রূপকথার ম্যাজিশিয়ান পর্ব-৯+১০

0
1829

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_9

ভোর হতে না হতেই প্রকৃতি নিজের অসীম নিস্তব্ধতা কাটিয়ে উঠেছে। গ্রামের লোকজন অধিকাংশই খুব ভোরে উঠে পড়ে। যার দরুন ভোর হতেই চারদিকে বেশ হৈ-চৈ পড়ে গেছে। কেউ বা ছুটছে রান্নাঘরে আবার কেউ মাঠের দিকে। সকলেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এই সাত সকালে। কুয়াশা ঘেরা এই ভোরে শিকদার বাড়ির পরিবেশ পূর্বেই মতোই নিশ্চুপ। সমস্ত বাড়ি খুঁজেও রূপকথাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে বারান্দার কোনায় বসে আছে আরজান। শরীর থেকে চাদরটা ছাড়িয়ে ফেলে রেখেছে পাশেই। মেয়েটার চিন্তায় তার শীত যেন কোথাও ছুটে পালিয়েছে। আরেকটু হলেই হয়তো বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরতে শুরু করবে।

কপালে হাত রেখে আনমনে মাটির দিকে চেয়ে আছে আরজান। কোথায় খুঁজবে? কী করবে? কিছুই মাথায় আসছেনা তার। তখনই হটাৎ পানির খলবল শব্দ ভেসে আসে। একবার মাথা তুলে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নেয় সে। মনের ভুল হয়তো! মাছ নেই পুকুরে, শব্দ হবে কিসের?

পুনরায় পানির জোরালো শব্দে বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে তাকায় সে। আকস্মাৎ মাথায় আসে, সে যাকে হন্যে হয়ে কামরায়-কামরায় খুঁজে চলেছে সে কোনো সাধারণ মানবী নয় বরং জীবন্ত এক জলরূপসী। যার আসল ঠিকানা পানি, তাকে কী করে স্থলে খুঁজে পাবে সে?

ততক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হুরমুরিয়ে পুকুরের দিকে ছোটে আরজান। পাড়ে দাঁড়িয়ে পুরো পুকুর পর্যবেক্ষণ করেও কোথাও রূপকথার কোনো হদিশ পায় না সে। পাবে কী করে? পানির উপরে অনেকটা জুরে কুয়াশার চাদরে ছেয়ে আছে। পানির উপরিভাগ কুয়াশার সাদা আচ্ছাদনে একাকার। ঠিকঠাকভাবে পানি পর্যন্ত নজর যাচ্ছে না তবে পানির খলবল শব্দ ঠিকই শ্রবণগোচর হচ্ছে। শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেও কিছু দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠে আরজান।

তখনই ভেসে আসে কারোর মায়া মিশ্রিত কন্ঠস্বর, “ম্যাজিশিয়ান”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত স্বরে কিছু বলতে নিয়েও আবার থেমে যায় আরজান। পুনরায় ভেসে আসে সেই ডাক, “ম্যাজিশিয়ান”

উত্তর দেয় না আরজান। বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় বারান্দায়। নিচে বসে থাকার ফলে তার পোশাকে যে ধুলো লেগেছিল তা ঝারতে ঝারতে পেতে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে বসে পড়ে ধপ করে। চিন্তার রেখা মুছে গিয়ে মুখ জুরে ফুটে উঠেছে রাগের লেলিহান। কপালে হাত রেখে চোখদু’টো বন্ধ করে নেয় সে। তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসে রূপকথা। মুহূর্তেই তার আঁশটেযুক্ত লেজ বিলীন হয়ে সাধারন এক রমনীর রূপ পায় ধারন করে সে। সেই সাথে বদলে যায় তার পোশাক-পরিচ্ছদ। শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায় আরজানের দিকে। নরম স্বরে শুধায়, “কথা বলবে না ম্যাজিশিয়ান?”

ঝট করে চোখ খুলে তাকায় আরজান। তাকে এতো চিন্তার মধ্যে ফেলেও মেয়েটা কতোটা স্বাভাবিক। সে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোমার সাথে কথা বলার জন্য মজুরি নিয়ে রেখেছি নাকি আমি?”

“তুমি বুঝি মজুরি ছাড়া কোনো কাজ করো না?”

রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজান। তাকে হয়রান করে আবার তার সাথেই কি-না তর্ক করছে! সে বিরক্ত স্বরে বলে, “বেশি কথা বলো না তো। শান্তিতে একটু থাকতে দাও।”

ব্যাস! আর কোনো শব্দ আসে না অপরপাশ থেকে। ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান। ঠকঠক করে একনাগাড়ে কেঁপে চলেছে রূপকথা। আরজান আর কিছু না বলে বারান্দায় ছেড়ে রাখা চাদরটা তুলে নিয়ে এগিয়ে দেয় রূপকথার দিকে। নিঃশব্দে সেটা নিয়ে নিজের শরীরে জড়িয়ে নেয় রূপকথা।

আরজান আকাশের দিকে চেয়ে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে শুধায়, “শীত লাগছে তাহলে পানিতে কী করছিলে তুমি? ঘরে থাকা উচিত ছিলো না তোমার?”

দু’হাতে শক্ত করে চাদর ধরে তার দিকে ফিরে তাকায় রূপকথা। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, “পানিতে আমার শীত লাগে না বরং পানির নিচে আলাদা এক উষ্ণতা পাই। ঘরে শীত নিবারণের কিছু না পেয়ে ওখানে গিয়েছিলাম।”

এবার দমে যায় আরজান। রূপকথা পানি থেকে উঠে আসলে অনেক রাগারাগি করবে ভাবলেও এখন আর তা হয়ে ওঠে না। ভুলটা তো তারই, এই শীতের রাতে মেয়েটাকে লেপ-কম্বল না দিয়ে চলে গেছে। সে আবারো শুধায়, “সারারাত ওখানেই ছিলে?”

রূপকথা উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই অবাক হয় আরজান। ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে দ্রুত হাতে টিনের বড় বাক্স খুলে লেপ বের করে বিছানায় রাখে। বাক্স বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলে, “বিছানায় লেপ রেখেছি যাও ওটা জড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ো। আমি বাজারে যাচ্ছি, একটু পরে খাবার আর শীতের পোশাক নিয়ে আসবো।”

কথা সম্পূর্ণ করে সদর দড়জার দিকে পা
বাড়াতেই ডেকে ওঠে রূপকথা, “আর একটু থাকো না ম্যাজিশিয়ান?”

দাঁড়িয়ে যায় আরজান। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় রূপকথার দিকে। ধমকে উঠতে চায় সে কিন্তু কাঁপতে থাকা রূপকথার দিকে নজর পড়তেই তার স্বর স্বাভাবিক হয়ে আসে। পুনরায় নজর হটিয়ে বলে, “তুমি ভেতরে যাও, আমি আসছি একটু পরে।”

আর কিছু বলেনা রূপকথা। নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় আরজান। তাকে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় ততক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে রূপকথা। আরজান সদর দড়জা পেরিয়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলে ধীর পায়ে ঘরে উঠে যায় সে। বিছানায় শুয়ে ব্যস্ত হাতে লেপ টেনে জড়িয়ে নেয়। লেপের তলায় যাওয়ার পরেও চাদরটা ছাড়ে না সে। সেভাবেই জড়িয়ে রাখে নিজের সাথে।
_________________________

রাস্তায় ইতিমধ্যে লোকজনের সমাগম শুরু হয়ে গিয়েছে। ছোট-ছোট বাচ্চাগুলোও এই শীতের সকালে দ্রুত উঠে পড়েছে। এতক্ষণে অবশ্য বেশ ভালোই দিনের আলো ফুটে গিয়েছে। কুয়াশাও কমতে শুরু করছে। বাজারের দিকে হাঁটছে কয়েকজন, হয়তো চা খেতে। গ্রামের বাজারের দোকানগুলোও সকাল সকাল খোলা হয়। চায়ের দোকানে তো ভীর লেগে যায়। মুরুব্বিরা সেখানে বসে চা খেতে খেতে নানারকম খোশগল্পে মেতে ওঠে। তার পাশাপাশি একজন মুরব্বি হেঁটে যাচ্ছে।

আরজানকে দেখে শুধায়, “কোন গেরামের পোলা তুমি? আগে দেখছি বইলা তো মনে হয় না।”

চমকে ওঠে আরজান। সে তো এই গ্রামেরই ছেলে কিন্তু আফসোস কেউ তাকে চেনে না। গলা ঝেড়ে বলে, “আমি শহর থেকে এসেছি, মেলায় জাদু দেখাতে।”

“ওহহো! তুমি তাইলে মিজিশিয়ান।”

চোক-মুখ কুচকে ফেলে আরজান। কিছুটা উচ্চস্বরে বলে, “মিজিশিয়ান নয় ম্যাজিশিয়ান হবে।”

“ঐ হইলো, একই কতা। আমাগো গেরামেও ম্যালা বড় মিজিশিয়ান ছিল তয় অহন আর নাই। বেচারা ডাকাতের হাতে মইরা গেছে ম্যালাদিন আগে। আরিজ শিকদার নাম তার, বড় ভালা মানুষ ছিল।” লোকটা আফসোসের স্বরে বলে ওঠে।

থমকে দাঁড়ায় আরজান। তার বাবার কথা এরা মনে রেখেছে তাহলে। হটাৎ ডাকাতদলের কথা মনে পড়তেই লোকটাকে শুধায়, “হেলাল বেপারীর বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারবেন? বা তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

কিছুক্ষণ ভাবে লোকটা অতঃপর খানিক উচ্চস্বরে বলে ওঠে, “হ্যাঁ, মনে আইছে, মনে আইছে। হেলাল বেপারী তো? তারে তুমি এই বেলায় তো বাজারেই পাইবা। সকাল কইরা চা খাইতে আসে।”

