#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_11
চোখ-মুখ কুচকে দু’হাতে নিজের হাঁটু চেপে ধরে মাটিতে বসে আছে রূপকথা। কয়েকবার ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজানের দিকে। অন্যদিকে তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আরজান। রূপকথার এমন দৃষ্টি দেখে বিস্মিত কন্ঠে বলে ওঠে, “আশ্চর্য! এভাবে তাকাচ্ছো কেন আমার দিকে? দৌড়াতে গিয়ে নিজে নিজে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছো অথচ এমনভাবে তাকিয়ে আছো যেন আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি!”
তার কথার কোনো প্রত্যুত্তর করে না রূপকথা। আরজানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে হাঁটু ছেড়ে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে। ব্যথার কারনে তাকে পা টেনে টেনে হাঁটতে হচ্ছে। যদিও কোথাও কেটে-কুটে যায়নি হয়তো তবুও অনেক বেশিই ব্যথা পেয়েছে সে। হয়তোবা চামড়াও ছিলে গিয়েছে। তার সহ্যশক্তি খুব বেশি নয় তবে এতটুকুতে কান্নাকাটি করে ভাসানোর মতো মেয়ে সে নয়। এভাবে পা টেনে টেনেই নিজে নিজে ঠিকই বাড়ি চলে যেতে পারবে কিন্তু এই লোকটার সাথে সে মোটেও কথা বলবে না। পেছন থেকে হাঁ করে চেয়ে আছে আরজান। মেয়েটা কি তাকে উপেক্ষা করছে? নাকি ভাব বেড়েছে হটাৎ?
তখনই রূপকথা পুনরায় ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে বসে পড়ে হাঁটু চেপে। ততক্ষণাৎ হুরমুর করে ছুটে আসে আরজান। রূপকথার সামনে বসে ব্যস্ত হয়ে শুধায়, “বেশি ব্যথা করছে?”
রূপকথা বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, “উঁহু, একদমই ব্যথা করছে না খুব মজা লাগছে। খুশিতে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইছে।”
অপর ব্যক্তিটির রাগের কথা বিবেচনা করে তা আর বলা হয়ে ওঠে না। সুপ্ত ইচ্ছাটা মনে চেপে বলে ওঠে, “তোমার জন্যই ব্যথা পেলাম আর তুমি কি-না জিজ্ঞেস করছো বেশি ব্যথা করছে কিনা? অনেক বেশি ব্যথা করছে।”
আশেপাশে নজর বুলায় আরজান। উঁহু, সাহায্য চাওয়ার মতো কেউ নজরে পড়ছে না। দু’য়েকজন পুরুষ মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সকলেই একবার বাঁকা চোখে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। মহিলা মানুষ হলে তাও বলা যেত একটু সাহায্য করতে। সে তো আর সিনেমার নায়ক নয় যে কোলে তুলে নিয়ে চলে যাবে। রূপকথাকে ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকতে দেখে রসিকতার সুরে বলে ওঠে, “তোমাকে তো কোলেও নেওয়া যাবে না যে বগলদাবা করে নিয়ে চলে যাবো। ওজন আছে তোমার, দেখলেই বোঝা যায়। কত ওজন হবে বলোতো? একশো কেজি? নাকি তারও বেশি?”
হতাশার শ্বাস ফেলে রূপকথা। সে বৃথায় আশা করে এই লোকটার থেকে। আরজানকে আর কিছু না বলে সে নিজেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কয়েকবারের চেষ্টায় সফল হয় সে। তখনই চিল্লিয়ে ওঠে আরজান, “আরে কী করছো? আবার পড়ে গিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর শখ হয়েছে নাকি? চুপচাপ এখানে দাঁড়াও আমি ভ্যান ডেকে দিচ্ছি।”
“তোমার কথা মোটেই শুনবো না আমি।” কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে রূপকথা।
“কেন?” ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান।
“তুমি একদমই আমার পরোয়া করো না।” সোজাসাপ্টা জবাব রূপকথার।
“তাই নাকি? পরোয়া কীভাবে করে বলোতো রূপ?”
“ধুর! যাও তো, ভ্যান ডেকে নিয়ে এসো।”
সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। এমন একটা সময়ে রূপকথাকে একা এখানে রেখে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না আরজান। তার উপর আবার পলাশ সুস্থ হয়ে গেছে। তার এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। আরো কয়েক ঘা বেশি মারলে তো ব্যাটা এতো দ্রুত সুস্থ হতে পারতো না। তাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে দেখে রূপকথা পুনরায় বলে ওঠে, “কী হলো? যাও।”
বিরস মুখে তাকায় আরজান। দু’য়েক পা সামনে গিয়ে পুনরায় পেছনে ফিরে তাকায়। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে রূপকথা। দ্রুত সামনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে আরজান। বেশিক্ষণ হাঁটতে হয় না তাকে। কিছুটা সামনে যেতেই একটা ভ্যান আসতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সে। ভ্যানটা কাছাকাছি আসতেই বলে ওঠে, “এই ভ্যান, যাবে?”
“ভ্যান যাইতে চাইলেও আমি যামু না।” ভ্যানচালক গামছা দিয়ে গলা,মুখ মুছতে মুছতে বলে।
এমনতর কথা শুনে রাগান্বিত হওয়ার কথা থাকলেও আরজান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। রাগারাগি করলে চলবে না। তাকে মানতে হবে এই গ্রামে সবাই হাশেমের দোকানের চা খায়। হাশেমের একটু গুন তো পাবেই তারা। সে পুনরায় বলে, “ভাড়া বাড়িয়ে দেবো।”
“কই যাইবেন?”
“শিকদার বাড়ি।”
“এমনেই গেরামে ভূতের উপদ্রব বাইরা গেছে। চেয়ারম্যানের পোলাডারে কী পিডান পিডাইছে শোনেন নাই? আর আপনে কি-না ঐ ভুতুড়ে বাড়ি যাইবেন! কেউ থাকেনা কইল ঐ বাড়ি, এক্কেবারে ফাঁকা।” উত্তেজিত কন্ঠে বলে ভ্যানচালক।
“তোমার এতো ভাবতে হবে না। তুমি শুধু বাড়ির সামনে পর্যন্ত ছেড়ে দাও। তোমাকে তো আর বাড়ির ভিতরে যেতে বলছি না।”
“আইচ্ছা চলেন, ভূত আইলে মাইরগুলা কইল আপনে খাইবেন।”
বিরক্ত মুখে উঠে আরজান। রূপকথার কাছাকাছি ভ্যান আসতেই থামাতে বলে সে। ভ্যান থামাতে থামাতে চালক বলে ওঠে, “কি হইলো? ডরাইছেন নাকি? যাইবেন না?”
আরজান রূপকথাকে দেখিয়ে বলে, “আমি যাবো না, উনি যাবে। ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দিও।”
ভ্যান থেকে নেমে রূপকথার কাছে গিয়ে শুধায়, “ভ্যানে উঠতে পারবে তো?”
চোখ বড়বড় তাকায় রূপকথা। এ কথা তো সে ভাবেনি! এখন কী করবে? সে মাত্রই বলতে নিবে যে চেষ্টা করলেই উঠতে পারবো তার আগেই একজোড়া হাত এসে আগলে ধরে তার বাহু। সে অবাক চোখে তাকাতেই ধমকে ওঠে আরজান, “একদম এভাবে তাকাবে না। আমি সাহায্য করছি দ্রুত উঠে বসো।”
দৃষ্টি সরিয়ে নেয় রূপকথা। একহাতে ভ্যান ধরে নিয়ে উঠার চেষ্টা করে। অন্যহাত সাবধানে আগলে ধরে আছে আরজান। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর উঠে বসতে সক্ষম হতেই নিজের হাত সরিয়ে নেয় সে। ভ্যানচালকের হাতে ভাড়া দিয়ে বলে, “সাবধানে পৌঁছে দিও আর ভ্যান ধীরে ধীরে চালাবে।”
রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “ভালো করে ধরে বসো আবার পরে গিয়ে নতুন করে ঝামেলা বাঁধিও না।”
“তুমি যাবে না?” শুধায় রূপকথা।
“না, তুমি গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমার কাজ আছ, একটু পরে আসছি।”
ভ্যান চলে যাওয়ার পরেও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আরজান। কিছুক্ষণ পর অন্য একটা ভ্যান পেয়ে সেটাতে করে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অপরদিকে যেতে যেতে ভ্যানচালক রূপকথাকে শুধায়, “আপনেরা কি জামাই-বউ?”
এতোক্ষন গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল রূপকথা। হটাৎ ভ্যানচালকের কথাতে হুঁশ ফেরে তার। জিজ্ঞাসু স্বরে বলে, “হুম?”
“আপনেরা কি জামাই-বউ?”
থতমত খেয়ে যায় রূপকথা। কী বলবে ভেবে পায় না সে। কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে, “হ্যাঁ।”
তারপর আর একটি শব্দও উচ্চারণ করে না সে। তাই ভ্যানচালকও আর কিছু বলতে পারে না। বাড়ির কাছাকাছি এসে ভ্যান থামিয়ে চালক শুধায়, “নামবার পারবেন? ধরমু আমি?”
না সূচক মাথা নাড়ায় রূপকথা। ভ্যান ধরে নিজেই ধীর ধীরে নামার চেষ্টা করে। কয়েকবার ব্যর্থ হয়ে ব্যথা অগ্রাহ্য করে কিছুটা জোর করেই নামতে চায়। ততক্ষণাৎ অতিরিক্ত ব্যথায় চোখদুটো খিচে বন্ধ করে নেয়। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর নামতে সফল হয় তবে ব্যথার পরিমাণ বেড়ে যায়। ভ্যান চলে যাওয়ার পরেও সেখানে কিছুক্ষণ হাঁটু চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। কারোর আসার শব্দ পেয়ে কোনোমতে পা টেনে টেনে ভেতরে গিয়ে দ্রুত সদর দড়জা ভিড়িয়ে দিয়ে ওখানেই ধপ করে বসে পড়ে। অনেক বেশি ব্যথা করছে কিন্তু বর্তমানে এর কোনো প্রতিষেধকও নেই তার কাছে। নীরবে ব্যথা সহ্য করা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় দেখছে না সে। স্থলে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত একজন জলপরির জন্য একটু বেশিই পীড়াদায়ক হয়। যত সময় বাড়ছে তত ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা দ্বিগুণ হচ্ছে। এখন তার প্রয়োজন পানি, অথৈ পানি।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর ফিরে আসে আরজান। বাড়িতে প্রবেশ করে সদর দড়জা লাগিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রূপকথা সদর দড়জার পাশেই বসে হাঁটু চেপে চোখ বন্ধ করে আছে। হাঁটুর উপরের পোশাকেও কিছুটা রক্ত দেখা যাচ্ছে অথচ সে ভেবেছিলো কেটেকুটে যায়নি হয়তো সামান্য ব্যথা পেয়েছে। এখন উপলব্ধি হচ্ছে মেয়েটা ভালোই ব্যথা পেয়েছে কিন্তু তবুও তার একফোঁটা কান্নার কোনো লক্ষণ দেখেনি সে।
তাড়াহুড়ো করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ডেকে ওঠে আরজান, “রূপ, এখনো এখানে বসে আছো কেন? ঘরে যাওনি?”
“না, খুব ব্যথা করছে ম্যাজিশিয়ান।” কাতর স্বরে বলে রূপকথা।
আরজান ব্যস্ত হাতে নিজের পকেট থেকে ওষুধ আর মলম বের করে বলে, “এই নাও, এখান থেকে একটা ওষুধ খেয়ে নাও আর ঘরে গিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে নাও। সকাল হতে হতে অনেকটা কমে যাবে।”
“এসবে কোনো কাজ হবেনা ম্যাজিশিয়ান। এইসব ওষুধ আমার ক্ষত নিবারণ করতে পারবে না। আমার পানি প্রয়োজন কিন্তু এই অবস্থায় আমার আর উঠার শক্তিও নেই। কয়েক পা এগোলেই পুকুর অথচ সেখানে যাওয়ার সাধ্যি আমার নেই।”
মুহুর্তেই নীরব হয়ে আরজান। সে তো ভুলেই বসেছিল রূপ কোনো সাধারণ মানবী নয়, সে একজন জলপরি। এসব সাধারন ওষুধ তার ক্ষত সারাবে কীভাবে?
তাকে নিশ্চুপ দেখে ডেকে ওঠে রূপকথা, “ম্যাজিশিয়ান”
এখনও নীরব আরজান। পুনরায় ডেকে ওঠে রূপকথা, “ম্যাজিশিয়ান”
ভাবনার মাঝে হকচকিয়ে ওঠে আরজান। শুধায়, “হুম, কিছু বলছো?”
“এতো কী ভাবছো? তুমি যেতে চাইলে চলে যেতে পারো, আমি আটকাবো না।”
উত্তর দেয় না আরজান। হুট করে এগিয়ে এসে রূপকথার হাত ধরে টেনে দাঁড় করায় তাকে। ব্যথার ধ্বনি তুলে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রূপকথা। রেগে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই তাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নেয় আরজান। বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় পুকুরের দিকে। রূপকথা রেগে কিছু বলার বদলে হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকে তার দিকে। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ায় আরজান। রূপকথা এখনো গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। বাকা হাসে আরজান। রূপকথা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তাকে ছুড়ে ফেলে পানিতে। মুহুর্তেই পানির গভীরে তলিয়ে যায় রূপকথা।
কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখা মেলেনা রূপকথার। কোনো শব্দ পর্যন্ত নেই, পানি একদম স্বাভাবিক। খানিক চিন্তিত হয়ে পড়ে আরজান। মেয়েটা এমনিতেই ব্যথাই কাতরাচ্ছে তারউপর এভাবে ছুড়ে ফেলা মোটেই উচিত হয়নি। তার ভাবনার মাঝেই পানিতে ভেসে ওঠে রূপকথা নিজের জলপরির রূপে। পানির উপরে শুধুমাত্র মাথাটা বের করে বলে, “এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলে যাও।”
আরজান অবাক স্বরে শুধায়, “আমার বাড়ি থেকে আমাকেই তাড়িয়ে দিচ্ছো?”
“তুমি তো চলে যাবে দেখেই আমাকে এভাবে তাড়াহুড়ো করে এনে ফেলে দিলে।”
ধমকে ওঠে আরজান, “বোকা মেয়ে, তাড়াতাড়ি এবার উঠে এসো। সত্যিই যেতে হবে আমার।”
“ব্যথা কমেছে কিন্তু ক্ষত ঠিক হতে অনেক সময় নেবে। তুমি একটু থাকো না ম্যাজিশিয়ান।” আবদারের ভঙ্গিতে বলে রূপকথা।
“ঠিক আছে, তাহলে পানির নিচে যাও শীত পড়ছে অনেক।” বলে আরজান।
“কিন্তু তুমি?” শুধায় রূপকথা।
“আমি ঘর থেকে চাদর-টাদর কিছু নিয়ে আসছি। তুমি পানির নিচে যাও।”
“তুমি ফিরে আসো তারপর যাবো।”
“জেদ করো না রূপ। অনেক ঠান্ডা পড়ছে।” কথাটা বলে চোখ রাঙিয়ে তাকায় আরজান।
তার চোখ রাঙানিকে যেন পাত্তাই দেয় না রূপকথা। সে তার কথাতেই অটল। বাধ্য হয়ে ঘরে চলে যায় আরজান। টিনের বাক্স খুলে মায়ের চাদর বের করে নেয়। বিছানার উপর পড়ে থাকা তার চাদরটাও সাথে নিয়ে নেয়। দুটো চাদর একসাথে করে শরীরে পেঁচিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। বারান্দা থেকে চেয়ার উঠিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে সেটা পেতে বসে পড়ে। হতবাক হয়ে রূপকথা শুধায়, “এতো গোছগাছ করে আসছো যে? সারারাত এখানে বসে কাটানোর পরিকল্পনা করেছো নাকি?”
“হ্যাঁ, ঐ ভ্যানচালকটা আজ দেখে গিয়েছে। কোনোভাবে যদি পলাশ জানতে পারে তাহলে ঠিকই এখানে পৌঁছে যাবে। অসভ্যটাকে নিয়ে একদম বিশ্বাস নেই আমার তাই আজ আমি এখানেই থাকবো।”
“পলাশ কে? ঐদিনের সেই খারাপ ছেলেটা?”
“হ্যাঁ কিন্তু তুমি এতো কথা বলছো কেন? যাও নিচে যাও।” রাগান্বিত স্বরে ধমকে ওঠে আরজান।
দ্রুত নিচে চলে যায় রূপকথা। আরজান নিজের মোবাইল বের করে গেম খেলতে থাকে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। গেম খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে আরজান। ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে আর অনেক ক্ষুধাও লাগছে তার। তবুও সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। ক্ষুধা লাগুক আর যায় হোক সে আজ কিছুতেই সরবে না এখান থেকে। মোবাইল পকেটে পুরে পানির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পানি একেবারে স্বাভাবিক, কোনো নড়চড় নেই।
চোখের পলকেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে যেন। বসে বসে ঘুমে ঝিমোচ্ছে আরজান। রাত প্রায় এগারোটা তখনই তার মোবাইল বেজে ওঠে বিকট শব্দ তুলে। আচমকা শব্দে চমকে ওঠে আরজান। মোবাইলে নজর দিয়ে দেখতে পায় মা কল দিয়েছে। এতো রাতে মা কল দিয়েছে! সে খানিকটা অবাক হয়।
একবার রিং বেজে কেটে গিয়ে পুনরায় বেজে উঠতেই রিসিভ করে সে। চিন্তিত স্বরে বলে, “হ্যাঁ, মা বলো। এতো রাতে কল দিলে যে? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“কপালটাই খারাপ রে। আজ এসে তোকে চমকে দেবো ভেবেছিলাম কিন্তু টিকিট পেলাম না। লামিয়ারও খুব মন খারাপ হয়েছে আজ যেতে না পেরে।” কষ্ট নিয়ে বলে সোফিয়া শিকদার।
মায়ের কথাতে যেন বজ্রপাত হয় আরজানের মাথায়। তারমানে মা আজই চলে আসতে চেয়েছিল যেন সে কোথাও চলে যেতে না পারে। তার ভাবনার মাঝেই সোফিয়া শিকদার পুনরায় বলে ওঠে, “কাল দুপুরের মধ্যে চলে আসবো একদম সকালের ট্রেনেই উঠবো। কাউকে ডেকে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে রাখিস তো।”
বলার মতো আর কিছু নেই আরজানের। সে আস্তে করে কল কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ দেয়। মা তো কিছুতেই বিয়ে না করিয়ে ছাড়বে না মনে হচ্ছে। এখন কী করবে সে? লামিয়াকে বিয়ে করে সংসারী হতে হবে তাকে?
তার ভাবনার মাঝে ভেসে আসে রূপকথার কন্ঠস্বর, “কী হয়েছে ম্যাজিশিয়ান? এতো চিন্তিত কেন তুমি? কার সাথে কথা বললে?”
সামনে তাকিয়ে রূপকথাকে একবার দেখে নেয় আরজান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রূপকথা। মাথায় হাত চেপে চোখদুটো বন্ধ করে নেয় আরজান। হটাৎ কিছু একটা ভেবে নিয়ে থমথমে কন্ঠে ডেকে বলে, “রূপ”
“হুম?”
“বিয়ে করবে আমাকে?” শুধায় আরজান।
চলবে,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_12
রাত বেড়েছে সেই সাথে সেই সাথে বেড়েছে দু’জন মানব ও জলপরির দৃষ্টির গভীরতা। তীব্র এই শীতের রাতেও পুকুর পাড়ে বসে ঘামতে শুরু করেছে মানবটা। চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করে চলেছে অপর ব্যক্তিটার উত্তরের। তার ঠিক সামনেই পুকুরের পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এক জলরূপসী। রাতের আঁধারে একে-অপরের চোখে দৃষ্টিগোচর না হলেও তারা ঠিকই বুঝে নিচ্ছে অপর ব্যাক্তিটির চাহনি। এভাবে নীরবতার সাথেই বয়ে যায় কিছুটা সময়। শেষমেশ রূপকথার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে গম্ভীর হয়ে ওঠে আরজান। গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকে, “রূপ”
হটাৎ ডাক শুনে হকচকিয়ে ওঠে রূপকথা। সে তো সামনের ব্যক্তিটার আশ্চর্যজনক প্রস্তাবে নিজের বোধ-বুদ্ধি খুইয়ে বসেছিল। যার দরুন গভীর ভাবনায় বুদ হয়েছিল এতোটা সময়। সে খানিক অবাক স্বরেই শুধায়, “কী সব ভুলভাল বকছো ম্যাজিশিয়ান? বিয়ে! তাও আবার আমার সাথে! এ কী করে সম্ভব?”
এমন উত্তরে যেন সন্তুষ্ট হতে পারে না অপর ব্যক্তিটা। সে রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “কেন সম্ভব নয় রূপ? তোমায় তো আমি কাউকে খুন করতে বলিনি, বলেছি শুধু বিয়ে করতে।”
“কিন্তু আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয় ম্যাজিশিয়ান। একজন জলপরির জীবনে বিয়ে-সংসার কখনোই সম্ভব নয়। যার দিন শুরু হয় জলাশয়ে, রাত নামে জলাশয়ে ডুবে ডুবে সে কী করে এসবে জড়াতে পারে বলো?” কঠিন গলায় উত্তর দেয় রূপকথা।
নড়েচড়ে বসে আরজান। তাকে আশ্বস্ত করে বলে, “তোমাকে সংসার করতে বলছি না আমি। শুধু বিয়েটা করো, কয়েকদিন এই বাড়িতে থেকে চলে যেও সমুদ্রে। আমি নিজেও সংসার করতে চায় না তাই কথাটা তোমাকে অনেক ভেবেচিন্তেই বলেছি আমি। এতে তোমারো কোনো সমস্যা হবেনা আর আমিও বিয়ের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো। আমি কথা দিচ্ছি সঠিক সময়ে তোমাকে তোমার স্থানে পৌঁছে দেবো। কখনোই অধিকার খাটাবো না তোমার উপর। তুমি তোমার মতো আর আমি আমার মতো থাকবো।”
“কিন্তু তবুও আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও ম্যাজিশিয়ান। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে এই পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে খেলতে পারবো না। তা আমি এই বিলে পুরো জীবন কাটিয়ে দিলেও না। গ্রামের মানুষের কাছে মারা পড়লেও না।”
দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে রূপকথা।
রাগ ফুটে ওঠে আরজানের চোখে-মুখে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় শক্ত করে। রূঢ় কন্ঠে বলে ওঠে, “তুমি বড্ড স্বার্থপর রূপ। আমার এই সাহায্যটুকু করতে পারবে না তুমি? এতোটা স্বার্থপর না হলেও পারতে। বিয়ে করা তো পাপ নয় রূপ তাহলে কেন বিয়ে করতে পারবে না তুমি?”
“আমি স্বার্থপর নই ম্যাজিশিয়ান। জলপরিদের জীবনে এসব থাকেনা। যেখানে দু’দিন পরে আমাকে ফিরে যেতে হবে নিজ স্থানে তাহলে কেন দু’দিনের জন্য এই সম্পর্ক?” করুন দৃষ্টিতে শুধায় রূপকথা।
“আমি শখ করে বা নিজের ইচ্ছা মেটাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি রূপ। বাধ্য হয়েই বলছি। আমার মা আমাকে বিয়ে না করিয়ে ছাড়বে না আর আমি লামিয়ার সাথে সংসার করতেও পারবো না।”
“লামিয়া?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শুধায় রূপকথা।
“আমার খালামণির মেয়ে যার সাথে মা আমার বিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। লামিয়াকে আমি সারাজীবন বোনের চোখেই দেখেছি তার সাথে কী করে সংসার করবো বলো? আমার দ্বারা অন্তত হবে না। বোঝার চেষ্টা করো একটু।”
“তোমার মা নিশ্চয়ই তোমার ভালোর জন্যই করছেন। মেয়েটা বোধহয় খুব সুন্দরী হবে, তুমি রাজি হয়ে যাচ্ছো না কেন?”
আরজান চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই চুপসে যায় রূপকথা। সবসময় এভাবে তাকায় কেন লোকটা? সে কি খারাপ কিছু বলেছে নাকি?
আরজান পুনরায় শুধায়, “বিয়ে করবে আমাকে?”
এবার আর কোনো উত্তর আসেনা, নিশ্চুপ রূপকথা। পানির দিকে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। আরজান কিছুক্ষণ আঁধারের মাঝেও চেয়ে থাকে পুকুরের দিকে। অতঃপর গলা ঝেড়ে বলে, “যাক উন্নতি হয়েছে। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। এখন ঘুমাও আর সকালে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থেকো, শুভ রাত্রি।”
নিমেষেই চমকে যায় রূপকথা। চোখ বড়বড় করে বলে, “তুমি কিন্তু জোর করছো এখন।”
কোনো উত্তর আসে না অপরপাশ থেকে। মাথা উচিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করে রূপকথা কিন্তু রাতের আঁধার ছাড়া আর কিছুই নজরে আসে না তার। সে পুনরায় ডাকে, “ম্যাজিশিয়ান”
এবারো নীরব অপর ব্যক্তিটা। বেশ বিরক্ত হয় রূপকথা। বিরক্তি নিয়ে বলে, “কথা বলছো না কেন? এতটুকু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”
তার কথা বোধহয় শুধু সেই শুনতে পাচ্ছে। অপরপাশের লোকটার কান পর্যন্ত তার আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠে রূপকথা। শেষে উপায় না পেয়ে আলগোছে পানির নিচে বিলীন হয়ে যায় সে। পানির শব্দ পেয়ে বাকা হাসে আরজান। সে কথা বললে মেয়েটা আবার টালবাহানা শুরু করতো। এখন একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক, কাল কী যুদ্ধ বাঁধবে কে জানে।
_____________________________
ভোর হয়েছে, একে একে ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে প্রতিটি প্রাণীর। পশু-পাখি, মানুষ সকলেরই ঘুমের অন্ত ঘটতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। শিকদার বাড়ির পুকুরে এই সাত সকালে খলবল শব্দ তুলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে এক জলপরি। পুকুরের পাড়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে শিকদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী। কুয়াশার মাঝেও বেশ বোঝা যাচ্ছে তার অবয়ব। রূপকথা সাঁতার থামিয়ে ঘুরে তাকায় তার দিকে। শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছে লোকটা। চাদরগুলো দু’হাতে শক্ত করে শরীরের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। শীতের তীব্রতায় মাঝে মাঝে নড়ে উঠলেও মুহূর্তেই আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে মুচকি হাসে রূপকথা। তার কিন্তু মোটেই হাসা উচিত নয়। লোকটা তো তার সুরক্ষা দিতেই এই শীতের পুরো একটা রাত ঘরের বাইরে চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলো। এতো এতো ঋণ সে কী করে চোকাবে?
এভাবে চেয়ে থেকেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় তার অজান্তে। কুয়াশা পুরোপুরি না কাটলেও সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গ্রামের লোকজন হয়তো কেউ আর ঘুমিয়ে নেই অথচ দেখো লোকটা কী আরামে এখনো ঘুমিয়ে যাচ্ছে। সে একবার ডাকতে চেয়েও আর ডাকে না। থাক না একটু ঘুমিয়ে, বেশ ভালোই তো লাগছে! কী স্নিগ্ধ তার মুখশ্রী অথচ জেগে থাকলে রাগারাগি, ধমকা-ধমকি ছাড়া একটু ভালো করে কথাও বলতে চায় না। এমন একটা ভাব যেন ভালো করে কথা বললে তার মানসম্মান খোয়া যাবে। আর ত্যাড়াবাঁকা কথার তো সে একদম রাজা। সোজা কথা বলতে যেন তার মজুরি লাগে!
আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে আনমনেই অধর বাঁকায় রূপকথা। হটাৎ মশা, মাছি কিছু একটা চোখে এসে পড়াতে ঘুমের মাঝে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে নেয় আরজান। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে যা দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি সে চিল্লিয়ে উঠবে রাগে। তার চোখ মুখের এমন ভাবভঙ্গি দেখে এবার শব্দ করেই হেসে ওঠে রূপকথা। সারাদিন সবার সাথে রেগে রেগে কথা বলে এখন ঘুমের মাঝেও কেমন রেগে যাচ্ছে লোকটা। আচমকা হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আরজানের। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই নিজেকে খোলা আকাশের নিচে আবিষ্কার করে খানিক ভড়কে যায় সে। মুহুর্তেই হাসির শব্দ অনুসরণ করে পুকুরের দিকে তাকাতেই পুরোপুরি ঘুম ছুটে যায়। হালকা কুয়াশার মাঝে পুকুরের সবুজ পানিতে ভেসে রয়েছে রূপকথা। হাসির তালে তালে তার সোনালি চুলগুলো নিজ নিয়মে দুলছে পানির উপর। এই প্রথম এভাবে তার সামনে হাসছে এই জলরূপসী। হাসলে এতো সুন্দর লাগে কিন্তু মেয়েটা কি-না হাসতেই চায় না!
আরজানের চোখ খোলা দেখেও হাসি থামছে না তার। শব্দ থামিয়ে ঠোঁট চেপে চেপে হেসে চলেছে। হাজার চেষ্টা করেও এই হাসি যেন সে থামাতেই পারছে না। আরজানের খোলা দৃষ্টিরও কোনো পরোয়া করছে না। আরজান কিছুক্ষণ একধ্যানে তার দিকে চেয়ে থাকার পর আচমকা যেন ঘোর কেটে যায় তার। মনে পড়ে যায় রাতের কথোপকথন কিন্তু মেয়েটা এভাবে একা একা হাসছে কেন? আশেপাশটা একবার নজর বুলিয়ে নেয় সে। না, কেউ তো নেই তাহলে তার এই হাসির কারন কী?
সে ভ্রু কুচকে শুধায়, “এতো হাসির কী ঘটেছে রূপ? হেসে পুরো পৃথিবী দুলিয়ে ফেলবে নাকি?”
থতমত খেয়ে যায় রূপকথা। এখন কী বলবে? সত্যি কথা জানতে পারলে তো এই লোকের রাগের আগায় আর দাঁড়ানো যাবে না। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে, “অনেকদিন হাসি না তো তাই একটু অনুশীলন করে দেখছি হাসি ভুলে গিয়েছি কিনা!”
এমন একটা আজগুবি কথা শুনে মুখ কুচকে ফেলে আরজান। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “সকাল সকাল ভুলভাল কথা বলোনা তো রূপ। কতো রাত করে ঘুমিয়েছি আর দিলে তো ঘুম টা ভাঙিয়ে।”
“সকাল সকাল বকবে না একদম। একটু ভালো করে কথা বলতে পারো না তুমি?” তার চেয়ে দ্বিগুণ রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে রূপকথা। নিমেষেই চোখদু’টি বড়বড় হয়ে যায় আরজানের। হতবাক হয়ে কিছু বলবে তার পূর্বেই রূপকথা পুনরায় বলে ওঠ, “ঠিক আছে, ঘুম না হলে ঘরে গিয়ে ঘুমাও তুমি।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আরজান। দু’হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে, “বিয়ের দিন বেশি ঘুমাতে হয় না। দ্রুত উঠে পড়ো, বিয়ে করে এসে তারপর সকালের নাস্তা করবো।”
কথাটা শ্রবণগোচর হতেই তাল হারিয়ে পানিতে ডুবে যায় রূপকথা। কিছুক্ষণ নাকানিচোবানিও খেতে হয় তাকে। দ্রুতই নিজেকে সামলে ভেসে ওঠে সে। সকাল করে এমন লাগামছাড়া কথা শুনতে হবে জানলে সে ভুলেও হাসতো না। নিজেকে সংবরণ করে বলে, “এতো তাড়াহুড়ো করার কী হয়েছে ম্যাজিশিয়ান? এটা শুধুমাত্র একটা নাটক তাই ধীরে সুস্থে পরেও করা যাবে।”
“বিয়ে আবার নাটক হয় নাকি? সবসময় বোকার মতো কথাবার্তা বলো তুমি।” কিঞ্চিত বিরক্ত স্বরে বলে আরজান।
“তারমানে সত্যি সত্যি বিয়ে করবো আমরা?” অবাক হয়ে শুধায় রূপকথা।
“তা নয়তো কী?”
“তবে তুমি যে কাল বললে বিয়েটা শুধু তোমার মাকে দেখানোর জন্য করবে!”
“দেখানোর জন্য হলেও সেটা নাটকের বিয়ে নয়। সমস্ত নিয়ম মেনে আসল বিয়ে হবে। তবে হ্যাঁ, সংসার করবো না আমরা। এখন তাড়াতাড়ি উঠে এসো তো, মাকে নিয়ে একদম বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে শেষ রাতের গাড়িতে চড়ে সাত সকালে চলে আসবে।”
রূপকথাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যস্ত পায়ে ঘরে চলে যায় আরজান। চোখে-মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে ধীর পায়ে উঠে আসে রূপকথা। মুহুর্তেই বদলে যায় তার বস্ত্র। মাত্রই ঘরের দিকে যেতে নেবে ওমনি হুরমুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আরজান একহাতে বড় একটা ব্যাগ নিয়ে। নিজের চাদরটা শরীরে জড়িয়ে মায়ের চাদরটা হাতে রেখেছে। রূপকথার দিকে এগিয়ে এসে চাদরটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা পড়ে নাও।”
বিনাবাক্যে সেটা নিয়ে নিজের শরীরে জড়িয়ে নেয় রূপকথা। ততক্ষণাৎ আরজান সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলে, “চলো।”
“এখনি?” আশ্চর্য হয়ে শুধায় রূপকথা।
বিরক্তিসূচক শব্দ করে আরজান। পেছনে ফিরে বলে, “এখন চেয়ারম্যান চাচার বাড়িতে যাবো। বিয়েতে সাক্ষী লাগবে না? আর অন্য কাজও আছে আমার। এখন আর কথা বলোনা তাড়াতাড়ি চলো।”
কথাটা বলেই হাঁটতে শুরু করে আরজান। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয় রূপকথা। পুনরায় ফিরে আসে আরজান। ধমকে উঠে বলে, “এখন কি পালকি আনতে হবে তোমার জন্য?”
চলবে,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_13
চেয়ারম্যান আকরাম মিঞার বাড়ির উঠোনে কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে রূপকথা। আকরাম মিঞা ও রোজিনা বেগম সেই কখন থেকে নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরখ করে চলেছে তাকে। ভীত চোখে চারপাশে নজর বুলায় রূপকথা। আরজান তাকে এখানে এনে আকরাম মিঞা ও রোজিনা বেগমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে হবু বউ বলে। তারপর বিয়ের কথা জানিয়ে কাজী ডাকতে বলে নিজে বাজারে চলে গেছে বিয়ের কেনাকাটা করতে। আকরাম মিঞা সাথে সাথে পলাশকে পাঠিয়ে দিয়েছে কাজী ডেকে আনার জন্য। পলাশ একবার কটমট দৃষ্টিতে রূপকথাকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বেরিয়ে গেছে হনহন করে। সেই থেকে চেয়ারম্যান আর তার স্ত্রী হাঁ করে চেয়ে আছে তার দিকে। হয়তো ভাবছে এমন শ্যামবর্ণের মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করলো ম্যাজিশিয়ান? মুচকি হাসে রূপকথা। তারা তো আর জানে না এটা মন থেকে করা বিয়ে নয়, শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য।
এতোক্ষন কথা বলার ছুতো খুঁজছিল রোজিনা বেগম। হটাৎ তাকে হাসতে দেখে কিছুটা ভরসা পায় সে। পোলাডা তো গম্ভীর কিন্তু মাইয়াডা বোধহয় অমন না। সে খানিক সাহস সঞ্চয় করে বলে, “তোমার নামডা তো কইলা না মা?”
মাথা তুলে তাকায় রূপকথা। ধীর স্বরে বলে, “রূপ, মানে রূপকথা আমার নাম।”
তার শুদ্ধ ভাষা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকায় রোজিনা বেগম। তার ধারণাই ঠিক, এই মাইয়া এই গেরামের না। সে এগিয়ে এসে বলে, “এইবার বুজবার পারছি তুমিও শহর থেইকা আইছো। তার জন্যিই তো কই যে গেরামের মাইয়া হইলে আমি চিনমু না ক্যান?”
তেতে ওঠে আকরাম মিঞা। তেড়ে এসে বলে, “হ, তুইতো চিনবিই। সারা গেরামে হাল চাষ কইরা বেড়াও না তুমি? পাড়ায় পাড়ায় দরবার কইরা বেড়ানো ছাড়া আর কাম কই তোর? ঘরে যা কইতাছি। মাইয়াডা কখন থেইকা শুদা মুখে বইয়া রইছে। খাওন-দাওন দিবিনা?
আমার পোলাডাও তোর যুতের হইছে।”
চুপসে যায় রোজিনা বেগম। সত্যিই তো, মাইয়াডারে চিনবার গিয়া তারে শুদা মুখে বসাইয়া রাখছে। সে দ্রুত শাড়ির আঁচল ভালোমতো টেনে নিয়ে দৌড়ায় খাবারের ঘরের দিকে। চেয়ারম্যান রূপকথাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুমি কিছু মনে কইরো না মা। তোমার চাচি কতা একটু বেশি কয় তয় মনের দিক দিয়া ভালা আছে।”
এতোক্ষন তাদের ঝগড়া শুনে মিটমিট করে হাসছিল রূপকথা। গ্রামের মানুষের ভাষা শুনতে তার খুবই ভালো লাগে। আর ঝগড়া হলে তো কথাই নেই। কোমর বেঁধে শোনার সাধ জাগে। আচমকা চেয়ারম্যানের কথায় হকচকিয়ে ওঠে সে। তাকে হাসতে দেখে নেয়নি তো? নিজেকে সংবরণ করে বলে, “না না, সমস্যা নেই। উনি তো স্বাভাবিক আলাপচারিতা করছিল।”
কিছুক্ষণ পর রোজিনা বেগম হাতে প্লেট আর একটা গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। প্লেটে কিছু ফলমূল আর গ্লাস ভর্তি দুধ। তার পাশে বেঞ্চিতে সেগুলো রেখে বলে, “খাইয়া নাও তারপর কতা কমুনি।”
মুচকি হাসে রূপকথা। প্লেটটা কোলের উপর তুলে নিয়ে কয়েকটা ফল মুখে পুরে নেয়। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আকরাম মিঞা ও রোজিনা বেগম। রূপকথা তাদের বসতে বললে প্লাস্টিকের চেয়ার এনে বসে যায় তারা। একঢোকে পুরো দুধ শেষ করে তাদের দিকে তাকায় রূপকথা। হাসি দিয়ে বলে, “এবার কথা শুরু করা যাক?”
হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে রোজিনা বেগম। আকরাম মিঞা গলা খাকারি দিয়ে বলে, “হ, তোমরা বইসা কতা কও। আমি যাই দেখি মেম্বার ভাইরে পাই নাকি।”
সে বেরিয়ে যেতেই গল্প মজিয়ে নেয় রোজিনা বেগম। রূপকথাও তার সাথে যেন গল্পে মজে গেছে। রোজিনা বেগম এটা সেটা বলে চলেছে একাধারে। কখনো গ্রামের বর্ণনা তো আবার কখনো তাদের বিবাহিত জীবনের বৃত্তান্ত। অনেকটা সময় কথা বলার পরেও তার শরীরের রং নিয়ে কিছু না বলাতে খানিক অবাক হয় রূপকথা! সাদাবিলে সে কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের অনেক দীর্ঘ একটা সময়। এখনকার মানুষ সম্পর্কে মোটামুটি ধারনাও পেয়েছে সে। সেই মোতাবেক সে বুঝে নিয়েছে সাদা মেয়ের সাথে কালো ছেলের বিয়ে হলেও সাদা ছেলের সাথে কালো মেয়ের বিয়ে যেন রাতের বেলা সূর্যের দেখা পাওয়ার মতোই দুঃসাধ্য ব্যাপার! সেখানে ম্যাজিশিয়ানের শরীরে বর্ণ তার তুলনায় অনেকটাই উজ্জ্বল। এক্ষেত্রে কিছু তো বলা উচিত ছিলো তার। যেখানে তার জাতি-গোষ্ঠীই তার এই বর্ণকে মেনে নিতে পারেনি সেখানে মানুষেরা কী করে মানবে?
অনেক সময় গল্প করার পর সে উপলব্ধি করতে পারে এই মহিলার মন আসলেই অনেক ভালো। গ্রামের আর দশটা কূটনৈতিক বুদ্ধিধারী মহিলার মতো নয় সে। বহুকাল ধরে চলে আসা সাদা-কালোর বর্ণভেদ তার মনুষ্যত্বের দুয়ারে পৌঁছাতে পারেনি। ম্যাজিশিয়ানের পরে এই একজন ব্যক্তি যাকে তার খুব মনে ধরলো। সে ভাবনাচ্যুত হয় রোজিনা বেগমের কথাতে।
রোজিনা বেগম উত্তেজিত কন্ঠে বলছে, “হায় হায়! আমি দেখি ভুইলাই বইছি। মাইয়া মানুষের জীবনে এই দিনডাই হইলো সবচেয়ে বেশি রংচঙা। এই দিনে সাজগোজের শখ-আল্লাদ ভালা কইরা মিটাইয়া নিবার হয়। পশ্চিম পাড়ার বিলকিছ খুব ভালা বউ সাজাইবার পারে। ওরে ডাইকা আনমু?”
তার কথার আগা-মাথা না বুঝতে পেরে চোখ ছোটছোট করে চেয়ে থাকে রূপকথা। তখনই উঠোনের কোনা থেকে ভেসে আসে আরজানের কন্ঠস্বর, “কোনো প্রয়োজন নেই, রূপ এভাবেই থাকবে।”
চকিতে তাকায় রূপকথা। দু’হাত ভর্তি অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসছে আরজান। শীতের সকালেও তাড়াহুড়ো করে এসব করতে গিয়ে ঘেমে উঠেছে সে। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা। শার্টের হাতা গুছিয়ে কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপকথা। লোকটা পারেও বটে!
আরজানের কথার প্রেক্ষিতে কঠিন নীরবতা পালন করে রোজিনা বেগম। যেন বোম ফেললেও এই মুহুর্তে তার মুখ দিয়ে টু শব্দটা বের করা যাবেনা। আরজান হাত ভর্তি ব্যাগগুলো নামিয়ে রাখে বেঞ্চের একপাশে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে রোজিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে, “রূপ এমনিই তো সুন্দর। ওকে আর সাজানো লাগবে না চাচি। সাজিয়ে বেশি সুন্দর করে দিলে তখন যদি আমাকে আর বিয়ে না করে?”
এই প্রথম আরজানের মুখে রসিকতা শুনে শব্দ করেই হেসে ওঠে রোজিনা বেগম। চোখ গোলগোল করে তাকায় রূপকথা। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি ম্যাজিশিয়ানের? সে! আর সুন্দর! কাল রাত থেকে এই লোকটা উল্টা-পাল্টা কথা বলেই চলেছে। মাথায় নিশ্চয়ই বড় কোনো গন্ডগোল হয়েছে।
রূপকথাকে ভাবতে দেখে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজান। ভ্রু কুচকে শুধায়, “কী ভাবছো রুপ? এখনি বিয়ে না করে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটছো নাকি?”
হকচকিয়ে ওঠে রূপকথা। এগুলো কী বলছে ম্যাজিশিয়ান? সে পালিয়ে যাবে কোথায়? সে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আরজান রোজিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে, “দেখেছেন চাচি, এখনি ভাবতে বসে গেছে। খবরদার বলছি, একে সাজিয়ে আমার কপাল পুড়াবেন না।”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রূপকথা। তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যাগগুলো হাতে নেয় আরজান। সুন্দর একটা সামান্য উঁচু জুতা বের করে রূপকথার পায়ের সামনে রাখে। ইশারা করে বলে, “এটা পড়ো।”
বিনাবাক্যে সেটা পড়ে নেয় রূপকথা। আরজান ভাবের স্বরে বলে ওঠে, “দেখেছো? কতো নিখুঁত আমার দৃষ্টি। একদম সঠিক মাপের জুতা এনেছি।”
পায়ের দিকে একবার তাকায় রূপকথা। আসলেই নিখুঁত মাপ সেই সাথে সুন্দরও বটে। এবার অন্য ব্যাগগুলোর মধ্য থেকে একদম ভিন্নরকম একটা ব্যাগ হাতে নেয় আরজান। ব্যাগটার রং অন্যগুলোর মতো নয়। সেটা খুলে বের করে আনে লাল টুকটুকে একটা গাউন। রোজিনা বেগম এইবার হতাশার স্বরে বলে ওঠে, “এইডা পইড়া বিয়া করবে? শাড়ি আনোনাই?”
“এইটা আমার মা শহর থেকে কিনেছিল ছেলের বউয়ের জন্য। গ্রামের বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। দর্জির দোকান থেকে ফিটিং করিয়ে এনেছি। আজ এটাই পড়বে রূপকথা। শাড়ি সামলাতে পারবে না ও।”
“ওহ।” বিরস মুখে উত্তর দেয় রোজিনা বেগম।
গাউনটা রূপকথার হাতে দিলে সে নেড়েচেড়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকে। তার দৃষ্টিভঙ্গিই বলে দিচ্ছে এটা তার পছন্দ হয়েছে। আরজান অন্য একটা ব্যাগ হাতে দিয়ে বলে, “এখানে একটা ওরনা আর চুরি আছে পড়ে নিও।”
রোজিনা বেগম বলে ওঠে, “শাড়ি পরা যাইবো না, সাজানো যাইবো না ভালা কথা কিন্তু মেন্দি তো নিবার পারে নাকি?”
রূপকথার দিকে একবার তাকায় আরজান। সে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। তার দৃষ্টির অর্থ যেন মুহুর্তেই উপলব্ধি করে নেয় আরজান। রোজিনা বেগমের দিকে চেয়ে বলে, “নেবেই তো, এটা কিন্তু চাচি আপনার দায়িত্ব।”
খুশি হয় রোজিনা বেগম। উল্লাসের স্বরে বলে, “পিছনের বাড়ির ছেড়িডা ভালা মেন্দি লাগাইতে পারে। আমি ওরে ডাইকা আনতাছি।”
কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দেরি করে না সে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। রূপকথার দিকে ফিরে তাকায় আরজান। বাকি ব্যাগগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে, “এগুলো তোমার সবসময় ব্যবহারের জিনিসপত্র। দুইটা পোশাকে তো আর দিন কাটবে না। আর একটা শাড়ি আছে ওটা চাচিকে দিও।”
“কিন্তু এতোকিছু দিয়ে আমি কী করবো ম্যাজিশিয়ান? আমিতো চলেই যাবো এখান থেকে।”
তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় আরজান। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “সে কথা কি আমি জানিনা? যাওয়ার আগে কি এই দুইটা পোশাকেই কাটিয়ে দেবে?”
তখনই বাড়িতে প্রবেশ করে আকরাম মিঞা। হাতে থাকা ব্যাগগুলো ঘরের বারান্দায় রাখতে রাখতে বলে, “তোমার চাচি কই বাজান?”
“চাচি তো,,,,,” আরজান কথা সম্পূর্ণ করা আগেই বাড়িতে প্রবেশ করে রোজিনা বেগম। সাথে একটা সতেরো/আঠারো বছরের মেয়ে। ভ্রু কুচকে তাকায় আকরাম মিঞা। রোজিনা বেগম মেয়েটাকে তাড়া দিয়ে বলে, “জলদি শুরু কর আবার কাজী আইসা পরবো। ভালা কইরা মেন্দি আঁকবি।”
বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আরজান। মেয়েটাকে বসতে বলে সে চলে যায় ঘরের দিকে। মেয়েটা দ্রুত বসে মেহেদী লাগাতে শুরু করে নিজের মতো করে। আকরাম মিঞা হেসে রোজিনা বেগমকে বলে, “তুই পারোসও রোজি। বুড়ি হইয়া গেলি অথচ মনের রং কমলো না তোর? আর দুইদিন পর পোলার বউ আইবো তখন কী করবি?”
“পোলার বউরে মন ভইরা সাজামু আমি। আপনের কতা শুনমু না সেইদিন।”
তার কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে আকরাম মিঞা। রূপকথা গভীর নয়নে চেয়ে আছে তাদের দিকে। হ্যাঁ, তারা ঝগড়া করছে কিন্তু তাও কতো মধুর লাগছে সেটা। বয়স বেড়েছে কিন্তু ভালোবাসার কমতি ঘটেনি তাদের মাঝে। ভালোবাসামাখা ঝগড়াগুলোও কতো মিষ্টি হয়। কিন্তু হায়! একজন জলপরির জীবনে কখনোই এমন দিন আসেনা। পানিতে সাঁতরেই জীবন কেটে যায়। ভালোবাসা পাবে কোথায়? বুড়ো বয়সে ভালোবাসা তো দুর, যৌবনেও তার ছোঁয়া পায় না কোনো জলপরি। ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপকথা। কী হবে এসব ভেবে? এই আফসোস যে ঘোচার নয়!
মেহেদী দেওয়া শেষ হলে রোজিনা বেগম সাবধানে তার হাত ধুইয়ে দেয়। রূপকথাকে নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যায় তাকে তৈরি করাতে। ঘরে ঢুকার পূর্বমুহূর্তে দেখা হয় আরজানের সাথে। সে গামছা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরোচ্ছে। একবার আড়চোখে রূপকথার দিকে তাকিয়ে আবার নজর সরিয়ে নেয়। বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় কলঘরের দিকে। গোসল ছাড়া তো আর বিয়ে করা যায় না। রূপকথার তো গোসল লাগেনা উল্টে গোসলেরই রূপকথাকে লাগে।
রূপকথা গাউন পড়ে নিলে রোজিনা বেগম ওরনাটা জড়িয়ে দেয় তার মাথায়। বেশ বড় ওরনা, সহজেই শরীর ঢেকে গিয়েছে। রূপকথাকে চুড়ি আর জুতা পরতে বলে সে আঁচলে বাঁধা চাবির গুচ্ছ ছাড়িয়ে আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেয়ে আলমারি বন্ধ করে হাসিমুখে এগিয়ে যায় রূপকথার কাছে। হাতে থাকা ছোট্ট বাক্সটা খুলে একটা স্বর্ণের চেইন বের করে আলগোছে পড়িয়ে দেয় রূপকথার গলায়। রূপকথা হতবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই মুচকি হাসে সে। দু’হাতে আলতো করে রূপকথার মুখখানা আগলে বলে, “আমার একটা মাইয়ার খুব শখ ছিলো, খোদা দিলোনা। এইডা বানাইয়া রাখছিলাম শখ কইরা। আইজ তোমারে দেইখা মনে হইতাছে আমার নিজের মাইয়ার বিয়া হইতাছে। এইডা ফিরাইয়া দিও না মা, তোমারে পইড়া থাকতে দেখলে আমার ম্যালা ভাল্লাগবো।”
ততক্ষণাৎ ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে রূপকথা। সে একজন মায়ের অভাব বোধ করেছে কতশতবার অথচ আজ না চাইতেও তা এসে ধরা দিচ্ছে তার নাগালে। জীবনের একটা আফসোস বোধহয় ঘুচল!
নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দেয় রোজিনা বেগম। দড়জায় কড়াঘাত পড়তেই দ্রুত চোখ মুছে এসে দড়জা খুলে দেয় সে। আকরাম মিঞা ব্যস্ত স্বরে বলে, “কাজী আইসা পড়ছে, হইছে তোমাগো?”
“আপনে যান, আমি ওরে নিয়া আইতাছি।” ধরা গলায় বলে রোজিনা বেগম।
ভ্রু কুচকায় আকরাম মিঞা, “তুই আবার কান্দস ক্যান? তোর বিয়া নাকি আইজ?”
হটাৎ এমনতর কথা শুনে তেতে ওঠে রোজিনা বেগম। স্বামীর মুখের ওপর সপাটে বন্ধ করে দেয় ঘরের দুয়ার। তা দেখে মুচকি হাসে রূপকথা। কিছুক্ষণ পর তাকে এনে বসানো হয় সেই বেঞ্চে। সামনেই চেয়ার পেতে বসে আছে একজন মুরব্বি। তার ভাবভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে সেই কাজী। পাশেই চোখ-মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। রাগে চোখদুটো লাল হয়ে আছে তার। বাবা-মায়ের সামনে না পারছে কিছু বলতে, না পারছে কিছু করতে। তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আরজান। মাথার ওরনাটা একহাতে ধরে সেদিকে তাকায় রূপকথা। সাদা পাঞ্জাবিটা ম্যাজিশিয়ানকে আজ সৌন্দর্যের শেখরে পৌঁছে দিয়েছে। সাদা পাঞ্জাবির উপর সোনালি সুতোর কাজটা যেন তার জন্যই করা হয়েছে।
কেউ কিছু বলার পূর্বেই রূপকথার পাশে এসে বসে পড়ে সে। কাজীর উদ্দেশ্যে তাড়া দিয়ে বলে, “নিন শুরু করুন।”
চোখ বড়বড় করে তাকায় কাজী। তার বিশ বছরের বিয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতার মাঝে এমনতর বিয়ের বর এই প্রথম দেখছে সে। যে কি-না নিজেই কাজীকে তাড়া দেয় বিয়ে পড়ানোর জন্য। কাজী হতবাক স্বরে কিছু বলার পূর্বেই আকরাম মিঞা বলে, “তয় একখান ঝামেলা আছে বাজান।”
ভ্রু কুচকায় আরজান। শুধায়, “কী হয়েছে চাচা?”
“সাক্ষী তো একজন কম পড়তাছে। তোমার হইয়া আমি আছি। তোমার চাচি নাকি মাইয়ার পক্ষের, তার মা হইবার শখ লাগছে। আর পলাশ হইবো মাইয়ার ভাই। রজত ভাইরে খুইজা আইলাম, সে বাড়িত নাই।”
সে কথা শেষ করার সাথে সাথে চিল্লিয়ে ওঠে পলাশ, “আমি ভাই?”
ধমকে ওঠে আকরাম মিঞা, “খাডাসের মতো চিল্লাস ক্যান? তোর মা মাইয়ার মা হইলে তুই কী চাচা হইবি? মাতাডা গরম করাস না কইতাছি, এমনেই সাক্ষী কম পড়তাছে।”
পলাশের অসহায় মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট চেপে হাসে আরজান। আকরাম মিঞার উদ্দেশ্যে বলে, “চিন্তা করিয়েন না চাচা। আমার সাক্ষী এখনি এসে পড়বে।”
তাদের কথপোকথনের মাঝেই কেউ পেছন থেকে বলে ওঠে, “আইয়া পড়ছি মিজিশিয়ান।”
চলবে,,,,