#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_28
বিষন্ন মনে বিছানায় বসে আছে রূপকথা। বিছানায় পড়ে রয়েছে নতুন কিছু পোশাক। কিছুক্ষণ পূর্বেই বাজার থেকে এগুলো এনে দিয়েছে ম্যাজিশিয়ান। সকালে বাড়িতে ফিরেই সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে আজই তাকে এই ঘর, এই বাড়ি, এই গ্রাম ত্যাগ করতে হবে। চলে যেতে হবে দুর সমুদ্রে। শুরু করতে হবে পূর্বের সেই জীবন। যেই জীবন শুধু পানিতেই সীমাবদ্ধ। যেখানে থাকবে না তার ম্যাজিশিয়ান। থাকবে না কোনো প্রিয়জন। মাত্র কয়েকদিনেই সে কেমন নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ম্যাজিশিয়ানের উপর! আশ্চর্যই বটে! সে তো সারাজীবন একাই কাটাতে চেয়েছিল তাহলে দুদিনের এই সম্পর্ক তাকে কেন এই বৃহৎ মায়ায় ফেলল? তারও লোভ বেশি। মৎসকন্যা হয়ে সংসারের স্বপ্ন বুনেছিল। নিজের উপর নিজেই তাচ্ছিল্য হাসে সে। তবে ম্যাজিশিয়ান ঠিকই বলেছে। একজন মানুষের পক্ষে কখনোই এমন ভিন্ন জাতির কাউকে গ্রহন করা সম্ভব নয়। তবুও আজ বড় বেহায়া হতে ইচ্ছে করছে তার। সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে থেকে যেতে ইচ্ছে করছে ম্যাজিশিয়ানের সীমানায়। তবে তা যে কস্মিনকালেও হবার নয়।
হঠাৎ নিজের হাতের দিকে নজর পড়তেই দেখতে পায় সেই রিং, যেটা টানাহ্যাঁচড়ার কারনে ঐ ঘরের মধ্যে পড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। এটা আবার তার হাতে এলো কী করে? তার যতদূর মনে পড়ছে এটা সে হারিয়ে ফেলেছিল ঐ ঘরে। নিশ্চয়ই ম্যাজিশিয়ান এনে দিয়েছে। সে ছাড়া আর কেই বা রাখবে তার এতো খেয়াল। এটা কখন পড়িয়ে দিয়েছে তা তার জানা নেই। তার অজান্তেই তার জীবন জুড়ে কতশত অবদান রেখেছে ম্যাজিশিয়ান। ঐ দুর সমুদ্রে কীভাবে কাটাবে সে একা? তার যে অভ্যেসে পরিণত হয়েছে ম্যাজিশিয়ানের সান্নিধ্য।
তার ভাবনার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে আরজান। রূপকথার দিকে একবার চেয়ে তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। তাকে এড়িয়ে গিয়ে বসে পড়ে চেয়ার টেনে। শার্টের উপরের বোতাম দুটো খুলে দিয়ে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় রূপকথার দিকে। তবে তার কোনো হেলদোল নেই। সে আরজানের দিকেই চেয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও নিশ্চুপ রূপকথা। অন্যদিকে মুখে যেন কুলুপ এঁটেছে আরজান। তাদের মাঝে নীরবতা আর দৃষ্টি আদান-প্রদান ব্যতীত আর কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় না। রূপকথার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেয় আরজান। দৃষ্টি জুরে তার হাজারটা প্রশ্ন। রূপ কি রেগে আছে? নাকি খুশি হয়েছে সমুদ্রে যেতে পারবে বলে?
আরোও কিছুটা সময় পেরিয়ে যায় এভাবেই। এখনো নীরব রূপকথা। এমনকি নিজের দৃষ্টিও সরিয়ে নিয়েছে আরজানের দিক থেকে। মাটির দিকে চেয়ে আছে সে। নিজের বেহায়া মনের সাথে যুদ্ধ করে পুনরায় আড়চোখে তার দিকে তাকায় আরজান। এমন চুপ করে আছে কেন মেয়েটা? খুশি-আনন্দ, রাগ-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট কিছুতো প্রকাশ করবে নাকি? এভাবে চূপ করে থাকার মানেটা কী?
এরমাঝে সোফিয়া শিকদার একবার এসে ডেকে যায় তাদের। সেও শুনেছে ছেলের মন্তব্য তবে সঠিক কারন সম্পর্কে অবগত নয়। আরজান শুধু তাকে জানিয়েছে রূপ এখানে নিরাপদ নয়। ওকে দুরে কোথাও রেখে আসবে সে। তবে লামিয়া বা তার খালু-খালামণিকে এ ব্যাপারে বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। আজ তারা চলে গেলেই রূপকথাকে রেখে আসবে আরজান। সোফিয়া শিকদারের হাজারটা আপত্তিতেও কান দেয়নি সে। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। সোফিয়া শিকদার রূপকথার কাছে দুয়েকবার ঘুরেও কোনো সুরহা করতে পারেনি। মেয়েটা সেই থেকে চুপ করে আছে তো আছেই। তাছাড়া তারও বিবেকে বাঁধছে রূপকথাকে এখানে থেকে যেতে বলতে। আকরাম মিঞার মুখে সে শুনেছে ডাকাতদলের ভয়াবহতা সম্পর্কে। তার ধারনা আরজানের সাথে শত্রুতার জের ধরেই রূপকথাকে নিয়ে গিয়েছিল তারা। জলপরি শুধুই তাদের ভ্রান্ত ধারনা।
বারান্দায় চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসে আছে আকরাম মিঞা, রোজিনা বেগম, লামিয়া এবং তার মা-বাবা। পাশেই সটান দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। তারা এখনো জানে না রূপকথার চলে যাওয়ার ব্যাপারে। লামিয়ার মা-বাবার আজ চলে যাওয়ার কথা ছিল লামিয়াসহ তবে পলাশের কারনে বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে তাদের। বাড়ির বাইরে কাউকে এক পাও বেরোতে দিচ্ছে না সে। লামিয়া বসে বসে শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কখনো চোরা চোখে দেখে নিচ্ছে আরজানের ঘরটা। সামনে পলাশ থাকার কারনে সে উঠে কোথাও যেতেও পারছে না। বেশ ভীত হয়ে উঠেছে সে। শুকিয়ে এসেছে তার উজ্জ্বল মুখশ্রী। সে বিরক্ত হয়ে পলাশের উদ্দেশ্যে বলে, “আমাদের ট্রেনের সময় হয়ে যাবে, যেতে হবে। এভাবে বসিয়ে রাখার মানেটা কী?”
তার আচরনে আগে থেকেই তার প্রতি ক্ষুব্ধ পলাশ। আবার এভাবে চেঁচিয়ে ওঠাতে বড্ড বেশিই বিরক্ত হয় সে। রাগান্বিত স্বরে কিছু বলার পূর্বেই ইশারায় থামিয়ে দেয় আকরাম মিঞা। ছেলেকে শান্ত করতে বলেন, “যাইয়া দেখ তো বাজান কী করতাছে? ডাইকা আন। এরাও তো আবার শহরে ফিইরা যাইব নাকি।”
হনহনিয়ে আরজানকে ডাকতে চলে যায় পলাশ। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গলা উচিয়ে ডাকে, “দুলাভাই, আব্বা ডাকে।”
তার ডাকে ধ্যান ভাঙে আরজানের। রূপকথার দিকে একবার দেখে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় সে। মুখ জুরে বজায় রেখেছে নিজের গম্ভীরতা। তার যাওয়ার পানে চোখ তুলে তাকায় রূপকথা। বিড়বিড়িয়ে বলে, “তুমি খুব খুশি হবে বুঝি আমি চলে গেলে? তাইতো এতো তোড়জোড় আমাকে রেখে আসার।”
বারান্দায় এসে লামিয়ার সামনে একটা চেয়ার নিয়ে ধীরে সুস্থে বসে পড়ে আরজান। সবার দিকে একবার দেখে নিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লামিয়ার ওপর। ইতিমধ্যে কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেছে লামিয়ার। এতে করে অধিকতর গম্ভীর হয়ে ওঠে আরজানের মুখভঙ্গি। আচমকা কোনো কথাবার্তা ছাড়াই সপাটে এক চড় বসিয়ে দেয় লামিয়ার গাল বরাবর। তা এতোটাই জোরে ছিল যে চেয়ারসহ নিচে ছিটকে পড়ে লামিয়া। আকস্মাৎ ঘটনায় হকচকিয়ে যায় সকলেই। সকলের আশ্চর্যের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শক্ত দৃষ্টিতে তাকায় আরজান। গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে চেয়ে থাকে লামিয়া। হঠাৎ কী থেকে কী হলো তা বুঝতেই লেগে যায় কিছুটা সময়।
তার সাথে কী ঘটেছে উপলব্ধি করতে পেরেও সে ঠাঁই বসে থাকে। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। লামিয়ার মা আরজানের দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, “ওকে মারছিস কেন তুই? পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই?”
লামিয়ার বাবা রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে। কিছুটা হলেও সে ধারনা করতে পারছে এই থাপ্পড়ের কারন। কাল থেকেই মেয়ের আচরন লক্ষ্য করছে সে। বাড়ির একটা মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রতিক্রিয়ায় নেই তার মেয়ের ভেতর। উল্টো তাকে খানিক খুশিই দেখাচ্ছিল। চোখে-মুখে ভেসে উঠেছিল অন্যরকম এক উল্লাস। যেন অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে সে। যতই তার শত্রু হোক তা বলে এমন একটা সময়ে লামিয়ার এমন আচরন মোটেই কাম্য নয়। মেয়ে তার বড় নির্দয়ের মতো ব্যবহার করছে কাল থেকে। মেয়ের এহেন আচরনে মনোক্ষুন্ন হয়েছে সে। এমনকি কোথাও তার সন্দেহ জাগছে কালকের ভয়াবহ ঘটনার পেছনে তার মেয়ের হাত নেই তো।
সকলের অগোচরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মেয়েটা আদর করতে গিয়ে শাসন করতে ভুলে গিয়েছিল সে। ব্যর্থ পিতা সে। মেয়েকে সে শিক্ষা দিতে পারলেও সুশিক্ষা বোধহয় দিতে পারেনি। শাসন প্রয়োজন লামিয়ার। তাই সে নিঃশব্দে উঠে ঘরে চলে যায়। যাবার পূর্বে স্ত্রীকেও টেনে নিয়ে যেতে ভোলে না। নিজের বিয়ের পর থেকে সে দেখে আসছে আরজানকে। ছেলেটাকে চিনতে আর বাকি নেই তার। নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো অপরাধ করেছে তার মেয়ে। তার দৃঢ় বিশ্বাস আরজান কখনো অন্যায়ভাবে চড়াও হবে না তার মেয়ের উপর। একে একে সকলেই চলে যায় সেখান থেকে। শুধু রয়ে যায় পলাশ।
বাবা-মা চলে যাওয়ার দিকে অসহায়ের ন্যায় চেয়ে থাকে লামিয়া। এমন সময় চেঁচিয়ে ওঠে আরজান, “জলপরি কেমন হয় জানিস তুই?”
উত্তর দেয় না লামিয়া। পুনরায় ধমকে ওঠে আরজান, “কী হলো? জানিস?”
ডানে-বামে মাথা নাড়ায় লামিয়া। যার অর্থ সে জানে না। খেঁকিয়ে ওঠে আরজান, “তাহলে বলেছিস কেন ওদেরকে? চিনলি কীভাবে ওদেরকে?”
লামিয়াকে চুপ থাকতে দেখে ধমকে ওঠে আরজান, “বল।”
কাঁপাকাপির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় লামিয়ার। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে শুরু করে, “প্রথম যেদিন এখানে আসলাম সেদিনই আমি ওকে দেখেছি খুব ভোরে পানি থেকে উঠে আসতে। নজরে নজরে রেখেছিলাম আমি। এরপর কিছুদিন আবার ওকে আমি পানিতে সাঁতরাতে দেখেছি আঁশটেযুক্ত লেজ নিয়ে। তাছাড়া ওর এই অদ্ভুত চুল সবকিছু ইঙ্গিত দেয় ও জলপরি। যেদিন তোকে বাঁচালো রূপকথা সেদিনই আমার সাথে দেখা হয়েছিল ঐ দলের অধিপতির সাথে। বয়স্ক একটা লোক ছিল। খোঁজ নিতে এসেছিল তুই বেঁচে আছিস কি-না। রাগের বশবর্তী হয়ে রূপকথার ব্যাপারে তাকে সবকিছু বলে দিয়েছিলাম আমি। সব শুনে লোকটা জানায় তাদের গ্রামে নাকি অনেক আগে থেকেই জলপরি বাস করে কিন্তু কেউ কখনো দেখতে পারেনি। খুশিতে খুশিতে চলে যায় সে। আর তার পরেই তো,,,,,,,,,,,।”
ভ্রু কুচকায় আরজান। হতবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, “তুই কি মাথা পাগল? এই তোর বাপ জীবনে জলপরি দেখছে? ঘরে গিয়ে শুনে আস তো দেখছে কি-না? পাগলের ঝাড়-বংশ কোথাকার।”
গালে হাত দিয়ে অসহায়ের ন্যায় চেয়ে থাকে লামিয়া। ব্যাথায় টনটন করছে গালটা। এরা জামাই-বউ মিলে তার সুন্দর গালটার হাল খারাপ করে দিয়েছে। জলপরি হোক বা না হোক সে আর এখানে থাকবে না। ইতিমধ্যে দুইজন দুইটা থাপ্পড় দিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কী করবে তার ঠিক নেই। তার ভাবনার মাঝে পুনরায় ভেসে আসে আরজানের বিরক্তভরা কন্ঠস্বর, “কী রে? কথা বলিস না কেন? তোর বাপকে বলবি শহরে গিয়ে আগে তোকে ডাক্তার দেখাতে। আর তোর বাপ কি জানে না? মেয়েকে আল্লাদ দেখিয়ে শাসন না করে শুধু আস্ত পাগল তৈরি করলেই হয় না তাকে ডাক্তারও দেখানোর প্রয়োজন আছে।”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লামিয়া। জোর গলায় বলে, “আমি পাগল? তাহলে ওর চুল সোনালি কেন? আর ঐ লেজ? সেটার ব্যাপারে কী বলবি তুই?”
