখেছে?

ঠিক কতটা সময় পেরিয়ে গেছে তা আন্দাজ করতে পারলো না আরজান। তবে শীতের তীব্রতা আর ক্ষুধার জ্বালা অসহনীয় উঠেছে। রাত হয়ে গেছে নাকি?
আশেপাশে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। চারপাশ কেমন শুনশান নিস্তব্ধতায় মেতে উঠেছে। নিজের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ শ্রবণগোচর হচ্ছে না। কে তাকে তুলে আনলো? তারও যে কোনো হদিস নেই। কী উদ্দেশ্যে এনেছে তাকে? মেরে ফেলতে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে?

আশেপাশে কেউ আছে কিনা তা উপলব্ধি করতে বারকয়েক গলা ফাটিয়ে ডাকে, “কেউ কি আছে এখানে? সাহস থাকলে সাড়া দে? পেছন থেকে আঘাত করিস, শা’লা কাপুরুষ।”

তার কথাগুলো শূন্যেই মিলিয়ে যায়, ফিরতি কোনো উত্তর আসে না। তারমানে কেউ নেই এখানে। তাহলে তাকে এখানে না মেরে ফেলে গেছে কেন এভাবে? শা’লারা কি না খাইয়ে মা’রার পরিকল্পনা এঁটেছে নাকি? এই শা’লাদের বিশ্বাস নেই, না খাইয়েও মা’রতে পারে। নিজের আপন শা’লাই তাকে মারতে পারলে খুশি হয় আর এ তো পাড়া-প্রতিবেশী শা’লা। এগুলো তো এমনিই হারা’মখোর হয়।

এমনভাবে বেঁধে রেখেছে যে হিসু পেলেও চেপে রাখা ছাড়া উপায় নেই। এই শা’লাদের বোধবুদ্ধি কি কোনোদিন হবেনা? তুলে আনলি ভালো কথা, খাইতে দিবি না তাও মেনে নিলাম তা বলে হিসু করার কোনো ব্যবস্থা রাখবি না? ছি ছি! ডাকাতদলের অতিথি আপ্যায়নের রীতিনীতি খুবই খারাপ। কে জানে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কোন মূর্খকে রেখেছে?

পুনরায় চিল্লিয়ে ওঠে সে, “কে আছিস? আমার ঘুম পাচ্ছে, যে আরামের বিছানা দিয়েছিস ঘুম না পেয়ে উপায় আছে? রাতে যদি আমার হিসু পায় তাহলে ডেকে দিস।”

কেউ একজন নিঃশব্দে তাকে অবলোকন করে যাচ্ছিল। হটাৎ তার এহেন কথাবার্তা শুনে তব্ধা খেয়ে বসে থাকে। তার জানা ছিল না বন্দিদশায় কেউ হিসু নিয়ে এতো ভাবে! আবার বলে কি-না হিসু পেলে জাগিয়ে দিতে! এটা বোধহয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! পৃথিবীর বুকে এমন ঘটনা বড়ই বিরল! একে তো মিউজিয়ামে রাখা উচিত, এখানে কী করছে?
মুহুর্তেই কারোর নাক ডাকার শব্দ পেয়ে চকিতে তাকায় লোকটা। এতোটুকু সময়ে আরজান ঘুমিয়ে কাদা এমনকি নাকও ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। লোকটা মাথায় হাত চেপে বসে থাকে। সে নিশ্চিত একে মিউজিয়ামে রাখলে লোকজন টিকিট কেটে দেখতে আসবে!

চোখের পলকে রাতের গভীরতা বাড়তে থাকে। পাহাড়ারত লোকটার চোখে মাত্রই তন্দ্রা লেগে এসেছিল এমন সময় কারো উচ্চস্বরের চিৎকার শুনে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আরজান এখনো চিৎকার করেই চলেছে, “বউ, বউ কই তুমি? জোরে একটা চুমু দাও তো।”

এবার যেন আশ্চর্যের চরম শেখরে পৌঁছে যায় লোকটা। মানে সে স্বপ্ন-টপ্ন দেখছে না তো! একটা মানুষ মাঝরাতে চিৎকার করে বউয়ের কাছে চুমু চাইছে! এমন প্রাণীও আছে এই দুনিয়ায়? বিলুপ্ত হওয়ার আগেই একে সংরক্ষণ করা উচিত।

তখনই পুনরায় চেঁচিয়ে ওঠে আরজান, “কাছে আসছো না কেন বউ? বুঝেছি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছি বলে রাগ করেছো। কাছে আসো, আদর করে দিই। বিশ্বাস করো এক চুমুতে রাগ উধাও করে দেবো।”

সামনে উপস্থিত লোকটার মনে হচ্ছে সে ভুল করে কারোর বাসরঘরে ঢুকে পড়েছে। যেকোনো সময় তার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করবে। তবে সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে এর বউয়ের ধৈর্য্য আকাশসম। আরজান আবার কিছু বলার পূর্বেই ধমকে ওঠে লোকটা, “এই থাম, তোর বউ কোথা থেকে আসবে? তুই কি ভুলে গিয়েছিস তোকে উঠিয়ে আনা হয়েছে?”

তেতে ওঠে আরজান। চিৎকার করে গালিগালাজ করে বলে, “শা’লা বিবাহিত মানুষকে তুলে আনতে হলে বউসহ তুলে আনতে হয় জানিস না তুই? বেক্কলের কারখানা কোথাকার।”

মুহুর্তেই চোখদুটো বড়বড় তাকায় লোকটা। বিবাহিত মানুষকে বউসহ তুলে আনতে হয় এমন নিয়ম কোন সংবিধানে লেখা আছে! নিজের কান বাঁচাতে হলে যত দ্রুত সম্ভব এটাকে চুপ করাতে হবে। তাই গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, “ঘুমা তুই, নাহলে মেরে বিলের পানিতে গেড়ে দেবো কিন্তু।”

“বউয়ের চুমু ছাড়া ঘুম হয় না আমার। হয় বউকে এনে দে নাহলে আমার সাথে সারারাত গল্প কর।” সোজা উত্তর আরজানের।

ধপ করে বসে পড়ে লোকটা। এ কোন মসিবত ঘাড়ে এসে জুটল! সারাটা রাত ঘুম কামাই করে এসব ঠোঁটকাটা কথাবার্তা শুনতে হবে!

তাকে চুপ থাকতে দেখে আরজান নিজেই বলতে শুরু করে, “কাল সারারাত বউ আর আমি,,,,,,,,,,,,,,,,,।”

অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে লোকটা। যখনি তার ঘুম লেগে আসছে তখনই চিল্লিয়ে উঠছে আরজান। এমন একটা মাস্টারপিস এখনো দুনিয়ার বুকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে তা তার জানা ছিল না। যদি তার হাতে সবকিছু থাকতো তবে সে এখনি এটাকে ছেড়ে দিতো। কিন্তু সে ঠিক করে নিয়েছে সকাল হতেই আগে স্যারের সাথে কথা বলে, হয় এটাকে আগে মুক্ত করবে নয়তো নিজেই পালিয়ে যাবে সবকিছু ছেড়ে।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে