#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_34
বেহিসেবি চন্দ্রশোভা ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের বুকে। পানির বিশাল জলরাশি আছড়ে পড়ছে দিক ভুলে। জোৎস্নার প্রবল আলোয় যেন চিকচিক করছে বালুগুলো। চারপাশ শূন্য, নিস্তব্ধ। এ পাশটা বড় নির্জন অন্যদিকের তুলনায়। এ সুযোগটাই লুফে নিয়েছে নেশাখোরগুলো। রাতবিরেতে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে বালুর ওপর। তাদের আড্ডাটাও পানির কলকল শব্দে হয়ে ওঠে জমজমাট। আজও নেশায় বুঁদ হয়েছে তারা। তিনজন কলেজছাত্র স্বল্প মূল্যে নেশার দ্রব্য পেয়েছে স্থানীয় দালালের থেকে। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিনেছে নিজেদের ধংসের খোরাক। মনের আনন্দে ছুটে এসেছে এই সমুদ্রের বুকে। নেশায় ডুবে হুঁশ হারিয়েছে আরো পূর্বেই। হঠাৎ তাদের নজর কেড়েছে কোনো সুন্দরী নারী। বর্তমানে তার পিছনেই হন্যে হয়ে ছুটছে তারা। তারই মধ্যে পেছন থেকে কেউ একজন উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে তাদের।
“আরেহ! মাতালের বংশধর।”
চমকায় তারা। দৌড়ানো ছেড়ে পেছনে ফিরে তাকায় ঢুলুঢুলু চোখে। নাহ! কেউ নেই! যতদূর দৃষ্টি পৌঁছায় শুধু বালু আর বালু! ধু ধু খোলা চত্বর একেবারেই ফাঁকা! তাহলে ডাকলো কে তাদের? চোখ টিপ টিপ করে তাকায় আবির। রাগান্বিত স্বরে বলে, “কে? কে ডাকলি আমাদের?”
তার কথা শূন্যে মিলিয়ে গেল। ফিরতি কোনো উত্তর আসে না। রকি বেসামাল কন্ঠে বলে ওঠে, “ভভভূত! ভভূত এসেছে!”
বিরক্ত হয় আহান। ধমকে উঠে বললো, “এই তুই চুপ কর। ভূত কীসের? সবসময় তোর শুধু বাজে কথা। রাক্ষস বল রাক্ষস! রাক্ষস এসেছে আমাদের খেতে। নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধা লেগেছে বেচারার।”
দ্রুত উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায় আবির। রকির দিকে চেয়ে বিরক্ত মুখে বলে, “আহান তো ঠিকই বলেছে। জ্ঞান-বুদ্ধি নেই নাকি তোর? এতো রাতে ভূত কী দেখতে আসবে? ঘুম নেই নাকি ওদের? ওরা কি তোর মতো মাতাল যে রাতবিরেতে জেগে থাকবে? রাক্ষস এসেছে। ইশশ! বেচারার কতো ক্ষুধায় না লেগেছে!”
আফসোসের ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ায় রকি। সে পুনরায় অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে, “কোথায় তুমি রাক্ষস? আহানের শরীরে দিনদিন অনেক মাংস বেড়ে যাচ্ছে। ও ডায়েটও করতে চায় না ঠিকমতো। অভদ্রের মতো শুধু নেশা করে এদিক-ওদিক পড়ে থাকে আর মাতলামো করে। ওর শরীর থেকে বিশ কেজি মাংস খেয়ে নাও তো।”
ইতিমধ্যে দৌড় থামিয়ে দিয়েছে রূপকথা। চোখ বড়বড় করে চেয়ে দেখে যাচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ড। হতবাক হয়ে শুনছে তাদের কথোপকথন। তাদের সমস্ত কথাবার্তা যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভূত! রাক্ষস! শব্দগুলো তার জ্ঞানভাণ্ডার বহির্ভূত। তবে নেশা আর মাতাল শব্দদুটো তার পরিচিত। গ্রামে থাকাকালীন সে শুনেছে বেশ কয়েকবার। টুকটাক বুঝতেও পারে এর অর্থ। ভূত শব্দটাও সে শুনেছে অগনিতবার। তবে এর কোনো অর্থ সে খুঁজে পায়নি আজও। তাই ভ্রু কুঞ্চিত করে আগ্রহের সাথে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। তার মাঝে নেই কোনো পালিয়ে যাবার তাড়া। ছেলেগুলো যে তার চেয়েও অধিক তারছেঁড়া তা সে বুঝে গিয়েছে। তাই গা ছাড়া একটা মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে উত্তেজিত সে। ছেলেগুলোর কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জোর কদমে।
আচমকা আহান মনে পড়ার ভঙ্গিমায় বলে ওঠে, “আরেহ! আমরা মায়াপরির কথা ভুলেই বসেছি।”
কপাল চাপড়ায় আবির। তারা দ্রুত ঘুরে তাকায় রূপকথার দিকে। অতঃপর দুঃখি স্বরে বলে ওঠে, “মায়াপরি রাগ করলে তো আমাদের প্রার্থনা শুনবেই না।”
সকলে হন্তদন্ত হয়ে তারা ছুটে আসে রূপকথার কাছে। তিনজন একসঙ্গে বালুর উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ে তার পায়ের কাছে। আচমকা এহেন ঘটনায় হকচকিয়ে যায় রূপকথা। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে তারা তিনজন সমস্বরে বলে ওঠে, “মায়াপরি।”
হুট করে রকি তার পা জড়িয়ে ধরে আকুতির স্বরে বলে ওঠে, “মায়াপরি, তুমি শুধু আমার কথা শুনবে। এই মাতালগুলোর চাওয়া একদম পূরণ করবে না। ওরা একদম মাতাল। নষ্ট সবগুলো।”
তেতে ওঠে আহান, “মাতলামি করিস না রকি। তুই বেশি খেয়েছিস। যা পেছনে গিয়ে দাঁড়া। আমারটা থেকে তোকে ভাগ দিবনে।”
নড়লো না রকি। নিজের স্থানে অনড় থেকে বলে, “মায়াপরি, এই নেশাখোরগুলোর কথায় তুমি কান দিও না। তুমি আমার চাওয়া পূরণ করো। বেশি কিছু চাই না আমি। আমাকে শুধু এক বালতি পাউডার দিলেই হবে।”
“পাউডার?” ভ্রু কুচকাল রূপকথা।
“আরেহ আমি বলতে চাচ্ছি ড্রাগস,,,,,,,,,,,,,,”
তাকে থামিয়ে দেয় আহান। কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “এসব কী রিক? মামনি কি এসবই শিখিয়েছে তোকে? এভাবে কেউ নেশার দ্রব্য চায়? মায়াপরির একটা সম্মান আছে না? তুই আজীবন মূর্খই থেকে গেলি।”
মুখটা চুপসে ফেলে রিক। আহান ফিরে তাকায় রূপকথার দিকে। ভদ্র ছেলের ন্যায় মুখভঙ্গি বানিয়ে বলে, “ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি মায়াপরি। মাতাল হলে ওর মাথা ঠিক থাকে না। সারাক্ষণ শুধু নেশা নেশা করে। তুমি আমার চাওয়া পূরণ করো। আমাকে শুধু একটু, না না একটু না, একটুর চেয়ে একটু বেশি পরিমাণ শুকনা দিও।”
“শুকনা!”
এবার খানিক এগিয়ে আসে আবির। আহানের উদ্দেশ্যে রাগান্বিত স্বরে বলে, “গাঁজা বলতে কী হচ্ছে?”
জিভ কাটে আহান। ফিসফিস করে বলে, “তুই কি মাতাল হলি? সরাসরি গাঁজা বলা মানে মায়াপরিকে অসম্মান করা। সে অসম্মানিত হলে আর আমাদের চাওয়াও পূরণ করবে না। বোকা কোথাকার!”
কপাল কুচকাল রূপকথা। গাঁজা! সে নিজ মনে কতক্ষণ আওড়ালো শব্দটা, “গাঁজা, গাঁজা, গাঁজা কী?”
এমন কোনো শব্দ সে আগে কখনো শুনেছে বলে মনে পড়ছে না। মস্তিষ্কে জোর দিয়েও সে এমন কোনো শব্দ খুঁজে পেল না নিজের জ্ঞানভাণ্ডারে। যেটা সে কোনোদিন শোনেইনি সেটা সে দেবে কী করে এদের! আজব! এরা তার কাছেই বা এগুলো চাইছে কেন? আবার তাকে জলপরি না বলে মায়াপরি বলছে!
হঠাৎ তার সমস্ত জল্পনা-কল্পনা মিলিয়ে যায় কারোর ঠান্ডা স্পর্শে। পেছন থেকে কেউ তাকে আশটেপিষ্টে জাপটে ধরেছে নিজের সঙ্গে। থমকাল রূপকথা। কারোর চওড়া বুক এসে ঠেকেছে তার পিঠের সাথে। উত্তপ্ত নিশ্বাস এসে পড়ছে কানের খুব কাছে। সে আতঙ্কিত হয়ে পিছনে ফিরতেই ধাক্কা খেল শক্ত বুকের সাথে। দ্রুত মাথা উঠিয়ে মানুষটার মুখ দর্শন করার আগেই ভেসে আসে আবেগঘন কণ্ঠস্বর, “রূপ।”
তৎক্ষণাৎ থেমে যায় রূপকথা। নুইয়ে নেয় নিজের দৃষ্টি। তাকাতে চায় না সে তার মুখের পানে। সে দেখতে চায় না এই সুন্দর মুখশ্রী। জড়াতে চায় না তার মায়ার আবেশে। তার এই নীরব উপেক্ষা যেন কিঞ্চিত উত্তেজিত করে তোলে লোকটাকে। ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে তাকায় সে। মেয়েটা কি তাকে অগ্রাহ্য করছে!
তার হাতদুটো ঠেলে দিয়ে পিছিয়ে আসে রূপকথা। দৃষ্টি তার বালুর উপরেই সীমাবদ্ধ। মাথা তুলে তাকাচ্ছে না সে। কঠিনভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটিকে! পুরুষটিও যেন আজ নাছোড়বান্দা হতে চাইছে! মোবাইলের আলো জ্বেলে বড়বড় পা ফেলে সে পুনরায় রূপকথার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। আচমকা দু’হাত বাড়িয়ে আগলে নেয় তার মুখখানা। চিন্তিত স্বরে বলে, “এগুলো কীভাবে হলো? ঠোঁট কেটেছে কীভাবে? চেহারার এ কি হাল বানিয়েছো!”
হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর দেয় না রূপকথা। তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। পুরুষটির বুঝি আজ আরোও অবাক হবার বাকি ছিল! রাগান্বিত স্বরে কিছু বলতে যাবে এমন সময় মোবাইলের আলো গিয়ে পড়ে তার কালশিটে পড়া হাতগুলোর দিকে। অমনি সে হন্তদন্ত হয়ে নিজের দিকে টেনে ধরে হাতদুটো। জমাট বাঁধা রক্তের দাগটুকু দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই স্থান শক্ত কিছু দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটার ফলেই এই চিহ্নের সৃষ্টি। তার বেঁচে থাকা স্বল্প রাগটুকুও যেন উবে গেল এবার! সে হতবাক নয়নে চেয়ে বলে ওঠে, “এসব কীভাবে হয়েছে রূপ?”
নিশ্চুপ রূপকথা। সে তাকাতে চায় না তার দিকে। পুরুষটার অবর্তমানে তার জন্য যে কঠিন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তার হৃদয়ে সে কিছুতেই চায় না তা প্রকাশ করতে। জানার বড় সাধ জাগে এতো রাতে এখানে কী করছে সে? তার তো এই অসময়ে এখানে উপস্থিত থাকার কথা নয়। কেন এসেছে সে এখানে? তাও এই মাঝরাতে!
“কথা বলবে না রূপ?”
এই আবেগঘন ভরাট কন্ঠ উপেক্ষা করা বড় দায় হয়ে উঠেছে রূপকথার জন্য। তাকে চমকে দিয়ে হুট করে তাকে টেনে কোলে তুলে নেয় আরজান। আলোসহ মোবাইলটা ধরিয়ে দেয় রূপকথার হাতে। এবার অবাক চোখে তার মুখের পানে তাকাল রূপকথা। তাকিয়েই যেন থমকে গেল সে। সুন্দর চেহারাটার মাঝে নেই পূর্বের ন্যায় সতেজতা। চেহারায় কেমন মলিনতার ছাপ!
চোখের নিচের কালিটুকু বুঝি কমিয়ে আনতে চাইছে তার অসীম সৌন্দর্যতা! মনটা বিষিয়ে ওঠে রূপকথার। এমন মুখ দেখতে হবে জানলে সে ভুলেও তাকাত না।
এমন সময় চিৎকার জুরে দেয় আহান ও আবির। রিক মুখ ফুলিয়ে দেখে যাচ্ছে তাদের। আহান তেড়ে এসে বলে, “এই এই, কে তুমি? উড়ে এসে জুরে বসেছো যে! ছাড়ো বলছি, রেগে যাবে তো মায়াপরি।”
বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে আরজান। বিড়বিড়িয়ে বলে, “শা’লার এই মাতালগুলো তো শান্তি দিল না।”
এতোক্ষন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিল আবির। হুট করে সে বলে বসে, “তুমি কি রাক্ষস?”
অগ্নি চোখে তাকাল আরজান। তাকে কি-না রাক্ষস বলছে! অসভ্য পোলাপান! রিক এগিয়ে এসে তাকে আরো কিছু বলার পূর্বেই সে বলে ওঠে, “তোমাদের কী চায় আমাকে বলো। মায়াপরি অসুস্থ এখন।”
তৎক্ষণাৎ দৌড়ে আসে রিক। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, “আমি আমার জন্য কিছু চাইব না। শুধু আহানের জন্য একটু শুকনা থুক্কু গাঁজা দিলেই খুশি আমি।”
তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো আরজান। অতঃপর ভ্রু কুচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “এতোরাতে আকাশ থেকে তো গাঁজার সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন কী করা যায় বলোতো?”
মলিন হয় তাদের প্রফুল্ল মুখগুলো। আবির হতাশ ভঙ্গিতে বলে, “এই জন্য আমি এসব বাজে খাবার খাই না।”
“তবে উপায় একটা আছে। তোমরা যদি ধৈর্য ধরতে পারো তবেই গাঁজা এনে দিতে পারি আমি।”
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় তিনজন। আরজান গম্ভীর স্বরে বলে, “তোমাদের মোবাইলগুলো আমার কাছে জমা দিতে হবে আগে।”
নীরব তারা। নিজেদের মাঝে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আরজান পুনরায় গম্ভীর গলায় বলল, “কী? গাঁজা চায় না তোমাদের? না চাইলে বলো, চলে যাই আমরা।”
এবার যেন বিচলিত হয় পড়লো তারা। নির্দ্বিধায় নিজেদের পকেট হাতরে মোবাইলগুলো বের করে দেয়। তাদের এসব মাতলামো কর্মকাণ্ডে ভেতরে ভেতরে ফুসলে ওঠে আরজান। এগুলো তো একেবারে জাত মাতাল তৈরি হয়েছে! এদের বাবা-মা করে টা কী! বিরক্তির তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কনট্যাক্ট খুঁজে তাদের বাবা-মায়ের নম্বরে মেসেজ করে দেয় সে। অতঃপর তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আকাশপথে গাঁজার সাপ্লাই বন্ধ। পানিপথে গাঁজা আসবে। তোমরা সকলে পানির কাছে গিয়ে বসো।”
পিটপিট করে তাকায় আহান। কথায় আছে মাতালের না আছে দিন আর না আছে রাত। তাদের অবস্থাও ঠিক তাই। আরজানের কথাতে তিনজন হুরমুর করে দৌড়ে যায় পানির খুব নিকটে। পেছন থেকে আরজান গলা উচিয়ে উচ্চস্বরে বলে, “চেয়ে থাকো পানির দিকে। খবরদার অন্যদিকে তাকাবে না। এখনি গাঁজা উঠে আসবে। সে আগে পাবে সেই পুরোটা নেবে।”
পানির কাছে বসে পড়ে তিনজন পা ছড়িয়ে। এক ধ্যানে চেয়ে থাকে পানির দিকে। বোম মারলেও বুঝি আর অন্যদিকে তাকাবে না তারা! বাঁকা হাসে আরজান। হাতের মোবাইলগুলো আছড়ে ফেলে বালুর ওপরেই। মাতালের বংশ কোথাকার! একটু পরেই হয়তো এদের বাবা-মা এখানে এসে হাজির হবে। তাই শুধু শুধু এদের পেছনে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। রূপকথাকে নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে রাস্তার দিকে। এতক্ষণ তার কোলে চেপেই এসব পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল রূপকথা। তার বাঁকা হাসিতে সে ঠিকই বুঝেছে এই লোক মিথ্যা কথা বলছে ওদেরকে। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে আবার কোথায় যাবার পরিকল্পনা এঁটেছে! ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে আরজানের দিকে চেয়ে থাকে সে।
তাকে অবাক করে দিয়ে মিষ্টি হাসে আরজান। রসিকতার সুরে বলে, “এভাবে নজর দিও না নিষ্পাপ একটা পুরুষের উপর।”
থতমত খেয়ে যায় রূপকথা। এহেন কথাতে দ্রুত নজর ঘুরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে সে। অবাক হওয়ার ভান ধরে আরজান। চোখদুটো স্বাভাবিকের তুলনায় বড়বড় করে বলল, “আবার নজর দিচ্ছ? তোমার মতলব তো ভালো ঠেকছে না রূপ। বাচ্চা ছেলের ইজ্জত লুটতে চাও?”
“বাচ্চা!” বিস্মিত নয়নে তাকায় রূপকথা।
আমলে নেয় না আরজান। এতোক্ষন পর মেয়েটা কথা তো বলেছে। সে কপাল কুচকে বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করলে না তো?”
“কী জিজ্ঞাসা করবো?”