স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে আরজান। লোকটাকে তাহলে আর বেশি খুঁজতে হবেনা। পাশের মুরব্বিটা পুনরায় বলে ওঠে, “বয়স হইছে তো, হুট কইরা কিছু মনে আসেনা। ম্যালাক্ষন ঠাহর করা লাগে।”

“হুম বুঝেছি, ধন্যবাদ।”

মুরব্বি আরো কিছু বলতে চায় কিন্তু তার আগেই বড়বড় পা ফেলে অনেকটা এগিয়ে যায় আরজান। তাকে নাগালের মধ্যে না পেয়ে সে আফসোসের স্বরে বলে ওঠে, “এককালে আমিও এমনে হাঁটবার পারতাম রে ছোকরা। তোগো সময় এহন, জোয়ানকালে তোর চাইতে বেশি জোর ছিল আমার পা’য়।”

কথাগুলো শ্রবণগোচর হলেও আর ফিরে তাকায় না আরজান। তার এখন আগে হেলাল বেপারীর সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজারে পৌঁছায় সে। বেশ কয়েকটা দোকান খোলা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাজারের শেষ মাথায় চায়ের দোকান। সেখানে গিয়ে বাশ আর কাঠ দিয়ে বানানো বেঞ্চিতে বসে পড়ে আরজান। তার পাশেই আরো কয়েকজন লোক বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। চায়ের দোকানি শুধায়, “রং চা খাইবেন নাকি দুধ চা খাইবেন?”

“রং চা।” চারপাশে দেখতে দেখতে বলে ওঠে আরজান। এখন হেলাল বেপারীকে চিনবে কীভাবে? এদের কাছে জিজ্ঞাসা করবে? কিন্তু ডাকাতরা তো গ্রামের মানুষের সাথে মিশে গেছে। তারা যদি কেউ এখানে উপস্থিত থাকে তাহলে তো সতর্ক হয়ে যাবে।

ভাবনার মাঝেই দোকানি এসে সকলের হাতে হাতে চা দিয়ে যায়। আনমনে চা হাতে ধরে চারদিকে নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে আরজান। তখনই একজন মাঝবয়সী লোক এসে তার পাশে বসে দোকানিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “একখান চা দিস তো, কড়া কইরা।”

তার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে পাশের একজন সেই লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, “হেলাল বেপারী যে, আইজ এতো দেরি করলা ক্যান?”

“আর কইয়েন না সবুর ভাই। পোলা আইতাছে, বউ সকাল কইরা ঘর থেইকা মুরগি বাইর করছে। সাথে ধইরা জবাই কইরা দিয়া আইলাম।”

কিছুক্ষণ পর তার চা চলে এলে খেতে খেতে তারা গল্পে মেতে ওঠে। এতো মানুষের সামনে কিছু বলতে না পেরে হাঁসফাঁস করছে আরজান। হটাৎ হেলাল বেপারীর নজর তার দিকে পড়তেই বলে ওঠে, “তোমার চা তো ঠান্ডা হইয়া আইলো। খাও না ক্যান?”

হকচকিয়ে যায় আরজান। আমতা আমতা করে বলে, “আমি বেশি গরম চা খাই না। একটু ঠান্ডা করেই খাই।”

“তুমি কি শহর থেইকা আইছো?”

“হুম” চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে আরজান।

“আমার পোলাও শহরে থাকে। আকাশ নাম, চেনো?” আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে হেলাল বেপারী।

“না।” ছোট করে উত্তর দেয় আরজান।

“তাইলে আইজ আইলে দেইখা নিও।” কথা বলতে বলতে হটাৎ কী মনে পড়ায় হন্তদন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পরে সে। দোকানিকে টাকা দিতে দিতে বলে, “আকাশের মা পোলার লিগা নতুন লুঙ্গি নিতে কইছিল। দ্যাখছো, এক্কেবারে ভুইলা বইছিলাম।”

দ্রুত কাপড়ের দোকানের দিকে ছোটে সে। চা রেখে সেদিকে তাকায় আরজান। এটাই সুযোগ, এখনি বলে দিতে হবে। দ্রুত টাকা দিয়ে সেও বেরিয়ে পড়ে পেছন-পেছন। দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আচমকা সামনে এসে দাঁড়ানোতে ভ্রু কুচকে তাকায় হেলাল বেপারী। শুধায়, “কিছু কইবা?”

উপর-নিচ মাথা নাড়ায় আরজান। দ্রুত সবকিছু খুলে বলতে থাকে। সমস্ত ঘটনা শুনে গলা শুকিয়ে আসে হেলাল বেপারীর। চোখ বড়বড় করে ভীত স্বরে বলে, “আমার পোলারে মাইরা ফালাইবো কইছে?”