“আরে মাথা মোটার বংশ ওর চুল প্রকৃতিকভাবে অমন নাকি? আমি হেয়ার কালার করিয়েছি। কৃত্রিম পদ্ধতিতে চুলে রং করা যাকে বলে। আর ঐ লেজটাও কৃত্রিম। যারা সাঁতার পারে না তাদের জন্য ওটা অনেক হেল্পফুল। রূপ তো ওটার সাহায্যেই সাঁতার শিখেছে। ওসব তুই দেখছোস জীবনে? দেখবি কীভাবে? তুই তো সাঁতার জানিস।”
চোখ গোলগোল করে চেয়ে থাকা ছাড়া বলার মতো আয কিছুই পায় না লামিয়া। আসলেই এমন কিছু পাওয়া যায়!
“গ্রামের মানুষ এমনিই একটু বেশিই হুজুগে। ওরা তো ভূতও বিশ্বাস করে। তুই ভূত দেখেছিস কখনো? আন্দাজে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে জলপরি বানিয়ে ফেললি! বোধবুদ্ধি সব খুইয়ে বসেছিস নাকি? পাগলের ডাক্তার দেখানো তোর জন্য ফরজ হয়ে গেছে।” বেশ বিরক্ত নিয়ে বলে আরজান।
এমন সময় ব্যাগপত্র হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে লামিয়ার বাবা। তার মাও ছুটে আসছে পেছন পেছন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখে নেয় আরজান। বারান্দার একদম শিয়রে এসে দাঁড়ায় তারা। লামিয়ার বাবা মেয়ের দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “এখনো বসে আছো কেন ওখানে? নাক কাটাতে আরোও কিছু বাকি আছে নাকি?”
লামিয়া হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই তারা সোফিয়া শিকদারের থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায় বাইরের দিকে। তারা সদর দরজা পেরোনোর পরে আরজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই পলাশকে দেখতে পায়। যে আপাতত ভ্রু কুচকে তার দিকে চেয়ে আছে।
“কী ব্যাপার শা’লাবাবু? তোমার হিরোইন চলে গেছে বলে কষ্ট পাচ্ছো নাকি?”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পলাশ। তেড়ে এসে বলে, “আমারে না ভূতে মারছিল? আপনেই তো কইছিলেন।আবার এখন কন ভূত হয় না। ভূত যদি না হয় তাইলে ঐডা কী আছিল? সত্য কইরা কন। নিজে মাইরা ভূতের দোষ দিতাছেন না তো?”
শুকনো হাসি হাসে আরজান। শা’লার দিনটাই খারাপ যাচ্ছে তার। সবাই মনে হচ্ছে তির-ধনুক নিয়ে তৈরি হয়ে আছে তাকে মারতে। ঐদিকে বউ কথা বলছে না। আর এইদিকে শা’লাবাবু বেশি কথা বলছে। পলাশ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে ছুটে ঘরে চলে যায়। আহাম্মকের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয় পলাশ।
ঘরে এস দরজায় খিল এঁটে ঘুরে তাকাতেই চমকে ওঠে আরজান। রূপকথা ঠিক তার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়েই থেমে নেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। চোখদুটো বড়বড় করে তাকায় আরজান। এ এভাবে আগাচ্ছে কেন তার দিকে! মতলব কী?
তাকে আরোও আশ্চর্য করে তার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে রূপকথা। ইতিমধ্যে এক পা দু’পা করে পেছাতে শুরু করেছে আরজান। তবুও থামাথামির কোনো নামই নেই রূপকথার। গলা শুকিয়ে আসছে আরজানের।এবার আর চুপ থাকতে পারে না সে। আমতা আমতা স্বরে বলে ওঠে, “এএএভাবে আআগাচ্ছো কেন রূপ? থাথামো বলছি। কী কী করছো এসব?”
চলবে,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_29
“আরেহ! পেছাচ্ছো কেন? সামনে এসো। তোমার কাঁধের উপর ময়লা লেগে আছে।”
রূপকথার কথাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আরজান। খানিক অবাকও হয় বটে! রূপকথা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে কাঁধ থেকে কিছু একটা ঝেড়ে ফেলে। অতঃপর সরে এসে বলে, “এভাবে পেছাচ্ছিলে কেন? আমি কি খেয়ে ফেলছি তোমাকে?”
এবার বেশ বিরক্ত হয় আরজান। ময়লা পরিষ্কার করতে এভাবে কাছে আসা লাগে! আরেকটু হলে তার জানটাই বেরিয়ে যেত ভয়ে! এর ডিকশনারিতে কমন সেন্স বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না। সবসময় উল্টা-পাল্টা কাজ ছাড়া আর কিছু পারেই না। আর তাকে হ্যনস্তা করার বেলায় তো সে একেবারে ওস্তাদ। নিজের ভাইয়ের থেকে এক বিন্দু কম যায় না। সে রূঢ় কন্ঠে বলে ওঠে, “হয়েছে? পরিষ্কার করা শেষ?”
রূপকথা দ্রুতবেগে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাতেই সে পুনরায় বলে ওঠে, “তাহলে তৈরি হয়ে নাও। যেতে হবে এখনি।”
মুহূর্তেই মুখটা কেমন ভার হয়ে আসে রূপকথার। এতো তাড়া কীসের তাকে দূর করার? এক মুহুর্তও কি সইতে পারছে না তাকে? তাকে তাড়িয়ে দিতে যেন উঠে পড়ে লেগেছে! তার ভাবনার মাঝেই আরজান শুধায়, “কী হলো? তৈরি হও।”
“আমিতো তৈরিই আছি। চোখে দেখছো না? চোখের মাথা খেয়েছো?” ঝাঁঝালো স্বরে বলে ওঠে রূপকথা। কথাটা সম্পূর্ণ করেই হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায় আরজান। এটা কী হলো! সামান্য কথাতে এভাবে মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল! সে এতোক্ষন খেয়াল করেনি যে রূপ পোশাক বদলেছে। তাই এই কথাটা বলেছিল। মনে হলো যেন গরম তেলভর্তি কড়াইতে মাছ ছেড়ে দিয়েছে! যা হোক, এতোক্ষন পর এটা তো বোঝা গেল যে সে রেগে আছে। ভাবনা ছেড়ে শার্ট বদলে পূর্ব থেকেই গুছিয়ে রাখা ছোট্ট ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। রূপকথাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রোজিনা বেগম। চোখভর্তি তার পানির ফোয়ারা। পাশেই গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ ও আকরাম মিঞা। বারান্দার চেয়ারে মুখ ভার করে বসে আছে সোফিয়া শিকদার। সকলের চোখে-মুখে যেন কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে। হয়তো এতোক্ষনে রূপকথার চলে যাওয়ার সংবাদ সকলের কাছেই পৌঁছে গেছে। তারা সকলেই যে আরজানের উপর রাগান্বিত তা সে জানে। বুক চিরে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আরজানের।
সামনে আগাতে আগাতে বলে, “তাড়াতাড়ি চলো, ট্রেনের সময় হয়ে যাবে।”
রাগান্বিত দৃষ্টিতে সকলে একসঙ্গে ফিরে তাকায় তার দিকে। বিচলিত হয় না আরজান। সে জানে এখন সকলে তাকেই দোষারোপ করবে কিন্তু রূপকথার ভালোর জন্য এটা তাকে করতেই হবে। নাহয় সকলের চোখে অপরাধী হবে সে কিন্তু রূপ তো নিরাপদে থাকবে। এই ঢের তার কাছে। তাকে সত্য প্রমাণিত করে পলাশ এগিয়ে আসে তার কাছে। হতবাক স্বরে শুধায়, “আপনে বোনরে নিয়া যাইবেন দুলাভাই? নকি মিছা কতা কইতাছেন আমারে উল্লু বানাইতে? হাচা কইরা কন তো। এমন মজা করা কিন্তু ভালা না। দেখেন মা কিরাম কইরা কাইন্দা দিছে।”
আরজান শুধু একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রোজিনা বেগমের দিকে। অতঃপর পলাশের দিকে চেয়ে বলে, “তোমার বোনের নিরাপত্তার জন্য এটা জরুরি। এখানে সে নিরাপদ নয়।”
“কিন্তু ওরা তো মইরা গেছে। অহন কিয়ের ভয়? কিছু হইব না আর। বোনরে নিয়া যাইয়েন না।” অসহায় কন্ঠে বলে পলাশ।
গম্ভীর হয় আরজানের মুখভঙ্গি। সকলের দিকে একবার চেয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে ওঠে, “বিপদ আছে কী নেই সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না এখানে। আমি নিশ্চয়ই রূপের খারাপ চাইব না। তাকে নিরাপদে রাখতেই এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি আমি। তাই আশা করি, এখানে কারোর কোনো আপত্তি থাকবে না। অন্তত রূপের ভালো চাইলে কেউ বাঁধা দিও না আর দিলেও সেটা আমি কখনোই শুনবো না। তাই শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করো না। রূপ আজ আর এক্ষুনি চলে যাবে। তাকে কিছু বলার থাকলে বলো। কান্নাকাটি না করে সুন্দরভাবে বিদায় দাও।”
এরপরে আর কোনো কথা বলার সুযোগ থাকে না। বললেও যে সে শুনবে না তা সকলেই বুঝে গেছে। তাছাড়া রূপকথার উপর যদি সবচেয়ে বেশি কারোর অধিকার থাকে সেটা হচ্ছে আরজানের। তাই তার উপর কোনো জোর চলে না। যেটা চলে সেটা শুধুই অনুরোধ। সেটাও আরজান শুনবে বলে মনে হয় না। তবুও রোজিনা বেগম বলেন, “মাইয়াডা কোই যাইব? থাকব কেমনে একলা একলা?”
“সেটার ব্যবস্থা করার জন্য আমি আছি। চিন্তা করবেন না, রূপ ভালো থাকবে।”
আরোও কিছু বলতে চায় রোজিনা বেগম কিন্তু তার পূর্বেই তাকে থামিয়ে দেয় রূপকথা। তার দু’গালে হাত রেখে মুচকি হেসে বলে, “এতো চিন্তা করো না। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।”
পলাশের দিকে চেয়ে বলে, “মায়ের খেয়াল রেখো। নিজেও একটা সুন্দর মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। আমি এসে যেন তোমায় একা না দেখি। কী? আমার কথা রাখবে তো?”
গলা ধরে আসছে পলাশের। সে কোনোমতে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। পুনরায় মুচকি হাসে রূপকথা। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সোফিয়া শিকদারের দিকে। তার সামনে মাটিতে বসে হাতদুটো ধরে শুধায়, “আমাকে কি আপনার মনে পড়বে মা?”
এতোক্ষন চেপে রাখা কষ্ট বুঝি এবার উগরে দেয় সোফিয়া শিকদার। সশব্দে কেদে দেয় সে। রূপকথার মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে চেপে ধরে বলে, “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমার ছেলেটা তোমাকে ছাড়া ভালো থাকবে না। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। পথ চেয়ে থাকবো তোমার আশায়।”
শুকনো হাসি হাসে রূপকথা। তার জানা নেই কেন এই মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে সে। আদৌ কি কোনোদিন ফিরে আসা হবে তার? মানুষগুলো কবে কীভাবে যেন তার প্রিয়দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে! তাদের ছেড়ে যেতে একদমই মন সায় দিচ্ছে না তার। কিন্ত হায়! ভাগ্য তার সাথ দিলো না। এতোগুলো প্রিয় মানুষ থাকতেও একা থাকতে হবে তাকে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আকরাম মিঞার দিকে দৃষ্টিপাত করে। যে আপাতত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। হয়তো কিছু বলতে চায় কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। আরজান তাড়া দিয়ে বলে, “চলো রূপ।”
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে রূপকথা। লোকটা বোধহয় আজ একটু বেশিই নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে! নিজেকে সংবরণ করে বলে, “তাহলে আসি। ভালো থেকো তোমরা।”
তার কাছে এগিয়ে যায় আরজান। রূপকথার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করে সদর দরজার দিকে। পেছন পেছন ছুটে আসে বাড়িতে উপস্থিত সবকটি প্রাণী। সদর দরজার বাইরে এসে ভ্যান ডেকে দাঁড় করায় আরজান। রূপকথাকে উঠে বসতে বলে নিজে বসে পড়ে অপর পাশে। ভ্যান ছেড়ে দেওয়ার পরেও আবারো পেছনে ফিরে তাকায় রূপকথা। শেষবারের মতো দেখে নেয় প্রিয় মুখগুলো।
ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায় তারা। তখনও অনিমেষ চেয়ে থাকে সে। আর কখনো কি হবে দেখা এই মুখগুলো? হয়তো হবে না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে তাকে ভুলে যাবে সবাই। তাকে ছাড়াই গড়ে নেবে নিজেদের পৃথিবী। কয়েক যুগ পর হয়তো কোনো ক্ষণে হুট করে মনে পড়বে তাকে। উপলব্ধি করবে তারা যে তাদের জীবনে কোনো একদিন রূপকথা নামের একজন ছিল। যে হারিয়ে গেছে দূর নীলিমায়। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় মগ্ন হবে নিজেদের দৈনন্দিন কর্মে। হারিয়ে গেলে কেউ কাউকে মনে রাখে না, কেউ না। জীবন বাঁচানোর তাগিদে রোজই যুদ্ধ করে চলতে হয়। এতো যুদ্ধের মাঝে আর সময় কোথায় পেছনে ফিরে তাকানোর? হাজারটা ব্যস্ততায় প্রকৃতি বোধহয় নিজ দায়িত্বে ভুলিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে।
তার ভাবনার মাঝেই ক্যারক্যার শব্দ করে থেমে যায় ভ্যান। সামনে বিশাল হট্টগোল চলছে। গ্রামের লোকজন সকলে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। সকলেই বেশ উত্তেজিত। ভীরটাও নেহাত কম নয়। ভীরের মধ্য থেকে ভেসে আস কারোর উত্তেজিত কন্ঠস্বর, “রাইতের বেলায় মেম্বারের মাঠঘরে আগুন লাইগা সব পুইড়া ছাই। বৃষ্টি না আইলে তো ক্ষেতও পুইড়া যাইত। পুলিশও আসতাছে না। চেয়ারম্যানসাব কইছে এইডা ডাকাতরা করছে। ঐ ঘরে কী আছিল কেডা জানে? মেম্বাররেও দেখা যাইতেছে না। ধইরা নিয়া গেছে মনে হয় ডাকাতরা। ওগো দিলে তো দয়া-রহম নাই।”
আরজানের ইশারা পেয়ে পুনরায় ভ্যান চালাতে শুরু করে চালক। ছুটে চলে স্টেশনের দিকে। এসব কথা শুনে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু হবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আরজান ভ্যান থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। রূপকথার হাত টেনে ধরে অগ্রসর হয় বাসের দিকে। টিকিট সে আগেই কেটে রেখেছে তাই কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। টিকিট দেখে নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পড়ে তারা। রূপকথা কোনো হেলদোল ছাড়াই চুপচাপ বসে থাকে তার পাশে। এদিক-ওদিক দেখারও কোনো প্রয়াস নেই তার মাঝে। নিজের গম্ভীর মুখভঙ্গি ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে আরজানের নিকট। সে কি বেশি নির্দয় হয়েছে?