“কতো কিছুই তো আজ জানতে চাওয়ার কথা তোমার। যেমন ধরো, গাঁজা কী? খায় না মাথায় দেয়? রাক্ষস কেমন হয়? হ্যান-ত্যান অনেক কিছু।”
“এসব জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমাকে নামিয়ে দিলে ভালো হয়। আর এভাবে যখন তখন আমার কাছে আসবেন না। দুরত্ব বজায় রাখবেন কিছুটা হলেও। তাছাড়া শুধু শুধু এতো কথারই বা কী প্রয়োজন? চলে যান আপনি।”
কে শোনে কার কথা। রূপকথার অভিমানী থমথমে কন্ঠকে খুব অবলীলায় অগ্রাহ্য করে যায় আরজান। তাকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে বলে, “আমার বউয়ের কাছে আসতেও কি তোমার অনুমতি নেব আমি? নিজের সমাজে গিয়ে তো দেখছি সাপের পাঁচ পা দেখেছো। আর নামিয়ে দেবো মানে টা কী? ইয়ার্কি পেয়েছো? তুমি এখন আমার সাথে রাতের বাসেই বাড়ি ফিরে যাবে। মাঝরাতে সমুদ্রের পাড়ে এমনি এমনি আসিনি আমি। সেই গ্রাম থেকে তাড়াহুড়ো করে এতদূর আসতে কত কষ্ট হয়েছে জানো? বউ না নিয়ে তো আমি কিছুতেই ফিরব না। তোমার জন্য সেই কখন থেকে এখানে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছি, নেশাখোরগুলোর মাতলামি সহ্য করছি আর তুমি কি-না আমাকেই উপেক্ষা করছো! কী সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার!”
রাগের পাশাপাশি হতবাকও হতে বাধ্য হয় রূপকথা। এই লোক কি-না মাঝরাতে এখানে তাকে নিতে এসেছে! কিন্তু সে যে ফিরে আসতে পারবে সে কথা তো সে নিজেই জানতো না! তার উপর মৎসকন্যার সাথে সংসার করতে আগ্রহী নয় এই সেই আরো কতো জ্ঞান দিয়েছিল সেদিন। আজ তাহলে কেন এসেছে আবার? সে কিছুতেই যাবে না এই লোকের সাথে।
তাকে এভাবে ভাবতে দেখে মিষ্টি হাসে আরজান। আগে কখনো তাকে এভাবে হুটহাট হাসতে দেখেনি রূপকথা। হয়েছে টা কী এই লোকের! সে কৌতূহলী গলায় বলেই বসে, “আপনি কীভাবে জানলেন যে আজ আমি পানি ছেড়ে উঠে আসব?”
“আমি কীভাবে জানবো? এমন জায়গায় থাকো যে যোগাযোগ পর্যন্ত করা যায় না। মন টিকছিল না তাই চলে এসেছি। সন্ধ্যার পরেই এখানে এসে পৌঁছেছি। অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য।”
“আমি যদি না আসতাম আজ?” শুধাল রূপকথা।
“তাহলে আর কী? অপেক্ষা করতাম যতক্ষণ না আসতে ততক্ষণ।”
চমকাল রূপকথা। মুখে যা আসছে তাই বলে দিচ্ছে নাকি মানুষটা! আরজান পুনরায় বলে ওঠে, “দেখো, সে তুমি আমাকে আপনি বলো আর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রাখো ওসবে কিছুই হবে না। তুমি বাড়ি যাচ্ছ আমার সাথে। ব্যাস!”
“মৎসকন্যার সাথে নাকি সংসার করা যায় না?”
“কে বলেছে এসব ফা’উল কথা? কোন শা’লা বলেছে এগুলো?”
“আপনি নিজেই বলেছেন।” তেতে ওঠে রূপকথা।
“আমি বলেছি?” বিস্মিত কন্ঠে শুধায় আরজান।
উত্তর দেয় না রূপকথা। তার মোটেই বাজে কথা শুনার ইচ্ছা নেই। মানুষটা যে এখন ফা’উল কথার ঝুড়ি খুলে বসবে তা ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে সে। সাত/আট দিনেই চেহারার করুণ দশা করে ছেড়েছে আবার বলে কি-না মৎসকন্যার সাথে সংসার করতে আগ্রহী নই আমি! বোকা পেয়েছে তাকে? সে বুঝি কিছুই বোঝে না। লোকটা ভাঙবে তবু মচকাবে না। উজ্জ্বল চেহারাটার মানচিত্রই বদলে ফেলেছে অথচ ভাব তার একচুল কমবে না!
তাকে চুপ থাকতে এবার বুঝি খানিক বিচলিত হলো আরজান। সে ভাঙ্গা গলায় বলল, “আচ্ছা, মেনে নিলাম আমি বলেছিলাম। কিন্তু তখন আমি ভেবেছিলাম তুমি ভালো থাকবে এখানে।”
“আমি ভালোই আছি।” কন্ঠে তার অভিমান স্পষ্ট।
“মিথ্যে বলো না রূপ। কতটা ভালো যে আছো তা আর তোমায় ব্যাখ্যা করতে হবে না। তোমার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারি আমি। অনুভব করতে পারি তোমার শরীরে সৃষ্ট এই ক্ষতস্থানগুলোর কার্যকারিতা। কিন্তু আফসোস! আমার অনুভূতির ভাষা তুমি পড়তে পারলে না!”
ফিরতি কোনো উত্তর না পেয়ে সে পুনরায় বলে ওঠে, “অযথায় দূরে যাওয়ার প্রচেষ্টা করে আমার হৃদয়ে বিরহের দাগ কেটো না জলরূপসী।”
তার কথার মর্মার্থ বুঝতে অক্ষম রূপকথা। সে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করে এই বাক্যের গভীরতা। আরজান হতাশ স্বরে বলল, “আজ আর এই মুহূর্ত থেকে আমার সঙ্গে থাকবে তুমি। এটাই শেষ কথা।”
মানল না রূপকথা। মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানিয়ে তাকে অনুকরণ করে বলল, “আমি আগ্রহী নই কোনো মানবের সাথে সংসার করতে। আপনি ফিরে যান। নামিয়ে দিন আমায়।”
“তবে কি কোনো মৎসমানবকে চাও তুমি?”
তার প্রত্যুত্তরে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রূপকথা। কোনো উত্তর দিল না সে। আশাহত হলো আরজান। পুনরায় আবেগ মেশানো কন্ঠে বলল, “দূরে যাওয়ার তালবাহানা করো না মেয়ে। বেলাশেষে তোমায় ফিরতে হবে আমার নীড়েই।”
চলবে,,,,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_35
মোবাইলটা শক্ত করে চেপে ধরে রাগে ফুঁসছে আরজান। কিছুক্ষণ পূর্বেই বাস কাউন্টারে কল দিয়েছিল সে। তবে তারা জানিয়েছে এত রাতে তাদের কোনো বাস সার্ভিস নেই গ্রামের দিকে। গ্রামের উদ্দেশ্যে আবার পরবর্তী বাস যাবে সকাল ছয়টায়। তাই তাদের গ্রামে ফিরতে হলে অপেক্ষা করতে হবে সকাল পর্যন্ত। শুনে তো কাউন্টারের লোকটার উপর ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছে আরজান। পারলে যেন সে নিজেই বাস চালিয়ে চলে যেত বাড়িতে। বিরক্ত হয়ে সে পুনরায় কল লাগায় কোনো ট্রেন আছে কি-না জানতে। তবে এখানেও তার দুর্ভাগ্য, বাস কাউন্টারের লোকগুলো অন্তত কল রিসিভ করেছিল এরা সেটাও করছে না। বারকয়েক চেষ্টা করার পরেও ফলাফল শূন্য। বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে কলটা। বিরক্ত হয়ে ওঠে আরজান। রাগান্বিত স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল, “শা’লারা এই সার্ভিস দিচ্ছে! কুম্ভকর্ণের দল। আরেহ! মাত্র রাত ১টা বাজলো আর এখনি এরা কাঁথা-কম্বল গুছিয়ে নিয়েছে! কারোর সার্ভিস নেই তো কেউ কলটাই উঠাচ্ছে না।”
তার পাশেই বালুর উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রূপকথা। তাকে এভাবে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে সে। শান্তি লাগছে তার! বেশ হয়েছে! এখন বুঝুক মজা! রাগচটা লোক একটা!
তার দিকে কটমট করে তাকাল আরজান। হনহন করে তার দিকে দু’পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “খুব হাসি পাচ্ছে?”
দুই ঠোঁট একসঙ্গে চেপে ধরল রূপকথা। কিছুতেই এই হাসি আটকাতে পারছে না সে। তবুও ডানে-বামে মাথা দুলালো সে। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেলল আরজান। সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে আজ! বেশিই সুন্দর লাগছে এই জোৎস্নার আলোতে! বালুতে মাখামাখি সোনালি চুলগুলোও তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাঁটা-ফাটা ঠোঁটটা মোটেই তার সৌন্দর্য কমাতে পারছে না। তাকে কাবু করতেই যেন পুনরায় মুচকি হাসল রূপকথা। অসহায় হলো আরজানের মুখভঙ্গি। এতো হাসির কী হয়েছে? সে সাবধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। আশেপাশে কেউ নেই দেখে যেন স্বস্তি পেল। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তা। তাকে অশান্তির চরম শেখরে পৌঁছে দিতেই যেন অদূরে আলোর সূচনা হলো। মুহুর্তের মধ্যে একটা কার এসে ঠেকল রাস্তার পাশে। দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা নেমে আসল গাড়ি থেকে। তারা হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে পানির দিকে। ভ্রু কুচকাল আরজান। বুঝতে পারলো এরা ঐ ছেলেগুলোর অভিভাবক। নিতে এসেছে এগুলোকে। এখনি হয়তো তাদের টেনে নিয়ে গাড়িতে করে ফিরে যাবে তারা। তাই আর ধ্যান দিল না সেদিকে।
সে গম্ভীর হয়ে রূপকথার দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “উঠে এসো।”
রূপকথা তার কথা খুব একটা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। সে সেভাবেই বসে রইল। তবে তার দৃষ্টি এখন পানির দিকে সীমাবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরজান। বুঝল এভাবে হবে না। এই অভিমানী যেন আজ পণ করে নিয়েছে তার কথা না শোনার জন্য। তার জানা নেই কী করলে ভাঙবে এই মান। আচমকা সে ধপ করে বসে পড়ে রূপকথার পাশে। চমকাল রূপকথা। ভ্রু কুচকে তার দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার হাতটা টেনে নিজের হাতে পুরে নেয় আরজান। যত্ন করে হাতটা ধরে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে কালশিটে পড়া দাগটুকু। দাগটার উপর আলতো করে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল, “জানতে চাইব না এগুলো কীভাবে হয়েছে। শুনে যদি সহ্য করতে না পারি! শুধু জানতে চাইব এসবের কারনটা কি আমিই?”
তার কথা যেন শুনেও শুনলো না রূপকথা। পুনরায় মনোনিবেশ করলো পানির দিকে। উত্তরের আশা করে না আরজান। সে বুঝে নিয়েছে আজ সে উত্তর পাবে না। মান ভাঙাতে তাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে। সে নিজেও দৃষ্টি ফেলল পানির দিকে। জলরাশির উত্তাল উচ্ছ্বাসে খানিক হিংসা হলো তার। কেমন ছন্নছাড়া হয়ে মহা আনন্দে আছড়ে পড়ছে তারা!
নীরবতা ভেঙে পুনরায় শুধাল, “পানিতে নামবে?”
চকিতে তাকালো রূপকথা। গম্ভীর স্বরে বলল, “এ সময় পানিতে নামলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তারা নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজতে আসবে এখানে।”
“পালিয়ে এসেছো তুমি? অত্যাচার করেছে ওরা? বলছো না কেন তোমার ফাটা ঠোঁটের কারন? কালশিটে পড়া হাতগুলো, ক্ষতস্থানগুলো কোন অপরাধে সৃষ্টি হয়েছে?” উত্তেজিত হয়ে পড়েছে আরজান।
“নিয়মভঙ্গের অপরাধে।”
কথাটা যেন ঝনঝন শব্দ তুলল আরজানের নিকট। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নিয়মভঙ্গের শাস্তি এতো কঠোর হয়! কী প্রয়োজন এমন নিয়মের? তার জলরূপসীর মায়াভরা মুখটা কি দৃষ্টিগোচর হয়নি তাদের? কেন তার কোমল শরীরটা ক্ষতচিহ্ন দিয়ে ভরিয়ে তুলল তারা! মায়া লাগেনি তাদের? বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হলো আরজানের। যার সামান্য কষ্ট সহ্য করতে হিমশিম খেতে হয় তাকে, তার শরীরে অগনিত ক্ষতস্থান তৈরি করে দিলো! চোখদুটো বন্ধ করে বড়বড় করে শ্বাস নিলো সে। বেশিক্ষণ এই ক্ষতস্থানগুলোর দিকে চেয়ে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে তার নিকট। সে তো চেয়েছিল তার জলরূপসী ভালো থাক। অজস্র পানির মাঝে একটু শান্তিতে থাক। অথচ সে নিজের অজান্তেই তাকে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুকূপে। চোখ বন্ধ করে সে অনুভব করতে চাইলো সেই অত্যাচারের দৃশ্য। চোখের সামনে আবছা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতেই ধপ করে চোখ খুলে ফেলল সে। সহ্য করতে পারছে না সে! কষ্ট হচ্ছে তার! ক্ষতস্থানগুলো অবিরত পোড়াচ্ছে তার হৃদয়! গলা শুকিয়ে এসেছে। শ্বাস নেওয়াটাও দায় হয়ে উঠেছে।
টানা টানা নিঃশ্বাসের শব্দ পেয়ে দ্রুত তার দিকে তাকালো রূপকথা। লাল চোখদুটোর দিকে চেয়ে থাকলো অবাক চোখে। সে কি রেগে যাচ্ছে! নাকি কষ্ট হচ্ছে তার! উপলব্ধি করতে অক্ষম হলো রূপকথা। সে ব্যস্ত কন্ঠে শুধাতে চাইলো, “তোমার কি খারাপ লাগছে ম্যাজিশিয়ান?”
কিন্তু সে সুযোগ আর পেলো না সে। তার পূর্বেই পানির মাঝে তোলপাড় শুরু হলো। অচিরেই দু’জন মৎসমানব ও একজন মৎসমানবী উঠে এলো পানির বুক চিরে। উঠে আসছে তারা। এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। রূপকথার আর বুঝতে বাকি রইল না তারা তাকেই নিতে এসেছে। তবে সে ভীত হলো না বরং আরজানের দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তার শরীর ঘেষে বসলো। হঠাৎ এমন করাতে ভাবনাচ্যুত হলো আরজান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রূপকথার দিকে। এমন সময় মৎসমানবী ও মৎসমানবদুটোর নজর পড়লো তাদের দিকে। রূপকথা দেখতে পাচ্ছে তারা ছুটে আসছে তার দিকে তবে তার মাঝে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। সে পূর্বের ন্যায় বসে আসে আরজানের শরীর ঘেষে।
খানিক অবাক হলো আরজান। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকাতেই সে দেখতে পেল তাদেরকে। পানি ত্যাগ করতেই বদলেছে তাদের সাজ-পোশাক। বিলীন হয়েছে আঁশটেযুক্ত লেজ। দেখে কোনোরূপ বোঝার উপায় নেই তাদের ভিন্ন সত্তা সম্পর্কে। সাধারণ মানুষের ন্যায় লাগছে তাদেরকে। ভ্রু কুঞ্চিত করলো আরজান। ক্ষীণ স্বরে রূপকথাকে শুধাল, “এদেরকে চেনো তুমি?”
উপর-নিচ মাথা নাড়ালো রূপকথা। যার অর্থ সে চেনে। রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো, “এরা আমারই জাতিগোষ্ঠী। ধরে নিয়ে যেতে এসেছে আমাকে। সমাজে হয়তো এতোক্ষনে রটে গেছে আমার গায়েব হবার খবর।”
কৌতূহলী দৃষ্টি বদলালো আরজানের। এতোক্ষন যেই চোখদুটো তার জলরূপসীর ব্যথায় ব্যথিত ছিল সেই চোখদুটোতে শুরু হলো অগ্নি বর্ষণ। কষ্টের প্রতিচ্ছবি মুছে গিয়ে ফুটে উঠলো সীমাহীন আক্রোশ। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। শক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো তাদের দিকে এগিয়ে আসা মৎসমানব-মানবীর দিকে। তারা ছুটে এসে ঠিক রূপকথার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে থেকে একজন মৎসমানব রূপকথার উদ্দেশ্যে চোখ গরম করে হিসহিসিয়ে বলল, “এতো অত্যাচারের পরেও তুই পালিয়ে এলি কী করে? আবার এসে এই মানবের কোল ঘেষে বসেছিস! একবার নিয়মভঙ্গ করে তোর শিক্ষা হয়নি?”
উত্তর দিল না রূপকথা। মুখ ঘুরিয়ে নিলো তাদের থেকে। তাদেরকে অগ্রাহ্য করে গুনগুন শব্দ তুলতে তুলতে আনমনে এগিয়ে গেলো উল্টোদিকে। এবার বোধহয় বেশিই হতবাক হলো তারা। হতবুদ্ধির ন্যায় কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো তার দিকে। আমলে নিলো না রূপকথা। সে তো পা দিয়ে খুঁটে খুঁটে বালুর ওপর আঁকাআঁকি করতে ব্যস্ত। এভাবে উপেক্ষা করাতে প্রচন্ড রাগান্বিত হলো তারা। একজন মৎসমানব ছুটে যেতে ধরলো তার দিকে। অমনি শক্ত হাতে তার হাত চেপে ধরলো আরজান। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মৎসমানবটি অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকাতেই সর্বশক্তি দিয়ে তার মুখ বরাবর আঘাত বসিয়ে দিলো সে। মৎসমানবটার আছড়ে পড়ার শব্দে ফিরে তাকালো রূপকথা। তবে অবাক হলো না সে। তার মুখভঙ্গি খুব স্বাভাবিক। যেন সে পূর্ব থেকেই অবগত যে এখন কী ঘটবে।
অপরজন তেড়ে এলো আরজানের দিকে। রাগান্বিত হয়ে তার শার্ট টেনে ধরতেই হাঁটু তুলে তার পেট বরবার আঘাত করে বসলো আরজান। ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে পেট চেপে ধরে ছিটকে সরে গেল মৎসমানবটি। অপরজন উঠে বসেছে এতোক্ষনে। আরজানকে শাসিয়ে বলল, “তোর সাথে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এই মৎসকন্যাকে ছেড়ে দে আমাদের কাছে। তুই একজন মানব হয়ে কেন আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিস? ওকে নিয়ে যাবার হুকুম আছে আমাদের। এই মৎসকন্যা নিয়মভঙ্গ করেছে আমাদের সমাজের। শাস্তিপ্রাপ্ত আসামী সে।”
রাগ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আরজানের! সে ছুটে গিয়ে লাথি বসিয়ে দিলো তার বুক বরাবর। পুনরায় বালুর উপর ছিটকে পড়লো মৎসমানব। চেচিয়ে ওঠে আরজান, “ছেড়ে দেবো? ছেড়ে দেবো ওকে? আমার সাথে কোনো দ্বন্দ নেই তোদের হ্যাঁ? যখন আর যেই মুহুর্তে ওর দিকে গরম চোখে তাকিয়েছিস ঠিক সেই সময়ই তোদের আর আমার মাঝে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছে। আর তোরা বলিস দ্বন্দ্ব নেই! তোদের সমাজে, এই পানির নিচে রূপ হয়তো একা ছিল, অসহায় ছিল। কিন্তু এই স্থলে সে একা নয়। তোদের দ্বারা ওর শরীরে যদি আর একটা আঁচড়েরও জন্ম হয় তাহলে আর ঐ পানির গহ্বরে ফিরে যাওয়া হবে না তোদের। তোরা কী ভেবেছিস? আমার সামনে থেকে রূপকে নিয়ে যেতে পারবি? জানে মেরে দেবো সবক’টাকে।”
শান্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে আছে রূপকথা। সে জানতো এমন কিছুই ঘটবে এখন। সে গা ছাড়া ভাব নিয়ে হাই তুলতে তুলতে বসে পড়ে বালুর উপর। দূরে দাঁড়ানো মৎসমানবীটি তাকেই পর্যবেক্ষণ করে চলেছে অবাক হয়ে। সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না রূপকথা। সে তো একদৃষ্টে চেয়ে আছে আরজানের দিকে। রেগে গেছে তার ম্যাজিশিয়ান! রাগে লাল আভার সৃষ্টি হয়েছে তার নাকের ডগায়। তা দেখে মুচকি হাসে রূপকথা। রাগলেও কতো সুন্দর লাগে ম্যাজিশিয়ানকে! অসীম এ সৌন্দর্যের মালিকানা যে তার হাতেই। তাহলে আর সে আফসোস করবে কী করে নিজের বর্ণ নিয়ে। এই বর্ণ তো তাকে নিরাশ করেনি। এই বর্ণের কারনে তো কখনো তার ম্যাজিশিয়ান চোখ-মুখ কুচকায়নি বরং মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকেছে শ্যামবর্ণা জলরূপসী দিকে!
এমন সময় একজন মৎসমানব হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে আঘাত করে বসে আরজানের পেট বরাবর। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় আরজান। খানিক বিচলিত হলো রূপকথা। সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ানোর পূর্বেই ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকালো আরজান। তার দিকে চেয়ে থেকেই পকেটে হাত পুরে বের করে আনলো জাদুতে ব্যবহার করা সেই ছোট্ট লাঠিখানা। লাঠিটার আকার এতোটাই ছোট যে তা অনায়াসে পকেটে পুরে ফেলা যায়। লাঠিটাতে দু’বার ফুঁ দিতেই তার আকৃতি পরিবর্তন হতে থাকে। কিছুটা বড় হয়ে সেটা শূন্যে ভাসতে শুরু করেছে। সেদিকে হতবাক নয়নে চেয়ে থাকে প্রতিটা প্রাণী। আচমকা লাঠিটা এগিয়ে যায় মৎসমানবগুলোর দিকে। আঘাত করতে থাকে তাদের শরীরে। একজনকে ছেড়ে একজনকে আঘাত করে চলেছে অবিরত।
প্রতিটা আঘাতে আঘাতে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে তাদের শরীরে। পূর্বের তুলনায় লাঠিটা বুঝি আজ বেশিই শক্তি ব্যবহার করছে তাদেরকে আঘাত করতে। গগণবিদারি চিৎকারে ফেটে পড়েছে তারা। মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা আঘাত পর্যবেক্ষণ করছে আরজান। তারা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে বালুর উপর। তবুও থামছে না লাঠিটা বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে তার বল প্রয়োগের পরিমাণ। মৎসমানবগুলো বালুর উপর পানি বিহীন মাছের ন্যায় তড়পাচ্ছে। দয়া হলো না বুঝি আরজানের। সে নিজের কঠোরতা বজায় রেখেই শক্ত দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সবকিছু। তন্মধ্যে ছুটে আসে মৎসমানবীটি। হাতজোড় করে বসে যায় আরজানের সম্মুখে। আকুতির স্বরে বলল, “ক্ষমা করুন। দয়া করে ছেড়ে দিন ওদেরকে। আমরা কথা দিচ্ছি আর কখনো ফিরব না এই মৎসকন্যার জীবনে। তার সাথে হওয়া অত্যাচারের জন্য ক্ষমা চাইছি আমি।”
শুনেও শুনলো না আরজান। হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো মৎসমানবীটির দিকে। রাগান্বিত স্বরে হিসহিসিয়ে বলল, “দ্বিতীয়বার সেই সুযোগ দেবো না আমি। রূপকথার শহরে প্রবেশ করতে হলে আগে এই ম্যাজিশিয়ানের সামনা করতে হবে। আর আমাকে পেরিয়ে হাওয়ায় ঝরে পড়া একটা পাতাও তার শরীর স্পর্শ করতে পারবে না।”
তার রাগের পরিমাণ এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে নিজেকে সংবরণ করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে। মৎসমানবীটিকেও হয়তো আঘাত করেই বসতো সে। তবে তার পূর্বেই সে সরে এলো রূপকথার দিকে। গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “তুমি চাইলে এই লাঠি আমার শরীরেও পড়বে। অপরাধীর শরীরে আঘাত হানতে তার কোনো বাঁধা নেই। সবচেয়ে বড় অপরাধটা যে আমিই করেছি রূপ!”
গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো রূপকথা। মৎসমানবগুলোকে দেখিয়ে বলল, “ছেড়ে দিন ওদেরকে।”
হতাশ হলো আরজান। হাত বাড়িয়ে টেনে নিলো লাঠিখানা। মৎসমানবীটি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো রূপকথার দিকে। অতঃপর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে কোনোমতে তুলে নিয়ে পানিতে নেমে তলিয়ে গেল তারা। তারা হারিয়ে যায় পানির অতলে। সেদিকে ধ্যান নেই কারোরই। ব্যথিত নয়নে রূপকথার দিকে চেয়ে আছে আরজান। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে হুট করে তার শরীর ঘেষে বসে পড়লো। আরো একবার চমকে দিয়ে তার কোলে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে রইল। হতবাক নয়নে তাকালো রূপকথা। ব্যস্ত স্বরে বলল, “করছেন টা কী? উঠুন বলছি। আপনাকে বলেছি না যখন তখন এভাবে আমার কাছে আসবেন না। অন্তত অল্প-স্বল্প দূরত্ব তো বজায় রাখা উচিত। লাজলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে নাকি?”
চোখ-মুখ কুচকে নিলো আরজান। চোখদুটো বন্ধ রেখেই একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “সবসময় দূর-দূর করবে না তো! কীসের দূরত্ব হ্যাঁ? অপরাধ করেছি শাস্তি দাও মাথা পেতে নেব। কিন্তু দূর-দূর করবে না একদম। আর বউয়ের কাছে কীসের লাজলজ্জা? আজব! বউয়ের সামনে লজ্জা পেলে বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করবো কীভাবে? আক্কেল-জ্ঞান আর তোমার এই জীবনে হলো না রূপ।”
আহাম্মক বনে যায় রূপকথা। চোখদুটো বড়বড় করে মুখটা হা করে চেয়ে থাকে আরজানের দিকে। লোকটা কী বলল এগুলো! ছি! কথাবার্তার কী ছিরি! মুখে যা আসে তাই বলে দেয় অসভ্যের মতো! সে ঠেলে নামিয়ে দিতে চায় আরজানের মাথাটা। তবে শক্তিতে পেরে উঠছে না তা করতে তবুও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে বসে আরজান। রাগান্বিত স্বরে বলল, “এভাবে ঠেলছো কেন? আরেহ বাবা! বাচ্চাকাচ্চা নেব বলেছি বলে কি এই খোলা ময়দানে প্রসেস শুরু করবো! দেখো রূপ, তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমি অতটাও নির্লজ্জ নই। বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তাছাড়া মায়ের থেকে অনুমতি নেওয়ারও একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে।”
মায়ের থেকে অনুমতি নিতে হবে! অসহায় হলো রূপকথার দৃষ্টি। কর্ণগহ্বর যেন ঝলসে গেল তার! বেকুব কাকে বলে? কত প্রকার? সেটা বোধহয় এ সময় নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতো না সে। কার উপরে অভিমান করেছে সে? এই, এই লোকটার উপর! এ তার মান ভাঙাবে! নাকি অসভ্যের মতো কথাবার্তা বলে তার কান পচাবে! সে কটমটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “তাই নাকি? বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করবেন আপনি আর অনুমতি নিতে হবে মায়ের থেকে?”
আরজান পুনরায় সরল ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “আরেহ! এভাবে তাকাচ্ছো কেন? মায়ের থেকে তো অনুমতি নিতেই হবে। তার একটা দায়িত্ব আছে না? সে ছাড়া বাচ্চাকাচ্চাগুলো বড় করে দেবে কে? দশ/বারোটা বাচ্চা তো আর তুমি একা সামলাতে পারবে না, বুঝো নাই?”
“দশ/বারোটা! সংখ্যাটা বোধহয় কম হয়ে গেল! আরেকটু বাড়ালে ভালো হতো না?”
আরজান ভাবুক স্বরে বলল, “ঠিকই বলেছো। সংখ্যাটা বাড়াতে হবে। মানুষের লক্ষ্য সবসময় বড় রাখা উচিত। তাছাড়া ডাকাতদলের অছিলায় গ্রাম থেকে কতগুলো লোক কমে গেছে। ভারসাম্য রক্ষারও তো একটা ব্যাপার আছে।”
“ভারসাম্য!” হতবুদ্ধির ন্যায় চাইল রূপকথা।
“হ্যাঁ, এতো অবাক হবার কী হয়েছে? ভারসাম্য রক্ষা করতে অলোকপুরের মানুষের উচিত বেশি বেশি বাচ্চা পয়দা করা। এখন যাকে তাকে তো আর গিয়ে বলা যায় না যে বাচ্চা পয়দা করো। প্রসেসটা নিজের ঘর থেকেই আগে শুরু করতে হয়। ভাবছি এখান থেকে ফিরে শা’লাবাবুর বিয়েটাও দিয়ে দেবো। তারও অধিকার আছে গ্রামের ভারসাম্য রক্ষায় অংশগ্রহণ করার।”
আর সহ্য করতে পারলো না রূপকথা। ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে! সে উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে অন্যদিকে। তব্ধা খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল আরজান। যখন বুঝলো রূপ তাকে ফেলে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে তখন সব ফেলে দৌড় লাগালো তার পিছু। গলা ফাটিয়ে উচ্চস্বরে বলল, “তোমাকে তো দেখছি কিছু বলাই যায় না আজকাল! সবকিছুতেই রাগ দেখাও। এখানেই তো ফুটে ওঠে একজন স্বামীর অসহায়ত্ব। আসলে বিবাহিত পুরুষদের জীবনে শান্তি বলতে আর কিছু থাকে না শুধু ভালোবাসাটুকু ছাড়া।”
থামলো না রূপকথা। আরো বাড়িয়ে দিলো পায়ের গতি।
চলবে,,,,,,,,,,,,