“হুম, আপনি ওকে আজ আসতে নিষেধ করে দিন মোবাইল করে। এরপর কাউকে না জানিয়ে একদিন হুট করে দিনের বেলায় চলে আসতে বলবেন। সাথে যেন বেশি টাকা-পয়সা না নিয়ে আসে সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দিবেন।”

“ওগোরে জানাইলো কেডা কও তো? আমি তো কিরা কইরাও কাউরে কই নাই। আকাশের মার তো গল্প করা স্বভাব, হেই বেডিই পাড়ায় যাইয়া গল্প কইরা আইছে।” রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে হেলাল বেপারী।

“থাক, এসব নিয়ে রাগারাগি না বাঁধিয়ে আগে আকাশকে সাবধান করে দিন।”

কেউ আসার আগেই আরজান জোরে পা চালিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। ভীত মুখ নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে হেলাল বেপারী। কিছুক্ষণ পর ধ্যান ভাঙতেই আগে ফতুয়ার পকেট থেকে বাটন মোবাইলটা বের করে ছেলেকে কল দিতে দিতে হাঁটতে শুরু করে। ততক্ষনে আরজান কাপড়ের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছে। দোকানি তাকে দেখে দ্রুত টুল পেতে দিয়ে ফোকলা দাঁতে হেসে বলে, “আবার আইছেন সাহেব? কী লাগবো কন।”

“শীতের পোশাক আছে আপনার দোকানে?” শুধায় আরজান।

“নাই আবার কী? সব পাইবেন আমার দোকানে। কী দিমু কন? সোইটার দিমু নাকি কালা জ্যাকেট দিমু? জ্যাকেটগুলা এক্কেবারে ত্যালত্যালে, পইড়া আরাম পাইবেন। চাইলে চাদ্দরও নিবার পারেন।” একদমে বলে যায় লোকটা।

বিরক্তি নিয়ে তাকায় আরজান। এতো বকবক করে কেন এই লোকটা? ভাগ্যিস গ্রামে এই একটাই কাপড়ের দোকান নাহলে তো এর দোকানে কেউ ভুলেও আসতো না এই বকবক শুনতে! সে রাগান্বিত স্বরে বলে, “মেয়েদের জন্য ভালো কোনো আরামদায়ক শীতের পোশাক দেখান।”

লোকটা পুনরায় বলে, “বউয়ের লিগা নিবেন?”

চোখ রাঙিয়ে তাকায় আরজান। ততক্ষণাৎ চুপসে যায় দোকানির মুখশ্রী। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পোশাক বের করতে। শীতের জন্য কয়েকটা মোটা মোটা বস্ত্র বের করে আরজানের সামনে রাখতেই সে ধবধবে সাদা রঙের উলের তৈরি পোশাকটা তুলে নিয়ে বলে, “এইটা প্যাকেট করে দিন।”

দোকানি চুপচাপ সেটা নিয়ে একটা কাপড়ের শপিং ব্যাগে ভরে দেয়। আরজান সেটা হাতে তুলে নিয়ে শুধায়, “দাম কতো?”

“পাঁচশো ট্যাকা।”

পকেট থেকে টাকা বের করে দোকানির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরজান বলে, “মানুষের জীবনে বউ ছাড়াও আরো অনেক মেয়ে থাকে। মা, বোন, ভাবি, চাচি, দাদি আরো কতজন।”

দোকানি টাকা নিয়ে ধীর স্বরে জবাব দেয়, “আর কমু না সাহেব।”

চুপচাপ বেরিয়ে আসে আরজান। জুতার দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কী ভেবে আবার রূপকথার জন্য আন্দাজ মতো একটা বাড়ি পড়ার স্যান্ডেল নিয়ে নেয়। অতঃপর খাবারের হোটেলের সামনে গিয়ে শুধায়, “কী কী আইটেম আছে?”

দোকান থেকে ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে বলে, “কী কইলেন সাহেব? বুঝবার পারি নাই।”

“তুমি এখানে কাজ করো?”

“না সাহেব, এইডা আমার আব্বার হোটেল। আইলাম আব্বারে একটু কামে সাহায্য করবার লিগা আর খাওনের লিগা। আমি ছাড়া আমার আব্বার আর কেউ নাই। তাড়াতাড়ি কন সাহেব, আমার আবার স্কুলে যাইতে হইবো।”

“স্কুলে যাও তুমি?

“হ, আমার আব্বায় কইছে আমারে পড়ালেখা কইরা ম্যালা বড় হতে হইব।”

“ঠিকই তো বলেছে তোমার আব্বু। আচ্ছা বলোতো মাছ আছে তোমাদের এখানে?”

“আছে সাহেব, মাছ, ডিম সব পাইবেন।”

“ঠিক আছে, চারটা ডিম আর ছয় পিচ বড়বড় দেখে মাছ দাও। সবজি বা ডাউল থাকলে সাথে দিয়ে দিও। ভাত দিও চারজনের খাওয়ার মতো।”

টাকা পরিশোধ করে দিয়ে একহাতে খাবারের প্যাকেট অন্য হাতে পোশাকের ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করে সে।
পথিমধ্যে হুট খরে রজত হাওলাদারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দ্রুত পাশ কাটিয়ে যেতে চেয়েও আর শেষ রক্ষা হয়না। রজত হাওলাদার অবাক চোখে চেয়ে শুধায়, “এতোকিছু নিয়া কই যাও?”

“কোথায় আবার? যেখানে থাকি সেখানেই।”

রজত হাওলাদারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জোর কদমে হেঁটে চলে যায় আরজান। এই লোকটা সুযোগ পেলেই শুধু প্রশ্ন করতে থাকে। বিরক্ত মুখে বাড়ি পৌঁছে দ্রুত সদর দড়জা লাগিয়ে দেয়। সামনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় রূপকথা তার চাদরটা শরীরে জড়িয়ে বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারটাতে চুপচাপ বসে আছে। তাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে এসে শুধায়, “এতো দেরি হলো কেন তোমার?”

আরজান একহাতে খাবার আর পোশাকটা ধরে স্যান্ডেল জোড়া তার সামনে রাখতে রাখতে বলে, “দেরি কই মেয়ে? খাওয়া লাগবে না তোমার? সবকিছু কিনতে এটুকু দেরি তো হবেই।”

“কিন্তু অনেক বেশি দেরি করেছো তুমি।”

“তুমি কী আমার উপর অধিকার খাটাতে চাইছো?” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে আরজান।

পেছন পেছন স্যান্ডেল হাতে দৌড়ে আসে রূপকথা। পুনরায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই ধমকে ওঠে আরজান, “হাতে নিয়েছো কেন ওটা? পায়ে দাও আর কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নাও।”

তার ধমকে কিছুই মনে করেনা রূপকথা। ধীরে সুস্থে স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। ফিরে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলে, “কই? দাও খাবার।”

অতিশয় বিরক্ত হয় আরজান। রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধপাধপ পা ফেলে রান্নাঘরে গিয়ে জগ-গ্লাস আর প্লেট নিয়ে ধুয়ে আনে। অতঃপর প্লেট এনে ভাত-তরকারি বেড়ে দেয় রূপকথার সামনে। রূপকথাকে খেতে দিয়ে জগ নিয়ে গিয়ে আবার কল থেকে পানি এনে বিছানার পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বলে, “খাওয়া হলে এগুলো ধুয়ে এনে এই টেবিলে রাখবে। আজ আর আসবোনা আমি। দয়া করে খাবার বেড়ে খেয়ে নিও।”

“কিন্তু আমি তো আগে কখনো এসব করিনি।” খেতে খেতে উত্তর দেয় রূপকথা।

“তাহলে না খেয়ে থেকো, আমার কী? বলার দরকার বললাম এখন খাবে কি না খাবে তোমার ব্যাপার।”

কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আরজান। এঁটো হাতে দৌড়ে আসে রূপকথা। তাকে আসতে দেখে বিরক্ত মুখে ফিরে তাকায় আরজান। রাগান্বিত স্বরে শুধায়, “আবার কী?”

“তুমি খেয়েছো?” শুধায় রূপকথা।

চলবে,,,,

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_10

দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল হতে শুরু করেছে। গোসল সেরে বিছানায় এসে বসেছে আরজান। মোবাইলটা হাতে নিয়ে মায়ের কোনো কল দেখতে না পেয়ে অবাক হয় সে। এতক্ষণ মায়ের সাথে কথা হয়নি অথচ মা কোনো কল দেয়নি! দ্রুত মায়ের নম্বরে কল লাগায় সে। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করে সোফিয়া শিকদার। সাথে সাথে আরজান বলে ওঠে, “মা”

উত্তর দেয় না সোফিয়া শিকদার। অবাক হয় আরজান, পুনরায় শুধায়, “মা, শুনতে পাচ্ছো?”

“হুম, শুনতে পাচ্ছি বল।” গম্ভীর স্বরে উত্তর দেয় সোফিয়া শিকদার।

“তুমি ঠিক আছো তো?” চিন্তিত স্বরে শুধায় আরজান।

“আমার আবার কী হবে? তোর আবার কোনো চিন্তা আছে নাকি আমাকে নিয়ে?”

“এভাবে বলছো কেন মা? কাল মেলা শেষ হলেই পরশু সকালের ট্রেনে আমি চলে আসবো।”

“তোর আর আসতে হবে না, আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাক। লামিয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছে গ্রামে যাওয়ার। আমি আর তোর খালামণি ভাবছি যে তোদের বিয়েটাও গ্রামেই দিব। কাল-পরশু চলে আসবো আমি আর লামিয়া, বিয়ের আগ দিয়ে তোর খালামণিরাও চলে আসবে।”

হতভম্ব স্বরে আরজান শুধায়, “বিয়ে! মাথা ঠিক আছে তোমার? যেখানে আমার সংসার করার কোনো ইচ্ছাই নেই সেখানে শুধু শুধু বিয়ে করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারবোনা। আমি কিছুতেই ওকে বিয়ে করবোনা। তোমাকে আর কীভাবে বললে বুঝবে বলোতো?”

ধমকে ওঠে সোফিয়া শিকদার, “একদম বেশি কথা বলবি না। অনেক শুনেছি তোর কথা, আর নয়। নিজের মন-মর্জি মতো চলতে চলতে তুই লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিস। এবার আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে। বিয়ে না করলে আমার মরা মুখ দেখবি এই বলে রাখলাম।”

রাগান্বিত স্বরে কথাগুলো বলে খট করে কল কেটে দেয় সোফিয়া শিকদার। ছেলেকে জব্দ করতে হলে তাকে কঠোর হতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে ছেলের সামনে কঠোর হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আজ লামিয়ার বুদ্ধিতে এটুকু বলতে পেরেছে তবুও অনেক কষ্টে। তার সামনে দাঁড়িয়ে সমানে মুখ চেপে হাসছে লামিয়া। হাসি থামিয়ে তাকে বাহবা দিয়ে বলে ওঠে, “বাহ! কী অভিনয় করেছো তুমি খালামণি। এক মুহূর্তের জন্য তো আমিই থমকে গিয়েছিলাম।”

পাশের টি-টেবিল থেকে দ্রুত গ্লাস উঠিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয় সোফিয়া শিকদার। অতঃপর চোখ বড়বড় করে বলে, “বজ্জাত মেয়ে, তুই হাসছিস? এদিকে আমার তো গলা শুকিয়ে আসছিল। আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেতাম।”

“ওকে এতো ভয় পাও কেন তুমি বলোতো? Be positive!” হাসতে হাসতে বলে লামিয়া।

অপরদিকে হতভম্বের ন্যায় বসে রয়েছে আরজান। মা কী বললো এগুলো? বিয়ে! আর সে! কখনোই না। এসব সংসার-টংসার তার দ্বারা হবে না। দিনকে দিন মায়ের পাগলামি বেরেই চলেছে। তাকে কি-না বিয়ের জন্যে মরার ধমকি দিচ্ছে! সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার! আসতে চাইছে আসুক কিন্তু বিয়ে সে করবেনা কিছুতেই। তখনই জোর গলায় ডেকে ওঠে রোজিনা বেগম, “খাইবা না বাপ? ভাত বাইড়া রাখছি তোমার লিগা।”

“হ্যাঁ, আসছি চাচি।”

সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দ্রুত খাবার খেয়ে নিয়ে জাদুর সরঞ্জাম হাতে বেরিয়ে পড়ে মেলার দিকে। জাদুর সময় এখনো হয়নি তাই আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সবকিছু। রজত হাওলাদার তার মোবাইলটা কানে ধরে মেলার মাঠে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। হয়তো কারোর সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু নেটওয়ার্ক মিলছে না এখানে। মোবাইলটা কান থেকে সরিয়ে আবার মাঝে মাঝে ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে। অবাক হয় আরজান, এ কেমন পদ্ধতি নেটওয়ার্ক আনার!

তাকে দেখতে দেখতে হাশেমের দোকানে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে আরজান। অমনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে হাশেম। গালভর্তি হাসি দিয়ে বলে, “চা খাইবেন মিজিশিয়ান?”

“হুম, দাও।” মেম্বারের দিকে চেয়েই উত্তর দেয় আরজান।

হাশেম চা বানাতে বানাতে বলে ওঠে, “ঐদিকে কী দেখতাছেন এমনে?”

“হুম?” নজর সরিয়ে হাশেমের দিকে তাকায় আরজান।

“কইতাছি যে, কী দেখতাছেন?” পুনরায় শুধায় হাশেম।

“মেম্বারকে দেখছি। দেখো কীভাবে মোবাইল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কথা বলছে। এখানে নেটওয়ার্ক না পেলে পরেও তো কথা বলা যায় কিন্তু সে রীতিমত যুদ্ধ করছে মোবাইলের সাথে।”

“ওহ, পোলা কল দিছে বোধহয়।”

“ছেলে আছে উনার? দেখলাম না তো একদিনও।”

“দ্যাখবেন কেমনে? শহরে থাকে তো। কলেজ পাশ করনের পর মেম্বারসাব আরো উপরের পড়া পড়ার লিগা পাঠাইছিল আর আসেনাই, চাকরি-বাকরি করে শহরেই। মাসে-চাঁদে একদিন আসে আবার চইলা যায়।”

কথা বলতে বলতে চা এনে দেয় হাশেম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার সেদিকে ফিরে তাকায় আরজান। ইতিমধ্যে ছুটোছুটি থেমে গেছে মেম্বারের। সে আপাতত ভীর থেকে দূরে মেলার এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইল কানে ধরে চিন্তিত মুখে কিছু একটা বিশ্লেষণ করে চলেছে অপরপাশের ব্যাক্তিটার কাছে। কথা শেষ করেও মোবাইল হাতে ধরে কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে।
হটাৎ আরজানের দিকে নজর পড়াতে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তোলে মুখে।

আরজান দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে আর এক মূহুর্ত থাকা যাবেনা। সে একদম নিশ্চিত মেম্বার এখন তার কাছেই আসবে। সুযোগ পেলেই লোকটা প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসে। তাকে দাঁড়াতে দেখে হাশেম হন্তদন্ত হয়ে শুধায়, “কী হইলো মিজিশিয়ান? পিঁপড়ে কামড়ায়ছে?”

হকচকিয়ে যায় আরজান। হতবাক স্বরে শুধায়, “তোমার এমন মনে হলো কেন?”

“ধাম কইরা দাঁড়াইয়া গেলেন দেইখা জিগাইলাম।”

এমন একটা মেজাজ খারাপ করার মতো কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া করে না আরজান। হাশেমকে চিনতে তার আর বাকি নেই। এর সাথে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ এইসব উজবুকের মতো কথাবার্তা শুনতেই হবে। তাই চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। এতে মাথা তো ঠান্ডা হয়ই না বরং হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তাকে চোখ বন্ধ করে এভাবে শ্বাস টানতে দেখে হাশেম চোখ বড়বড় করে শুধায়, “আপনে কি এস্টক করতাছেন মিজিশিয়ান? ভ্যান ডাকমু না ডাক্তার ডাকমু?”

হটাৎ আশ্চর্যজনক কথাটা কানে আসতেই ঝট করে চোখ মেলে তাকায় আরজান। হাশেমের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “তোমার কথা শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে একবারে ভ্যান আর ডাক্তার ডাকিও।”

হাঁ করে তাকায় হাশেম। বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে হাশেমের হাতে দিয়ে গটগট করে চলে যায় আরজান। যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে বলে, “আহাম্মক কোথাকার!”

তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় রজত হাওলাদার। বিরক্তির শ্বাস ছাড়ে আরজান। বিড়বিড়িয়ে বলে, “এক মসিবতকে বিদায় দিতে না দিতেই আরেক মসিবত হাজির।”

“কিছু কি কইলা?” সন্দেহের চোখে শুধায় রজত হাওলাদার।

“নাহ, কী বলবো? জাদুর সময় হয়ে গেছে আমি যাই।”

“আরে বেলা হয়নাই। চলো ইসটেজে বইসা দু’দন্ড আলাপ-টালাপ করি।”

না চাইতেও স্টেজে উঠে পেতে রাখা চেয়ারগুলোর থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে আরজান। রজত হাওলাদার তার পাশেই এসে বসে। তারপর তার দিকে চেয়ে আগ্রহের সাথে শুধায়, “তারপর কও, কিরাম লাগতাছে আমাগো গেরাম? অসুবিদে হইতাছে না তো?”

“না না, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বেশ ভালোই লাগছে আমার।” জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে আরজান।

“তা তুমি কি বিয়া-সাদি করছো? ভালা ভালা মাইয়া আছে কিন্তু আমাগো গেরামে, খুইজা দিমু ?”

ক্রমেই রাগ উঠে যাচ্ছে আরজানের। ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে রাগান্বিত স্বরে কিছু বলতে যাবে তখনই স্টেজের পাশ থেকে ভেসে আসে আকরাম মিঞার কন্ঠস্বর। সে রজত হাওলাদারের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলে ওঠে, “নাইমা আসেন তো মেম্বার ভাই, কতা আছে।”

“হ, আসতাছি চেয়ারম্যান ভাই।”

আরজানের দিকে চেয়ে বলে, ” দু’দন্ড কতা কওয়ার’ও
ফুরসত পাই না আমি। বেলা হইয়া আইলো জাদু শুরু কইরা দিও তুমি।”

আরজান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। রজত হাওলাদার স্টেজ ছেড়ে নেমে গেলে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে সে। জাদু দেখার আশায় ইতিমধ্যে স্টেজের সামনে ভীর জমতে শুরু করেছে। শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ছেলেগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাদেরকে বসতে অনুরোধ করছে। তারা চেষ্টা করেও একসঙ্গে এতো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ চিৎকার-চেঁচামেচি, হৈ-হট্টগোল লেগেই আছে। কান চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় আরজান। অমনি নীরব হয়ে যায় সকলে, আগ্রহের সাথে চেয়ে থাকে জাদু দেখার আশায়।

আর দেরি করে না আরজান। জাদুর সরঞ্জাম থেকে ধবধবে সাদা রঙের কাপড়ের টুকরো হাতে নিয়ে দর্শক সারিতে একবার নজর বুলিয়ে নেয়। কাপড়ের টুকরোটাতে ফু দিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শূন্যে নিক্ষেপ করতেই তা একগুচ্ছ গোলাপে রূপান্তরিত হয়ে আরজানের হাতে পড়ে। উত্তেজনায় চিল্লিয়ে ওঠে উপস্থিত জনতা। অমনি ফুলের গুচ্ছটা দর্শকদের মাঝে ছুড়ে মারে আরজান। সকলে হামলে পড়ে সেটার ওপর। একটা ছোট ছেলে ফুলগুলো পেয়ে লাফাতে শুরু করে খুশিতে। তা দেখে মুচকি হেসে পুনরায় জাদু প্রদর্শন করতে থাকে আরজান।

জাদু দেখানো শেষ করে ধীরে সুস্থে নেমে আসে স্টেজ থেকে। মেলার মাঠে প্রবেশের পথ দিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ সাথে করে পলাশকে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হয় সে। ব্যাটা এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেছে! উঁহু, ভালোমতো ধোলাই হয়নি বোধহয়। আরো কিছুদিন বিছানায় পড়ে থাকতে পারতো। শুধু শুধু আবার ঝামেলা করতে হবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পলাশ তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আরোও হতবাক হয় আরজান। আফসোস করে বিড়বিড়িয়ে বলে, “আহা! একটাবার চোখ গরম করেও তাকালো না। নাকি মাইরের চোটে বুঝতেই পারেনি কে ধোলাই করেছে?”

আচমকা রূপকথার কথা মনে আসতেই ভরকে যায় সে। নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে দর্শকের ভীরে। দৌড়ে এগিয়ে যায় ভীরের মাঝে কিন্তু কোথাও নজরে আসে না রূপকথা। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে বেরিয়ে আসে সে। হাঁপ ছেড়ে বলে, “আজ আসেনি বোধহয়।”

স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করতে মেলার মাঠ ত্যাগ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেসে আসে সেই মায়ায় ভরা কন্ঠস্বর।

“ম্যাজিশিয়ান”

চকিতে ফিরে তাকায় আরজান। রূপকথাকে হেঁটে আসতে দেখে ততক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পরে সেখানে। কাছাকাছি আসতেই ধীর কন্ঠে বলে ওঠে, “তুমি এখানে কী করছো? বাইরে কেন এসেছো?”

উত্তর দেয় না রূপকথা উল্টো নিজেই শুধায়, “তুমি আমাকে ফুলগুলো দিলে না কেন?”

“ফুল? কীসের ফুল?” ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান।

“ঐযে তুমি দিয়ে দিলে বাচ্চা ছেলেটাকে। আমাকে কেন দিলে না?”

“ওহ, ঐ ফুলের কথা বলছো। ওটাতো এমনিই ছুড়ে মেরেছিলাম, যে ধরতে পারে আর কি। কাউকে উদ্দেশ্য করে দেয় নি।”

কথা সম্পূর্ণ করেই আবার চোখ বড়বড় করে তাকায় আরজান। অবাক স্বরে শুধায়, “তারমানে তুমি মেলায় ছিলে? দেখতে পেলাম না তো।”

“তুমি তো আমার দিকে তাকাও নাই, দেখবে কীভাবে?”

আরজান কিছু বলার পূর্বেই পুনরায় শুধায় রূপকথা, “তুমি বুঝি আমাকে খুঁজছিলে?”

বিরস মুখে তাকায় আরজান। ঝাঁঝালো স্বরে বলে, “পাগলে ধরেছে নাকি আমাকে? এতো সময় নেই আমার।”

“পাগলে কীভাবে ধরে ম্যাজিশিয়ান? তুমি কিন্তু প্রচুর উল্টা-পাল্টা কথা বলা শুরু করেছো।” চোখ-মুখ কুচকে বলে ওঠে রূপকথা।

চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে আরজানের। রাগান্বিত স্বরে বলে, “বেশি বকবক করো না তো, তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাও। আর এভাবে হুটহাট একা একা বাইরে চলে আসো কেন? ঐ ছেলেটা যদি আবার ক্ষতি করতে আসে তখন কী করবে তুমি? বারবার কি তোমাকে ভূত বাঁচাতে আসবে? ভূতের তো আরো অনেক কাজ আছে নাকি?”

কথাটা বলে যেন নিজেই আহাম্মক বনে যায় আরজান। সে কি-না নিজেকে নিজে ভূত বলছে! কী দিনকাল পড়লো! এই মেয়ের সাথে থাকলে সে বোধহয় খুব দ্রুত মরে বাস্তবেই ভূত হয়ে যাবে। রূপকথাকে নিজের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে দেখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে, “ধুর!”

চেয়ারম্যানের বাড়ির রাস্তা ছেড়ে উল্টো ঘুরে শিকদার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে জোর কদমে। এত জোরে জোরে পা চালাচ্ছে যেন পারলে সে উড়েই চলে যাবে বাড়িতে। পেছন থেকে দৌড়ে আসছে রূপকথা। দৌড়াতে দৌড়াতে চিল্লিয়ে ডাকতে থাকে, “আরে দাঁড়াও না ম্যাজিশিয়ান। এতো জোরে জোরে হাঁটছো কেন? আমাকে সাথে নিয়ে যাও।”

কে শোনে কার কথা। তার ডাকাডাকিতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না আরজান। নিজের মতোই পূর্বের গতি বজায় রেখে হাঁটতে থাকে সে। রূপকথার এতো চিল্লাচিল্লি যেন তার কর্ণ গহ্বরে গিয়ে পৌঁছাচ্ছেই না।
কিছুক্ষন দৌড়ে অবশেষে হাঁপিয়ে ওঠে রূপকথা। দাঁড়িয়ে পড়ে বড়বড় শ্বাস নিতে নিতে বলে ওঠে, “দাঁড়াও না ম্যাজিশিয়ান।”

চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে