রূপকথার ম্যাজিশিয়ান পর্ব-৬+৭+৮

0
1765

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_6

দুপুরের কড়া রোদ এসে মিশেছে মাঠের প্রান্তরে। সকালের কুয়াশায় ঢাকা সেই প্রকৃতির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই এই বেলায়। রোদের উজ্জ্বলতায় তা মিইয়ে পড়েছে আরো পূর্বেই। সাদাবিলের পানিটুকু চিকচিক করে নিজের আরেক ঝলমলে রূপ প্রদর্শন করছে।
বিলের পাড়ে পা ঝুলিয়ে বিরস মুখে বসে আছে আরজান। মাঝে মাঝে পাশ থেকে ছোট ছোট দু’য়েকটা ঢিল তুলে আনমনেই ছুড়ে ফেলছে বিলের পানিতে।

তার ঠিক সামনেই রূপকথা পানির মাঝে নিজ মনে সাঁতরে চলেছে। কখনো বিলের এপাড় তো কখনো আবার সাঁতরে ওপাড়ে গিয়ে উঠছে। নিজের আঁশটেযুক্ত বিশাল লেজ নেড়ে নেড়ে পানির মাঝে উৎফুল্লতার সাথে খলবলিয়ে উঠছে। সোনালি চুলগুলো পানিতে স্বভাব মতোই ভেসে রয়েছে। মেয়েটার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে আজ সে ঠিক কতোটা আনন্দিত। হবে নাইবা কেন? আজ কতগুলো দিন পর আবার দুপুরের ঝলমলে রোদের মাঝে প্রাণ খুলে সাঁতরাচ্ছে সে! মানুষের ভয়ে সে শুধু রাতেই একটু সাঁতরাতে পারে তাও বেশিক্ষণ নয়। কখন কে চলে আসে এই ভয় থেকেই যেত।

তার উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিমা পছন্দ হয় না আরজানের। বসে থেকে থেকে বিরক্ত সে, মোবাইলটাও সাথে নেই যে কিছু করবে। জলপরিটা কী অবলীলায় তার সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে আর সে কি-না বসে বসে তাকে পাহাড়া দিচ্ছে! জলপরি? হ্যাঁ, এই মেয়েটা জলপরি। কোনো আবেগি উদাহরণের জলরূপসী নয়, সে বাস্তবেই এক জীবন্ত জলরূপসী। তবে এই জলরূপসী রূপকথার গল্পে বর্ণনা দেওয়া সেই সাদা বর্ণের জলরূপসী নয় বরং অঢেল মায়ার আঁধার এই জলরূপসী। শ্যামবর্ণ তার রূপের কোনো অংশ কমাতে পারেনি, উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।

পানির খলবল শব্দে ভাবনাচ্যুত হয় আরজান। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় মেয়েটা এখনো সাঁতরে চলেছে। সে বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে, “থামবে তুমি?”

থেমে যায় সে। তার দিকে চেয়ে আবদারের সুরে বলে, “আর একটু?”

“আর এক মূহুর্তও আমি এখানে থাকবো না।” গর্জে ওঠে আরজান।

“অল্প একটু?”

“এক সেকেন্ডও না।” উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে আরজান। সে কেন পাহাড়া দেবে বসে বসে? একেতো জলপরির অস্তিত্ব তাকে অতিশয় বিস্মিত করেছে তার উপর মেয়েটার এসব উদ্ভট আবদার। সে কি দায় ঠেকেছে কারোর আবদার মেটাতে? হটাৎ যখন সে নিজেকে জলপরি বলে জাহির করেছিল, প্রচন্ড রাগান্বিত হয়েছিল আরজান। অথচ তাকে আরো অবাক করে মেয়েটা নিজের আঁশটেযুক্ত লেজ পানিতে ঝাপটে প্রমাণ দিলো নিজের কথার সত্যতা।

এমন নির্জন জায়গায় পানির মাঝে মেয়েটা একা থাকে। থাকতেই পারে, জলপরিরা আবার ভয় পায় নাকি? হয়তোবা পায়, তবে সেটা নির্জন জায়গাকে নয় বরং মানুষের হিংস্রতাকে। জলপরির সন্ধান পেলে যে তারা মরিয়া হয়ে উঠবে তাকে ধরার জন্য। তাকে মাধ্যম বানিয়ে টাকা উপার্জন করতেও পিছপা হবেনা। এমনকি তাকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবেনা তারা।

মেরে ফেলার কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই চমকে যায় আরজান। দ্রুত তাকায় সামনে ভেসে থাকা জলরূপসীর দিকে। এতো মায়ায় ভরা জলরূপসীর মৃত্যু? উঁহু, মরবে না সে।

ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে এসে ধমকে ওঠে আরজান, “পানির নিচে যাও, আমি চলে যাবো এখন।”

“একটু থাকো না ম্যাজিশিয়ান?” বায়না করে বলে সে।

পাত্তা দেয় না আরজান। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে মাঠের দিকে। কী ভেবে আবার পেছনে ফিরে তাকায়। রূপকথাকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলে, “এখান থেকে একটা পোশাক পড়ে তারপর মেলায় আসবে।”

মুচকি হাসে রূপকথা, “আমাকে আমন্ত্রণ করছো?”

“একদমই না, আমি জানি তুমি আসবে। কিন্তু ঐ ফ্রক ভুলেও পড়বে না। ওটা পড়লে তোমার বয়স অনেক কমে লাগে তাছাড়া পলাশ তোমাকে ঐ পোশাকে দেখেছে। এরপর ঝামেলা করতে পারে তাই সাবধান।”

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, “ঐ ফ্রকে বয়স কম লাগার রহস্য তুমি বললে না ঠিক আছে কিন্তু খবরদার ওটা আর কখনো পড়বে না। আর হ্যাঁ, ব্যাগে পোশাকের সাথে ওড়না আছে। মুখ ভালো করে ঢেকে যাবে ওটা দিয়ে, বুঝেছো?”

“তুমি এতো ভাবছো কেন?”

আচমকা এমন প্রশ্নে খানিক চমকে ওঠে আরজান। নিজেকে সংবরণ করে বলে, “নিজের ভালো পাগলেও বোঝে কিন্তু আফসোস, জলপরি বুঝলো না।”

কথাটা বলে বড় বড় পা ফেলে সেই স্থান ত্যাগ করে। হাঁটতে থাকে আইলের উপর দিয়ে। পেছন থেকে হাঁ করে চেয়ে আছে রূপকথা। মাথা চুলকে ভাবে, “কী বলে গেলো ম্যাজিশিয়ান? আমাকে কি অপমান করলো?”

উত্তর মেলেনা তার ভাবনার। সমস্ত ভাবনা ছেড়ে সে লাফিয়ে পড়ে পানির মাঝে। কৃষকরা মাঝে মাঝে উঠে আসে বিলের পাড়ে বিশ্রাম নিতে। তাই এই সময় বাইরে থাকা মানেই হয়তো তার জীবনের সমাপ্তি।

অন্যদিকে আরজান বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। দ্রুত গোসল, খাওয়া সেড়ে নিয়ে মায়ের নম্বরে কল লাগায়। লামিয়ার বিষয় টেনে আনাতে মায়ের সাথে ঠিকমতো কথায় বলতে পারছেনা আজকাল অথচ এই মানুষটাই তার একমাত্র আপন মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। মা ছাড়া আর এই দুনিয়ায় কে আছে তার? কেউ নেই।
কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ হয় কল। অপরপাশ থেকে ভেসে আসে সোফিয়া শিকদারের মমতাভরা কন্ঠ, “মায়ের কথা মনে পড়েছে তাহলে রাজপুত্রের?”

“তার কথা আমি ভুলি কবে যে নতুন করে মনে পড়বে? সে তো সবসময় আমার হৃদয়েই বাস করে।”

মুচকি হাসে সোফিয়া শিকদার। শুধায়, “খাওয়া-দাওয়া করছিস তো ঠিকমতো?”

“সে আর বলতে? গ্রামের টাটকা সবজি, টাটকা মাছ সবই যে আমার ভীষণ প্রিয়। পেট পুরে খেয়ে উঠেছি এইমাত্র। তুমি খেয়েছো তো?”

“হ্যাঁ, খেয়েছি।”

“ওষুধ খাচ্ছো তো নিয়মিত?” শুধায় আরজান।

“খাচ্ছি বাবা খাচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে আস।”

“কাজ শেষ হলেই আমি চলে আসবো। তুমি এতো চিন্তা করো না তো।”

সোনিয়া শিকদার আরো কিছু বলবে তার পূর্বেই কল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে অবাক চোখে তাকায় মোবাইলের দিকে। তার ছেলে কি বুঝে ফেললো যে সে এখন লামিয়ার কথা বলবে? নাকি এমনিই কেটে দিয়েছে?

অপরদিকে মোবাইল হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে আরজান। সে জানতো তার মা এখন আবার লামিয়ার প্রসঙ্গ তুলবে, তাইতো কেটে দিয়েছে। বিড়বিড়িয়ে বলে, “তুমি কেন বোঝো না মা? আমি ওকে বোনের নজরে দেখেছি সারাজীবন। তাকে কী করে হটাৎ অন্য নজরে দেখবো? মন থেকে না টানলে তার সাথে কি সংসার সম্ভব?”

ভেবেছিল দুপুরে একটু ঘুমাবে কিন্তু তা আর হলো কই? এখন কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসবেনা। একেতো জীবন্ত এক জলপরির অস্তিত্ব, তার উপর আবার গ্রামে ঘটে চলা একের পর এক ডাকাতি। ডাকাত? শব্দটা মনে পড়লেই তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। তা হয়তো ভয় কিংবা ঘৃণারই কোনো রূপ। ঘৃণায় হবে হয়তো! ডাকাতদলের প্রতি তার রাগ, ঘৃণা সবকিছুই আকাশসম।

বিকাল হতে আরো কিছুটা সময় বাকি। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে জাদুর সরঞ্জাম হাতে বেরিয়ে পড়ে আরজান। অনেক কিছু জানার আছে তার। মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় কয়েকজন কৃষকের সাথে। তারা কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। কাউকে চিনতে না পেরে আরজান কিছুটা এগিয়ে যায় তাদের দিকে। একজন কৃষককে ডেকে শুধায়, “বাড়ি কোথায় আপনার?”

কৃষকটা গামছা দিয়ে শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, “এই গেরামেই সাহেব।”

“গ্রামের কোন জায়গায় বাড়ি? আগেতো কখনো দেখিনি আপনাকে।” ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান।

“নতুন আইছি তো সাহেব কিন্তু তাও তো ম্যালাগুলা বছর হইয়া গেছে। বাড়ি বানাইছি গ্রামের শ্যাষে।”

আর কিছু বলে না আরজান, সোজা চলে যায় মেলার মাঠে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো রজত হাওলাদার। তাকে দেখতে পেয়ে পান চিবোতে চিবোতে এগিয়ে আসে তার দিকে। মাটিতে পিচকারি ফেলে বলে, “আইজ এতো তাড়াতাড়ি আসলা যে?”

“এমনি, একটু ঘুরে দেখি মেলার দোকানগুলো। এসে পর্যন্ত তো দেখার সুযোগ পেলাম না।” কথাটা বলেই তার সামনে থেকে সরে যায় আরজান। এগিয়ে যায় দোকানপাটের দিকে।

মেলার চায়ের দোকানি হাশেম তাকে দেখে উৎফুল্ল স্বরে বলে, “মিজিশিয়ান, ভালা আছেন?”

ম্যাজিশিয়ান’কে মিজিশিয়ান বলাতে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায় আরজান। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “ওটা মিজিশিয়ান নয়, ম্যাজিশিয়ান হবে।”

লজ্জা মিশ্রিত হাসি দেয় হাশেম। মাথায় হাত দিয়ে বলে, “ওইডাই তো মনে রাখবার পারি না। আপনে কি চা খাইবেন? আমার দোকানের চা কিন্তু ম্যালা ফ্যামুস।”

“ফ্যামুস?” ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান। এমন কোনো শব্দ আদৌ আছে বলে তার জানা নেই।

“এতো বড় মিজিশিয়ান আর ফ্যামুস চেনেন না? বিখ্যেত কই ওইডারে, বিখ্যেত।”

“Famous?” শুধায় আরজান।

“হ হ, ওইডাই।”

বিরক্তির শ্বাস ছাড়ে আরজান। রাগান্বিত স্বরে বলে, “বিখ্যাত বলবে এখন থেকে।”

“কিছু একটা কইলেই হইলো। ইনজিরি কইতে পারি দেইখ্যা এই গেরামে আমার চা এতো বিখ্যেত।” গর্ব করে বলে হাশেম।

আবারো বিখ্যাতকে বিখ্যেত বলাতে আরজানের রাগ যেন এবার সপ্তম আসমান পৌঁছেছে। কিছু না বলে ধপ করে বসে পড়ে দোকানের সামনে পেতে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে। ব্যস্ত স্বরে বলে, “মুখটা দয়া করে বন্ধ রাখো আর চা দাও দ্রুত।”

চুপসে যায় হাশেমের মুখশ্রী। তার বুঝে এটাই আসছেনা যে, “তার ইনজিরির কতো তারিফ এই গেরামে আর তারে কি-না মুখ বন্ধ করবার কয়। আসলেই শহরের সাহেবরা ভালা জিনিসের কদর করবার পারে না।”

অসন্তুষ্ট মুখে সে চা বানিয়ে দেয়। চা হাতে নিয়ে একবার ভাবে আরজান। হাশেমের দিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে চুমুক দেয় চায়ের কাপে। চুমুক দিতেই মন-প্রাণ যেন জুড়িয়ে আসে। চা শেষ করে পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে দেয় আরজান। স্বাভাবিক স্বরেই বলে, “তোমার কথা বিখ্যাত না হলেও, তোমার চা আসলেই বিখ্যাত হবার যোগ্য।”

গালভরে হাসি দেয় হাশেম। তার হাতের চা খাইয়া তারিফ করেনাই এমন লোক আছে নাকি এই দুনিয়ায়?
চায়ের কাপ ধুতে ধুতে আবার ফিরে তাকায় আরজানের দিকে। সামনের চেয়ার ফাকা দেখে অবাক হয় সে। আফসোস করে হাশেম, কোথায় সে ভাবলো আবার একটু ইনজিরি শুনাইয়া চায়ের মতো নিজের ইনজিরিরও তারিফ শুনবে!

ততক্ষণে আরজান স্টেজে উঠে এসেছে। জাদুর সরঞ্জাম রেখে একবার তাকায় দর্শকদের ভীরের মাঝে। তার দু’চোখ না চাইতেও ভীরের মাঝে খুঁজে চলেছে সেই জলরূপসীকে। কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে খানিক হতাশ হয় সে। বিড়বিড়িয়ে বলে, “রূপকথা কি আসবেনা আজ?”

দর্শকদের চিল্লাচিল্লিতে হুঁশ ফেরে আরজানের। নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব সে। মেয়েটা না আসলে তার কী? কেন খুঁজছে সে তাকে?

নজর সরিয়ে জাদুর দিকে মনোযোগ দেয় সে। রঙ-বেরঙের কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে তাতে আলতো ফু দেয়। কাগজগুলো শূন্যে উড়িয়ে দেবার আগে আবারো তাকায় দর্শকদের ভীরের মাঝে।
তখনই তার নজর কাড়ে ধূসর বর্নের পোশাক পরিহিতা এক মেয়ে। কালো ওরনাটা দিয়ে মুখমণ্ডল আবৃত করা থাকলেও চিনতে বিন্দু পরিমাণ কসুর করতে হয় না তার। ডানহাতে ওরনাটা ধরে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে স্টেজের দিকেই চেয়ে আছে মেয়েটা। দু’য়েকটা সোনালি চুল ওরনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে হালকা বাতাসে আছড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে আরজান। অজান্তেই ধীর স্বরে বলে ওঠে, “রূপকথা”

চলবে,,,,,,

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_7

সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। বাইরে ধীরে ধীরে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে, সাথে হালকা শীত ও পড়ছে কিন্তু মেলার পরিবেশ এখনো রমরমা। মেলার দোকানগুলোতে জ্বলে উঠেছে হলুদ আলো বিশিষ্ট বাল্ব। ডাকাতের ভয়ে বড়রা বাড়ির দিকে ছুটলেও অপেক্ষাকৃত ছোট বয়সের ছেলেরা এখনো মেলায় ঘোরাঘুরি করছে। কেউ কেউ ভীর জমিয়েছে দোকানগুলোতে। জাদু শেষ করে জাদুর সরঞ্জাম হাতে স্টেজের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরজান। রজত হাওলাদার কী একটা কাজে দ্রুত চলে গেছে। আকরাম মিঞা তো ছেলে নিয়েই ব্যস্ত। তবে আজ আর কোনো ব্যস্ততা নেই আরজানের। আজ সাথে লাইট এনেছে, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। জাদু শেষ হয়েছে আরো আগে কিন্তু এখনো বাড়ি যাওয়ার কোনো ভাবগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না তার ভেতর। সে একদম নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবখানা এমন যে, দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও সে চুল পরিমান নড়বে না। জাদুর বাক্সের দিকে একবার তাকায়, পরক্ষণেই নজর সরিয়ে চারপাশ দেখতে থাকে। নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রূপকথা। কিছুক্ষণ আরজানের দিকে চেয়ে থেকে তার কোনো ভাবান্তর না হওয়ায় বিরক্ত হয় সে। তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হটাৎ এক লাফে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আচমকা এভাবে সামনে আসায় চমকে ওঠে আরজান।

দু’পা পিছিয়ে গিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “এগুলো কোন ধরনের ব্যবহার? ভূতনি হয়েছো তুমি?এতো লাফালাফি করছো যে!”

চোখ বড়বড় করে তাকায় রূপকথা। তার তো মুখ ঢাকা ওরনা দিয়ে, চিনলো কী করে? সে ভেবেছিলো হটাৎ সামনে এসে চমকে দেবে ম্যাজিশিয়ানকে। তা তো হলোই না, উল্টো বকা শুনতে হচ্ছে।

তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে আরোও রাগান্বিত হয় আরজান। গলা উচিয়ে বলে, “এভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছো কেন? রূপ বেরিয়েছে আমার? নাকি ডানা গজিয়েছে দু-চারটা?”

কথা বলে না রূপকথা। মুখ থেকে ওরনা ছেড়ে দিয়ে একবার চোখ পাকিয়ে তাকায় আরজানের দিকে। অতঃপর মুখ বাঁকিয়ে গটগট করে হাঁটতে থাকে মেলা থেকে বেরোনোর রাস্তার দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় আরজান। এই মেয়ের তো সত্যিই ডানা গজিয়েছে। দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায় দিকে, রাগান্বিত স্বরে বলে, “কী হলো? এতো ভাব ধরছো কেন হটাৎ? সাপের পাঁচ পা দেখেছো?”

দাঁড়িয়ে যায় রূপকথা। পেছনে ফিরে ভ্রু কুচকে বলে, “সাপের পাঁচ পা হয় নাকি আবার? ভুলভাল কথা বলো না-তো।”

আরজান কিছু বলতে নিবে তখনই লক্ষ্য করে বাইরের আলো ফুরিয়ে আসছে। একটু পরেই হয়তো সন্ধ্যার আজান দিবে। রূপকথার দিকে চেয়ে ব্যস্ত হয়ে শুধায়, “এই সন্ধ্যায় তুমি এখানে কী করছো? তোমার এভাবে খোলামেলা ঘুরে বেড়ানো একদম উচিত না, বিপদ হতে পারে।”

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে ওঠে, “মুখ খুলেছো কেন? মরতে ইচ্ছে করছে খুব?”

“মরতে তো হবেই একদিন। এখানে আর কতোদিন এভাবে লুকিয়ে বাঁচবো? অনেক তো হলো।” স্বাভাবিক কন্ঠ রূপকথার।

চকিতে তাকায় আরজান। বলে কী মেয়ে? মরা এতো সহজ নাকি? সে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলে, “তাড়াতাড়ি চলো, তোমাকে পৌছে দিয়ে আমি বাড়ি যাবো।”

“তুমি কী চলে যাবে ম্যাজিশিয়ান?”

“হ্যাঁ, বলছি শুনছো না যে বাড়ি যাবো।” হাঁটতে হাঁটতে সামনে তাকিয়ে উত্তর দেয় আরজান।

“সে কথা বলিনি আমি। তুমি কী আবার শহরে চলে যাবে মেলা শেষ হলে?” কাতর স্বরে শুধায় রূপকথা।

“তা তো যেতেই হবে, শহরে অনেক কাজ আমার। এখানে মেলাটা শেষ হলে বাঁচি। কেন?”

আচমকা দাঁড়িয়ে পরে রূপকথা। পেছনে ফিরে তাকায় আরজান। ভ্রু উচিয়ে শুধায়, “হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? তাড়াতাড়ি চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে।”

নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করে রূপকথা। আরজান নিজেও আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করে না। নীরবতায় কেটে যায় কিছুটা সময়। মাঠের মাঝখানে এসে পৌঁছেছে তারা অথচ তাদের মধ্যে কারোরই মুখে কোনো কথা নেই। আজ বোধ হয় তারা চুপ থাকার জন্য পণ করেছে। তখনই তাদের চমকে দিয়ে মাঠের মাঝে কারোর ফিসফিসিয়ে কথোপকথনের শব্দ শ্রবণগোচর হয়। কয়েকজন মানুষ যেন কিছুটা দূরেই একজোট হয়ে কিছু একটা বলাবলি করছে। স্বল্প আলোতে দৃষ্টিগোচর হয় না কিছুই। রূপকথা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরজান তাকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে মাঠের পাশে অবস্থিত বিশাল মেহগনি বাগানের দিকে টেনে নেয়। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে হাঁপ ছাড়তেই রূপকথা হতবাক হয়ে কিছু বলতে চায়। অমনি সজোরে মুখ চেপে ধরে আরজান। কিছুক্ষণ বাদে মুখ ছেড়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, “একদম চুপ থাকো।”

রূপকথা ফিসফিসিয়ে শুধায়, “কিন্তু কেন চুপ থাকবো?”

অতিশয় বিরক্ত হয় আরজান, “মানুষ আছে আশেপাশে, কথা বলছে শুনতে পাচ্ছো না?”

এবার যেন কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে রূপকথা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মানুষের ফিসফিসানি শুনতে পেয়ে দমে যায় সে। ভয়ে একদম সেটিয়ে যায় গাছের গায়ে। পরক্ষণেই মনে পড়ে, এখন তো সে জলপরির রূপে নেই তাহলে আবার ভয় কিসের?

সে উল্টে আরজানের দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “আমিতো এখন জলপরির রূপে নেই তাহলে শুধু শুধু লুকোচ্ছি কেন আমরা?”

চোখ রাঙিয়ে তাকায় আরজান। দ্রুত নিজের মুখে হাত চেপে ধরে রূপকথা। নজর সরিয়ে মাঠের দিকে তাকায় আরজান। হালকা ছায়া দৃষ্টিগোচর হচ্ছে চার-পাঁচজন মানুষের। মেহগনি বাগানের দিকেই এগিয়ে আসছে তারা। রূপকথাকে টেনে এনে আরোও গাছের সাথে মিশে দাঁড়ায় আরজান। লোকগুলো মেহগনি বাগানের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ে। অবাক চোখে তাকায় আরজান। তাদের সকলের হাতেই একটা করে গামছা। এরা কি কৃষক নাকি? কিন্তু কৃষক হলে তো আরো আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা।

শ্রবণগোচর হয় তাদের কথোপকথন। তাদের মধ্যে সবথেকে লম্বামতো লোকটা বেশ খুশিমনে বলছে, “কাইল ভালা দান মারবার পারমু, হেলাল বেপারীর পোলা আইতাছে কাইল শহর থেইকা। খবর পাইছি ম্যালা মাল-কড়ি আনতাছে সাথে কইরা।”

দ্বিতীয় লোকটা বলে ওঠে, “বেশি তেড়িবেড়ি করবার চাইলে কিন্তু মাইরা ফালামু?”

সাথে সাথে আরেকজন বলে ওঠে, “তুই আবার কী কস? মারমু না তো কি আদর করমু?”

দ্বিতীয় লোকটা পুনরায় বলে, “আমাগো ভাগ ঠিক কইরা পামু তো?”

“হ হ, পাইবি। খালি কাম করবি ঠিক কইরা।” লম্বা লোকটা বলে।

অন্যজন আবার দ্বিতীয়জনের কথায় সুর মিলিয়ে বলে ওঠে, “আমাগো ভাগ ঠিকঠাক না পাইলে আর এই কাম করমু না। কষ্ট করমু আমরা আর ভাগ বড়ডা নিবো আরেকজন!”

চতুর্থ লোকটা কিছু বলতে নিলেই খ্যাক করে ওঠে লম্বা লোকটা। কিছুটা উচ্চস্বরে বলে, “এতো কতা কস ক্যান তোরা? ডর করে না তোগো? জানের মায়া নাই? বউ-পোলাপানগুলারে অকালে মারবার চাস?”