কিছুক্ষণ পরে নিজ নিয়মমাফিক বাস চলতে শুধু করে। যাত্রীতে ভরপুর বাসে শোরগোলও কম নয়। জানালা খোলা থাকায় বাতাস এসে উড়িয়ে দিচ্ছে রূপকথার সোনালি চুলগুলো। বারবার উড়ে এসে আছড়ে পড়ছে তার চোখেমুখে। বিরক্ত করছে রূপকথাকে। তবুও তার কোনো চেষ্টা নেই চুলগুলোকে বদ্ধ করার। আরো খানিক এগিয়ে আসে আরজান। নিজেই দুহাত বাড়িয়ে চেষ্টা করতে থাকে চুলগুলোকে আয়ত্তে আনার। প্রচেষ্টা চালায় বেঁধে দিতে। তবে বরাবরের মতোই সে ব্যর্থ হয় এই কাজে। চুলগুলোও আজ বড্ড অবাধ্য হয়ে উঠেছে। রূপকথার সুন্দর মুখখানাতে চালাচ্ছে নিজেদের অবাধ বিচরণ। সহ্য হয় না আরজানের।
রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায় সে। চিল্লিয়ে ডাকতে থাকে, “এই ড্রাইভার, গাড়ি থামাও।”
তার কথাকে পাত্তা দেয় না কেউ। মাঝ রাস্তায় এভাবে গাড়ি থামাতে বলবে কে? সকলে নিজের মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয়। গাড়ি চলছে নিজস্ব গতিতে। কিছুক্ষণ পর আরজান পুনরায় একই কথা বলে চিৎকার করে উঠতেই সকলের ভুল ধারনা ভেঙে যায়। তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে কসে এক ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে যায় গাড়ি। ড্রাইভার রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় তার দিকে। হেল্পার দ্রুত তার কাছে গিয়ে শুধায়, “কী হইছে?”
আরজান ব্যস্ত হাতে নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে হেল্পারের হাতে দিয়ে বলে, “পাশের ঐ দোকান থেকে সুন্দর দেখে দুটো চুলের ক্লিপ কিনে আনো।”
“জী?” পুনরায় শুধায় হেল্পার।
“আরে চুলের ক্লিপ আনো। বউ টউ নেই নাকি তোমার? চুলের ক্লিপ চিনো না? চুল বাঁধে যে ওগুলো কিনে আনো যাও।” নির্দ্বিধায় বলে যায় আরজান।
“এখন? এইটা তো এতো জরুরি কিছু না। গাড়ি পৌঁছানোর পরেও কিনতে পারবেন।”
“বউ হচ্ছে আমার আর জরুরি কি-না বলার তুমি কে হে? এখনি লাগবে। তুমি আনলে আনো নাহলে আমিই যাচ্ছি কোনো সমস্যা নেই।”
গাড়ির প্রতিটা প্রাণী হতবাক নয়নে চেয়ে থাকে তার দিকে। মাঝ রাস্তায় দ্রুতগামী বাস থামিয়ে বউয়ের জন্য চুলের ক্লিপ কেনার ঘটনা বোধহয় এই প্রথম। ড্রাইভার কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। ইতিমধ্যে বাস জুরে কানাঘুষো শুরু হয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে আরজান পুনরায় বলে ওঠে, “কী হলো? যাও।”
অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেল্পার। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বউয়ের জন্য চুলের ক্লিপ কিনছে! এসবও দেখতে হচ্ছে তাকে! সে না গেলে লোকটা নিজেই চলে যাবে। এতে করে দেরি হবার সম্ভাবনা আরোও বেশি। অগত্যা তাকেই যেতে হয় দোকানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দুটো চুলের ক্লিপ এনে আরজানের হাতে দিলে সে শান্ত হয়। ধপ করে সিটে বসে রূপকথার দিকে তাকাতেই আপনাআপনি তার ভ্রুযুগল কুচকে যায়।
রূপকথা কটমটে দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। অবাক হয় আরজান। এভাবে তাকানোর কী হয়েছে!
তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে সে ফটাফট হাত বাড়িয়ে চুলগুলোকে ক্লিপে আবদ্ধ করে দেয়। একটু এলোমেলো হয়েছে তবে ব্যাপার না, চলবে। এতোক্ষনে যেন স্বস্তি পেলো সে। তার সাথে সস্তি পায় বাসের সকল যাত্রী। অমনি রূপকথা রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “কী শুরু করেছো এসব? সবাই কী ভাবছে কে জানে।”
“যে যা ভাবে ভাবুক, আমাদের কী? তুমি তাদের নিয়ে এতো না ভেবে আমাকে নিয়ে ভাবো তাতেই চলবে।” দায়সারা জবাব আরজানের।
বিরক্ত হয়ে পড়ে রূপকথা। একেতো তাকে সমুদ্রে দিয়ে আসছে আবার এসব আজগুবি কর্মকাণ্ড করছে। অথচ তার মাঝে কোনো হেলদোলই নেই। বাজে লোক একটা। সবাইকে শুধু হ্যনস্তা করতে ব্যস্ত থাকে সবসময়। সে রাগে গজগজ করতে করতে আরজানের কাছে সরে এসে তার কাঁধেই মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। আরজান চোখ বড়বড় করে তাকাতেই বলে ওঠে, “এভাবে তাকাবে না আর নড়বে না একদম। ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাবো আমি।”
বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকা ছাড়া আরজানের আর কোনোই করণীয় থাকে না। তার উপর রেগে গিয়ে তার কাঁধেই মাথা রেখে ঘুমাবে! কিছুক্ষণ এভাবে চেয়ে থেকে আলতো স্বরে ডেকে ওঠে সে, “রূপ।”
নাহ, কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। কোনোমতে হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সে ঘুমিয়ে পড়ছে। বড়বড় নিশ্বাস ফেলছে। মুচকি হাসে আরজান। খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে ধীরে সুস্থে রূপকথার মাথাটা ধরে কাঁধ থেকে সরিয়ে নিজের বুকে টেনে আনে। মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে কিছুক্ষণ তার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। বেশ খানিকটা সময় পরে সে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিশ্চিত হয়ে চোখ মেলে তাকায় রূপকথা। নিজের হাত টেনে আনে আরজানের বুকের অন্য পাশে। তার বুকের মধ্যে হওয়া ধ্বক ধ্বক শব্দটা স্পষ্টভাবে সে অনুভব করতে পারছে। সে ধীর স্বরে বলে ওঠে, “আমি এখানেই থাকতে চাই ম্যাজিশিয়ান।”
চলবে,,,,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_30
সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। বাস নিজের গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। যথারীতি সমস্ত যাত্রী একে একে বাস থেকে নামতে শুরু করেছে। সকলের হট্টগোলে ঘুম ছুটে যায় কোনো প্রেমিক যুগলের। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় কপাল কুচকে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে আরজান। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে উপলব্ধি করতে পারে তারা পৌঁছে গিয়েছে নিজেদের গন্তব্যে। নিজের ভারী হয়ে থাকা বুকটার দিকে তাকাতেই প্রশান্তি ছেয়ে যায় তার নয়ন জুরে। রূপকথা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তার বুকের ওপর। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে তার শার্টটা। কী নিদারুণ সৌন্দর্য তার ঘুমন্ত মুখখানাতে! হঠাৎ মনে পড়ে যায় তাদের এখানে আসার মূল কারন। ছেড়ে যেতে হবে রূপকথাকে। ত্যাগ করতে হবে এই মায়া। তার সমস্ত প্রশান্তির মূল উৎসটাই রেখে যেতে হবে এখানে। রূপকথাকে ডাক দেওয়ার পূর্বেই সে তার বুক থেকে উঠে আসে। চোখ-মুখ কুচকে বাসের চারপাশ দেখে নিয়ে বলে, “আমরা কি চলে এসেছি?”
“হ্যাঁ” গম্ভীর স্বরে জবাব দেয় আরজান।
“এতো দ্রুত চলে আসলাম? এতো কাছে কেন সমুদ্র?” পুনরায় শুধায় রূপকথা।
“দ্রুত কোথায়? কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলে তার হিসেব আছে?” কথাটা বলে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পায় ড্রাইভার ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে। তার উপর কিঞ্চিত রাগান্বিত হয় সে। এতো দ্রুত গাড়ি চালানোর কী প্রয়োজন? ধীরে সুস্থে চালিয়েও তো পৌঁছানো যেত।
“আমরা তাড়াতাড়ি চলে এসেছি ম্যাজিশিয়ান। চলো আবার ফিরে যায় বাড়িতে।”
ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান। এর কি সমুদ্রে যাওয়ার ইচ্ছে নেই? নাকি ঘুম থেকে উঠে ঘুমের রেশ কাটেনি এখনো তাই এসব ভুলভাল বলছে? সে কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “তাড়াতাড়ি আসলেই কি বাড়ি যেতে হবে? চুপচাপ ওঠো আর চলো আমার সাথে।”
বাক্য সম্পূর্ণ করে উঠে দাঁড়িয়ে যায় সে। বাস থেকে নামার সময় পুনরায় রূপকথা বলে ওঠে, “জোর করে রেখে যাবে?”
থমকায় আরজান। তবুও নিজেকে সংবরণ করে রূঢ় স্বরে বলে, “হ্যাঁ, প্রয়োজনে সেটাই করবো। বেশি কথা না বলে আমার সাথে এসো।”
রূপকথার হাত ধরে টেনে নিয়ে নেমে পড়ে আরজান। গ্রামের রাস্তার মতো প্রশান্তি খুঁজে পায় না সে। শহরটা বড্ড অগোছালো, যানজটে ভরপুর। রাস্তা জুরে হাজারো যানবাহনের ভীর। মানুষে গিজগিজ করছে প্রতিটা গাড়ি। সাহেবের বেশে কেউ ফিরছে নিজের আলিশান বাসায়। আবার কেউ ছুটছে নিজের কর্মস্থলে। কেউবা নোংরা জামাকাপড়ে ক্লান্ত শরীরে ফিরছে নিজের নীড়ে। মানুষের জীবন কতোই না বিচিত্র। একেকজনের জীবনের একেকটা রং। এই শহরের কোনে কেউ দুঃখ-কষ্টে নিপীড়িত আবার কেউ নিজের আলিশান জীবনযাপন নিয়েও সুখে নেই। বড়বড় গাড়িগুলো শাঁ শাঁ করে ছুটে চলেছে নিজেদের গন্তব্যে। মাঝে মাঝে বিকট শব্দে হর্ণ বাজিয়ে জানান দিচ্ছে নিজের ব্যস্ততা। রূপকথা ঘুরে ঘুরে দেখছে সবকিছু। তার কাছে এ সবই নতুন। তবে ভালো লাগছে না তার এতো হট্টগোল। এর চেয়ে ঢের ভালো ঐ অলোকপুর গ্রাম। এই বিশাল রাস্তার চেয়ে গ্রামীণ ছোট্ট মাটির রাস্তাটাই তার কাছে অধিক প্রিয়। এমন সময় আরজান শুধায়, “রূপ, বললে না তো ইট-পাথরের এই শহর কেমন লাগছে তোমার?”
“একদমই সুন্দর নয় ম্যাজিশিয়ান। চারদিকে সবাই শুধু ছুটোছুটি করছে। দু’দন্ড থামার জো নেই।” চোখ-মুখ কুচকে বলে রূপকথা।
হেসে ওঠে আরজান। রূপকথার চোখ-মুখের প্রতিক্রিয়া দেখেই সে আগেই বুঝেছিল এই শহর তার পছন্দ হয়নি। শহরের কোলাহলের চেয়ে গ্রামটাই তার অধিক পছন্দের। রূপকথা আরো কিছু বলার পূর্বেই সে অটো ডেকে দাঁড় করায়। ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকায় রূপকথা। গ্রামের ভ্যানগাড়ির সঙ্গেই সে পরিচিত। এখন এতো প্রকার যানবাহন দেখে সে খানিক কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। আরজান অটোচালকের সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে তবে রূপকথার হাত ছাড়েনি। টেনে ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে নিজের পাশে। কিছুক্ষণ পর অটোতে নিজে উঠে বসে রূপকথাকেও টেনে উঠিয়ে আনে। তারা উঠে বসতেই চলতে থাকে গাড়ি। রূপকথা কৌতূহলী হয়ে শুধায়, “এবার কি আমরা বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি?”
“না।” এতোটুকু বলেই চুপ হয়ে যায় আরজান।
বিষন্ন মনে বসে থাকে রূপকথা। একসময় সে এই সমুদ্রে আসার জন্যে কতোই না দিন গুনেছে অথচ আজ,,,,,,,,,। আজ আর ইচ্ছে করছে না সেখানে ফিরে যেতে। সেই জাতিগোষ্ঠীর কাছে যেতে যারা তাকে বিতাড়িত করেছিল। তার চাপা বর্ণের কারনে তাকে রাখেনি নিজেদের সাথে। অভিশাপ ভেবেছিলো তাকে। ঐ গ্রামে যখন সে প্রতিটি মুহুর্তে মৃত্যুভয়ে কাটিয়েছে তখনও তারা তার খোঁজ নেয়নি। ভুল করেছিল সে এখানে ফিরতে চেয়ে। একা একা সে সাদাবিলের পানিতে এতোগুলো দিন ভয়ে আতঙ্কে তড়পেছে। অথচ তার জাতিগোষ্ঠীর কেউ কখনো তাকে ফেরত নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করেনি। তাদের একবারও মনে হয়নি যেই কন্যা দুনিয়াদারি কিছু জানে না সে নিজের পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে আবার ফিরবে কীভাবে। সেই স্বার্থপরদের কাছে ফিরে যাবে সে! যেখানে শুধুমাত্র বর্ণের কারনে ঠাঁই মেলেনা। আর দাদিমা, সে তো তাকে খুব ভালোবাসতো। তার হৃদয়েও ঠাঁই করে নিলো বর্ণবৈষম্য। তাকে ছেড়ে দিলো একা একা। পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে তাকে ফিরতে বলেছিল তবে কি পঁচিশটা বছর যথেষ্ট অভিশাপ কাটাতে?
পঁচিশ বছর তো তার পূর্ণ হয়েছে এখন কি অভিশাপ কেটেছে? নাহ, কাটেনি বরং সে জড়িয়ে পরেছে মানুষদের সঙ্গে। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে একজন মানুষের সঙ্গে। তার জীবনসঙ্গী একজন মানুষ। তারা কি মেনে নেবে তা? নাকি নতুন করে অভিশপ্ত বলবে তাকে। হয়তো শাস্তি দেবে নিয়ম ভঙ্গের অপরাধে। সেই শাস্তি বড় কঠিন হবে তার জন্য। তারা যে নিজেদের নিয়ম রক্ষায় বড় নির্দয় হয়ে ওঠে। যেমনটা পনেরো বছর পূর্বে হয়েছিল। মাত্র দশ বছরের মৎসকন্যাকে নিজের বর্ণের কারনে ত্যাগ করতে হয়েছিল নিজের বাসস্থান। অভিশাপ কাটাতে যেতে হয়েছিল মানুষদের মাঝে। তাচ্ছিল্য হাসে সে। যেখানে বর্ণের কারনে ঠাঁই মেলেনি সেখানে তার মনুষ্য জীবনসঙ্গী কেই বা মেনে নেবে? কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দেবে তাকে। তবে তার মোটেও আফসোস নেই নিজের জীবনসঙ্গী নিয়ে। সে চায় না কোনো মৎসমানবকে। তার ম্যাজিশিয়ানের মতো কে রাখবে তার এতো খেয়াল? কেউ রাখবে না, কেউ না। তার ম্যাজিশিয়ান সকলের চেয়ে আলাদা। যার হৃদয়ে প্রবেশ করেনি কোনো বর্ণবৈষম্য। যে খুব যত্ন করে কাউকে আগলে রাখতে জানে। বসাতে পারে নিজের জীবনের সুউচ্চ আসনে।
তার ভাবনার মাঝেই থেমে যায় গাড়ি। শহরের কোলাহল ছেড়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছে তারা। যার দরুন চারপাশে নেই কোনো শোরগোল। যানবাহনের বিকট বিকট শব্দগুলো যেন হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেছে। শ্রবণগোচর হচ্ছে পানির কলকল শব্দ। চকিতে তাকায় রূপকথা। বাইরের স্বল্প আলোয় স্পষ্ট নজরে আসছে পানির বিশাল জলরাশি। পানি বুঝি আজ বেজায় খুশি। কিছুক্ষণ পরপরই ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের বুকে। তারা নেমে দাঁড়াতেই চালক বলে ওঠে, “আপনারা বোধহয় জানেন না। এই জায়গাতে কোনো পর্যটক আসে না। দেখছেন না কেমন জনমানবশূন্য জায়গাটা। আপনাদের কি নিয়ে যাবো সঠিক জায়গায়?”
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের এখানে একটু কাজ আছে। আপনি যেতে পারেন এখন।” ভাড়া দিতে দিতে বললো আরজান।
অটোচালক কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চলে যায় নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আরজান। রূপকথার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে পানির দিকে।
“রূপ”
আচমকা ডাক শুনে চমকে ওঠে রূপকথা। তার দিকেই চেয়ে আছে আরজান। কেমন যেন করুণ তার চাহনি। এই চাহনির অর্থ জানা নেই রূপকথার। সে আবদারের স্বরে বলে ওঠে, “চলো না ফিরে যায় ম্যাজিশিয়ান?”
“তা কখনোই সম্ভব নয় রূপ। এটাই তোমার স্থান তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। একদিন না একদিন তোমাকে আসতেই হতো এখানে। তাছাড়া মানুষের মাঝে থাকা তোমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ঐ ঘটনায় আরেকটু হলেই তোমার প্রাণটা বেরিয়ে যেত সে কথা ভুলিনি আমি। তোমার জন্য পানির শূন্যতা বড় পীড়াদায়ক সেটা তোমার বোঝা উচিত। তোমার জন্য এটাই সঠিক স্থান।” গম্ভীর স্বরে বলে যায় আরজান।
“কিন্তু আমি এখানে থাকতে চাই না। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো না বাড়িতে? আমার এখানে ভালো লাগছে না।” করুন স্বরে বলে রূপকথা।
“তুমি এখানেই থাকবে। তাই শুধু শুধু অযথা কথা বলে কথা বাড়িয়ো না।”
“আমি একা একা এখানে কীভাবে থাকবো? আমার মন টিকবে না এখানে।”
“একা কোথায়? তোমার জাতিগোষ্ঠীর সকলেই আছে এখানে। তাদের সাথে অনেক ভালো থাকবে তুমি।” কন্ঠের দৃঢ়তা বজায় রেখেই বলে আরজান।
“তুমি তো নেই ম্যাজিশিয়ান।”
ক্ষণিকের জন্য থমকায় আরজান। চাইছেটা কী রূপ! উল্টা-পাল্টা বলে তাকে দুর্বল করতে? বদলাতে চাইছে তার সিদ্ধান্ত? এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। দ্রুত ত্যাগ করতে হবে এই স্থান। রূপকথার এমন আবদারেও সে কঠিনভাবে বজায় রেখেছে নিজের গাম্ভীর্যতা। সে একই রকমভাবে বলে ওঠে, “পানিতে যাও দ্রুত। আমাকে আবার ফিরতে হবে।”
“না, নামবো না আমি। থাকবো না এখানে। আমি বাড়িতে যাবো।” জেদি স্বরে বলে রূপকথা।
“একদম চুপ। কিছু বলছি না দেখে কি মাথায় উঠে বসেছো? তখন থেকে একই কথা বলে বলে জেদ করেই চলেছো। আমার বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব। তাছাড়া এমনিতেই তোমার পেছনে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে আর নয়। আরো অনেক কাজ আছে আমার। তাই শুধু শুধু আমাকে বিরক্ত না করে ফিরে যাও নিজের স্থানে।”
মুহুর্তেই দু’পা পিছিয়ে যায় রূপকথা। সময় নষ্ট হয়েছে!
সত্যিই তো তার পেছনে অনেক সময় নষ্ট করেছে ম্যাজিশিয়ান আর কতো? তাকে কি বিরক্তি মনে করে ম্যাজিশিয়ান? সে কি খুব বেশি বিরক্ত করে তাকে? পরক্ষণেই নিজেকে ধমকে বলে, “উঁহু, মিথ্যে বলছে ম্যাজিশিয়ান। সে মোটেই বিরক্ত হয় না তার কারনে।”
তাকে চুপ থাকতে দেখে আরজান পুনরায় বলে, “কী হলো? সমস্যা কী? নামছো না কেন? আর কি কোনো কাজ নেই আমার? বলছি না বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।”
“আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও না ম্যাজিশিয়ান? আমি একদম তোমাকে বিরক্ত করবো না। তোমার বাড়িতেও থাকবো না। আবার সাদাবিলে চলে যাবো।”
শক্ত করে নিজের দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় আরজান। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। অতঃপর শুকনো কন্ঠে বলে ওঠে, “আমার সময় নষ্ট করো না রূপ। সাদাবিলে তুমি থাকতে পারবে না ওভাবে। আর একজন মৎসকন্যার সঙ্গে আমি সংসারও করতে আগ্রহী নই। তোমার জন্য এটাই ভালো হবে তুমি পানিতে নেমে যাও।”
“তবে কি তুমি আমার বিয়ে করবে? কোনো মানুষকে? যে হবে অধিকতর সুন্দরী? সে কি লামিয়া? নাকি অন্য কেউ?”
“হ্যাঁ, সেটাই করবো। আবার বিয়ে করবো আমি তাই তোমাকে নিজের সাথে নিতে পারবো না। বুঝতে যখন পেরেছো তাহলে এখন যা বলছি তা করো।”
চিৎকার করে ওঠে রূপকথা, “পাগল পেয়েছো আমাকে? উল্টা-পাল্টা বলবে আর সেগুলো আমি বিশ্বাস করে নেব? কাউকে বিয়ে করবে না তুমি বুঝেছো? তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।”
শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরজান। রূপকথার এমন আচরণের সঙ্গে সে পরিচিত নয়। সে কিছু বলার পূর্বেই তার দিকে এগিয়ে আসে রূপকথা। তার একদম কাছে এসে দৃঢ় কন্ঠে বলে, “শুনতে পেয়েছো? বিয়ে হয়ে গেছে তোমার। সুন্দরী কেন মহাসুন্দরী আসলেও তুমি এই শ্যামবর্ণের মেয়েটারই থাকবে। আমার জীবনসঙ্গী তুমি। আমার ম্যাজিশিয়ান।”
পেছনের দিকে কয়েক পা সরে যায় আরজান। বেশ খানিকটা দূরত্ব সৃষ্টি হয় তাদের মাঝে। তার দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকে রূপকথা। এই সামান্য দূরত্বও সহ্য হচ্ছে না তার। না চাইতেও রেগে যাচ্ছে সে। আচমকা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে। হকচকিয়ে যায় আরজান। হন্তদন্ত হয়ে তার কাছে এগিয়ে এসে ব্যস্ত কন্ঠে শুধায়, “কককী হয়েছে রূপ? ককাঁদছো কেন?”
“থাকবো না আমি এখানে। নিয়ে চলো আমাকে।”
এবার বড্ড বেশিই রাগান্বিত হয় আরজান। চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “এখন কান্নাকাটি করে মন গলাতে চাইছো? এতোটা অধঃপতন ঘটেছে তোমার? তুমি কী বলেছিলে বিয়ের আগে? সমুদ্রে চলে আসার কথা ছিলো তোমার প্রথম থেকেই। এখন দু’দিনের সম্পর্কে সব ভুলে বসলে? আমার যে কস্মিনকালেও সংসার করবার ইচ্ছা ছিলো না সে কথা তো তোমার অজানা নয়। বিয়ের আগেও বলেছি, পরেও বলেছি। তাহলে এখন কীসের জন্য এতো ধানাইপানাই? কেন এসব করছো তুমি? একজন মানুষ কীভাবে মৎসকন্যার সঙ্গে জীবন কাটাতে পারে? বোধবুদ্ধি খুইয়ে বসেছো?”
তার যুক্তিতে থমকে যায় রূপকথা। দ্বিতীয় কোনো শব্দ উচ্চারণ করে না সে। ধীরে ধীরে পেছাতে থাকে আরজানের থেকে। আরজানের সাথে তার দূরত্ব যত বাড়ছে সমুদ্রের সাথে দূরত্ব তত কমছে। আরজানের সাথে দূরত্বের সাথে সাথে সমুদ্রের সাথে তার নৈকট্য বেড়েছে কয়েকগুণ। একসময় সমুদ্রের শীতল পানি এসে বাড়ি খায় তার পায়ে। তবুও সেদিকে ধ্যান নেই রূপকথার। সে আরজানের দিকে চেয়ে থেকে পিছিয়েই চলেছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই পানির অতলে তলিয়ে যায় সে। বিলীন হয় তার অস্তিত্ব।
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে ওঠারও সময় পায় না আরজান। সবকিছু এতোটাই দ্রুত ঘটে গেলো যে সে চোখের পলকও ফেলতে পারেনি বোধহয়। হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকে ঢেউ খেলে যাওয়া পানির দিকে। সে ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি যে রূপ হুট করে এমন কিছু করবে। ঠিক মতো বিদায়ও দেওয়া হলো না তাকে। দু’চোখ তার টইটম্বুর নোনা জলে। হারিয়ে গেছে তার জলরূপসী। চিরতরে হারিয়ে গেছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সে ডাকতে চায় রূপকথাকে কিন্তু তার কন্ঠটাও যেন তার বিরোধিতা করছে। গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোতে নারাজ। তার শব্দভাণ্ডার যেন শূন্য হয়ে পড়েছে নিমেষেই। হৃদযন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণ বেড়েছে কয়েকগুণ। ধপ করে সে বসে পড়ে বালুর উপরে। সমুদ্রের বুক চিরে যেন ভেসে আসছে কারোর তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠ, “এবার খুশি তো ম্যাজিশিয়ান?”
সময় পেরিয়েছে নিজ গতিতে। সন্ধ্যাকে বিদায় দিয়ে রাত নেমেছে বহু সময়। জোৎস্নার আলোয় আলোকিত হয়েছে চতুর্দিক। এখনো সমুদ্রের পাড়ে বসে রয়েছে আরজান। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সমুদ্রের পানে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে গুনে চলেছে প্রতিটা ঢেউ। এমন সময় বিকট শব্দ করে বেজে ওঠে তার মোবাইল। লক স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে সোফিয়া শিকদারের মুখখানা। বালুতে মাখামাখি হাতটা বাড়িয়ে আনমনে কল রিসিভ করে কানে ধরতেই সোফিয়া শিকদার চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে, “কোথায় তোরা? কতো রাত হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে আই তোরা। পরে নাহয় ভাবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিস দু’জন।”
জবাব দেয় না আরজান। অবিরত ভেসে আসছে সোফিয়া শিকদারের কন্ঠস্বর, “হ্যালো, হ্যালো কী হলো? শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? আরজান?”
“রূপ অভিমান করেছে, মা।”
একটাই কথা, তারপরেই আবার সব নিশ্চুপ। কল বিচ্ছিন্ন করে দেয় আরজান।
চলবে,,,,,,,,,,