#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_14
আকরাম মিঞা বিরস মুখে চেয়ে আছে তার স্ত্রীর দিকে। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর থেকেই রোজিনা বেগম রূপকথার হাত চেপে ধরে কেঁদে চলেছে। এ কান্না যেন আজ থামার নয়। আরজান, হাশেম, কাজী সাহেব সকলেই ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সেদিকেই চেয়ে আছে। পাশেই পলাশ গম্ভীর হয়ে মুখে হাত চেপে বসে আছ। বিয়ে যে শেষ হয়ে গেছে সেটা যেন কারোর মাথাতেই নেই। আকরাম মিঞা কয়েকবার উচ্চস্বরে রোজিনা বেগমকে ডেকেও তার কোনো হেলদোল না পেয়ে কিঞ্চিত বিরক্ত হয়। রাগান্বিত স্বরে বলে, “তুই কান্দস ক্যান বেডি? বিয়া যে খতম হইলো মিষ্টি মুখ করাইতে হইব না?”
এবারও কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য হয় না রোজিনা বেগমের ভেতর। আকরাম মিঞা বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে বলে, “এখন হইলো গিয়া মিষ্টি মুখ করনের বেলা আর এই বেডি কান্দনের ঝোলা খুইলা বইছে।”
কিছু সময় ডাকাডাকি করেও কোনো সুরহা করতে পারে না সে। শেষে অতিমাত্রায় বিরক্ত হয়ে নিজেই মিষ্টির প্যাকেট খুলে সকলের হাতে দিতে শুরু করে। মিষ্টিগুলো সে বিয়ের জন্যই এনেছে বাড়ি আসার সময়। শুভ কামে কি মিষ্টি মুখ না করাইলে হয়?
মিষ্টি হাতে নিয়ে হাশেম বলে ওঠে, “আমি আইতে কিন্তু বেশি দেরি করি নাই। মিজিশিয়ানের বিয়ার সাক্ষী হইবার লিগা দোকান ফালাইয়া ছুইটা আইছি।”
এবার মুখ খোলে আরজান, “তোমার তো আরো আগে আসার কথা ছিলো?”
জীভ কাটে হাশেম, “আর কইয়েন না, আপনে ডাইকা আইলেন আর অমনি একটা লোক আইয়া চা চাইলো। বেডা যায় না তে যায়ই না।”
কাজী বলে ওঠে, “আমার কাম তো শ্যাষ, আমি তাইলে যাই চেয়ারম্যানসাব। রহমানের বড় ছেড়ির বিয়া পড়াইতে হইব আইজ।”
“কিছু খাইয়া যাইবেন না?” শুধায় আকরাম মিঞা।
“আইজ এক্কেরে সমায় নাই, তাড়াতাড়ি যাইতে হইব।”
আরজান উঠে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলে, “ঠিক আছে যান।”
অতঃপর পলাশের দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বলে, “শা’লাবাবু, যাও কাজী সাহেবকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসো।”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পলাশ। আরজান কিছু বলার পূর্বেই আকরাম মিঞা বলে ওঠে, “চক্ষে কি ধানের বাইল ঢুকছে? এমনে তাকাস ক্যান ছেড়া? যা আগাইয়া দিয়া আই।”
বাপের কথায় উঠে দাঁড়ায় সে। আরজানের দিকে একবার গরম চোখে তাকিয়ে কাজী সাহেবকে সাথে করে চলে যায় সে। সবার অগোচরে বিজয়ী হাসি হাসে আরজান। বিড়বিড়িয়ে বলে, “ইশ! বেচারা পলাশ, শেষে কি-না বোন হয়ে গেলো?”
আকরাম মিঞা বলে ওঠে, “বাজান, আইজ তো মেলা শ্যাষ। তুমি বরং আরো কয়ডাদিন আমার বাড়িত থাইকা যাও নতুন বউ নিয়া।”
এবার নড়েচড়ে বসে আরজান। আকরাম মিঞার উদ্দেশ্যে বলে, “আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি চাচা। আমি এই গ্রামেরই ছেলে আর গ্রামে নিজের বাড়িতে আরো কিছুদিন থাকবো আমরা।”
“কও কী? কুন বাড়ির পোলা তুমি? বাপের নাম কী?” অবাক হয়ে শুধায় আকরাম মিঞা।
“আরিজ শিকদারের ছেলে আমি।”
“শিকদার বাড়ির পোলা তুমি! হাছা কইতাছো?” চোখ বড়বড় করে শুধায় আকরাম মিঞা।
“হ্যাঁ, আজ আমার মা আসবে তাই আমাকে বাড়িতেই থাকতে হবে।”
এতক্ষণে হুঁশ ফেরে রোজিনা বেগমের। রূপকথার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শুধায়, “তোমরা গেরামেই থাকবা?”
“হ্যাঁ, কিছুদিন।”
খুশি হয় রোজিনা বেগম। মাইয়াডারে আরো কইদিন দেখবার পারব এই তো কত! সে রূপকথার কপালে আদর মাখা চুম্বন করে বলে, “আমাগো বাড়ি আইসো মাঝে মাঝে।”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায় রূপকথা। ঠোঁট জোড়া বিস্তৃত করে বলে, “হুম, আসবো।”
কথোপকথন শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আরজান। ঘর থেকে নিজের জিনিসপত্রের ব্যাগ আর জাদুর সরঞ্জাম বের করে আনে। অতঃপর আকরাম মিঞা ও রোজিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে, “আজ তাহলে আসি। আপনারা কিন্তু আসবেন আমাদের বাড়িতে আর চাচির যখনি মেয়েকে দেখতে মন চাইবে তখনি চলে আসবেন ভ্যান নিয়ে।”
অতঃপর রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “চলো, যাওয়া যাক।”
“হুম।” ধীর স্বরে জবাব দেয় রূপকথা। একহাতে ওরনাটা ধরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে আরজানের সাথে। পেছন পেছন এগিয়ে আসে আকরাম মিঞা ও রোজিনা বেগম। রাস্তায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হয় তাদের ভ্যানের অপেক্ষায়। মায়াভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রোজিনা বেগম। আকরাম মিঞা স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেয়। তার বউডার ম্যালা শখ আছিলো একটা মাইয়ার। এখন এই মাইডারে দেইখা নিজের মাইয়া ভাবতাছে। তখনই ভ্যান এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। আরজান ভ্যানচালকের সাথে কথা বলছে। রূপকথা দৌড়ে এসে আবার জড়িয়ে ধরে রোজিনা বেগমকে। রোজিনা বেগমও পরম আদরে আগলে নেয় তাকে। আরজান ভ্যানচালকের সাথে কথা সম্পূর্ণ করে জিনিসপত্র ভ্যানে উঠিয়ে রেখে ডেকে ওঠে রূপকথাকে, “রূপ, এসো।”
রোজিনা বেগমকে ছেড়ে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে ভ্যানে গিয়ে বসে রূপকথা। ভ্যান ছাড়ার পরেও আবার পেছনে ফিরে তাকায় রূপকথা। সে যেন আপন কাউকে ছেড়ে যাচ্ছে এমন অনুভূতি হচ্ছে! কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর ভাঙা রাস্তার মাঝে ভ্যান পড়ে বেশ জোরে একটা ধাক্কা লাগে। আনমনেই কিছু কথা ভাবছিল রূপকথা। হটাৎ এমন ধাক্কায় নিজেকে সামলাতে না পেরে কিছুটা সামনে ঝুঁকে পড়ে সে। আরজান দ্রুত একহাতে শক্ত করে ভ্যান ধরে অন্যহাতে রূপকথার হাত টেনে ধরে। মুখ থুবরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চোখ-মুখ শুকিয়ে এসেছে রূপকথার। তাকে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে ধমকে ওঠে আরজান, “ভ্যান ধরে বসো। এমনভাবে বসেছো যেন দুনিয়া জয় করে এসেছো। এখন আর কারো ধার ধারার সময় নেই।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রূপকথা। এটা কেমন কথা? সে কিছু বলতে নিবে তখনই আরজান ভ্যানচালকের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বলে, “ধীরে সুস্থে চলুন, এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। যুদ্ধে যাচ্ছি না আমরা।”
পুরো রাস্তায় আর কোনো কথোপকথন হয় না তাদের মধ্যে। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই দ্রুত নেমে পড়ে রূপকথা। আরজান কিছু বলার আগেই হনহন করে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আরজান একবার সেদিকে দেখে নিয়ে ভ্যান থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে দেয়। ভ্যানচালক চলে যেতেই তার স্বাভাবিক মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। হতবাক স্বরে বলে, “নিজের জিনিসপত্রগুলোও নেয়নি! এই মেয়ের কি ভাব বেড়েছে নাকি?”
সে নিজেই কোনোমতে দু’হাতে সবকিছু টেনেটুনে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। সবকিছু বারান্দায় রেখে আগে চারদিকে নজর বুলিয়ে দেখে নেয়। নাহ, পরিবেশ স্বাভাবিক আছে তারমানে মা এখনো এসে পৌঁছায়নি। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে নিজের জিনিসপত্রগুলো নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। রূপকথা বিছানায় বসে আছে পা ঝুলিয়ে। ওরনাটা মাথার উপর থেকে নামিয়ে দিয়ে শুধু শরীরে পেঁচিয়ে রেখেছে। তাকে ঢুকতে দেখেও একবার ফিরে তাকায় না রূপকথা। এতে খানিকটা অবাক হয় আরজান, এর আবার হলো কী! তার দিক থেকে নজর সরিয়ে আলমারি খুলে সবকিছু রাখতে রাখতে বলে, “নিজের জিনিসপত্রগুলো ঘরে এনে আলমারিতে রাখো।”
“ক্ষুধা লেগেছে আমার ম্যাজিশিয়ান।” পেটে হাত চেপে বলে রূপকথা।
চকিতে তাকায় আরজান। সত্যিই তো, বেলা তো অনেক হলো। আলমারি বন্ধ করারও যেন সময় পায় না সে। ব্যস্ত স্বরে বলে, “তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি খাবার নিয়ে আসছি।”
বড়বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় সে। তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সোনালি ওরনাটা শরীর থেকে খুলে রাখে রূপকথা। বারান্দায় এনে রাখা ব্যাগগুলো ঘরে এনে বিছানার উপর রাখে। একটা পোশাক পছন্দ করে পরে নেয় বাকি সবকিছু সাবধানে এক এক করে আলমারিতে তুলে রাখে। আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে নজরে আসে আলমারির সামনে রাখা আরজানের পোশাকগুলো। সেগুলোও সযত্নে তুলে রাখে রূপকথা। সবশেষে মুচকি হাসে সে। তার ধারনারও বাইরে ছিলো যে তারও কোনোদিন বিয়ে হবে। এভাবে কারোর বাড়িতে সে বউ হয়ে আসবে। কেউ তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সবকিছুই তার আফসোসের জীবনে হুট করেই ধরা দিয়েছে কিন্তু শীঘ্রই তাকে আবার সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে বহুদূরে। সেই দিন কি খুব দ্রুত চলে আসবে?
চলে যাওয়ার কথা মনে আসতেই হুট করেই তার হৃদয়টা যেন হাহাকার করে ওঠে। তার জানা নেই কেন এই হাহাকার। তার তো খুশি হওয়ার কথা। অথৈ পানির সমুদ্রে গেলে সে বিনা সংকোচে যখন ইচ্ছে তখন সাঁতরে বেড়াতে পারবে। সীমাহীন সেই পানির মাঝে জেগে উঠবে তার আপন স্বত্বা। মানুষের এই জীবন তো তার জন্য নয় তবে কেন এতো দ্বিধা তার মাঝে? হয়তো ম্যাজিশিয়ানের মতো একজন বন্ধু পেয়েছে বলে। যে তার সমস্ত ভালো-মন্দের খেয়াল রাখে। ম্যাজিশিয়ান শিকার করুক বা না করুন সে মানুষটা খারাপ নয়। আবার হতে পারে একজন মা পেয়েছে বলে এই দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে। একজন মায়ের অভাব তো সে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করেছে আর আজ পেয়েও তাকে ছেড়ে যেতে হবে দূর সমুদ্রে। এই জীবন যে তার জন্য নয়, তার জগৎ ভিন্ন। এসবের প্রতি মায়া না বাড়ানোই উত্তম।
দু’দিন পরেই ত্যাগ করতে হবে এই জীবনকে। সেই সাথে ত্যাগ করতে হবে এই জীবনের সাথে সম্পৃক্ত সমস্ত আপন মানুষগুলোকে। হারিয়ে যেতে হবে চিরতরে।
হটাৎ সে উপলব্ধি করতে পারে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এখন তার পানি প্রয়োজন। এই মুহুর্তে একমাত্র পানিই পারবে তার এই কষ্ট লাঘব করতে। সে দ্রুত ঘর ছেড়ে এগিয়ে যায় পুকুরের দিকে। পুকুরের পানিটুকু চকচক করছে রোদের মাঝে। হয়তো তাকে নিজের মাঝে আগলে নিতে আহ্বান করছে। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ভেসে আসে আরজানের কন্ঠস্বর, “ওখানে কী করছো এখন? খাবেনা তুমি?”
অবাক হয় রূপকথা। তার দিকে দু’পা এগিয়ে এসে শুধায়, “এতো দ্রুত চলে আসলে তুমি?”
একহাতে খাবারের প্যাকেট অন্য হাতে কাঁচা বাজার নিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আরজানকে। তার ভেতর এমন উদ্ভট প্রশ্নে কিঞ্চিত বিরক্ত হয় সে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কাঁচা বাজারের ব্যাগগুলো বারান্দায় রাখতে রাখতে বলে, “এতো দ্রুত কোথায় রূপ? কতক্ষণ গেছি তার খেয়াল আছে তোমার? ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি এটুকু সময়ে?”
এবার খানিক বিব্রত হয়ে পড়ে রূপকথা। তারমানে সে ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় পার করে দিয়েছে। কখন এতোটা সময় গেল সে টের পর্যন্ত পেল না!
তার ভাবনার মাঝেই আরজান তাড়া দিয়ে বলে, “অনেক হয়েছে, আর দাঁড়িয়ে থেকো না হাঁ করে।কলপাড় থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
নড়েচড়ে দাঁড়ায় রূপকথা। আরজানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঘরে গিয়ে পানির পাত্রটা হাতে করে আবার কলপাড়ে চলে যায়। মুচকি হাসে আরজান, “যাক উন্নতি হয়েছে তাহলে।”
খাবারের প্যাকেট ঘরে রেখে দিয়ে দ্রুত কাঁচা বাজারটা রান্নাঘরে রেখে সে নিজেও এগিয়ে যায় কলঘরের দিকে। সে আসতেই রূপকথা পানির পাত্রটা দ্রুত ভরে নিয়ে ঘরে চলে যায়। ধীরে সুস্থে হাত-মুখ পরিষ্কার করে ঘরে আসে আরজান। খাবার বাড়তে এগোতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। রূপকথা দুটো প্লেটে খাবার বেড়ে রেখেছে টেবিলের উপর। পাশেই গ্লাস ভর্তি পানিও রাখা আছে। এই মেয়ে তো সব রপ্ত করে নিয়েছে। মুচকি হেসে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে আরজান। রূপকথার উদ্দেশ্যে বলে, “না খেয়ে বসে দাঁড়িয়ে আছো কেন? নতুন বউ হয়েছো বলে কি এসব করতে হবে? ক্ষুধা লেগেছে না তোমার? দ্রুত খেতে বসো।”
ঠোঁট বাকায় রূপকথা। একহাত বাড়িয়ে ভাতের প্লেট নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। আরজান রাগান্বিত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকিয়ে বলে, “ওখানে কেউ খায়? বোকা মেয়ে, এখানে এসো।”
আবার উঠে গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে রূপকথা। আরজান খেতে খেতে বলে, “আমি বেরিয়ে গেলে সদর দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিও। মা আসার আগ পর্যন্ত যতক্ষণ পারো পানিতে থেকো। মা আসলে কিন্তু পুকুরের ধারে কাছেও যাবে না।”
চুপচাপ খেয়ে চলেছে রূপকথা। আরজান কিঞ্চিত বিরক্ত স্বরে বলে, “বুঝেছো?”
খেতে খেতেই উপর-নিচ মাথা নাড়ায় রূপকথা। চোখ ছোট ছোট করে তাকায় আরজান। বিড়বিড়িয়ে বলে, “কথা বলারও সময় পাচ্ছে না, খাদক কোথাকার।”
মাথা উঠিয়ে তাকায় রূপকথা। ভাতের লোকমা মুখে পুরে শুধায়, “কিছু বললে?”
“নতুন বউ না তুমি? নতুন বউয়েরা কি এভাবে খাদকের মতো খায়? একটু লজ্জা-সরম পেয়ে গাল লাল করে ধীরে সুস্থে খাবা। তা দেখে আমি বলবো লজ্জা পেয়ো না, এটাতো তোমারি সংসার। তা না দেখো কীভাবে খেয়ে চলেছো।” চোখ-মুখ কুচকে বলে আরজান।
খাওয়া রেখে হাঁ করে তাকায় রূপকথা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের হাতে থাকা ডিমের কুসুমটুকু রূপকথার হাঁ করে থাকা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় আরজান। বিরক্ত স্বরে বলে, “খাও খাও, পারলে আমাকেও খেয়ে নাও। লজ্জা পেতে বলেছি, এভাবে হাঁ করে চেয়ে থাকতে বলিনি। এই তুমি কি চাইছো আমি লজ্জা পাই?”
কুসুম গলায় বেঁধে কেশে ওঠে রূপকথা। আরজান দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে ধরে তার সামনে। খপ করে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয় রূপকথা। অতঃপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে আরজানের দিকে চেয়ে বলে, “লজ্জা কি আদৌ আছে তোমার?”
“সে কী কথা! আমিতো এখনো তোমার সাথে নির্লজ্জের মতো কিছুই করিনি। তার আগেই এমন গর্বিত হওয়ার মতো অপবাদ!” হতবাক স্বরে বলে আরজান।
কথা শেষ করে মাত্রই আবার পানি মুখে নিয়েছিলো রূপকথা। এমন কথায় পানি আর তার গলার ভেতরে পৌঁছাতে পারে না উল্টো ছিটকে পড়ে আরজানের সাদা পাঞ্জাবিতে।
চলবে,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_15
“আমার বিয়ের পান্জাবী তুমি ভিজিয়ে দিলে রূপ?” চোখ বড়বড় করে শুধায় আরজান।
হকচকিয়ে যায় রূপকথা। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “এটা কোন দিক দিয়ে বিয়ের পান্জাবী লাগে? শুধু একটু সুতোর কাজ। তুমি সুন্দর বলে বেশ মানিয়েছে তার মানে এই নয় যে তুমি চোর বাজার থেকে পান্জাবী কিনে সেটাকে বিয়ের পান্জাবী বলে চালিয়ে দিবে।”
আরজানের প্রতিক্রিয়া এবার দেখার মতো। এমন একখানা ভাব যেন, খাওয়া-দাওয়া চুলোয় যাক আগে পান্জাবীর অপমান চোকাতে হবে। চেয়ার ছেড়ে সোজা দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকে বলে, “ওহ আচ্ছা, এখন সাধারণ পোশাকে আমাকে সুন্দর লাগছে দেখে হিংসা হচ্ছে তোমার? তুমিও তো সাজগোজ ছাড়া বিয়ে করেছো, আমি কি কিছু বলেছি?”
তার কথায় খুব একটা বিচলিত হয় না রূপকথা। এক লোকমা ভাত মুখে পুরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, “সেটার সম্পূর্ণ দায়ভার তোমার।”
“মেনে নিলাম আমার দায় কিন্তু তা বলে তুমি নিজের স্বামীর বিয়ের পান্জাবীকে এভাবে অপমান করবে?” পুনরায় অবাক কন্ঠে বলে ওঠে আরজান।
অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রূপকথা। কন্ঠে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে বলে, “পান্জাবীকে কখন অপমান করলাম আমি? চোর বাজার থেকে পান্জাবী কিনেছো তুমি, এতে পান্জাবীর তো কোনো দোষ দেখি না আমি। তুমি বর্তমান কালে খুব ভুলভাল বকতে শুরু করেছো ম্যাজিশিয়ান।”
চোখদুটো আরো বড়বড় করে তাকায় আরজান। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “কী বললে? তার মানে তুমি আমাকে অপমান করছো?”
উত্তর দেয় না রূপকথা। চুপচাপ নিজের মতো খেয়ে চলেছে সে। এই লোকটার সাথে এখন কথা বলাটাই বেকার। শুধু শুধু কথা পেঁচিয়ে ‘আম’কে ‘আমড়া’ বানাচ্ছে।”
পাত্তা না পেয়ে চিল্লিয়ে ওঠে আরজান, “আরে কথা বলছো না কেন? নতুন বউয়েরা কখনো এমন করে নাকি?”
“উফ ম্যাজিশিয়ান! কথা বলোনা তো, আমাকে শান্তিতে খেতে দাও।” বিরক্ত কন্ঠে বলে রূপকথা।
রূপকথা যেন বড়ই বিরক্তিকর কিছু বলে ফেলেছে। পান্জাবী চেপে ধরে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে আরজান।
ধপধপ পা ফেলে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়।আলমারি থেকে সবুজ রঙা শার্টটা বের করে বিছানায় রেখে পান্জাবী খুলতে শুরু করেও আবার থেমে যায়। আড়চোখে রূপকথার দিকে চেয়ে দেখতে পায় সে একমনে খেয়েই যাচ্ছে। অন্য দিকে তাকানোর মতো সময়ই যেন নেই তার কাছে। তবুও যদি হূট করে তাকিয়ে দেখে নেয়? ছি ছি! মানসম্মান আর কিছুই থাকবে না।
শার্টটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই ডেকে ওঠে রূপকথা, “কি হলো? বাইরে যাচ্ছো কেন?”
“পোশাক বদলাবো আমি। যদি তুমি আবার লজ্জা পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করো তাহলে তো বউয়ের সামনে পোশাক বদলানোর অপরাধে গ্রামের মানুষের কাছে গণপিটুনি খেতে হবে আমাকে। তাই রিস্ক নেওয়া যাবেনা, আমি বাইরে থেকে বদলে আসি।”
এবার যেন তাকে হ্যনস্তা করার জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায় রূপকথা। দ্রুত হাত ধুয়ে পেছনে ফিরে হাসিমুখে বলে, “না না, আমি একদমই লজ্জা পাবো না। তুমি পোশাক বদলে ফেলো, কোনো সমস্যা নেই। তুমি তো আমারই স্বামী তাই না? স্বামীর সামনে লজ্জা কীসের?”
থতমত খেয়ে যায় আরজান। বলে কী এই মেয়ে?
রূপকথা পুনরায় বলে ওঠে, “কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলে যে? পান্জাবী খোলো।”
“না থাক, আমি বরং বাইরেই যাই। প্রথম দিনেই বউয়ের সামনে পোশাক বদলানো মোটেও ভালো কথা নয়। এটা প্রচুর নির্লজ্জতার উদাহরণ।”
কথা সম্পূর্ণ করে দরজার দিকে পা বাড়াতেই পুনরায় ডেকে ওঠে রূপকথা। ভ্রু কুচকে শুধায়, “তখন কী যেন বলছিলে তুমি?”
“কই না তো।” এক পা দু’পা করে দরজার দিকে পেছাতে থাকে আরজান।
“নির্লজ্জতা গর্বিত হওয়ার মতো অপবাদ, তাই না?” তার দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রূপকথা।
“ওটা তো তোমাকে রাগানোর জন্য বলেছিলাম। আমি একদমই অমন নই, বিশ্বাস করো।” জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে আরজান।
রূপকথা দু’পা এগিয়ে আসতেই এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় সে। বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বিয়ে করে অজান্তেই নিজের ইজ্জত লুটার অনুমতি দিয়ে ফেলেছে সে। এখন থেকে একটু সাবধানেই থাকতে হবে। না হলে তার এতোদিনে অর্জন করা সব ইজ্জত এই মেয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেবে। আরেকটু হলেই মানসম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে দিতো রূপ! সে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে পান্জাবী খুলতে শুরু করে।
অপরদিকে দরজার ওপারে তাকে হ্যনস্তা করতে পেরে ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে হেসে চলেছে রূপকথা। সকাল থেকেই খুব জ্বালাচ্ছিল লোকটা। রাগি, একঘেয়ে লোকটার গোমড়া মুখের পেছনে এই রূপ যেন বড় অচেনা! ম্যাজিশিয়ান কি লক্ষ্য করেছে সে নিজের উপর বিছিয়ে রাখা শক্ত আবরন ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে?
কিছুক্ষণ আগের কথা মনে করে পুনরায় ঠোঁট চেপে হেসে ওঠে সে। এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে আরজান। রূপকথাকে ঠোঁট চেপে হাসতে দেখে আপনা-আপনি তার ভ্রু যুগল কুচকে যায়। সন্দিহান চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এই হাসির কারন। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায় রূপকথার দিকে। শুধায়, “হাসছো কেন? সমুদ্রে যাওয়ার লটারি লেগে গেছে নাকি?”
চোছ-মুখ কুচকে তাকায় রূপকথা। এই লোকের চিন্তা-ভাবনা সবসময় এতো বাজে হয় কেন? তাকে এভাবে তাকাতে দেখে আরো কিছুটা এগিয়ে আসে আরজান। আচমকা চোখদুটো বড়বড় করে শুধায়, “আবার এভাবে তাকিয়েছো? নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে।”
“ধুর! সরো তো।” বিরক্তির শ্বাস ছাড়ে রূপকথা। ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। অনেকটা সময় সে পানি থেকে দূরে রয়েছে। এখন তার পানি প্রয়োজন।
পেছন থেকে চিল্লিয়ে ওঠে আরজান, “বিয়ে হতে না হতেই স্বামীকে সহ্য করতে পারছো না। নতুন নতুন বিয়ে হলে জামাই-বউ কাছাকাছি থাকতে হয়। মোহব্বত বাড়ে বুঝেছো?”
চকিতে তাকায় রূপকথা। কানের কাছে যেন বেজে উঠছে সেই ভ্যানচালকের বলা কথাটা “আপনেরা কি জামাই-বউ?”
তখন সে মিথ্যা বললেও এখন সেটাই সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে। আরজানকে চেয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে। পুকুর পাড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পানির বুকে।
তাকে আর বিরক্ত করে না আরজান। তার নিজেরও কিছু কাজ আছে। তবে রূপকথার সাথে স্বাভাবিক হওয়াটাও জরুরি নতুবা তার মা ঠিকই ধরে ফেলবে।
ঘরে গিয়ে জাদুর সরঞ্জাম হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
পুকুরের কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় পানি একদম স্বাভাবিক। রূপকথা কোথাও নেই কিন্তু সে ঠিকই জানে রূপকথা পানির নিচেই আছে। তাই তাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলে, “আমি বাইরে যাচ্ছি রূপ। দড়জাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিও। মা আসলে আবার খুলে দিও আর উল্টা-পাল্টা কিছু করে ঘেঁটে দিও না সবকিছু।”
তার কথা শেষ হতেই পুকুরের মাঝ বরাবর পানি খলবলিয়ে ওঠে। রূপকথা শুনতে পেয়েছে বুঝতে পেরে চলে যায় আরজান। রাস্তা থেকে ভ্যান ডেকে উঠে পড়ে সেটাতে, উদ্দেশ্য পুলিশ স্টেশন। এতো এতো চুরি-ডাকাতি, খুনোখুনি অথচ পুলিশের কোনো হালচাল নেই বিষয়টা অবাক করার মতোই। এতোগুলো ডাকাতির ঘটনা ঘটে গেছে গত দশটা বছর ধরে। পুলিশের কানে খবর যায়নি এমন তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে এর ভেতর। ভাবনার মাঝেই ভ্যান এসে থামে পুলিশ স্টেশনের সামনে। ইট দিয়ে গেথে উপরে টিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই থানা। অলোকপুর গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে এই পুলিশ স্টেশন কিন্তু অলোকপুরের দায়িত্ব তাদেরই। এই থানার আয়ত্তে অলোকপুরসহ আরো কিছু গ্রাম রয়েছে। তবে আগে কখনো আসা হয়নি এখানে।
সে ভেতরে ঢুকতেই হাবিলদার এগিয়ে এসে বলে, “কেডা আপনে?”
“আমি অলোকপুর গ্রাম থেকে এসেছি। এখানে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার কোথায়? কাউকে তো দেখছি না।” শুধায় আরজান।
লোকটা পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধীরে সুস্থে তাতে আগুন ছোঁয়ায়। অতঃপর সিগারেটে দুটো টান দিয়ে বলে ওঠে, “কী সমেস্যা? আমারে কন, স্যার শহরে গেছে ম্যাডামরে নিয়া জামা-কাপড় কিনবার লিগা।।”
“ওহ, ছুটিতে গিয়েছে?”
খেঁকিয়ে ওঠে লোকটা, “এই ছোড়া তরে জবাব দিবার লিগা মাইনে পাইনে আমি। কেচ লিখবার আইলে সমেস্যা কইয়া ফালা। মাতাডা খাইস না বকবক কইরা।”
এতোক্ষন শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আরজান যেন মুহুর্তেই বদলে যায়। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখদুটো বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে কিন্তু লোকটার কর্মকাণ্ডে কতক্ষণ মাথা ঠান্ডা রাখতে সক্ষম হবে তা তার অজানা। এটা ঝামেলা করার জায়গা নয়, ঝামেলা চোকানোর জায়গা। লোকটা সমানে তার সামনে সিগারেট টেনে চলেছে। লোকটা পুনরায় বলে, “সমেস্যা কইবি নাকি ধাক্কা মাইরা বাইর কইরা দিমু?”
আরজান প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখেই সে বলে, “ঠিক আছে, লিখুন। অলোকপুর গ্রামে ডাকাতি হচ্ছে সবার ঘরে ঘরে। ডাকাতরা যেন ঘাঁটি গেড়ে বসেছে একদম। একের পর এক ডাকাতি হচ্ছে গত দশটা বছর ধরে। শুধু ডাকাতি করেই থেমে নেই তারা, প্রয়োজনে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করে না। আশা করি আপনারা এর তদন্ত শীঘ্রই শুরু করবেন।”
সব শুনে আরাম করে চেয়ার টেনে বসে লোকটা। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, “আমরা কী করমু না করমু হেইডা তর ভাবতে হইব না। শুইনা লইছি, এখন যা।”
“কিন্তু এখনই এর সুরহা করা দরকার। গ্রামের মাঝে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তারা। সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে তাদেরই জিনিসপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে। চেষ্টা করবেন একটু দ্রুত তদন্ত করতে।” উত্তেজিত স্বরে বলে আরজান।
“তরে যাইতে কইছি না? গেরামে কোনো ডাকাইত নাই। যা এখন, আমাগো আরো ম্যালা কাম আছে।”
এবার যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সাধ্যের বাইরে চলে যায় আরজানের। চোখদুটো নিমেষেই লালবর্ণ ধারন করেছে। রাগে হনহন করে এগিয়ে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার চেয়ারে লাথি মারে। বুঝে উঠার আগেই হাবিলদার ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে। রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু করার পূর্বেই চেয়ার তুলে ছুড়ে মারে আরজান। চেয়ারের ধাক্কায় পুনরায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লোকটা। চেয়ারের কোনা লেগে শরীরের কিছু জায়গায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে ক্ষতস্থান থেকে। ইতিমধ্যে সে অনেকটাই আহত হয়ে পড়েছে তবুও উঠার চেষ্টা করতেই তেড়ে গিয়ে গলা চেপে ধরে আরজান। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, “শা’লা জানো’য়ার, এমন ব্যবহারই করিস গ্রামের লোকগুলোর সাথে? ভেবেছিস আমাকেও উল্টা-পাল্টা বলে তাড়িয়ে দিবি? গ্রামে আর একটাও ডাকাতি হলে তোকে প্রাণে মে*রে দেবো, হারা’মখোর।”
হাবিলদার কোনোমতে গলা থেকে তার হাত ছাড়িয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। কাশতে কাশতে বলে ওঠে, “তুই জানস না আইনের মাইনসের গতরে হাত দিবার শাস্তি। তরে জেলের ভিতরে ঢুকাইয়া,,,,,”
এবার যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে তার বলা কথাগুলো। কথা সম্পূর্ণ করার আগেই কিছুক্ষণ আগে মাটিতে গড়িয়ে পড়া সিগারেটের টুকরোটা হাতে তুলে নেয় আরজান। তা নজরে আসতে না আসতেই ততক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায় হাবিলদারের কথা। তার মস্তিষ্ক বলছে এই জলন্ত সিগারেট তার শরীরেই চেপে ধরা হবে। ভাবতে না ভাবতেই এক ঝটকায় সেটা তার মুখ বরাবর উঠিয়ে আনে আরজান। আসন্ন বিপদ চোখের সামনে দেখে চিৎকার করে ওঠে লোকটা। দু’হাতে যথাসম্ভব ঢেকে নেয় নিজের মুখমণ্ডল। অবশ্য তাতে খুব একটা লাভ হয় না, মুখের একাংশ বাইরেই রয়ে গেছে।
সিগারেটটা হাতে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে আরজান, “শাস্তি দিবি? জেলে ঢুকাবি? তাহলে তোকে খুন করে একবারেই জেলে যাই, কি বলিস? শা’লা চাকরি কি তোকে সিগারেট টানার জন্য দিয়েছে? কাজের কাজ তো করিস না আবার সাধারন মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করিস? ইচ্ছা তো করছে এটা তোর গ’লায় চেপে ধরে একেবারের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেই।”
এতোগুলো কথা বলার পরেও টু শব্দটা পর্যন্ত করে না হাবিলদার। এতক্ষণে হয়তো উপলব্ধি করে নিয়েছে যে সে ভুল শামুকে পা কেটেছে। এই ক্ষত সহজে মেটার নয়। অন্যদিকে আরজানের রাগ যেন সপ্তম আসমান ছুঁয়েছে। সে পুনরায় রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “গ্রামে এতো চুরি-ডাকাতি, খু’ন-খারাবি চোখে বাঁধে না তোদের তাই না? তোর স্যার আবার যায় শহরে শপিং করতে! এক মাস, ঠিক এক মাসের মধ্যে ডাকাতদল শনাক্ত করে জেলে ঢুকাতে না পারলে তোদের মেরে অলোকপুর বাজারে টাঙিয়ে দেবো আমি।”
সিগারেট ছুড়ে ফেলে বড়বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় সে। শার্টের হাতা টেনেটুনে ঠিক করতে করতে নিজেই বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে, “শা’লার কপালটাই খারাপ। যখনি ভালো হতে চাই তখনই এই নমুনাগুলো চোখের সামনে চলে আসে।”
সোজা ভ্যান নিয়ে মেলার মাঠে চলে আসে সে। জাদুর সরঞ্জাম হাতে নিয়ে মেলার মাঠে প্রবেশ করতেই পলাশের দেখা পায়। কিছুক্ষণ আগেও রাগে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটার মনের আকাশে যেন মুহূর্তেই রাগ সরে গিয়ে শয়’তানি ভর করে। বাঁকা হেসে এগিয়ে যায় তার দিকে। ধীর পায়ে পলাশের পেছন এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে ডেকে ওঠে, “শা’লাবাবু”
পলাশ রাগে গজগজ করতে করতে পেছনে ফিরে তাকাতেই মিইয়ে যায় তার রাগ। একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে চোখে-মুখে। এক ঝটকায় কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে দিতেই আরজান বলে ওঠে, “আহা! শা’লাবাবু, রাগ কেন দুলাভাইয়ের সাথে?”
তেতে ওঠে পলাশ। তেড়ে এসে বলে, “এই খবরদার কইতাছি আমারে শা’লা কইবি না। মাতাডা গরম আছে কইয়া দিলাম।”
“ওহ, এই কথা? কী হয়েছে শা’লাবাবু? মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করবো?” ভাবুক স্বরে জবাব দেয় আরজান।
বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে পলাশ। হটাৎ করে এই লোকটার এতো পরিবর্তন মেনে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। আগে তো তারে দেখবার পারলেই মুখটা গম্ভীর বানাইয়া উপেক্ষা কইরা চইলা যাইত। বিয়ে হইতে না হইতেই লোকটার যেন আগা-গোড়ায় বদলাইয়া গেছে। সে খানিক বিরক্ত স্বরে বলে, “তুই তর কাম কর যা। আমারে নিয়া এতো ভাবতে হইব না।”
“তা কী করে হয়? তুমি আমার দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র শা’লাবাবু। আমাকে বলে তো দেখো, হতে পারে আমিও তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি।”
এবার কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায় পলাশ। ঐদিন মেলায় তো এই লোকটাও আছিলো। হইতেই পারে যে সে কিছু দেখবার পারছে। এবার সে কিছুটা ধীর স্বরেই বলে, “ঐদিন তো তুইও আছিলি মেলায়। আমারে কি হাচায় ভূতে মারতাছিলো? তুই কিছু দেখছিলি নি?”
চমকে উঠে কিছুটা দূরে সরে যায় আরজান। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকায়। অতঃপর পলাশের একদম কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, “এই কথা আর মনে করিয়ো না শা’লাবাবু। সেইদিনের ভয়ে তো আমি দুইদিন গোসলই করতে পারিনি।”
“ভূতের সাথে গোসলের কী সমেস্যা?” রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পলাশ।
“আরে আগে শোনো তো। ঐদিন মেলা শেষে আমি ভদ্র ছেলের মতোই চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু জাদুর একটা সরঞ্জাম ভুল করে রেখে গিয়েছিলাম। তাই আবার ওটা নিতে ফেরত এসে দেখি একটা ধবধবে সাদা আলখাল্লা পড়া লোক হাতে লাঠি নিয়ে সমানে তোমাকে পিটিয়ে চলেছে। কী বড়বড় তার চোখদুটো! আর বিশাল বড়বড় দাঁত! লাল টকটক করছিলো চোখগুলো! আমিতো ভয়েই লুকিয়ে পড়েছিলাম! পড়ে লোকজনের ভূত ভূত করে পালাতে দেখে পালিয়ে গিয়েছিলাম ওদের সাথে। জান হাতে নিয়ে পালিয়েছি একদম!”
ইতিমধ্যে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে পলাশের। মুখটা একদম চুপসে গেছে ভয়ে। এসব দেখে পেট ফেটে হাসি আসছে আরজানের। তবুও অনেক কষ্টে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে পুনরায় বলে ওঠে, “তোমার কি কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা আছে ভূতের সাথে? ভূতটা যে পরিমাণ রেগে ছিলো আমার তো এটাই মনে হয়েছে।”
পলাশ কাঁপা কাঁপা স্বরে শুধায়, “তুই সত্য কইতাছোস?”
“আবার জিগায়? হাজার হলেও তুমি আমার শা’লাবাবু। তোমাকে কী মিথ্যা কথা বলবো আমি? আমি তো বলবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বড় কোনো ওঝা বা তান্ত্রিকের কাছে যাওয়া উচিত। মানে যে পরিমাণ রেগে ছিলো ভূতটা, না জানি কখন আবার আবির্ভাব হয়ে যায়!” গুরুতর ভঙ্গিতে বলে আরজান।
এবার পলাশের মুখভঙ্গি যেন আরোও করুন হয়। ভীত মুখে ব্যস্ত পায়ে ত্যাগ করতে চায় মেলার মাঠ। পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে আরজান, “আরে আরে, কোথায় চললে? আরেহ ওওওও শা’লাবাবু?”
চলবে,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_16
আকাশের বুক থেকে সূর্য মুছে গিয়ে আবির্ভাব হয়েছে এক ঝলসানো সুন্দরীর। সোজা ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে ‘চাঁদ’ আর ছোটদের ভাষায় ‘চাঁদ মামা’। যার রূপে মুগ্ধ হয়ে হাজারো কবি-সাহিত্যিক কতোই না কাব্য রচনা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। কতশত প্রেমিক যুগল তার আলোয় প্রেম জমিয়েছে। পৃথিবীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত সমস্ত নারী হয়তো নিজের একাকিত্ব ঘোচাতে এই চাঁদের সান্নিধ্যই বেছে নিয়েছে। হাজার প্রেমিক পুরুষের নিজের প্রিয়তমাকে ভেবে মুচকি হাসির সাক্ষী থেকেছে এই রূপবতী। একাধারে কবি-সাহিত্যিক, একলা পথিক, অবুজ শিশু, প্রেমিক-প্রেমিকা সকলের হৃদয়ে সে নিজের স্থান তৈরি করে নিয়েছে। তার বর্ণণা যেন শেষ হওয়ার নয়!
গ্রামের রাস্তা ধরে জাদুর সরঞ্জাম হাতে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে আরজান।শেষ সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় স্পষ্ট সবকিছু নজরে না আসলেও পথ চলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। পরিষ্কারভাবে কোনো কিছু তো দেখা যাচ্ছেই না উল্টো স্বল্প আলোতে আরো ভয়ঙ্কর লাগছে সবকিছু। রাস্তার দুই ধারে অবস্থিত বিশাল বিশাল গাছগুলোর অবয়বও যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এই আঁধারে। এই গ্রামে সন্ধ্যার পর মানুষজন খুব একটা বাইরে দেখা যায় না। যার একমাত্র কারন ডাকাতদল। তবে এখনো স্বল্প কয়েক মানুষ হয়তো বাইরে আছে। যার দরুন কিছু সময় পরপর রাস্তায় দুয়েকজনের দেখা মিলছে। কিন্তু এসবে তার ধ্যান দেওয়ার সময় কই? যত দ্রুত সম্ভব এখন তাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
সারাদিনের হাজার ব্যস্ততায় সে বেমালুম ভুলে বসেছিল যে বাড়িতে কেউ তার অপেক্ষায় আছে। তার উপর আজ সম্পূর্ণ নতুন দু’জন মানুষের আসার কথা বাড়িতে। কোনো না কোনো ঝামেলা যে আজ বাঁধবেই তার ইঙ্গিত সে আগেই পেয়েছে। রূপকথা কি পারবে সবকিছু সামলে নিতে? নাকি ঘেঁটে দিয়েছে সবকিছু?
জাদু দেখানো শেষ করে সে একটু বাজারে গিয়েছিল কিছু কিনতে। যার কারনে এতো দেরি হয়ে গেলো। ভ্যান পেলে তবুও কিছুটা সময় সঞ্চয় হতো কিন্তু তারও তো উপায় নেই। ডাকাতের ভয়ে যে যার বাড়িতে গিয়ে দরজায় খিল এঁটেছে বোধহয় আরো আগে। এখন একমাত্র উপায় হলো হেঁটে যাওয়া। অবশ্য তাতে অনেকটা সময় বেশি ব্যায় করতে হবে কিন্তু কিছুই করার নেই তাতে। সে আনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে, “মা এসে না জানি কী করছে?”
বেশ কিছুটা সময় হাঁটার পর সে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছে। এমন করে হাঁটার অভ্যাস নেই কতকাল। রাস্তাটাও যেন আজ মান করেছে তার সাথে। সুদীর্ঘ করে নিয়েছে নিজের আয়তন। অনেকটা সময় হাঁটার পর বাড়ির সীমানায় এসে দূর থেকেই নজরে আসে বিশাল এক জটলা। খানিক অবাক হয় সে, এতো মানুষ তার বাড়ির সামনে কী করছে এই সময়ে! যত এগোচ্ছে তত একাধিক মানুষের কথোপকথন শ্রবণগোচর হচ্ছে। এখানো যেন এক আকাশসম অবাক হওয়া বাকি ছিল তার। ভীর ঠেলেঠুলে জটলা ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই সামনের দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। এতোক্ষনে সে উপলব্ধি করে অনেক বেশিই দেরি করে ফেলেছে সে। কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা আর তার মা তাকে টেনেটুনে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করছে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে লামিয়া। গ্রামবাসীরা এটা নিয়েই জটলা পাঁকিয়ে হৈ-হট্টগোল করছে।
কেউ বলছে, “এই মাইয়া কেডা তুমি সত্য কইরা কও?”
কেউ আবার রাগান্বিত স্বরে বলে বলছে, “চুরি করবার লিগা আইছিলি ছেড়ি?”
তখনই শ্রবণগোচর হয় একজন বয়স্ক মহিলা তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “মাইয়া তো কইতাছে সে তোমার পোলার বউ। আগে পোলা আইসা নেক এরপর নাহয় ফয়সালা কইরো।”
উত্তরে সোফিয়া শিকদার রাগান্বিত স্বরে বলে, “কীসের ছেলের বউ? আমর ছেলে যেখানে সংসার করতেই ভয় পায় বাবার মৃত্যুর পর থেকে সেখানে এই শ্যামবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করে নিজের কপাল পোড়াবে? ছেলে কি কম সুন্দর আমার? এই মেয়ে মিথ্যা কথা বলছে।”
পুরুষ মানুষের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যাই এখানে অত্যধিক। জনাকয়েক পুরুষ কিছুটা দূরে থেকেই এসব পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। হটাৎ লামিয়া রেগেমেগে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে রূপকথাকে ধাক্কা মেরে দেয় বাইরের দিকে। উদ্দেশ্য তাকে বাড়ির বাহির করা। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ার আগেই ছুটে এসে তাকে নিজের বাহুতে আগলে নেয় আরজান। চেনা মানুষটার শরীরের ঘ্রানে টলমলে দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরে তাকায় রূপকথা। তার বাহুতে মিশে থেকেই মাথা উঁচু করে একপলক দেখে নেয় মানুষটার মুখভঙ্গি। পানিতে টইটম্বুর তার আঁখিজোরা। এতোক্ষন সেই পানি নিয়ন্ত্রণ করলেও চেনা মানুষটার সঙ্গ পেয়ে মুহূর্তেই তা গড়িয়ে পড়ে কোটর ছেড়ে। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে আরজান। কিছু সময়ের ব্যবধানেই মেয়েটার চোখ-মুখের এ কী অবস্থা হয়েছে! রূপকথার চলাফেরার সুবিধার্থেই বাড়ির সব জায়গাতে লাইট লাগিয়েছিল সে আর সেই লাইটের আলোতে তার-ই ভেজা চোখ দেখতে হচ্ছে অথচ এখানে সম্পূর্ণ দোষটা শুধু তার একার। তার ভুলের জন্যই মেয়েটাকে সহ্য করতে হচ্ছে এসব। দু’আঙুলের সাহায্যে বেয়ে পড়া অশ্রুটুকু আলতো করে মুছে দিয়ে ধীর স্বরে শুধায়, “ব্যথা পেয়েছো রূপ?”
সঙ্গে সঙ্গেই ডানে-বামে মাথা নাড়ায় রূপকথা। কিন্তু তার ভেজা চোখজোড়া যেন অন্য কিছুই সাক্ষী দিচ্ছে। সে আরো কিছু বলার আগেই হনহন করে এগিয়ে আসে সোফিয়া শিকদার। রাগান্বিত স্বরে চিৎকার করে বলে, “এই মেয়ে, ছাড় বলছি আমার ছেলেকে।”
আরজন অবাক হয়ে তার মায়ের ব্যবহারগুলো দেখে যাচ্ছে। তার মা তো কখনোই এমন ছিল না! সে এতটাই স্তব্ধ যে কথা বলার ভাষাটাই যেন হারিয়ে বসেছে! মাকে কী বলা উচিত তা তার জানা নেই। তখনই সোফিয়া শিকদার পুনরায় বলে ওঠে, “তুইও কি হুঁশ-জ্ঞান সব হারিয়ে বসেছিস আরজান? মেয়েটাকে বাড়ির বাইরে দিয়ে আয়। চুরি-চামারি করতে এসেছিল বোধহয়!”
মায়ের কথায় রূপকথার দিকে ফিরে তাকায় আরজান। তার চুপসে যাওয়া মুখশ্রীর পানে চেয়ে যতটা সম্ভব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার কোমল হাতটা। অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে রূপকথা। অবাক চোখে কখনো দু’জনের বদ্ধ হাতের দিকে তাকাচ্ছে তো আবার কখনো তার মুখের পানে তাকিয়ে মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে। এমন একটা পরিস্থিতিতেও মেয়েটার এসব হাবভাব দেখে অনেকটাই বিরক্ত হয়ে ওঠে আরজান। কিছুটা ঝুঁকে এসে কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে ফিসফিসিয়ে বলে, “বোকার মতো তাকিয়ো না, হাসি আসে আমার।”
আচমকা কথাটা শ্রবণগোচর হতেই কান্নাকাটি সব ফেলে চোখ বড়বড় করে তাকায় রূপকথা। সে বেফাঁস কিছু বলার পূর্বেই আরজান তড়িঘড়ি করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “আমি হুঁশ-জ্ঞান হারায়নি মা। ও আমার বিবাহিতা স্ত্রী আর আমি সজ্ঞানে, সেচ্ছাই ওকে বিয়ে করেছি।”
এতো এতো হৈ-হট্টগোলের মাঝে তার বলা একটা বাক্য যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত হানে। সকলের কথপোকথন, চেঁচামেচি সবকিছু এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তবে বেশিক্ষণ সেই নীরবতা বজায় থাকে না বরং কিছু মুহূর্তের মাঝেই আরোও উত্তেজিত হয়ে ওঠে সকলে। তাদের মনের মাঝে তৈরি হওয়া প্রশ্নের জবাব পেলেও তাদের কৌতূহল বিন্দুমাত্র দমে না বরং পরবর্তী কাহিনী দেখার আশায় সকলে উঁকি-ঝুঁকি মারছে তাদের দিকে। আরজানও কী ভেবে থামায় না তাদের। এতোকিছু যখন দেখে নিয়েইছে তাহলে বাকি ঘটনারও সাক্ষী থাকুক তারা। কিয়ৎ দূরে দাঁড়ানো লামিয়ার মাথায় যেন হুট করে সম্পূর্ণ আকাশটাই একসাথে ভেঙে পড়েছে। তার থমকানো দৃষ্টি উপেক্ষা করে মায়ের দিকে ফিরে তাকায় আরজান। সোফিয়া শিকদারের আশ্চর্যের সীমা যেন অতিক্রম করে ফেলেছে এই বাক্য। সে হতবাক নয়নে চেয়ে শুধায়, “বিয়ে করবি না বলে এতোবড় একটা মিথ্যা কথা বলতে পারছিস তুই?”
“আমার বলা একটা বাক্যও মিথ্যা নয় মা আর এমন একটা পরিস্থিতিতে তো মিথ্যা বলার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। গ্রামের চেয়ারম্যান, তার বউ-ছেলে, চায়ের দোকানি, কাজী সাহেবসহ সবাইকে সাক্ষী রেখেই বিয়ে করেছি আমরা। প্রয়োজনে তুমি খোঁজ নিতে পারো।” স্বাভাবিক কন্ঠে বলে ওঠে আরজান।
এবার খানিক দমে যায় সোফিয়া শিকদার। তার ছেলে এমনিতেও মিথ্যা কথা বলে না। তার উপর এমন গুরুতর বিষয়ে মিথ্যা বলার মানুষ তো সে একদমই নয়। তবুও সে শেষ আশাটুকু বজায় রেখে বলে ওঠে, “প্রমাণ চাই আমি, আশা করি প্রমাণ দিতে তোর কোনো সমস্যা নেই?”
বাকা হাসে আরজান, সে জানতো এমন কিছু হবে। তার মা যে সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয় সে কথা তার চেয়ে ভালো আর কে জানবে। তাই এর ব্যবস্থা সে আগেই করে রেখেছে। এই বিষয়টা মাথায় রেখে বিয়ের পড়েই সুকৌশলে পলাশকে দিয়ে তাদের দু’জনের একত্রে কিছু ছবি উঠিয়ে রেখেছে। এতে তার উদ্দেশ্য ছিল দুইটা। এক তো দেখানোর মতো প্রমাণ সংরক্ষণ আর দুই হচ্ছে পলাশকে জ্বালানো। তবে বেশ কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে তাকে। পলাশ তো পণ করে বসেছিল সে ছবি তুলবে না তো তুলবেই না। অবশেষে আকরাম মিঞার ধমক শুনে বাধ্য হয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছে। তার ভাবনার মাঝেই ছুটে আসে লামিয়া। বিদ্রুপ করে বলে, “কই দে প্রমাণ? দিচ্ছিস না কেন? দিবি কীভাবে? প্রমাণ থাকলে তো দিবি। আমাকে তোর পছন্দ না বেশ মানলাম, তা বলে তুই এমন একটা নাটক সাজাবি?”
তার কথায় খুব একটা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য হয় না আরজানের ভেতর। সে ধীরে সুস্থে নিজের মতো করে পকেটে হাত গলিয়ে মোবাইলটা বের করে আনে। কিছুক্ষণ মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে ছবিগুলো বের করে মায়ের দিকে এগিয়ে দেয়। সোফিয়া শিকদার একঝলক দেখতে না দেখতেই খপ করে মোবাইলটা নিয়ে নেয় লামিয়া। লাল গাউন পরিহিতা নারীটি পাশে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে হাসিমুখে বসে আছে আরজান। মেয়েটার মাথা থেকে শরীর পর্যন্ত সোনালি বর্ণের বিশাল ওরনা পেঁচানো। হাতভর্তি চুড়ি ছাড়া সাজসজ্জা নেই বললেই চলে তবে তার মেহেদী রাঙা হাতটা একটু বেশিই নজর কাড়ছে। পরের ছবিতে তাদের সাথে আরো চারজনকে দেখা যাচ্ছে। দু’জন বয়স্ক পুরুষ তার মধ্যে একজনের হাতে খাতা-কলম, চোখে চশমা আর ভাবভঙ্গিমাই বলে দিচ্ছে সেই হচ্ছে কাজী, অন্যজন হয়তো আরজানের বলা সেই চেয়ারম্যান। পাশেই লুঙ্গি আর পান্জাবী পড়া একজন কমবয়সী লোক। মেয়েটার শরীরের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে আরো একজন মহিলা। তার পড়নে তুলনামূলক দামি শাড়ি। গ্রামের মহিলারা এসব খুব কমই পড়ে, নিতান্তই টাকা-পয়সাওয়ালারা এসব পড়ে। তারমানে ইনি হলেন চেয়ারম্যানের স্ত্রী যার কথা কিছুক্ষণ আগে আরজান বললো।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটা ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সে। লক্ষ্য একটাই, ছবিতে কোনো ত্রুটি বের করা। কিন্তু নাহ, এই ছবি নিখুঁতভাবে পরিপূর্ণ। যে কেউ দেখে বুঝে নেবে ছবিতে থাকা দু’জন নর-নারী কোনো সদ্যবিবাহিত দম্পতি। কোনো ত্রুটি না পেয়ে রাগে চোখ-মুখের রং-ই বদলে গেছে তার। গজগজ করতে করতে মোবাইলটা ছুড়ে ফেলতে নিলেই টান দিয়ে কেড়ে নেই আরজান। অতঃপর বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে, “আমার মোবাইল নষ্ট করবি ভালো কথা কিন্তু আমার বিয়ের ছবিগুলো নষ্ট করিস না বোন। শেষে ছবি তোলার জন্য আবার বিয়ে করা লাগবে। কত খরচ জানিস? আরেকবার বিয়ে করতে গেলে আমার বাপ-দাদার সব সম্পত্তি শেষ হয়ে যাবে। আর আমি ফকির হয়ে গেলে আমার বউও থাকবে না।” তার কথাগুলো রসিকতা মনে হলেও তার মুখভঙ্গি অত্যন্ত গুরুতর। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে তার শক্ত দৃষ্টি।
মোবাইল ভাঙতে না পেরে আরো ক্ষেপে ওঠে লামিয়া। ছোট থেকে তার একটাই স্বভাব, কোনো জিনিস তার চায় মানে চায়-ই। এক কথায় যাকে বলে প্রচন্ড জেদী ও একরোখা। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় দরুন তার সমস্ত আবদার হাসিমুখে মেনে নিয়েছে তার বাবা-মা। হাজারটা অন্যায় আবদারও বাধ্য হয়ে পূরণ করেছে তারা। হাজারখানেক সাজ-সজ্জার প্রসাধনী সারাদিন মাখামাখি করা আর রাত-বিরাতে বন্ধুদের সাথে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানোই তার দৈনন্দিন কাজ। মেয়ে বন্ধুর তুলনায় ছেলে বন্ধুর সংখ্যায় বেশি।তাদের মধ্যে দুয়েকজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের খবরও পেয়েছে আরজান। সেখানেও সে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। মাকে পর্যন্ত জানায়নি শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে বলে। খালামণিকে জানিয়েছিল তবে তার থেকেও আশানুরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি সে। একমাত্র মেয়ে বলে তার অন্যায় মেনে মেনে তাকে মাথায় উঠানোতে খালামণির ভূমিকা ছিল উল্খেযোগ্য। এখন এমন একটা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে আরজানও তার কাছে জেদের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যে কোনো মূল্যে সে তাকে আদায় করতে চাইবে। আরজানের কাছে হাজারটা কারন আছে তাকে অপছন্দ করার কিন্তু সম্পর্কে বোন বলেই হয়তো সে নিশ্চুপ এ ব্যাপারে। শুধু আরজানের মায়ের কাছেই সে ধোঁয়া তুলসীপাতা। হয়তো বোনের একমাত্র মেয়ে বা এসব সম্পর্কে সে খুব একটা অবগত নয় বলেই নিজের ছেলের বউ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। জেদ সম্পর্কে খানিকটা অবগত থাকলেও লামিয়ার অবাধ চলাফেরা সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই তার।
এর মধ্যে আবার লামিয়া রাগে গজগজ করতে করতে রূপকথার দিকে তেড়ে যেতে নিলেই রূপকথার সামনে এসে দাঁড়ায় আরজান। রূপকথাকে না পেয়ে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আরজানের শার্ট টেনে ধরে সে। চিৎকার করে বলে, “আমি মানি না এই বিয়ে। সব মিথ্যা, এই ছবিগুলোও মিথ্যা। তোকে নিয়ে যত স্বপ্ন দেখেছি আমি তা পূরণ করতে যা যা করতে হয় আমি করবো। বুঝেছিস তুই?”
কথাগুলো বলতে বলতে পূর্বের তুলনায় অত্যাধিক উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সে। সোফিয়া শিকদার দৌড়ে এসে নিজের বুকে আগলে নেয় তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “এমন করে না মা। আমরা ঘরে বসে আলোচনা করে কিছু একটা সমাধান করবো। তুই একটু শান্ত হ।”
পুনরায় চেঁচিয়ে ওঠে লামিয়া, “কীভাবে শান্ত হবো আমি? তুমি এই মেয়েটাকে তাড়িয়ে দাও এক্ষুনি। সব দোষ এই কা’লনাগি’নীর। না আছে এক আনা রূপ আর না আছে শরীরের কোনো বর্ণ। তবুও পুরুষ বস করতে পারদর্শী একেবারে নাহলে কি আর আরজানের মতো মানুষের মাথা খেতে পারতো? বের করে দাও, ওকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
এমন একটা অনুচিত আবদারেও বোধহয় চোখ খোলে না সোফিয়া শিকদারের। বোনের মেয়ের আবদার মেটাতে হয়তো এই অনুচিত কাজটা করতেও পিছপা হবে না সে। লামিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রূপকথার দিকে ফিরে তাকায় সে। তবে মেয়েটার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলে। ছেলের শক্ত মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে এই বিষয়ে সে এক বিন্দু ছাড় দেবে না। উপায় না পেয়ে লামিয়াকে বোঝাতে বোঝাতে ঘরে টেনে নিয়ে যায় সে। শেষ মাথার ঘরটাতে সে সবসময় এসে থাকে। এই ঘরেই সে শেষবারের মত স্বামীর সাথে সময় কাটিয়েছে। পাশের ঘরটাতে লামিয়ার থাকবার ব্যবস্থা করেছে। মাঝের ঘরটাতে আরজান থাকতো তাই সে ঘরে সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ধীরে ধীরে জটলা কমতে শুরু করেছে বাড়ির সামনে থেকে। একে একে সকলেই ফিরে যায় নিজের বাড়ি। আরজান স্বস্তির শ্বাস ফেলে ফিরে তাকায় রূপকথার দিকে। রূপকথাকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে, “এতোক্ষন তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিলে, এখন আবার এভাবে চেয়ে আছো কেন? ছিঁচকাদুনি কোথাকার।”
রূপকথার কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলে ওঠে, “শোনো মেয়ে, যার তার কথায় একদম চোখের পানি ঝরাবে না। প্রিয়জনের জন্যও কিছু বাঁচিয়ে রেখো।”
অবাক চোখে তাকায় রূপকথা। প্রিয়জন! শব্দটা বড় কঠিন লাগে তার কাছে। এই শব্দের মর্মার্থ বুঝতে হয়তো কয়েক যুগ পেরিয়ে যাবে তার।
ভাবনা ছেড়ে সে কিছু বলার পূর্বেই আরজান ভ্রু কুচকে বলে ওঠে, “আবার এভাবে বোকার মতো তাকিয়েছো?”
“সবসময় আমাকে অপমান করবেনা বলে দিচ্ছি।” ঝাঁঝালো স্বরে কথাটা বলে রূপকথা। রাগ দেখাতে চাইলেও যেন পেরে উঠছে না সে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তর। এতোক্ষনের টানাটানিতে হাতটা তো ফুলে লাল হয়েছেই সেই সাথে পায়েও বিভিন্ন স্থানে কাঁটা-ছেড়া। হয়তো টানাটানির মধ্যে কিছুতে লেগে এভাবে কেটে গিয়েছে। তবুও সেই ব্যথা এখন আপাতত দেখাতে চাইছে না সে।
কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে ব্যাপারখানা ধরতে পেরে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজান। আচমকা তাকে টেনে কোলে তুলে হাঁটতে শুরু করে। হটাৎ এমন হওয়াতে তাল সামলাতে তার শার্ট টেনে ধরে রূপকথা। কোনোমতে নিজেকে সামলে হতবাক দৃষ্টিতে আরজানের দিকে তাকাতেই সে বলে ওঠে, “যত দোষ কি আমার শার্টটা করেছে? সবাই আমার শার্টটাকে কেন অত্যাচার করছো? যাকে দেখছি সেই আমার শার্টের উপর হামলে পড়ছে!”
তেতে ওঠে রূপকথা। চোখ রাঙিয়ে বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? নামাও বলছি।”
“নিজের ব্যথা লুকিয়ে একদম নায়িকা সাবানা হওয়ার চেষ্টা করবেনা। সেলাই মেশিন কেনার টাকা নেই আমার। আর না তো জসিমের মতো লটারিওয়ালা ভাগ্য আমার! তাই একদম সাবানা হওয়ার প্রচেষ্টা করবে না।” সামনে তাকিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে বলে আরজান।
“কে বলেছে তোমাকে জসিম হতে?” বিরক্ত কন্ঠে শুধায় রূপকথা।
“তবে কি বাপ্পারাজ হতে বলছো?” চোখ-মুখ কুচকে শুধায় আরজান।
“কেন ভালো মানুষগুলোর পেছনে পড়লে বলোতো? তুমি ম্যাজিশিয়ান হয়েই যা করছো!”
“কী করেছি আমি হ্যাঁ? কী করেছি? শুধু একটা বিয়ে করেছি এই যা আর বিয়ে করা নিঃসন্দেহে গর্বের কাজ।” বুক ফুলিয়ে বলে আরজান।
বিরক্ত হয় রূপকথা। লোকটা তার সামনে আসলেই ভুলভাল বকতে শুরু করে। আসলে দোষটা তার নাকি ম্যাজিশিয়ানের? হটাৎ আরজান দাঁড়িয়ে পড়াতে ভাবনাচ্যুত হয় সে। সামনে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হতেই হয় তাকে। ম্যাজিশিয়ান তাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে এসেছে! কিন্তু কেন? এখন তো বাড়িতে সে একা নয় আরো দু’জন মানুষের উপস্থিতি রয়েছে। এখন পুকুরের ধারে-কাছেও আসা তার জন্য সঠিক নয়।
কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই তাকে নামিয়ে দিয়ে আরজান বলে ওঠে, “থাক, বলতে হবেনা, বুঝেছি আমি। এতো ভয় পাও কেন তুমি? আমি আছি না।”
কথাগুলো স্বাভাবিক হলেও যেন বেহিসেবি ভরসা লুকিয়ে আছে তার মাঝে। তার দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রূপকথা। ধীর স্বরে বলে, “কেউ দেখে নিলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
তাকে আশ্বস্ত করতেই যেন আরজান বলে ওঠে, “কিচ্ছু হবে না। তোমার ক্ষত ঠিক হওয়া প্রয়োজন। তুমি শুধু ভোর পর্যন্ত পানির নিচেই থাকবা, উপরে উঠবে না খবরদার। আমি এসে ডাকবো তারপর উঠবে, ঠিক আছে?”
উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় রূপকথা। ধীরে ধীরে সে পানিতে নেমে গেলেও দাঁড়িয়ে থাকে আরজান। তার দিকে একবার চেয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নেয় রূপকথা। পানিতে ঝুপ করে শ্বব্দ তুলে সে বিলীন হয়ে যায় পানির মাঝে। আরো কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে আরজান। কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও পানির অবস্থা স্বাভাবিক দেখে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ঘরের দিকে রওনা দেয় সে।
চলবে,,,,