আর একটা শব্দও কানে আসেনা। সকলের মুখ এই এক কথাতেই থেমে গেছে। তাদের মুখভঙ্গি নজরে আসেনা আঁধারের মাঝে। নিঃশব্দে তারা আবার আগের মতোই হেঁটে চলে যায় জমির আইল ধরে। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আরজান। একরাশ চিন্তা প্রকাশ পাচ্ছে তার চোখে-মুখে। অনেকগুলো প্রশ্ন মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। লোকগুলো কারা? কীসের পরিকল্পনা করছে তারা? এতটুকু তো বুঝা হয়েই গেছে এরা এমন কোনো অপরাধী যারা দলবদ্ধভাবে মানুষের ক্ষতি করে।
খট করে মাথায় খেলে যায়, এরা ডাকাত নয়তো?

তখনই রূপকথা বলে ওঠে, “এদের তো আমি আগেও দেখেছি। বিলের পাড়ে মাঝে মাঝেই আসে অনেক রাতে। কিছুক্ষণ বসে এরকম আজগুবি কথা বলে বলে চলে যেতো।”

আরোও চিন্তিত হয়ে পড়ে আরজান। তার ভাবনা ঠিক হলে এরাই সেই ডাকাতদল যাদের ভয়ে গ্রামের লোকজন অতিষ্ঠ। চিন্তিত মুখশ্রী বদলে মুহূর্তেই রাগের লেলিহান ছড়িয়ে পড়ে। ডাকাতদলের উপর তার রাগ যেন আকাশ ছোঁয়া। নিজ হাতে একেকটাকে খুন করতে পারলে হয়তো শান্তি মিলতো। আগে হেলাল বেপারীকে খুজে বের করতে হবে। বাড়ি আসা থেকে আটকাতে হবে তার ছেলেকে নয়তো অকালেই হয়তো ঝরে পড়বে আরো একটা প্রাণ। সে রেগে থাকতে পারে নিজের গ্রামের মানুষের উপর কিন্তু তা বলে জেনে শুনে একটা মানুষকে মরতে দেবে কীভাবে?

রূপকথার দিকে চেয়ে ব্যস্ত স্বরে বলে, “তাড়াতাড়ি পা চালাও। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আরো অনেক কাজ আছে আমার।”

তাকে চিন্তিত দেখে আর কিছু বলে না রূপকথা। চুপচাপ হাঁটতে শুরু করে বিলের দিকে। সাদাবিলের সামনে এসে বিলের পাড়ে উঠে দাঁড়ায় দু’জনে। আরজান ইশারা করে বলে, “ঝাঁপ দাও।”

রূপকথা এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকায়। আকুলতাভরা কন্ঠে বলে, “ম্যাজিশিয়ান”

“হু” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আরজানের।

“আমাকে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে দেবে?”

চলবে,,,,,

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_8

বিলের পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে রূপকথা। পাশেই রেগেমেগে তার দিকেই চেয়ে আছে আরজান। মেয়েটা সেই যে তখন থেকে পানিতে না নেমে পাড়ে বসে আছে তো আছেই। তার একই কথা, তাকে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। আরজান রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোমার পেছনে পড়ে থাকা ছাড়া আমার কি আর কোনো কাজ নেই?”

“আছে তো, অনেক কাজ তোমার। আমার পেছনে আবার তুমি কবে পড়ে থাকলে?” রূপকথা পানির দিকে চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলে।

বিরক্ত হয় আরজান। কিঞ্চিত উচ্চস্বরে বলে, “আরে বাবা! সমুদ্রে গিয়ে কী করবে তুমি? সাদাবিলের পানি কি ভালো লাগছে না?”

তার দিকে ফিরে তাকায় রূপকথা। নরম স্বরে বলে, “এখানে আমার প্রাণের ঝুঁকি আছে ম্যাজিশিয়ান, তুমি বুঝবে না। সমুদ্রই আমার আসল বাসস্থান, সেখানেই আমার নিজের দেশ আছে।”

এতোক্ষনে আসল ব্যাপার বুঝতে সক্ষম হয়েছে আরজান। আসলেই তো! এতোক্ষন ডাকাতের চিন্তাতে সে ভুলেই বসেছিল রূপকথার প্রাণের ঝুঁকি আছে এই গ্রামে। এতো জনবসতির মাঝে কীভাবে একা একটা জলপরি বসবাস করবে? তাকে দেখতে পেলেই তার প্রাণ নিতে উঠে পড়ে লাগবে সকলে।

রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “তোমাকে টাকা দিয়ে দিলে তুমি যেতে পারবে না? গাড়িতে উঠতে পারো?”

রূপকথার ফটাফট উত্তর, “আমি কিছুই চিনি না, পানি ছাড়া বাইরের জগৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই বললেই চলে।”

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, “নিয়ে যাবে কি-না বলো? রাত অনেকটা হলো, তখনকার লোকগুলো আবার চলে আসতে পারে এখানে।”

চকিতে তাকায় আরজান। রূপকথাকে এখানে একা রেখে যাওয়া যাবে না। ডাকাতগুলোর মনে কোনো দয়া-রহম নেই। ওকে দেখতে পেয়ে যদি কোনো ক্ষতি করে বসে! সে ব্যস্ত স্বরে বলে, “তোমার এখানে থাকা লাগবে না। এসো আমার সাথে।”

“কোথায়?”

চিল্লিয়ে ওঠে আরজান, “যা বলেছি তা করো।”

“কিন্তু আমি কোথায় যাবো?”

আরজান চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রূপকথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার উপরে উঠে আসে হাতে কিছু একটা নিয়ে। অন্ধকারে নজরে আসছেনা জিনিসটা তাই আর সেদিকে ধ্যান দেয় না আরজান। ব্যস্ত পায়ে আবার হাঁটতে শুরু করে মাঠের দিকে। রূপকথা একবার সাদাবিলকে দেখে নিয়ে ছোটে তার পেছনে পেছনে। তার জানা নেই সে কোথায় যাচ্ছে তবে এই মানুষটাকে সে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারে। ম্যাজিশিয়ান ছাড়া আর তো কেউ নেই তাকে বাঁচানোর মতো। সে যা করছে অবশ্যই তার ভালোর জন্যই করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বিনাবাক্যে তার পিছনে যাওয়াটাই উত্তম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা চেয়ারম্যানের বাড়ি পেরিয়ে পৌঁছে যায় গ্রামের মধ্যে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরজান ফিরে তাকায় রূপকথার দিকে। তার ধারনা ছিলো এতো হেঁটে হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা। কিন্তু না, তার মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে আসছে সে। তাই আর কথা বাড়ায় না সে, জাদুর বাক্সটা ভালো করে ধরে আবার হাঁটতে শুরু করে। রাত অনেকটাই গভীর হয়ে এসেছে।
রাস্তাঘাটে লোকজন কমে এসেছে পূর্বের তুলনায়। গ্রামের মানুষের রাত এমনিতেই তাড়াতাড়ি হয় তার উপর ডাকাতের ভয়। তাই হয়তো সকলে আরো আগেই নিজ নিজ গৃহে ফিরে গিয়েছে।

অনেকটা সময় হাঁটার পর একটা বাড়ির সামনে এসে থেমে যায় আরজান। ইট গেঁথে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ির চারপাশে কিন্তু বাড়িটার সদর দড়জা মোটা কাঠের তৈরি। কাঠগুলোতে শ্যাওলা জমেছে, ভঙ্গুর ধরেছে প্রাচীরের গায়ে। সাবধানে সদর দড়জা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে আরজান। কতগুলো বছর বাদে আবার নিজের বাড়িতে আসছে সে। পূর্বের স্মৃতিগুলো না চাইতেও মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে যার ফলস্বরূপ ভিজে উঠতে চাইছে তার চোখগুলো। ভাবনা ছেড়ে দ্রুত গিয়ে বারান্দায় লাগানো বাল্বটা জ্বালিয়ে দেয় সে। লাইটের আলোয় জ্বলে ওঠে পুরো বাড়ি। মা এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকে বলে সবকিছুই গুছিয়ে রাখা রয়েছে। চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে রূপকথা। বাড়ির আশপাশের জায়গা নেহাতই কম নয়। বাড়ির চারপাশে প্রাচীরের শরীর ঘেঁসে লাগানো ভিন্ন-ভিন্ন রঙের বাগানবিলাসের গাছগুলো বিশাল আকৃতি ধারন করেছে। একপাশে ছোট্ট একটা পুকুর যেটা আরজানের বাবা তৈরি করেছিল ছেলেকে পুকুরে সাঁতার শেখানোর জন্য। আরজানকে নিয়ে সে প্রায়ই পুকুরের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত সাঁতরে বেড়াতো। তার ঠিক পাশেই কলঘর।

আরজান কিছুক্ষণ পুকুরের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “ভেতরে চলো।”

ধ্যান ভাঙে রূপকথার। ব্যস্ত স্বরে বলে, “হুম চলো।”

ঘিয়ে রঙা ঘরটার বিশাল বারান্দায় লাগানো কাঠের মোটা খুঁটিগুলোতে ঘুণ ধরেছে কিছুটা জায়গায়। বাড়িটা দেখে বোঝা যায় এটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় মাঝে মাঝে। ঘিয়ে রঙটাও হয়তো নতুন করে পালিশ করা হয়েছে দ্রুতই। গ্রামের মাঝে এই ঘিয়ে রঙা পাঁচ কামরার ঘরটা কী নিদারুণ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার একপাশে রান্নাঘর অপরপাশে হয়তো বাথরুম। জাদুর সরঞ্জামের মধ্যে থেকে একটা চাবি বের করে মাঝের ঘরটার তালা খুলে দেয় আরজান। ভেতরে গিয়ে সমস্ত আসবাবপত্রের উপর থেকে সাদা চাদর টেনে ওঠাতেই ধুলো উড়তে শুরু করে। সোফিয়া শিকদার সবকিছু পরিষ্কার করে ঢেকে রেখে গিয়েছিল কিন্তু বেশ কিছুদিন কেউ না থাকায় ধুলো জমেছে আসবাবপত্র আবৃত করা কাপড়ের উপর।

আলমারি থেকে নতুন চাদর বের করে বিছানায় বিছিয়ে দিয়ে দড়জার পাশ থেকে ঝাড়ু নিয়ে দ্রুত ঝেড়ে পরিষ্কার করে দেয় সবকিছু। অন্য একটা ঝাড়ু এনে ফ্লোরে ঝাড়ু দিয়ে হাঁপ ছেড়ে তাকায় রূপকথার দিকে। সে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তার দিকেই। ধমকে ওঠে আরজান, “দেখেছো তো কীভাবে কী করেছি, এভাবে রোজ পরিষ্কার করবে।”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় রূপকথা। আরজান জাদুর সরঞ্জাম হাতে নিয়ে আবারো ফিরে তাকায় তার দিকে। একহাতে শরীরের ধুলো ঝারতে ঝারতে বলে, “সকালে খাবার এনে দেবো আর সাঁতরাতে ইচ্ছা করলে পুকুরে গিয়ে সাঁতরাবে। বাইরে থেকে সদর দড়জা আমি আটকে দিয়ে যাবো।”

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, “কী বলেছি বুঝতে পেরেছো তো? নাকি আবার বলতে হবে।”

“বুঝেছি এতো বলতে হবে না।”

আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় আরজান। সদর দড়জায় বিশাল তালা ঝুলিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও আবার কী ভেবে থেমে যায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, “রূপকথাকে একা এখানে রেখে যাওয়াটা উচিত হবে কি? যদি কোনো গন্ডগোল পাকিয়ে বসে মেয়েটা?”

কয়েকবার পা বাড়াতে গিয়েও আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা আরজানের। নিজের ইচ্ছাশক্তি যেন প্রবলভাবে তার বিরোধিতা করছে। জাদুর সরঞ্জাম মাটিতে রেখে পুনরায় ফিরে তাকায় বাড়ির দিকে। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে রাতের নিস্তব্ধতা সেই সাথে শীতের তীব্রতা। চারদিকে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর দুয়েকটা নিশাচর প্রাণীর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঘিয়ে রঙা শিকদার বাড়িটা রাতের আঁধারে নিজের মতোই দন্ডায়মান।

শরীরে জড়ানো জ্যাকেটটা বেশ মোটা হওয়া স্বত্তেও শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছে আরজান। বাড়ি থেকে আসার সময় জ্যাকেটের চেইন খোলা রাখলেও এখানে আসার আগেই তা লাগিয়ে নিয়েছে সে। তবুও যেন শীত নিবারণে অক্ষম হচ্ছে সে। গলায় পেঁচানো কালো মাফলারটা দিয়ে ভালোমতো কান নাক ঢেকে নেয় সে।
মশাগুলোও যেন পেয়ে বসেছে আজ। কামড়ে কামড়ে একাকার করে দিচ্ছে। বাড়ির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রাত পেরিয়ে যায় নিমেষেই। কিছুটা নিদ্রা লেগে এসেছিল আরজানের চোখে হটাৎ অতিরিক্ত শীত লাগায় ঝট করে চোখ খুলে তাকাতেই দেখা পায় কুয়াশাচ্ছন্ন এক ভোরের। আরেকটু পরেই হয়তো রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়ে যাবে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে জাদুর সরঞ্জাম নিয়ে দ্রুত সে এগিয়ে যায় চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

বাড়িতে পৌঁছে দ্রুত বিছানায় শুয়ে লেপ টেনে জড়িয়ে নেয়। এতোক্ষনে যেন একটু শান্তি লাগছে তার অমনি মনে পড়ে রূপকথাকে তো লেপ-কম্বল কিছু বের করে দেওয়া হয়নি। এই শীতের রাতে কীভাবে আছে মেয়েটা? লেপের আরাম ছেড়ে আবারো উঠতে হয় তাকে। জ্যাকেটের উপর আরো একটা চাদর জড়িয়ে জাদুর সরঞ্জামের মধ্যে থেকে বাড়ির চাবি নিয়ে পুনরায় বেরিয়ে যায় সে। বারান্দায় দেখা হয়ে যায় আকরাম মিঞার সাথে। সে বোধ হয় মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলে, “কই ছিলা বাজান? রাইতে ম্যালাক্ষন বইয়া ছিলাম। তোমার চাচি ভাত বাইড়া রাখছিলো তোমার লিগা। তুমি আইলা না দেইখা ম্যালা রাইতে শুইতে গেছি।”

হকচকিয়ে যায় আরজান। এবার কী বলবে? কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়, “বাজারে ছিলাম চাচা। আপনি চিন্তা করিয়েন না।”

“ওহ, কই যাও এতো ভোরে?”

“এইতো সামনেই, একটু হাঁটাহাটি করে আসি।” কথাটা বলেই দ্রুত বেরিয়ে আসে আরজান। মেয়েটা হয়তো এতক্ষণে শীতে কুঁকড়ে গিয়েছে। বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় শিকদার বাড়ির দিকে। পথ যেন শেষ’ই হচ্ছে না, দূরত্বটা বোধ হয় নিমেষেই বেড়ে গেছে।

বাড়িতে এসে ব্যস্ত হাতে তালা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখতে পায় মাঝের কামরার দড়জাটা হাট করে খোলা। চমকে ওঠে আরজান, দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকে রূপকথাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার। পুরো ঘর খুঁজেও কোথাও রূপকথাকে না পেয়ে ভীত মুখে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে